অলংকরণ: আরাফাত করিম
অলংকরণ: আরাফাত করিম

কুকুরেরা

পিৎজা ডেলিভারি দিতে গিয়ে জার্মান শেফার্ডের কামড় খেতে খেতে বেঁচে গিয়ে ভয়ংকর সেই মুহূর্তে অদ্ভুত কোনো কারণে বাসার গ্যারেজের নেড়ি কুকুর আর মুবারক আলী স্যারের কথা একই সঙ্গে মনে পড়ল। অথচ দেশ ছাড়ার পর গত দুই বছর তাদের কথা মোটেই স্মরণ করিনি।

মুবারক আলী স্যারের সঙ্গে সেদিনই ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের শেষ ক্লাস। কিছু পড়াননি। বেশির ভাগ সময় চুপ করে ছিলেন। ক্লাস শেষের দিকে এসে ঘড়ি দেখলেন। আমাদের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘সময় কি শেষ?’ ‘জি স্যার’, বলতেই স্যারের চেহারাটা বেশ করুণ হয়ে গেল। ‘সময় শেষ’ শব্দ দুটো যে আজ তাঁর জন্য বিশেষ, আমাদের মনে ছিল না। হাত থেকে ঘড়িটা খুলে টেবিলে রেখে বললেন, ‘তোমাদের তেমন কিছুই শেখাতে পারিনি। একেক সময় একেক দলে ভিড়ে আর বিভিন্ন সিন্ডিকেট করে করে জীবন গেল। করতে হয়, নইলে বিপদ হয়ে যায়।’ আমরা ভদ্রতাবশত চুপ করে ছিলাম। স্যারের সঙ্গে সহমর্মী হওয়ার মতো শীতল রক্ত আমাদের তখনো ছিল না। ‘দেশের অবস্থা কী হয়েছে, জানো?’ স্যার নিজে থেকেই বললেন, ‘গতানুগতিক মানুষ এখানে এক জীবনে দুই রকম অবস্থার মধ্য দিয়ে যায়। প্রথমেই আসে আক্ষেপ। এ দেশে কেন জন্মালাম! ভবিষ্যৎ কী! খাব কী! জিনিসপত্রের দাম কত! একটা চাকরি কে দেবে! চাকরি পেতে হলে কী কী করতে হবে! সঠিক পথের চেয়ে এখানে শর্টকাটের মূল্য বেশি। তারপর আসে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার তীব্র বাসনা, বিশেষ করে পশ্চিমে। আমাদের ধারণা, ওখানে ফ্রেশ খাবার পাওয়া যায়। দুর্নীতি কম। সরকারি অফিসে হয়রানি নেই। ওয়েজ বোর্ড ভায়োলেট করার উপায় নেই, কাজেই প্রাপ্য বেতন কেউ আটকাতে পারে না। এমনকি একটা কাজের বুয়াও ওই দেশের সুইপার হতে আগ্রহী। নিজের জমি চাষ না করে বেচে দিচ্ছে সাবঅলটার্ন মানুষেরা। প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে মহাসাগর পার হয়ে অন্য দেশে গিয়ে দাস হতে চাচ্ছে। তোমরাও নিশ্চয় বিদেশি একটা ডিগ্রি নিতে চাচ্ছ, যাতে এ দেশ তোমার দিকে তাকিয়ে হাততালি দেয়। চাচ্ছ না?’

সেদিন আমিই একমাত্র হাত তুলে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘জি স্যার। আমরা এভাবেই ভাবি। কিন্তু এভাবে চিন্তা করা কি ভুল?’

‘মোটেই নয়। একেবারেই সঠিক চিন্তা। এ জন্যই আমার এত আক্ষেপ যে আমাদের এভাবে ভাবতে হচ্ছে। প্রত্যেকে এক পা তুলে রেখেছে, যেন হান্ড্রেড মিটার স্প্রিন্টের জন্য রেডি। বাঁশি বাজলেই দৌড় দেবে। যে মানুষটা স্বদেশ ত্যাগ করতে চাচ্ছে, সে অসুখী।’

‘ওয়েস্টে যদি স্যার সুখ পাওয়া যায়, অসুবিধা কী?’

‘তা অবশ্য। মানুষ সুখী হতে চাইবে, উন্নতি করতে চাইবে, সম্মান চাইবে, এর চেয়ে স্বাভাবিক আর কী হতে পারে? তোমরা পারলে যেয়ো, নইলে পস্তাবে।’ মুবারক আলী স্যার দুই আঙুলে কপাল টিপে ধরে খানিক্ষণ মাথা নিচু করে থেকে বেরিয়ে গেলেন।

ক্লাস শেষে অত্যন্ত যৌক্তিক আলোচনায় স্থির হয়েছিল যে মুবারক আলী স্যারের কোনো বিদেশি ডিগ্রি নেই বলেই স্যার এত বিষণ্ন। এ কারণে এ দেশে একাডেমিয়া তাঁকে পিছিয়ে রেখেছিল। তিনি চাইলে পাশ্চাত্যের একটা ডিগ্রি সহজেই আনতে পারতেন, কেন আনেননি, তিনিই জানেন। সম্ভবত সুপারভাইজারের নির্দেশনা মানতে বাধ্য বলেই। স্যারের নিজস্বতা বোধ খুব প্রবল দেখেছি। পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক হয়েও খানিকটা আধ্যাত্মিক ছিলেন। আমরা আড়ালে তাঁকে ‘মুরাকাবা স্যার’ নাম দিয়েছিলাম। প্রত্যেক মানুষ যেদিন নিজেকে সঠিকভাবে বুঝতে পারবে, সেদিন থেকে পৃথিবীতে পদার্থবিজ্ঞান বলে কোনো বিষয় থাকবে না—এই ছিল তাঁর প্রতিটি লেকচারের শেষ কথা।

আমি অবশ্য স্যারের কথা মেনেছি। বহু সাধ্যসাধনা করে আজ পাশ্চাত্যে এসেছি। স্কলারশিপের ডলারে খরচ কুলোয় না। পিৎজা ডেলিভারির কাজ করে নিশ্চয়তা কেনার চেষ্টা করি।

নেড়ি কুকুরের কথা মাথায় আসার কারণ হলো, যেদিন নানা জায়গায় অ্যাপ্লিকেশন করতে করতে, কয়েক শ কাগজ জোগাড় করতে করতে, অল্প কিছু রিকমেন্ডেশন লেটারের জন্য প্রফেসরদের তোয়াজ করতে করতে, আইইএলটিএস দিতে দিতে, প্রতিটি পাশ্চাত্য বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব নিয়ম মেনে আলাদা আলাদা ‘স্টেটমেন্ট অব পারপাস’ লিখতে লিখতে, থিসিস প্রপোজাল বদলাতে বদলাতে, সুপারভাইজার খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে যেদিন একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমন্ত্রণ এল, সেই মাহেন্দ্রক্ষণে গ্যারেজের নেড়ি কুত্তাটা খ্যাঁক খ্যাঁক করে ডাকতে আরম্ভ করেছিল। জীবনের অন্যতম বড় সুখবর পেয়ে মনটা অন্য জগতে চলে গিয়েছিল বলে শুরুতে ‘খ্যাঁক খ্যাঁক’কে খিক খিক হাসির মতো মনে হয়েছিল আমার কাছে। খানিক পরই নিচে হইচই। কুকুরটা গ্যারেজে বাচ্চা দিয়েছে। খাবার খুঁজতেই বাইরে গিয়েছিল, ফিরে এসে দেখে গেট বন্ধ। মাতৃসুলভ মায়ায় কান্নাকাটি শুরু করেছে।

আশপাশের মানুষগুলো পাষাণ নয়, আবার অতি দয়ালুও নয়। তারা কোত্থেকে একটা বেলচা এনে চোখ না-ফোটা বাচ্চাগুলোকে তুলে একটা রিকশার গ্যারেজের খালি জায়গায় রেখে দিল, যাতে মা ও শিশু একসঙ্গে থাকতে পারে। আর আমি নিজেকে প্লেনে তুলে নিয়ে মা-বাবা ছেড়ে পাশ্চাত্যে চলে এলাম।

এ দেশে এসে দেখি, বাসাভাড়া অসীম। ডরমিটরিতে আপাতত সিট পাওয়া গেল না। ছোট একটা ঘরই সপ্তাহে হাজার ডলার। মাঝবয়সী ল্যান্ডলর্ড আমার দিকে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে তাকিয়ে বলেছিলেন, ‘ওয়েল, ইয়াং ম্যান, অ্যান ইমিগ্র্যান্ট সিকিং হায়ার এডুকেশন, রাইট?’ তাঁর কথা বলার ভঙ্গি স্পষ্ট বলে দিচ্ছিল যে আমার নিজের দেশে খাবার জুটছে না, আমার দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গেছে এ কারণেই আমি বাবা-মা, বন্ধুবান্ধব ছেড়ে তাঁর দেশে এসেছি হাত পেতে। শেষে বললেন, ‘এইটিন হানড্রেড ডলারস আ মান্থ। আ ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট ক্যান এফোর্টলেসলি অ্যাফোর্ড ইট, রাইট?’ তারপর হেসে বললেন, ‘নো সুয়েট।’ মানে কোনো ব্যাপারই না।

ভয়ানক নির্জন এক অঞ্চল। মুগ্ধকর ও নিঃসঙ্গ। গ্রামাঞ্চলের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেয়ে রাজধানীর এই আমি ধন্য হয়ে গেছি। পিৎজা ডেলিভারির পাশাপাশি সপ্তাহে এক দিন পিৎজা শপের টয়লেট পরিষ্কার করতে হয়। ভালো বিষয় একটাই, টাকাটা সময়মতো পাওয়া যায়। সকালটা পাওয়া যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে কে কবে কোথায় কী লিখেছিলেন, সেসব রেফারেন্স জোগাড় করতে আর ফিজিকস ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে। বিকেল থেকে রাত দুটা পর্যন্ত সেকেন্ড হ্যান্ড একটা গাড়িতে করে বেশ দূরদূরান্তে পিৎজা ডেলিভারি দিয়ে বেড়াই। মাঝখানে পড়ে মনোরম বন, সরু পথ, কাঠবিড়ালি, পাখি আর ঝরাপাতারা। প্রতি বর্গকিলোমিটারে মাত্র আড়াইজন মানুষের বাস। এত নিস্তব্ধ যে কানে শোঁ শোঁ আওয়াজ হয় মাঝেমধ্যেই। ঢাকায় থাকতে শব্দে শব্দে ঝাঁঝরা বাতাসে রোজই ভেবেছি একটু নিস্তব্ধতার কথা। ওখানে মনে হতো, একটু নির্জনতা পেতে হলে, কয়েকটা পাখির ডাক শুনতে হলে, বিশুদ্ধ বাতাসে একটু শ্বাস নেওয়ার জন্য টিকিট কেটে বহু সময় ব্যয় করে বহুদূর যেতে হবে, হোটেলের খরচ দিতে হবে, ট্যুরিস্ট পেয়ে সিএনজিচালকেরা আর রিকশাওয়ালারা ঠকিয়ে নেবে। বছরে একবার প্ল্যান করে আর টাকা জমিয়ে সেখানে যেতে হয়। আর এখানকার লোকে আজীবনই এসব আরাধ্য জিনিসের মধ্যেই বাস করে। শহর থেকে দুই পা বাড়ালেই বন। আধা ঘণ্টা গাড়ি চালালেই সমুদ্র। ঘরের জানালা দিয়েই চোখে পড়ে পাহাড়। লোকালয়েও বাড়িগুলো দূরে দূরে। পিৎজা ডেলিভারির জন্য যখন কোনো বাড়িতে যাই, লোহা বা কাঠের গেট পেরিয়ে ইঁট বিছানো সরু পথে হেঁটে সদর দরজা। বেশির ভাগ বাড়িতেই কুকুর আছে। সেসব কুকুরের লোম নিয়মিত ছাঁটা হয়। ওই সুকর্তিত-সুরভিত পশমের দিকে তাকিয়ে প্রায়ই আমার হাত চলে যায় মাথায়। ছয় মাস হলো চুল কাটি না, চুল কাটা ভয়ানক খরচ এখানে। তিনটি উইকেন্ডের বেতন চলে যায়। একটা ট্রিমার কিনব, সেই সাহসও হয় না টাকা খরচের ভয়ে। বাড়ির লোকজন তাদের কুকুরটিকে নিয়মিত গোসল করায় তার আলাদা বাথরুম আছে, আলাদা খাবার কেনা হয় মানুষ কখন তার খাবার থেকে দয়া করে দুটো উচ্ছিষ্ট ছুড়ে দেবে—এই অপেক্ষায় এদের থাকতে হয় না। কুকুর এমনিই প্রভুভক্ত, সেই প্রভু যদি হয় সেবক, তাহলে ভক্তি অসীম হয়ে যাবে, এটাই স্বাভাবিক।

কুকুরের কামড় খেতে খেতে যে রাতে বেঁচে গেলাম, সেদিন দুপুর পর্যন্ত বীভৎস কেটেছে। আমার থিসিসের টপিকটাও আজ আর পরিষ্কার মনে নেই। তবে এর মধ্যে পূর্ব-পশ্চিমের একটা ব্যাপার ছিল। সেই অধ্যায় লিখতে গিয়ে পাশ্চাত্যের সামান্য সমালোচনা বুঝি প্রতিভাত হয়েছিল। এতে ইন্টারনাল আর এক্সটারনাল সুপারভাইজারের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব লেগে গেল।

ইন্টারনাল বললেন, ‘ভুল তো লেখেনি। অ্যান্থ্রপজেনিক কার্যকলাপে পশ্চিমের একটা বড় ভূমিকা তো আছে। আর ইস্টকে তারা ডিসক্রিমিনেটও করে। ওভারঅল, এখানে ইনটেক্সট সাইটেশনেও কোনো ভুল নেই।’

এক্সটারনাল প্রফেসরটির মধ্যে বেশ হামবড়া ভাব। বিশেষ যুক্তি খুঁজে না পেয়ে তিনি বললেন, ‘আমাদের আসলে এডওয়ার্ড সাঈদের যুগ থেকে বেরোনোর সময় হয়েছে, প্রফেসর। কালারড এই ছেলেটিকে যে আমরা উন্নত শিক্ষার সুযোগ দিচ্ছি, স্কলারশিপও দিয়েছি, এতেই কি বোঝা যায় না যে আমরা ডিসক্রিমিনেট করি না? যোগ্যতার মূল্য দিই? চোখের সামনে কনটেক্সট থাকতে ইনটেক্সট সাইটেশন কী প্রমাণ করবে?’

তখন দাঁত সামান্য বের করে দুজনের দিকে তাকিয়েই অমায়িক হেসেছি। ডিগ্রিটা তো দরকার। পাশ্চাত্যের সিল মারা সার্টিফিকেটটা নিয়ে দেশে ফিরব, আমাকে ঘিরে ‘শাবাশ শাবাশ’ রব পড়ে যাবে। দেশের যেসব বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বমানের শিক্ষা বিতরণের কৃতিত্ব দাবি করে, তারা অন্য অনেক দেশি ডিগ্রিধারীকে উপেক্ষা করে আমাকে বড় পদে নিয়োগ করবে, কয়েক লাখ টাকা বেতন পাব, আমার এসি রুমের বাইরে চকচকে নেমপ্লেটে নামের আগে ড. লেখা থাকবে। শিহরিত হওয়ার মতো ঘটনা।

এক্সটারনালের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকেই নিজের হাসিটাকে অসহ্য লাগছে। আমার আর কোনো দিন হাসা উচিত নয় বলে বিশ্বাস হচ্ছে। এই অবস্থায় সন্ধ্যার পর সাড়ে ছয় মাইল দূরের এক বাড়ি থেকে পিৎজার অর্ডার নিতে হলো। নির্জন বাড়িটা দেখেই মনে হলো, এ নিশ্চয় কোনো সিরিয়াল কিলারের আস্তানা। খুব নিরীহ আর বিশ্বস্ত চেহারার একজন ভদ্রলোক দরজা খুলবে, হাসিমুখে কথা বলবে। তারপর বিরাট একটা ডলার বের করবে। আমাকে বলতে হবে যে ভাঙতি নেই। সে তখন আমাকে ডাইনিংরুমে বসতে বলে ভাঙতি আনতে ভেতরে যাবে। এ দেশে আবার বসতে বললে ‘না’ বলার পথ নেই। বিশেষ করে আমার মতো ‘কালারড’ মানুষের পক্ষে। ওরা এটাকে অভদ্রতা মনে করে। আরেকটা অভদ্রতা হলো কুকুরের সঙ্গে অভদ্রতা করা। পথেঘাটে হাঁটতে গেলেই যেকোনো সময় একটা বিশালদেহী কুকুর গায়ে এসে পড়তে পারে। আমার সঙ্গে চার-পাঁচবার এমন হয়েছে। প্রথমেই চোখে পড়ে কুকুরের বিরাট হাঁ করা মুখ। কুকুরের ভারী দেহটা সামাল দিয়ে তটস্থ চোখে এদিক–সেদিক তাকালে মালিকের হাসি হাসি মুখটা নজরে আসে। কুকুরগুলো অবশ্য আক্রমণ করার জন্য গায়ে এসে পড়ে না। আদর চায়। আদর পেলে বিনিময়ে সে আমার গাল চেটে আদরের প্রতিদান দিতে পারে। আদর না করলে কুকুর কিছু মনে করে না, মনে করে কুকুরের মালিক। কুকুরকে আদর না করাকে এখানে মানুষকে অপমানের শামিল। 

সেই নির্জন রাতে গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই ‘ঘেউ ঘেউ’ করে বিশালদেহী জার্মান শেফার্ডটা ঝাঁপিয়ে পড়ল সামনে। সাধারণত বাইরের কেউ আসবে জানলে এখানকার লোকে কুকুর বেঁধে রাখে। এরা কোনো কারণে ভুলে গেছে। কুকুরের হাত তিনেক দূরে দাঁড়িয়ে আমি প্রথমে জমে গেলাম। মুহূর্তে কেন যেন এক্সটারনালের মুখটা ভেসে উঠল চোখে, তিনি থাকলে আমাকে বাঁচাতেন। কেন তাঁকে রক্ষাকর্তা মনে হলো, বলতে পারি না। বেঁচে থাকার আদিম তাগিদ জেগে উঠল। পিৎজার বাক্সটাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করলাম। দূর থেকে যদি কেউ দেখে, মনে করবে কুকুরটাই পিৎজা অর্ডার করেছে আর আমি ডেলিভারি দিচ্ছি। এক্ষুনি কুকুরটা তার ঝাঁকড়া লোমের ভেতর থেকে টাকা বের করে দেবে। ততক্ষণে কুকুরের মালিক আর মালকিন এসে পড়েছে। কুকুরটাকে সরিয়ে নিতে তাদের বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল। মালিক-মালকিন যদিও বলছে, ‘লিভ হিম অ্যালোন, ফ্রেডি! হি ইজ আ ফ্রেন্ড।’ ফ্রেডি সে কথা বিশ্বাস করতে চাইল না। একজন বহিরাগতকে চেনার ক্ষেত্রে কুকুরের দক্ষতা মানুষের চেয়ে নিঃসন্দেহে বেশি।

দিন কয়েক বাদে পিৎজা ডেলিভারি দিয়ে এক দুপুরে ফিরছি। হঠাৎ বিশালদেহী আরেকটি কুকুর কোত্থেকে দৌড়ে এসে গায়ে লাফিয়ে পড়ল। ভয় পেলাম না একেবারেই। কারণ, আমি জানি, ও কামড়ানোর জন্য আমার গা বেয়ে ওঠেনি। আদর চায়। তাকে আদর করাই এখন আমার দায়িত্ব। যখন আমি ওর মালিকের সীমানার ভেতর, তখন আমি হুমকিস্বরূপ। রাস্তায় যদি আপনা থেকেই দেখা হয়ে যায়, তাহলে আদর লেনদেনের মাধ্যমে বন্ধুত্ব করাটা অনিরাপদ নয়।