মেজর জেনারেল মঞ্জুরকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছিল

মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আবুল মনজুর হত্যার ৪২ বছর পূর্ণ হলো আজ। ১৯৮১ সালের আজকের এই দিনে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে সমারিক হেফাজতে হত্যা করা হয় এ মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তাকে। ওই ঘটনায় মামলা হলেও ২৮ বছরে তার বিচার শেষ হয়নি। দেশের আলোচিত এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে ‘দ্বিতীয় খুনের কাহিনি’ শিরোনামে উপন্যাস লিখেছেন কথাসাহিত্যিক মশিউল আলম। অনুসন্ধান ও গবেষণার মাধ্যমে এ উপন্যাসে ইতিহাসের অন্ধকার থেকে লেখক তুলে এনেছেন শ্বাসরুদ্ধকর সেই হত্যাকাণ্ডের কাহিনি। প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ওই উপন্যাসের মনজুর হত্যাকাণ্ডের অংশটুকু প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।

মেজর জেনারেল এম আবুল মঞ্জুর
মেজর জেনারেল এম আবুল মঞ্জুর

হাটহাজারী থানার ওসির রুমে একটি চেয়ারে বসে আছেন জেনারেল মনজুর। আরেকটি চেয়ারে মেজর রেজা। থানার লোকেরা সেভেন-আপ কোমল পানীয় আর জেনারেলের জন্য ডানহিল সিগারেট কিনে এনেছে। রেজা সেভেন-আপ খাচ্ছেন। মনজুর ধূমপান করে চলেছেন।

একটু পর সেখানে প্রবেশ করলেন পুলিশের ডিআইজি সাজাহান। জেনারেল মনজুর তাঁকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘আসেন সাজাহান সাহেব। আমার অনেক কথা আছে। আমাকে কিছু সাংবাদিক ডেকে দেন। আমি সাংবাদিকদের সামনে কথা বলতে চাই।’

‘স্যার, সাংবাদিকদের সাথে আপনার কথা বলা নিষেধ আছে। আমাদেরকে উপরের নির্দেশ মেনেই কাজ করতে হবে।’

জেনারেল মনজুর একটু বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘লুক, দ্য প্রেসিডেন্ট অব দ্য কান্ট্রি হ্যাজ বিন অ্যাসাসিনেটেড। আই হ্যাভ বিন ব্লেইমড ফর ইট। সো আই শুড গেট অ্যান অপোরচুনিটি টু ফেইস আ ট্রায়াল। আপনি আমাকে ইমিডিয়েটলি চিটাগাং জেলে নিয়ে চলেন। জেলখানায় নিয়ে যান। সেইফ কাস্টডিতে নেন, যাতে করে আমি ট্রায়াল ফেস করতে পারি, আমাকে যেন আমার কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয়।’
‘ঠিক আছে, স্যার। আপনি শান্ত হোন।’
‘সাজাহান সাহেব,’ আবার ডাকলেন জেনারেল, ‘আমি যার কাছে সারেন্ডার করেছিলাম, তাকে একটু ডাকেন।’

শিল্পীর চোখে মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আবুল মনজুর হত্যাকাণ্ড

একটু পর সিআই কুদ্দুস সাহেব এসে ঢুকলেন। জেনারেল মনজুর তাঁকে দেখে বললেন, ‘নো, নট হিম। হি ওয়াজ নট দিয়ার। আমি তো একজন হাবিলদারের কাছে সারেন্ডার করেছি। তাকে ডাকেন।’

ওসির কক্ষের দরজাটি সামান্য খোলা। মেজর রেজা সেই ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকিয়ে সেই হাবিলদারকে খুঁজতে লাগলেন। তিনি দেখলেন, হাবিলদারটি ভেতরে উঁকি মারছে।
‘ওই তো স্যার, সেই হাবিলদার,’ জেনারেল মনজুরকে বললেন রেজা, ‘যার কাছে আপনি সারেন্ডার করেছিলেন।’

সাজাহান সাহেব তখন হাবিলদারকে ডেকে বললেন, ‘এই, তুমি ভিতরে আসো।’
হাবিলদার ভেতরে ঢুকে স্যালুট দিয়ে দাঁড়ালেন।

জেনারেল মনজুর উঠে দাঁড়িয়ে নিজের কোমরে হাত দিলেন। সেখানে তাঁর পিস্তলটি এখনো আছে। সবাই ভয় পেয়ে গেল। জেনারেল অভয় দিয়ে বললেন, ‘না না, ভয় পাওয়ার কিছু নাই। আমি গুলি করব না। আমি আমার এই পিস্তলটা এখনো পর্যন্ত সারেন্ডার করিনি, বিকজ আই ওয়াজ নট শিয়োর দ্যাট আই  অ্যাম  ইন সেইফ কাস্টডি। তা ছাড়া আমি ছিলাম..., আমার সঙ্গে আমার ফ্যামিলি ছিল, আমার সঙ্গে কেউ মিসবিহেভ করলে আমি এটা ইউজ করতাম। বাট নাউ আই অ্যাম কনফার্মড দ্যাট আই  অ্যাম  ইন সেইফ কাস্টডি, অ্যান্ড দ্যাট আই  অ্যাম  গেটিং দি অপোরচুনিটি টু ফেইস এ ট্রায়াল। তাই আমি এখন আমার এই উইপন সারেন্ডার করছি।’

এই বলে তিনি পিস্তলটি হাতে নিয়ে ওই হাবিলদারকে কাছে ডাকলেন। তারপর ডিআইজি সাজাহানের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘সাজাহান সাহেব, আমি এই হাবিলদারের কাছে সারেন্ডার করেছি। আমাকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য যে পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে, সেই টাকার একমাত্র হকদার হচ্ছে এই হাবিলদার। এই টাকার উপর অন্য কারও কোনো হক নাই। আমি এখন আপনাকে সাক্ষী রেখে আমার এই পিস্তলটিও তার কাছে সারেন্ডার করছি।’

ডিআইজি সাজাহানকে সাক্ষী রেখে জেনারেল মনজুর সবার সামনে তাঁর পিস্তলটি তুলে দিলেন সেই হাবিলদারের হাতে। তার পরই সাজাহানকে বললেন, ‘এখন আমাকে চিটাগাং জেলখানায় নিয়ে চলেন। এখানে আর দেরি করার কোনো দরকার তো নাই। আমাকে এক্ষুনি নিয়ে চলেন।’
‘ঠিক আছে, চলেন।’ চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন ডিআইজি সাজাহান

জেনারেল মনজুর ও মেজর রেজাকে ওসির কক্ষ থেকে বের করে তোলা হলো একটি ট্রাকে। সেখানে দুই পাশে বেঞ্চ। তাঁরা সেই বেঞ্চে বসলেন। ডিআইজি সাজাহান ভেতরে চলে গেলেন। জেনারেল মনজুর উঁচু গলায় তাঁকে ডাকতে আরম্ভ করলেন। কিন্তু সাজাহান আর বেরিয়ে এলেন না। পুলিশের সশস্ত্র সদস্যরা ট্রাকটি ঘিরে দাঁড়িয়ে রইল।

চট্টগ্রাম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সেন্টারের (ইবিআরসি) প্রশিক্ষণ ব্যাটালিয়নের একটি কোম্পানির অধিনায়ক ক্যাপ্টেন এমদাদকে এক সৈনিক এসে বলল, ‘স্যার আপনারে সালাম দিছে।’
‘কে?’
‘বড় স্যার। আপনারে অক্ষনই তার অফিসে যাইতে কইছে।’
বড় স্যার মানে ইবিআরসির কমান্ড্যান্ট ব্রিগেডিয়ার আজিজ, যিনি জেনারেল মনজুর ও বিদ্রোহী অফিসাররা পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে চট্টগ্রাম সেনানিবাসের সর্বেসর্বা। তাঁর নেতৃত্বে সেনানিবাস এখন চলছে সেনাসদরের নির্দেশে।

ক্যাপ্টেন এমদাদ হন্তদন্ত ছুটে গিয়ে উপস্থিত হলেন ব্রিগেডিয়ার আজিজের অফিসে। সেখানে তিনি দেখতে পেলেন আজিজের থেকে কিছুটা সিনিয়র তবে একই পদমর্যাদার এবং চট্টগ্রামের ২০৩ নম্বর ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার লতিফকে। তিনি আগের দিন পর্যন্ত ছুটিতে ঢাকায় ছিলেন। পরবর্তীকালে শোনা যাবে, রাষ্ট্রপতি নিহত হওয়ার পর এরশাদ তাঁকে ডেকে নিয়ে একান্তে আলাপ করেন। এরশাদ নাকি তাঁকে বলেন, ‘লতিফ, এই সময় তুমি ঢাকায় কী করছ? তোমাকে ইমিডিয়েটলি চিটাগাং যেতে হবে।’
ব্রিগেডিয়ার লতিফ সেনাপ্রধান এরশাদের বিশেষ নির্দেশে তাৎক্ষণিকভাবে ঢাকা ত্যাগ করে চট্টগ্রামের উদ্দেশে যাত্রা করেন। কিন্তু চট্টগ্রাম সেনানিবাস যতক্ষণ পর্যন্ত জিওসি মনজুরের নিয়ন্ত্রণে ছিল, ততক্ষণ পর্যন্ত ব্রিগেডিয়ার লতিফ এখানে আসার সাহস করেননি। তিনি কুমিল্লা সেনানিবাসে আশ্রয় নেন। সেখানে বসে চট্টগ্রামের দিকে চেয়ে চেয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনছিলেন, কখন বিদ্রোহীদের পতন ঘটে।
এমদাদ লক্ষ করলেন, ব্রিগেডিয়ার লতিফের পরনে বেসামরিক পোশাক।

জেনারেল মনজুরকে নিয়ে মেজর এমদাদের জিপ সেনানিবাসের ভেতরে বিভিন্ন রাস্তায় চক্কর খায়। চোখবাঁধা, হাতবাঁধা মেজর জেনারেল অনর্গল কথা বলে যেতে থাকেন: ‘সৈনিকদের জন্য, ফ্রিডম ফাইটারদের জন্য, সেনাবাহিনীর জন্য, দেশের জন্য কত কিছুই না করেছি...আমার অপরাধ আমি মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ বাজি রেখে যুদ্ধ করেছিলাম...পঁচাত্তরের পর থেকে জেনারেল জিয়ার পাশে ছিলাম আমি! কত সহযোগিতা করেছি তাকে..., ভোর পর্যন্ত আমি জানতামই না জিয়াকে মেরে ফেলা হবে বা অলরেডি মেরে ফেলা হয়েছে...ওরা আমাকে ধোঁকা দিয়েছে, মতি, মাহবুব, দেলোয়ার, মোজাফফর আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে। আমি জাতির সামনে সব বলে যেতে চেয়েছিলাম...।’

দুই ব্রিগেডিয়ার বসে আছেন পাশাপাশি। তাঁদের কথা শুনতে পাবে এমন দূরত্বে আর কেউ নেই। ব্রিগেডিয়ার আজিজ এমদাদকে বললেন, ‘মনজুর পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে। ফ্যামিলিসহ সে এখন হাটহাজারী থানায় আছে। তার সাথে দেলোয়ারের বউ আর দুই বাচ্চাও আছে। মেজর খালেদও ধরা পড়েছে এবং সে-ও ওইখানে পুলিশের কাস্টডিতে আছে।’

‘জি স্যার।’ এমদাদ এমন সুরে বললেন, যেন তিনি ইতিমধ্যে এসব খবর জেনে গেছেন।
আসলেই তাই। তিনি বিকেলেই মনজুরের গ্রেপ্তার হওয়ার খবর শুনেছেন। আরও শুনেছেন ফটিকছড়ির দিকে ভারতীয় সীমান্তের কাছাকাছি জঙ্গলে ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাটালিয়নের সঙ্গে লেফটেন্যান্ট কর্নেল মতি ও মাহবুবের দলের গোলাগুলি হয়েছে, সেখানে মতি ও মাহবুব দুজনই নিহত হয়েছেন।
‘তোমাকে একটা বিশেষ দায়িত্ব পালন করতে হবে,’ ব্রিগেডিয়ার আজিজ বললেন।
ক্যাপ্টেন এমদাদের বুকের ভেতরটা সামান্য কেঁপে উঠল: ‘কী দায়িত্ব, স্যার?’
‘যা বলি, শোনো, মাঝখানে কথা বলবে না। আমি বলতে বললেই শুধু কথা বলবে।’
‘রাইট, স্যার।’

‘একটা জিপ আর একটা পিকআপ ট্রাক নিয়ে তুমি হাটহাজারী থানায় যাবে,’ বলে চললেন ব্রিগেডিয়ার আজিজ, কান খাড়া করে দাঁড়িয়ে রইলেন ক্যাপ্টেন এমদাদ। ‘পাঁচজন গার্ডকে সাথে করে তুমি যাবে হাটহাজারী থানায়। গিয়ে দুই অফিসারের পরিবারকে ওঠাবে পিকআপে, তিনজন গার্ডকে দিবে তাদের সাথে। গার্ডদের বলবে তাদেরকে ক্যান্টনমেন্টে এনে নিজ নিজ বাসায় নামায়ে দিতে। জেনারেল মনজুর আর মেজর খালেদকে ওঠাবে তোমার জিপে। বাকি দুই গার্ড তোমার সাথে ওই জিপে থাকবে এসকর্ট হিসাবে। তুমি কি শুনতেছ মন দিয়ে?’

শিল্পীর চোখে মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আবুল মনজুর হত্যাকাণ্ড

‘জি স্যার, ইয়েস স্যার!’

‘হাটহাজারী থেকে আসার পথে অথবা ক্যান্টনমেন্টে ঢোকার পরে সুবিধামতো একটা জায়গায় দুজনকে খতম করে দিবে। আই মিন, কিল বোথ অব দেম।’ এ পর্যন্ত বলে ব্রিগেডিয়ার আজিজ ব্রিগেডিয়ার লতিফের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এই তো, স্যার।’

এবার ব্রিগেডিয়ার লতিফ ক্যাপ্টেন এমদাদকে বললেন, ‘শোনো, মেজর খালেদ কিন্তু ভীষণ দুর্ধর্ষ প্রকৃতির। ওর ব্যাপারে সাবধান। ওকে হাত-পা বেঁধে পানিতে ফেলে দিলেও বেঁচে যাওয়ার কৌশল ওর জানা আছে। বুঝতে পারছ? প্রথমেই ওকে মেরে ফেলতে হবে।’

ক্যাপ্টেন এমদাদ নীরবে দাঁড়িয়ে রইলেন। এরই মধ্যে তাঁর হৃৎস্পন্দন বেড়ে উঠেছে।
‘এটা কিন্তু আর্মি হেডকোয়ার্টারের একদম উপরের নির্দেশ। ইউ হ্যাভ নো ওয়ে টু ফেইল। আন্ডারস্টুড?’
‘ইয়েস স্যার,’ অসহায় কণ্ঠে বললেন এমদাদ।

‘তোমার আর কিছু জানার আছে?’ জিজ্ঞাসা করলেন ব্রিগেডিয়ার আজিজ।
ক্যাপ্টেন এমদাদ এবার কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে মিনমিনে সুরে বললেন, ‘স্যার, মেজর কামাল স্যারকে যদি সাথে পেতাম, তাহলে ভালো হতো, স্যার।’

‘কামাল তোমার আশপাশেই থাকবে,’ আশ্বস্ত করলেন ব্রিগেডিয়ার আজিজ।
কিন্তু ব্রিগেডিয়ার লতিফ একটু কড়া সুরে এমদাদকে জিগ্যেস করলেন, ‘মেজর কামালকে কেন দরকার?’
‘স্যার, কাজটা খুবই কঠিন।’

‘শাট আপ!’ ধমক দিয়ে উঠলেন ব্রিগেডিয়ার লতিফ, ‘এর চেয়ে অনেক কঠিন কাজ তোমার চেয়ে জুনিয়র অফিসাররা করেছে। তুমি কেন পারবে না?’

টেলিফোন বেজে উঠল। ব্রিগেডিয়ার আজিজ এমদাদকে বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করতে বলে ফোন রিসিভ করলেন।

এমদাদ দুরু দুরু বুকে বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। মিনিট পনেরো পেরিয়ে গেল। তারপর বেরিয়ে এলেন দুই ব্রিগেডিয়ার। ব্রিগেডিয়ার আজিজ ব্রিগেডিয়ার লতিফকে বললেন, ‘ব্যাপারটা কি আর একবার ভেবে দেখবেন, স্যার?’

‘নো। দ্য ডিসিশান হ্যাজ বিন টেকেন অ্যান্ড ইট হ্যাজ টু বি ডান।’ ঠোঁট শক্ত করে বললেন ব্রিগেডিয়ার লতিফ। তারপর এমদাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘নো আদার অফিসার উইল গো উইথ ইউ। ইউ ডু ইট অ্যালোন। নাউ গো!’

এমদাদের বুকের ধকধক বেড়ে চলল। তিনি প্রশিক্ষণ ব্যাটালিয়ন অফিসের দিকে এগিয়ে গেলেন। সেখানে এক সুবেদার মেজরকে ডেকে বললেন, ‘এক সেকশন ভালো এনসিওকে আমার কাছে পাঠান।’
সুবেদার মেজর মাথা নেড়ে চলে গেল। এমদাদ তাঁর অফিসের পাশে প্রশিক্ষণ ব্যাটালিয়নের চিফ ইন্সট্রাক্টর (সিআই) লেফটেন্যান্ট কর্নেল আজিজের অফিসে ঢুকলেন। সিআই আজিজ অবাক চোখে তাকালেন। এমদাদকে ভীষণ বিপর্যস্ত দেখাচ্ছে।

‘কী হইছে তোমার?’

‘স্যার, আমার কপালটাই খারাপ। ব্রিগেডিয়ার আজিজ আর ব্রিগেডিয়ার লতিফ বলে, জেনারেল মনজুরকে পুলিশের কাছ থেকে এনে মেরে ফেলতে হবে। তারা আমার ওপর এই দায়িত্ব চাপায়ে দিল। স্যার, এই কাজ আমি কীভাবে করি?’

সিআই আজিজ স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। তারপর হঠাৎ এমদাদকে ঠেলতে ঠেলতে দরজার দিকে নিয়ে যেতে যেতে বললেন, ‘ওরা তোমারেও শেষ করে দিবে। আমারে এই সবের মধ্যে জড়ায়ো না, যাও এখান থেকে! বের হও!’

ধাক্কা দিয়ে এমদাদকে ঘর থেকে বের করে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন সিআই আজিজ। ক্যাপ্টেন এমদাদ যেন অথই সাগরে পড়ে হাবুডুবু খেতে লাগলেন। তাঁর মনে হলো, তিনি কি এখন ইউনিফর্ম খুলে ফেলে দিয়ে সেনানিবাস ছেড়ে পালিয়ে যাবেন? ভাবতে ভাবতে তিনি নিজের অফিসে বসলেন।
পরক্ষণেই মনে হলো, তাহলেও কি রক্ষা পাওয়া যাবে? এর মধ্যে একজন জেসিও আর নয়জন এনসিও এসে হাজির হলো। এমদাদ জেসিও নায়েব আশরাফকে বললেন, ‘আরও চারজন এনসিওকে ডেকে আনেন আর তিনজন ড্রাইভার পাঠান।’

কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা এসে হাজির হলো। তিনজন ড্রাইভারসহ মোট ১৩ জনকে নিয়ে এমদাদ চলে গেলেন ট্রেনিং গ্রাউন্ডের মাঝখানে। ইতিমধ্যে সন্ধ্যার আঁধার নেমে এসেছে। আশপাশের কেউ তাঁদের দেখতে পাচ্ছে না। এমদাদ তাদের বললেন, সেনাসদরের সর্বোচ্চ মহলের জরুরি নির্দেশে তাদেরকে এখন একটা বিশেষ দায়িত্ব পালন করতে হবে। ১৩ জন জওয়ানই এমদাদের খুব বিশ্বস্ত ও অনুগত। এমদাদও তাদের ওপর গভীর আস্থা পোষণ করেন। একজন বলল, ‘কী দায়িত্ব, স্যার?’

এমদাদ ব্রিগেডিয়ার আজিজের দেওয়া বিশেষ দায়িত্বের কথা তাদের জানালেন। তারপর বললেন, ‘আমাকে বলা হয়েছে, দুইটা গাড়ি আর পাঁচজন লোক নিয়ে যেতে। বেশি লোক নেওয়া যাবে না। কিন্তু কাজটা খুব সহজ মনে হচ্ছে না। সেই জন্য আমি তোমাদেরকে আসতে বললাম। মাত্র পাঁচজনে এই কাজ করতে পারবে না।’

জওয়ানদের একজন বলল, ‘স্যার, আপনে কোনো চিন্তা করবেন না। এটা যখন উপরের অর্ডার, আমরা এই অর্ডার পালন করব, স্যার। আপনে চিন্তা করবেন না। চিন্তার কিছু নাই।’

সব প্রস্ত্ততি শেষ করে ক্যাপ্টেন এমদাদ আবার গেলেন ব্রিগেডিয়ার আজিজের অফিসে রিপোর্ট করতে। তাঁকে দেখে ব্রিগেডিয়ার আজিজ বললেন, ‘স্যার, আমরা রেডি। এখনই আমরা হাটহাজারী থানার উদ্দেশে রওনা দিব।’

তিনি যে অতিরিক্ত লোক নিয়ে যাচ্ছেন, সেটা বললেন না।
ব্রিগেডিয়ার লতিফ বললেন, ‘মনে আছে তো, মেজর খালেদকে প্রথমেই শেষ করে দিতে হবে?’
‘জি স্যার।’
‘তুমি কি এনওসিদেরকে বলেছ, কী দায়িত্ব দিয়ে তোমাদেরকে পাঠানো হচ্ছে?’ জিগ্যেস করলেন ব্রিগেডিয়ার আজিজ।
‘জি স্যার।’

‘তাদের কী মনোভাব? তারা কী বলল?’

‘তারা বলল, উপর থেকে যখন এই অর্ডার আসছে, তখন আমরা এটা পালন করব।’
দুই ব্রিগেডিয়ার একসঙ্গে বললেন, ‘যাও। উই উইশ ইয়োর সাকসেস।’
হাটহাজারী থানা চত্বরে একটি পাঁচটনি ট্রাকে বসিয়ে রাখা হয়েছে জেনারেল মনজুর, তাঁর পরিবার, লেফটেন্যান্ট কর্নেল দেলোয়ারের পরিবার ও মেজর রেজাকে।

একটু আগেই মনজুর পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি সাজাহানের সামনে পুলিশের কাছে নিজের পিস্তলটি সমর্পণ করে বলেছেন, ‘সাজাহান সাহেব, আমি পুলিশের কাছে সারেন্ডার করেছি। কিন্তু আর্মি আমাকে নিয়ে যেতে চাইবে। আপনারা আমাকে আর্মির কাছে হ্যান্ডওভার করতে পারেন না। আমাকে জেলখানায় নিয়ে চলেন।’

ডিআইজি সাজাহান এমন ভঙ্গি করেছেন যে মনজুর বুঝে নিয়েছেন তাঁকে কারাগারেই নেওয়া হবে। এই ভেবে তিনি অন্যদের নিয়ে ট্রাকে উঠে বসেছেন। কিন্তু সময় বয়ে যাচ্ছে, ট্রাকে স্ট্রার্ট দেওয়া হচ্ছে না। ট্রাকটি ঘিরে রয়েছে সশস্ত্র পুলিশ। ডিআইজি সাজাহানও ট্রাকের কাছে আসছেন না।

কিছুক্ষণের মধ্যেই যখন তিনটি সামরিক জিপ সৈন্যসহ থানার চত্বরে ঢুকে পড়ল, তখনই মনজুর বুঝে ফেললেন, সময়ক্ষেপণ করা হচ্ছিল এদেরই অপেক্ষায়। তিনি ট্রাকের ভেতর থেকেই চিৎকার করে উঠলেন, ‘সাজাহান সাহেব, আমাকে কোনো অবস্থাতেই আর্মির কাছে হ্যান্ডওভার করবেন না। ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। আমি আইন অনুযায়ী বিচারের সম্মুখীন হতে চাই। সব সত্য ঘটনা আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বলতে চাই, দেশের জনগণকে জানাতে চাই আসলে কী ঘটেছে। প্লিজ, আমাকে জেলখানায় নিয়ে চলেন!’

কিন্তু সাজাহান সাহেবের কোনো সাড়াশব্দ নেই।

জেনারেল মনজুর ট্রাকটির পাহারায় নিয়োজিত পুলিশের সদস্যদের বললেন, ‘এই, তোমরা ডিআইজি সাজাহানকে আমার কাছে আসতে বলো।’

কিন্তু ডিআইজি সাজাহান আর ওই ট্রাকের ধারেকাছেও ভিড়লেন না। তিনি এখন ওসির কক্ষে। সেখানে ঢুকলেন ক্যাপ্টেন এমদাদ। তিনি ডিআইজি সাজাহানকে সালাম দিয়ে বললেন, ‘স্যার, আমি ক্যাপ্টেন কাজী এমদাদুল হক। চিটাগাং ক্যান্টনমেন্ট থেকে আসছি। ব্রিগেডিয়ার আজিজ স্যার ও ব্রিগেডিয়ার লতিফ স্যারের নির্দেশে আমি মেজর জেনারেল মনজুরসহ পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণকারী সকলকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যেতে আসছি।’

ডিআইজি সাজাহান এমদাদকে বললেন, ‘ক্যাপ্টেন, উই নিড রিটেন অর্ডার। প্লিজ প্লেস দি অর্ডার অন দ্য টেবিল।’

‘স্যার, আমার কাছে তো লিখিত কিছু নাই। কিন্তু সত্যিই স্যার, উনাদের অর্ডারেই আমি এসেছি। আপনারা উনাদেরকে ফোন করে কনফার্ম হতে পারেন।’

ডিআইজি সাজাহান ব্রিগেডিয়ার আজিজের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করলেন। আদেশের নিশ্চয়তা পাওয়া গেল। তারপর এমদাদ নিজের হাতে একটা গ্রহণপত্র লিখে তাতে স্বাক্ষর করে তারিখ লিখে পুলিশের ডিআইজির হাতে দিলেন। তারপর ওসির কক্ষ থেকে বেরিয়ে ট্রাকটির পেছনে গিয়ে দাঁড়ালেন। তিনি মিসেস মনজুরকে দেখতে পেয়ে বলে উঠলেন, ‘ভাবি, আমরা আপনাদেরকে নিতে আসছি। নেমে আসেন।’

প্রথমা প্রকাশন থেকে বেরোনো ‘দ্বিতীয় খুনের কাহিনি’ উপন্যাসের প্রচ্ছদ।

জিওসি-পত্নী রানা মনজুর পুঁচকে অফিসার এমদাদের দিকে চেয়ে বললেন, ‘আমরা কেন তোমাদের সাথে যাব? আমরা তো পুলিশের কাছে সারেন্ডার করেছি। আমরা তোমাদের সঙ্গে যাব না।’
ঝট করে উঠে দাঁড়ালেন জেনারেল মনজুর। ট্রাকের পেছন দিয়ে নেমে এমদাদের দিকে তাকিয়ে রেগে চিৎকার করতে থাকলেন, ‘হু ইজ দ্যাট অফিসার? হু ইজ দ্যাট অফিসার।’

আলো-আঁধারিতে তিনি এমদাদকে চিনতে পারছিলেন না। এমদাদ হকচকিয়ে পিছে হটে গেলেন। জেনারেল মনজুর তাঁর দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললেন, ‘তোমাদের লজ্জা করে না? তিন-সাড়ে তিন বছর ধরে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে আমি তোমাদের জন্য, সেনাবাহিনীর জন্য, দেশের জন্য কী না করেছি? তোমরাই সব ঘটনা ঘটালে, আবার তোমরাই সব গিয়ে সারেন্ডার করলে, আর এখন এসেছ আমাকে ধরে নিয়ে যেতে? তোমাদের লজ্জা করে না? যাও, চলে যাও! আমি তোমাদের সঙ্গে যাব না। পুলিশের কাছে সারেন্ডার করেছি, আমি পুলিশের কাছেই থাকব, জেলে যাব। তোমরা চলে যাও!’

খুব জোরে চিৎকার করে উঠলেন জেনারেল মনজুর।

এমদাদ পিছিয়ে গিয়ে তাঁর সঙ্গে আসা সৈনিকদের মধ্যে গিয়ে দাঁড়ালেন। তারপর এক সুবেদারকে কিছু বললেন। সুবেদারটি মনজুরের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আপনে আসেন, আপনে আসেন।’
মনজুর ডান হাতটি তুলে সুবেদারকে উড়িয়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে নেড়ে ধমক দিয়ে বললেন, ‘নো! আমি তোমাদের সঙ্গে যাব না, যাও!’

মেজর জেনারেল মনজুরের উদ্যত দুর্বিনীত ডান হাতটি খপ করে ধরে ফেলল তাঁরই সেনানিবাসের এক অতি সাধারণ সুবেদার। ধরে হ্যাঁচকা টান মেরে নিচে নামিয়ে দিল।
সঙ্গে সঙ্গে মেজর জেনারেলের সমস্ত অহংকার ও মর্যাদাবোধ যেন ভূলুণ্ঠিত হলো। তিনি আর একটি শব্দও উচ্চারণ করলেন না। স্রেফ দাঁড়িয়ে রইলেন। সুবেদার এসে তাঁর হাত দুটি পিছমোড়া করে বাঁধল, তারপর বেঁধে দিল তাঁর চোখ দুটি। তিনি কোনো বাধা দিলেন না।

এর মধ্যে দুজন সৈনিক লাফ দিয়ে উঠে পড়ল ট্রাকের ওপর। বাচ্চারা চিৎকার করে কান্নাকাটি শুরু করে দিল। সৈনিকেরা তাদের ধরে ধরে এক এক করে নামাল। তারপর নামানোর সংগ্রাম শুরু হলো মিসেস মনজুরের সঙ্গে। তিনি কোনোভাবেই ট্রাক থেকে নামবেন না। সৈনিকেরা দ্বিধান্বিত, তারা কী করে জিওসি-পত্নীর গায়ে হাত দিয়ে বলপ্রয়োগ করে তাঁকে ট্রাক থেকে নামাবে। কিন্তু সুবেদার তাদের উদ্দেশে চিৎকার করে উঠল, ‘জলদি করো!’

তখন দুই সৈনিক অগত্যা মিসেস মনজুরকে ধরে টেনেহিঁচড়ে ট্রাক থেকে নামাল। দেলোয়ারের স্ত্রী কোনো বাধা না দিয়ে নিজেই নামলেন। সৈনিকেরা তাঁদের নিয়ে গিয়ে তুলল নিজেদের সামরিক পিকআপে।
তখন এক পুলিশ অফিসার বলে উঠল, ‘ভিতরে একজন মেজর সাহেব আছেন।’ এমদাদ নিশ্চিত ধরে নিলেন, এই মেজরই হবেন ব্রিগেডিয়ার লতিফের বর্ণিত দুর্ধর্ষ মেজর খালেদ। কিন্তু এখন তিনি নিশ্চয়ই নিরস্ত্র। তাই এমদাদ পিস্তল হাতে ট্রাকের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালেন, তারপর ভেতরে তাকিয়ে মেজর খালেদের জায়গায় দেখতে পেলেন মেজর রেজাকে।

‘দোস্ত, তুমি? মেজর খালেদ কোথায়?’

রেজা উত্তর না দিয়ে এমদাদকে বললেন, ‘হোয়াটস দিস? তোমরা জেনারেলের সাথে এরকম বিহেভ করছ কেন? তোমাদের যদি বলাই হয়ে থাকে তাঁকে নিয়ে যেতে, তাহলে তাঁকে বুঝিয়ে বলো যে স্যার, আপনাকে আমাদের সাথে যেতে হবে। আপনি স্বেচ্ছায় না গেলে আমাদেরকে বাই ফোর্স আপনাকে নিয়ে যেতে হবে। তা না করে তোমরা আগেই জেনারেলের গায়ে হাত দিয়ে টানাটানি শুরু করে দিলে কেন?’
‘দোস্ত, তুমি চুপ করো। ফর গডস সেক, তুই কিচ্ছু বলিস না। তুই সিচুয়েশন বুঝতে পারতেছিস না। আমাদেরকে কিছু দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, আমাদের সেগুলা করতেই হবে। তুই বাধা দিতে আসিস না, নিজের ব্যাপারে তুই আমার উপরে কনফিডেন্স রাখিস। আয়, নেমে আয়।’

ক্যাপ্টেন এমদাদের কথায় নেমে এলেন তাঁর কোর্সমেট, রক্ষীবাহিনী থেকে আত্তীকৃত মেজর রেজা। এর মধ্যে ওই সুবেদার জেনারেল মনজুরের দুই হাত পিছমোড়া করে বেঁধেছে, একটা কাপড় দিয়ে বেঁধেছে তাঁর চোখ দুটিও। এই সুবেদার তাঁর ডান হাত ধরে ঝটকা মেরে নামিয়ে দেওয়ার পর থেকে জেনারেল আর কোনো কিছুতেই কোনো বাধা দেননি।

একটি পিকআপে দুই অফিসার-পত্নী আর তাঁদের সন্তানদের তোলা হলো। স্ত্রী-সন্তানদের কাছে চূড়ান্তভাবে বিচ্ছিন্ন করে মেজর জেনারেল মনজুরকে তোলা হলো সামরিক অতিরিক্ত জিপটিতে, ওই জিপে ড্রাইভারের পাশের সিটে উঠে বসলেন ক্যাপ্টেন এমদাদ। আর মেজর রেজাকে তোলা হলো অন্য পিকআপে, চারজন সৈনিক রইল তাঁকে পাহারা দেওয়ার জন্য।

সামরিক বাহিনীর তিনটি যান, সেগুলোর সামনে, মাঝখানে ও পেছনে পুলিশের পাঁচটি ভ্যানসহ একটা গাড়িবহর হাটহাজারী থানা থেকে বেরিয়ে এগিয়ে চলল চট্টগ্রাম সেনানিবাসের দিকে। সেনানিবাসের সিগন্যাল ব্যাটালিয়নের কাছে এমপি চেকপোস্ট পর্যন্ত গিয়ে পুলিশের ভ্যানগুলো ফিরে গেল। আর সেনাবাহিনীর তিনটি বাহন ঢুকে পড়ল সেনানিবাসের ভেতরে। একটু পরই তিনটি গাড়ি চলে গেল তিনটি আলাদা পথে। অফিসারদের স্বজনদের নিয়ে পিকআপটি গেল তাঁদের সরকারি বাসভবনের দিকে, মেজর রেজাকে নিয়ে পিকআপটি গেল ইবিআরসির দিকে, আর জেনারেল মনজুরকে নিয়ে জিপটি চক্কর খেতে লাগল সেনানিবাসের ভেতরের বিভিন্ন রাস্তায়। সেটির ড্রাইভার ক্যাপ্টেন এমদাদের দিকে বারবার তাকাচ্ছে গন্তব্য জানার জন্য। এমদাদ তাকে বলেন, ‘যেতে থাকো।’

জেনারেল মনজুরকে নিয়ে মেজর এমদাদের জিপ সেনানিবাসের ভেতরে বিভিন্ন রাস্তায় চক্কর খায়।

চোখবাঁধা, হাতবাঁধা মেজর জেনারেল অনর্গল কথা বলে যেতে থাকেন: ‘সৈনিকদের জন্য, ফ্রিডম ফাইটারদের জন্য, সেনাবাহিনীর জন্য, দেশের জন্য কত কিছুই না করেছি...আমার অপরাধ আমি মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ বাজি রেখে যুদ্ধ করেছিলাম...পঁচাত্তরের পর থেকে জেনারেল জিয়ার পাশে ছিলাম আমি! কত সহযোগিতা করেছি তাকে..., ভোর পর্যন্ত আমি জানতামই না জিয়াকে মেরে ফেলা হবে বা অলরেডি মেরে ফেলা হয়েছে...ওরা আমাকে ধোঁকা দিয়েছে, মতি, মাহবুব, দেলোয়ার, মোজাফফর আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে। আমি জাতির সামনে সব বলে যেতে চেয়েছিলাম...।’

বিপরীত দিক থেকে একটা জিপ এগিয়ে আসছে। ক্যাপ্টেন এমদাদ দেখেই বুঝতে পারলেন ওটা ইবিআরসির জিপ। তিনি নিজের জিপের ড্রাইভারকে থামতে বলে নেমে গিয়ে দেখতে পেলেন, সেখানে বসে আছেন মেজর কামালউদ্দিন ভুঁইয়া, যাকে তিনি তাঁর সঙ্গে পেতে চেয়েছিলেন। কামালের পাশে বসে আছেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল শামস।

‘এত দেরি হলো কেন?’ এমদাদকে বললেন শামস, ‘তোমার সাথে এত লোক কেন? যাও, তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে আসো।’
ক্যাপ্টেন এমদাদ তাঁর স্যারদের স্যালুট দিতে ভুলে গেলেন। তিনি ঘুরে ছুটে গিয়ে আবার উঠলেন সেই জিপে। ড্রাইভারকে আস্তে করে বললেন, ‘রেঞ্জের দিকে যাও।’

চোখবাঁধা, হাতবাঁধা জেনারেল রেঞ্জ কথাটা শুনেই বুঝে ফেললেন গাড়ি এখন ফায়ারিং রেঞ্জের দিকে যাচ্ছে। তিনি বিড়বিড় করে কোরআনের আয়াত পাঠ করতে শুরু করলেন।

ফায়ারিং রেঞ্জের কাছে জিপ থামল। প্রথমে নেমে পড়লেন ক্যাপ্টেন এমদাদ। তারপর পেছনে বসা সৈনিকেরা জেনারেল মনজুরকে ধরে নিচে নামাল, তাঁর দুই বাহু ধরে দুজন সৈনিক তাঁকে হাঁটিয়ে নিয়ে চলল উত্তরের একটি পাহাড়ের দিকে। হেঁটে যেতে যেতে জেনারেল মনজুরের কণ্ঠে কোরআনের আয়াত আরও উঁচু স্বরে এবং দ্রুততর গতিতে উচ্চারিত হতে লাগল। পাহাড়ের কাছে গিয়ে সবাই থেমে দাঁড়াল। দুই সৈনিক ছেড়ে দিল জেনারেলের দুই বাহু।

এমদাদ এবার জেনারেলকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘স্যার, আমাদেরকে মাফ করে দিয়েন। উপরের নির্দেশে আমাদেরকে এই কাজ করতে হচ্ছে, স্যার।’

চোখবাঁধা জেনারেল দাঁড়িয়ে আছেন অন্ধের মতো। তিনি বললেন, ‘জানি। ইউ আর গোয়িং টু এলিমিনেট মি নাউ। অলরাইট। আমার ওয়াইফকে বলো, আমাকে যেন মাফ করে দেয়। তার জন্য, সন্তানদের জন্য আমি কিছু রেখে যেতে পারলাম না। যারা আমার উদ্দেশ্য জানে, তাদেরকে বলো, দয়া করে তারা যেন সেটা সবাইকে জানায়। আমার পকেটে একটা ছোট কোরআন শরিফ আছে, ওটা বের করে নাও। একটা ফরমেশন সাইন আছে, সেটা বের করে রেখে দাও।’

সৈনিকেরা নীরবে জেনারেলের শেষ দুটি নির্দেশ পালন করল। কেউ কেউ বিড়বিড় করে দোয়া-দরুদ পড়তে লাগল। তারপর এমদাদ সৈনিকদের উদ্দেশে বললেন, ‘কে শু্যট করবে?’

সবাই নীরব। জেনারেল মনজুরের কণ্ঠে জোরে জোরে কোরআনের আয়াত উচ্চারিত হতে লাগল। তিনি টের পাচ্ছেন সবাই তাঁর কাছ থেকে দূরে সরে গেছে। তিনি আবার শুনলেন এমদাদের কণ্ঠ, যেন ভেসে এলো অনেক দূর থেকে, ‘কে?’

কিন্তু তার কোনো উত্তর শুনতে পেলেন না জেনারেল।

আবার এমদাদের কণ্ঠ: ‘আপনে?’

নীরবতা। জেনারেল বুঝতে পারছেন না কী হচ্ছে, ওরা কে কী করছে। তাঁর দেখার উপায় নেই যে অবশেষে সৈনিকদের মধ্যে একজন এইমাত্র নীরবে হাত তুলে তাঁকে গুলি করতে সম্মতি জানাল। তিনি জানতে পারলেন না যে ক্যাপ্টেন এমদাদ সব সৈনিকের কাছ থেকে সব অস্ত্র নিয়ে প্রতিটির বুলেট বের করে ফেললেন।

তিনি জানতে পারলেন না, এমদাদ এখন একটিমাত্র রাইফেলে একটিমাত্র বুলেট ভরছেন। তারপর সেটি এগিয়ে দিচ্ছেন সেই সৈনিকের দিকে, যে তাঁকে গুলি করতে রাজি হয়েছে।

চোখবাঁধা জেনারেলের মনের চোখে হঠাৎ ঝলমল করে উঠল তাঁর সন্তানদের মুখ, বড় মেয়েটির অনাবিল হাসি, সবচেয়ে ছোটটির ছোট্ট মায়াভরা মুখ।

তারপর হঠাৎ তীব্র আলোর ঝলক। তারপর আর কিছু নেই।

মধ্যরাতের গভীর অন্ধকারে একটি গুলির শব্দ পাহাড়ের গায়ে প্রতিধ্বনি তুলল। খুলির এক পাশ উড়ে যাওয়া জেনারেলের দেহটি সশব্দে পড়ে গেল মাটিতে। সঙ্গে সঙ্গে কী যে হলো, ক্যাপ্টেন ও তাঁর সৈনিকেরা ঝট করে সরিয়ে নিল চোখ, তারপর ভূততাড়িতের মতো দৌড়ে পেরোতে লাগল ফায়ারিং রেঞ্জের চওড়া মাঠ।

নির্জন পাহাড়ের কোলে পড়ে রইল মেজর জেনারেল আবুল মনজুর বীর উত্তমের খুলি-উড়ে-যাওয়া দেহ।

প্রথমা প্রকাশন প্রকাশিত ‘দ্বিতীয় খুনের কাহিনি’ উপন্যাসটি কিনতে অর্ডার করুন: Prothoma.com