‘শুনছ? আইমানের অঙ্ক খাতা শেষ হয়ে গেছে। আসার সময় একটা অঙ্ক খাতা কিনে আইনো!’
অফিসে একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং ছিল। রেবার ফোন বলে মিটিংয়ের মধ্যেও অনেক কায়দা করে ফোনটা ধরেছিল আবিদ। আজকাল রেবাকে প্রচণ্ড ভয় পায় সে। সামান্যতেই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে রেবা আজকাল, রেগে গিয়ে চিৎকার করতে থাকে। জিনিসপত্র ভাঙচুর করে। নিজের চুল ধরে টানে। তারপর সবকিছু একসময় শেষ হয় কান্নায়—এক তীব্র, সুদীর্ঘ, ভয়ধরানো কান্নায়। সে যখন কাঁদতে শুরু করে, তখন গোটা পৃথিবী যেন চুপ হয়ে যায়। রাতের আকাশে ফ্যাকাশে ছাইরঙা মেঘেরা উড়তে উড়তে থেমে পড়ে। বারান্দার গাছের কালো কালো পাতাদের সরসর শব্দ হঠাৎ থমকে যায়। দেয়ালের টিকটিকিগুলোও অবাক হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। যতক্ষণ না রেবা থামে, ততক্ষণ চারদিকে কিছুই চলে না। সব অচল, সব স্থবির হয়ে থাকে।
রেবা বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকে। ঘোলাটে আর অপ্রকৃতিস্থ সেই দৃষ্টি। যেন আবিদকে সে চিনতে পারছে না। আবিদ ওর হাত ধরে, ‘চলো রেবা। বাসায় যাই।’
তাই আবিদ ওকে আজকাল ভয় পায়। আজ কি তবে আবার ওর মন খারাপের দিন এল? আজও কি আবার সিনক্রিয়েট করবে রেবা? অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। কি–না–কি করে বসে! আর হ্যাঁ, মনে করে অঙ্ক খাতাও কিনতে হবে ফেরার সময়। স্টেশনারি দোকানটা বাড়ির পথের উল্টো দিকে, বেশ খানিকটা ঘোরা হবে তাহলে। কিন্তু যদি সে বলে কাল কিনে দেব, আজ না, তাহলে আর রক্ষা নাই। ধুর, মিটিং থেকে মন উঠে গেল আবিদের। মিটিংয়ে কে কী বলছে, তাতে আর মনোযোগ দিতে পারছে না। অনেক কষ্টে একটা দীর্ঘশ্বাস আটকে রেখেছিল বুকে। মিটিং শেষে টয়লেটে গিয়ে দীর্ঘশ্বাসটা ছাড়ল। সিংকের ট্যাপ খুলে ঝরতে থাকা পানির দিকে অকারণেই চেয়ে রইল অনেকক্ষণ।
কারণে–অকারণে যখন–তখন রেবা ফোন করে বসে। অদ্ভুত সব বায়না ধরে। যা বলবে, তক্ষুনি তার চাই। যদি বলে আজ আইমানকে নিয়ে ওর পছন্দের চিজকেক খাওয়াতে নিয়ে যাবে, তাহলে তখনই আবিদকে আসতে হবে, তাকে নিয়ে যেতে হবে সিক্রেটস রেসিপিতে। যদি বলে আইমান আজ ওর সঙ্গে ঘুমাবে, তবে আবিদকে তা মেনে নিয়ে কাঁথা–বালিশ নিয়ে চলে যেতে হবে ছোট্ট গেস্টরুমে, বেডরুম ছেড়ে দিয়ে। রাত গভীর হলে আবিদ অবশ্য একসময় চুপি চুপি উঠে আসে গেস্টরুম থেকে, রেবা কী করে দেখতে। কখনো দেখে রেবা আইমানের স্কুল ড্রেস জড়িয়ে ধরে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে, ডাক্তার ওকে হাই পাওয়ারের ঘুমের ওষুধ দিয়েছে বলে বেশিক্ষণ জেগে থাকতে পারে না। কখনো আবার দেখে সে মোটেও ঘুমায়নি, তন্ময় হয়ে টেলিভিশন দেখছে, যদিও তাতে দেখার কিছু নাই, চলছে কেবল বিজ্ঞাপনের পর বিজ্ঞাপন, তবু নিষ্পলক টেলিভিশনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে। আবিদ সাধারণত খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে রেবাকে দেখে আবার ফিরে আসে চুপচাপ। কিছু বলে না। ডাক্তার বলেছেন কোনো রকম কনফ্রন্টেশনে না যেতে। কিছুদিন এভাবেই চলুক। পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার ছয় মাস, এমনকি এক বছর পর্যন্ত থাকতে পারে। তারপর হয়তো থিতিয়ে আসবে সবকিছু। কিন্তু সত্যি কি রেবার শোক থিতিয়ে আসবে কোনো দিন?
এখন আবিদ ঘরে ঢুকতেই বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল রেবা, ‘খাতা আনছ?’
শার্ট খুলতে খুলতে আবিদ বলে, ‘হুঁ।’
‘দাও, দাও। স্কুলব্যাগে এখনই ঢুকায়ে রাখি। এই সপ্তাহে অঙ্ক পরীক্ষা। ছেলের কাণ্ডজ্ঞান দেখো, আমাকে বলে নাই। আমি শুনলাম রুম্মানের আম্মুর কাছ থেকে।’
আবিদ আস্তে করে বলল, ‘রেবা, এক কাপ চা খাব। মাথা ধরছে।’
হুট করে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল রেবা, ‘চা? ওহ, চা? আচ্ছা, দাঁড়াও। দিচ্ছি। আইমানের স্কুলড্রেস ইস্তিরি করতেছিলাম। কাজটা শেষ করে দিই? তুমি একটু ড্রয়িংরুমে বসো।’
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবিদ বলে, ‘ঠিক আছে।’
জামাকাপড় ছেড়ে বসার ঘরে টিভি ছেড়ে বসে আবিদ। চ্যানেলের পর চ্যানেল পাল্টাতে থাকে। সব চ্যানেলে একই খবর। রক্তাক্ত জুলাইয়ে কতজনকে হত্যা করা হয়েছে। কীভাবে ঠা-ঠা-ঠা করে গুলি করা হয়েছে ছোটদের ওপর। কীভাবে লাশ ঠেলে ফেলে দেওয়া হয়েছে ট্যাংকের ওপর থেকে নিচে পিচঢালা রাস্তায়। কীভাবে লাশগুলো কোরবানির চামড়ার মতো ছুড়ে ছুড়ে ফেলা হয়েছে ভ্যানের ওপর। দম বন্ধ হয়ে আসে এসব দেখলে। মাথার ভেতরটা কেমন ওলট–পালট হয়ে যায়। আবিদ খালি চ্যানেল পাল্টাতে থাকে। আর কোনো খবর নেই দেশে? ধুস শালা! খালি মৃত্যু আর মৃত্যু! খালি লাশ আর লাশ! চ্যানেল পল্টাতে পাল্টাতে আল–জাজিরা চলে এলে গাজার আরও আরও শিশুর লাশের ছবি দেখে তার মাথা সত্যি গরম হয়ে যায় এবার। টিভিটা ভেঙে ফেলতে ইচ্ছা করছে। নাহ্, কালই টেলিভিশনটা এখান থেকে সরায়ে ফেলবে। ড্রাইভার জসিমকে দিয়ে দেবে ওটা। এই জীবনে আর টেলিভিশনের দরকার নেই তার। তাদের জীবনে সব সংবাদের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েছে।
অনেকক্ষণ পর রেবা চা নিয়ে এল। সঙ্গে এক বাটি বাদাম। কামিজটা পাল্টে ফেলেছে। কাপড় ইস্তিরি করতে গিয়ে মনে হয় খুব ঘেমে গিয়েছিল। আজকাল হট ফ্লাশ হয় রেবার। মেনোপজের সময় ঘনিয়ে আসতেছে। ডাক্তার বলছেন, এ সময় এমনিতেই মনমেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। সময় দেন একটু, ধৈর্য ধরেন। আস্তে আস্তে ঠিক হবে। আবিদ নিজেকে সামলায়। টিভির রিমোট রেখে দেয় পাশে। চায়ের কাপ টি–টেবিলে রেখে ওর পাশে বসে রেবা। ওড়না দিয়ে মুখের ঘাম মুছে বলে, ‘কালকে তুমি আইমানকে স্কুল থেকে আনবা?’
সতর্কভাবে জিজ্ঞেস করে আবিদ, ‘তুমি কি চাও? তুমি যাবা? তাহলে অফিসের গাড়ি পাঠায়ে দেব?’
‘হুম। ভাবতেছি আমিই যাব কালকে। পরীক্ষা চলে আসতেছে। সবার সঙ্গে কথাটথা বললে অনেক কিছু জানা যায়। অনেক দিন যাই না। কারও সাথে দেখা হয় না। আড্ডা হয় না মায়েদের সাথে।’
‘ইয়ে, মানে কয়টার দিকে বের হবা? আমি আসব?’
রেবা এবার ঘাড় কাত করল, ‘নাহ্, থাকুক। আমি একাই যেতে পারব। গাড়ি লাগবে না। আমি একটা রিকশা নিয়ে চলে যাব। এখন তুমি খাইতে আসো, রুটি সেঁকতেছি। খেয়ে ঘুমায়ে যাই। আইমানের টিফিন রেডি করতে হবে সকালে উঠে। তাড়াতাড়ি ঘুমায়ে যাই আসো।’
আজ মনে হয় ঘুমের ওষুধ ভালো কাজ করছে। বেহুঁশের মতো ঘুমাচ্ছে রেবা। একটা ছোট শিশুর মতো কাঁচুমাচু হয়ে। ফ্যানের বাতাসে ওর খুচরা চুলগুলো উড়ছে। আবিদ একটা পাতলা বেডশিট ছড়িয়ে দিল পায়ের ওপর। তারপর ছাদের দিকে চেয়ে চুপচাপ শুয়ে রইল। ওর ঘুম আসে না সহজে। প্রায়ই সারা রাত জেগে থাকে সে। ঘুমের ওষুধ খেতে ইচ্ছা করে না। নিজেকে বরং কষ্ট দিতে ইচ্ছা করে। কী আশ্চর্য! তাদের একমাত্র ছেলেটা কোথায় পড়ে আছে, আর তারা কিনা এখানে তিনতলা ফ্ল্যাটে মাথার ওপর ফ্যান ছেড়ে নরম পরিষ্কার ধবধবে বিছানায় শুয়ে ঘুমাচ্ছে! কী করে পারছে তারা?
‘শোভন, রেবা তো আজ আইমানের স্কুলে গেছে!’
দুপুরের দিকে আর থাকতে না পেরে বন্ধু শোভনকে ফোন করে আবিদ। দুশ্চিন্তায় অফিসে কোনো কাজ করতে পারছে না। বারবার উতলা হয়ে পড়ছে।
‘কী করব বল তো? আমি যাব একবার? দেখে আসি?’
ফোনের ওপারে কিছুক্ষণ চুপ থেকে শোভন বলে, ‘যাওয়া উচিত। একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকিস। খেয়াল করিস কী করে। আগবাড়িয়ে কিছু বলিস না।’
আবিদ দ্রুত কাজ শেষ করে বসকে বলে বেরিয়ে পড়ল। কোন অঘটন না ঘটে যায়। রেবা তো সারাক্ষণ আনমনা থাকে। রাস্তা পেরোনোর সময়ও কোনো দিকে খেয়াল করে না। পথ চলতে চলতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে। আজকাল ওকে একা ছাড়তেও ভয় হয়।
স্কুলের সামনে পৌঁছাতে একটু দেরি হয়ে গেল আবিদের। এত ট্রাফিক আজ রাস্তায়। সবকিছু কেমন এলোমেলো। গার্জিয়ানরা একে একে প্রায় সবাই বেরিয়ে গেছে সন্তানদের নিয়ে। স্কুলের সামনেটা ক্রমে খালি হয়ে যাচ্ছে। দারোয়ান দুজন গেট বন্ধ করে দেওয়ার চিন্তাভাবনা করছে এখন। রেবা একটা ফ্যাকাশে নীল শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছে গেট থেকে একটু দূরে ছাতিমগাছটার নিচে। তার সামনে ফুটপাতে ঝুড়িতে লেবু আর ক্যাপসিকাম বিক্রি করতে বসেছে একজন। তারও সামনে আইসক্রিমওয়ালার ভ্যান। সাদা স্কুলড্রেস পরা ছেলেরা ফুটপাতজুড়ে কলকল করে হাঁটছে বাড়ির পথে। রিকশার জটলা লেগে গেছে গেটের সামনে, দারোয়ানরা লাঠি দিয়ে তাদের পথ ছেড়ে দেওয়ার জন্য শাসাচ্ছে। স্কুলের গেট পুরোপুরি খালি হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল আবিদ। তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল রেবার দিকে। রেবার মুখ গরমে ঘেমে লাল। লম্বা বেণি করা চুল ভিজে সপসপে। আবিদ এগিয়ে গিয়ে ওর কাঁধে হাত রাখল। নরম গলায় বলল, ‘বাসায় চলো, রেবা।’
রেবা বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকে। ঘোলাটে আর অপ্রকৃতিস্থ সেই দৃষ্টি। যেন আবিদকে সে চিনতে পারছে না।
আবিদ ওর হাত ধরে, ‘চলো রেবা। বাসায় যাই।’
রেবা এবার একটু হেসে বলে, ‘জানো? ওরা স্কুলের ভেতর সব দেয়ালে আইমানকে নিয়ে গ্রাফিতি এঁকেছে। দেয়ালে দেয়ালে আইমানের ছবি। ওর বন্ধুরা এঁকেছে সব। স্কুল ভরে গেছে আমার আইমানের ছবি দিয়ে। আইমানকে তো তুমি দেখতে দাও নাই আমাকে ঢাকা মেডিকেলে। তুমি আমাকে একবারও দেখতে দাও নাই ছেলেটারে। ভাবছিলাম তোমাকে কোনো দিন ক্ষমা করব না আমি এই জন্য। কিন্তু আজ তোমাকে আমি ক্ষমা করে দিছি। যদি রোজ স্কুলে আসতে দাও আমাকে, তাহলে আরও ক্ষমা করব। বলো, তুমি আসতে দিবা! বলো, আবিদ!’
আবিদ এবার জড়িয়ে ধরে রেবাকে। গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া ছেলের শরীর কীভাবে সে রেবাকে দেখতে দেয়? ওইটুকু একটা শরীরকে নিস্পন্দ করতে কয়টা গুলি লাগে? মেডিকেলে ছেলেকে শেষবার দেখার সেই ভয়ানক স্মৃতি আবিদ একা নিজে বয়ে বেড়াবে সারা জীবন, তবু রেবাকে তার ভাগ দেবে না। কখনোই না। সে রেবাকে নিয়ে রিকশায় উঠতে উঠতে বলল, ‘ঠিক আছে, রোজ আসবা তুমি। আমিও আসব তোমাকে নিতে রোজ। আমরা আইমানকে দেখতে আসব এখানে। রোজ আসব, কথা দিলাম।’
শহরের ব্যস্ত জনাকীর্ণ রাস্তায় তাদের রিকশা এগিয়ে চলে। পথের দুধারের দেয়ালে গ্রাফিতিতে ভরা। কত রঙের গ্রাফিতি, কত কিছু লেখা। রেবা আর আবিদ পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে শূন্য দৃষ্টিতে তাদের এই শহরের দেয়ালজোড়া গ্রাফিতিগুলো দেখে।