সকাল আটটায় হাতের মুঠোয় ফোনটা চেপে রেখে চুলায় চা চাপায় মাকসুদা। টেবিলে চা পৌঁছে দিয়ে মুঠো খুলে ফোনটার দিকে তাকিয়ে থাকে। চোখ ঘোলা হয়ে আসে। সাহেব আর ম্যাডাম চা শেষ করে অফিসের রাস্তায় নামেন, দরজা বন্ধ করলে সকালের দায়িত্ব শেষ। তারপর মিনিট দশেক রান্নাঘরের পিঁড়িতে বসে ঘোলা চোখে ফোনের ছোট্ট মনিটরটার দিকে তাকিয়ে থাকা। চোখ ভরে একটা ফোঁটা টুপ করে ফোনের ওপর পড়লে আরব দেশের চেনা নম্বরটায় বার কয়েক ফোন করে সে। ওদিকে রিং বেজে চলে এখনো। ধরে না কেউ। সাত বছর হয়ে গেছে, কেউ ধরেনি।
সকাল আটটা মানে শেফালির ওখানে ভোর পাঁচটা। কাজ শুরুর তোড়জোর আগে প্রতিদিন সে মাকসুদার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলে নেবে, আরব দেশে যাবার আগে মা-মেয়ের মধ্যে এমনই কথা হয়েছিল। মায়ের পেটের মধ্যে বাপের ফেলে যাওয়া, কষ্টে মানুষ মেয়েটা এত দূর চলে যাবে, ভাবতেই বুকটা খালি হয়ে গিয়েছিল মাকসুদার। তাই প্রতিদিন একবার কথা হবে, সেটুকুই ছিল মাকসুদার সান্ত্বনা। সেইমতো চলেছিলও মাস চারেক। শেফালি তিন মাস বিশ হাজার করে টাকা পাঠিয়েছিল। টাকা দুই হাতে চেপে মাটিতে বসে ঝরঝর করে কেঁদেছিল মাকসুদা। তাকে তবে আর মানুষের বাড়িতে কাজ করতে হবে না! বয়স বাড়তে বাড়তে কিনা এতটাই সুখ তার কপালে লেখা ছিল!
মেয়েটা সময়মতো ফোন করত আর কথা বলত ঠিকই, কিন্তু ধীরে ধীরে ভারী বিষণ্ণ হয়ে যাচ্ছিল। মুখ দিয়ে কথা বেরোয় কি বেরোয় না, অস্পষ্ট উচ্চারণের চেয়ে কখনো কান্নার দমকটা স্পষ্ট শোনা যেত। মাকে ছেড়ে গেছে বলে মনটা খারাপ হয়তো, তা ছাড়া গ্রাম থেকে কোনো দিন বাইরে পা না দেওয়া মেয়েটা কিনা উড়োজাহাজে গিয়ে বসেছে, গিয়ে নেমেছে রিয়াদে। তারপর দিন যায়, সপ্তাহ যায়, মাসও যায়—মেয়েটা একা একা কে জানে কী খায়, কীভাবে ঘুমায়! এসব চিন্তা এলে মাকসুদা কাঁদত বটে, কিন্তু চিন্তাটা মন থেকে এক পাশে সরিয়ে রাখত। চল্লিশ হাজার টাকা খরচ করে মেয়ে গেছে, সেই টাকা উঠে গেছে, এখন বাকি জীবন খালি লাভ। লাভের টাকা কিছুটা বেহিসাবিও খরচ করে মাকসুদা। কোনো দিন পেট ভরে পোলাও খাওয়া হয়নি, একদিন ফুলপ্লেট কাচ্চি খায়। শেফালিকেও বলে, ‘তুই না দামি দোকান থেইকা কাপড় কিনতে চাইছিলি? আমারে ট্যাকা কিছু কম দিয়া পরের মাসে কিন্যা ফালা।’
কিনমু কী মা, বাড়ি থেইকা বাইর হইতে পারলে কাপড় না মা, খালি ছুইট্টা পালাইতাম যেদিকে দুই চউখ যায়।
মানে? বাড়ি থেইকা বাইরাইতে দেয় না?
‘তয় আর কী কই, মা, খুব কষ্ট। কিন্তু তোমারে কইতে চাই নাই,’ শেফালি ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কাঁদে। মাকসুদা বিরক্ত হয়, ‘আরে, মাইয়া কান্দে ক্যা?’ শেফালি ফোঁস করে শ্বাস নেয়, ‘ঘুমাইতেও দেয় না, তিনজন পুরুষ, বাপেও আসে, আবার পোলায়ও...’ শেফালি কী যেন বলতে চায়, বলা বাদ দিয়ে ফোঁপায়। মুখের সামনে কাচ্চি খেয়ে আসার সময় কিনে আনা একটা গরম রসগোল্লা জুড়ায়। মাকসুদার মুখে রোচে না, কোনোরকমে বলে, ‘কী কইলি তুই!’
তারপর দুদিকেই নিস্তব্ধতা। হঠাৎ উদ্ভ্রান্তের মতো মাকসুদা বলে, ‘এর একটা বিহিত করতে হইব। ওই ব্যাডা কই, আর ওই এজেন্সি, অরা কি এই কামের জন্য নিছিল তরে?’
ওরা জাইনা–শুইনা এইডা করছে, মা। বেইচা দিছে আমারে।
তখন যে কইল সরকারি? কইল বাড়ির কামের চাকরি, সরকারি কাগজপত্র দেখাইল, এইডারে বৈধ কয় না?
বৈধ উপায়েই বেচছে আমারে, মা। পাচার করছে।
তুই কেমনে জানলি?
এরা প্রতিবার আইসা খালি কয়, মিসকিন মিসকিন! আমারে মনে কয় মিসকিনের দ্যাশ থেইকা কিন্যা আনছে। আমি বুজি জাইনা-শুইনাই বিক্রি হইছি, এখন চিল্লাইয়া ফায়দা কী?
এই সব কী কইতাছস তুই? এজেন্সিরে ফোন কর। তারা উদ্ধার করব না?
ফোন ধরে না, মা। ধরব না অরা।
গরিবের বুঝি আল্লাহ অনেক পরীক্ষা নেন—ভাবে আর শান্ত থাকে মাকসুদা। ঠিক যেমন শান্ত ছিল শেফালির বাপ তাকে ইয়া বড় পেটসহ ফেলে যাওয়ার পর। বুকে দুধ থাকা গ্রামের এক মহিলার কাছে দশ দিনের বাচ্চা রেখে মাকসুদা ঢাকায় চলে গিয়েছিল কাজ করতে। নাহলে নিজে খাবে কী আর বাচ্চা বড় করবে কীভাবে? প্রতিদিন সকাল আটটা বাজলেই মেয়ের কান্না শুনে শুনে কাহিল হলেও মাকসুদা তেমনই শান্ত থাকে। তারপর একদিন হুট করে বেরিয়ে পড়ে। গ্রামের পরিচিত যে ছেলেটা দামি কাজের কথা বলে শেফালিকে এজেন্সির কাছে নিয়ে গেছিল, সে গ্রামে নেই। তার ঠিকানা কেউ জানে না। এজেন্সিতে ফোন করে করে মাকসুদার দিনটা যায়। পরদিন মনে হয়, অন্যায় হলে মানুষ কার কাছে যায়, পুলিশের কাছেই তো! তাই সে সোজা চলে যায় থানায়। একটা বেঞ্চে অদৃশ্যের মতো বসে থাকতে থাকতে একসময় তার ডাক আসে।
কী বিষয়?
মাইয়ারে আটকাইয়া রাখছে। বাইত্তে রাইখা অর লগে...!—মাকসুদা ভেঙে বলতে পারে না।
কে আটকায়ে রাখছে? কোথায়?
কে সেইডা কইতে পারি না। আরব দ্যাশে।
পাগল নাকি মহিলা! এইখানে কী চায়?—থানার লোকেরা কৌতূহলী হয়। দু–একজন মজা পাওয়ার আশায় এগিয়ে আসে। তারপর তাকে ধরাধরি করে থানা থেকে বের করে রিকশায় উঠিয়ে দেয়।
পরদিন আবার সকাল আটটা বাজে।
‘আর তো পারি না, মা,’ মেয়ে কাঁদে। ‘আমার লগে একটা মাইয়া আইছিল, সে কইল পালাইয়া এক নম্বর মক্তবে গেছে।’
সেইটা কী?
সেফ হাউস, দূতাবাস থেইকা পাঠায়। তুমি বুঝবা না।
তাইলে তুই হেইখানে যাইতে পারস না ক্যান?
কীভাবে? দরজায় তালা।
মাইয়াডারে ক তরে নিয়া যাইতে।
সে নিজেই মরে মরে অবস্থা। এইডা কুন জাগা, সে ক্যামনে জানব? এইডা কুথায় আমিও জানি না। হারাইয়া গেছি, মা, এক্কেরে হারাইয়া গেছি আমি, মা গো!
মা কাঁদে। মেয়েও কাঁদে। তারপর তিন দিন সকাল আটটায় ফোন বেজে চলে। মেয়ে ধরে না। মায়ের অস্থিরতা চরমে উঠলে আবারও থানার দরজায় গিয়ে দাঁড়ায়।
আমি আর কুথায় যাব বলেন, বাবারা। আমার মাইয়ারে সৌদি আরবে কুথায় আটকাইয়া রাখছে আপনেরা খুঁইজা দেন।
দুই পুলিশ মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। একজন আরেকজনকে বলে, ‘এজেন্সির নাম জানতে চান, নির্ঘাত বলতে পারবে না। কিন্তু মেয়েকে পাঠানোর বেলায় আগ্রহ ষোলো আনা। লোভ, বুঝলেন? এদের এ রকম হবে না তো কী হবে!’
সরকারই নাকি পাঠাইতে কইছে, বাবা। অনেক চাকরি আছে, অনেক লোক লাগব। আমরা গরিব মানুষ, বাবা—মাকসুদা মাঝখান দিয়ে কথা বলে। তার কথা যেন কেউ শুনতে পায় না।
অন্যজন বলে, ‘আরে, পলিসি আছে, একজন নারী শ্রমিক ওখানে পাঠালে দুইজন পুরুষ শ্রমিক পাঠানোর অনুমতি পাওয়া যাবে, বুঝলেন না? তাই লোভ দেখায়ে এজেন্সি এই সব করে।’
তা নাম-ঠিকানা-নম্বর কিছু আছে নাকি? কে পাঠাইছে আপনার মেয়েকে?—এক পুলিশ জানতে চায়।
আমগো গেরামের রতন নিয়া গেছিল এক অপিসে। সেইখান থেইকা চাকরি দিছে। আর কিছু তো জানি না। রতনের ফোন বন্ধ অহন, তাইলে আমি...—মাকসুদা কান্নায় ভেঙে পড়ে।
ব্যস, হলো তো? এ রকম রতন... এরা ঠিকই জোগাড় করে ফেলে—একজন পুলিশ আরেকজনের দিকে কেস সমাধান করার তৃপ্তি নিয়ে তাকায়।
‘আপনেরা কী কন, বাবা? আমার মাইয়া ছাড়া পাইব?’ মাকসুদার উৎকণ্ঠা দেখে একজনের দয়া হয়। বলে, ‘শোনেন, ওটা কিন্তু বিদেশ। আমাদের কোনো হাত নেই। আর এজেন্সির ঠিকানাও আপনি জানেন না। কেউ কেউ এ রকম কাজের জন্য বৈধ পথে মেয়েদের পাঠায়, কিন্তু নাম-ঠিকানা না হলে আমরা ব্যবস্থা নেব কীভাবে?’
সরকার? সরকার তাদের ধরতে পারে না?
ঘরের ভেতরে কী হয়, সরকার জানে না। এজেন্সিও বলতে পারে না।
এইডা কী কন, বাবা, কামের খবর না নিয়া আপনেরা আমার মাইয়ারে পাঠান কেমনে? আপনের মাইয়া হইলে পাঠাইতেন?
আমিও তো এটাই বলি, আপনারা মেয়েকে পাঠান কেন?—লোকটার কণ্ঠস্বরে মাকসুদা বিভ্রান্ত হয়।
অভাব, বাবা, অভাব। জুতমতো কাম পাইলে কি পাঠাইতাম?
এক পুলিশ অন্যজনকে বলে, ‘আর মন্ত্রী কয় দিন আগে কী বলছিলেন মনে আছে? অনেককেই ওখানে পাঠানো হচ্ছে, বেশির ভাগ মেয়েই ম্যানেজ করে নিচ্ছে, কয়েকজন যে কেন পারতেছে না, সেটা বোঝা যাচ্ছে না।’
মাকসুদা ততক্ষণে বুঝতে পারে, ওখানে কথা বলে লাভ নেই। বরং পরের সকাল আটটার অপেক্ষা। তিন দিন পর মেয়ে ফোন করে, ‘অসুখ হইছে, মা। মনে কয় বাঁচুম না।’
কী কস!
হ মা, তারা ডাক্তার আনছিল। ডাক্তারে কইছে, হামিল। শুইনা উনারা খুব রাগ করছে। কী হইছে আমি বুঝি নাই।
আচ্ছা, তুই ঘুমাইয়া থাক।
এক্কেরে ঘুমামু, মা। ওই যে সেফ হাউসের মাইয়াডা, সে মইরা গেছে মনে কয়। ফোন ধরে না আর।
মরলে কী করে ওরা?—প্রশ্নটা যেন মাকসুদা নয়, তার ভেতর থেকে অন্য কেউ করে। মুখ দিয়ে বেরিয়ে যাবার পর নিজেই জিবে কামড়ে ধরে।
জানি না। পাঠাইয়া দিতে পারে। তুমি কিন্তু আমার লাশটারে এট্টু বুকে নিয়ো।
মাকসুদা কিংবা শেফালি, কেউই আর কথা বলে না। ফোঁপায় না। আর কোনো শব্দই থাকে না তাদের মধ্যে। কী মনে করে মাকসুদা সোজা মসজিদের দিকে হেঁটে যায়, গেটের কাছে অপেক্ষা করে। মসজিদের ইমামকে দেখতে পেয়ে জানতে চায়, হুজুর, একখান কতা আছিল, হামিল মানে কী?
কে, তুমি না তোমার মাইয়া? লা হাওলা ওয়ালা কু...—হুজুরের মুখটা বিকৃত দেখায়। মাকসুদার শরীরের মধ্যভাগে তার বিষদৃষ্টি খেলে যায়। তারপর গলা খাকারি দিয়ে বলে, ‘মাইয়াডারে কয় দিন আগে আরব দেশে পাঠাইছিলা না? এই গেরামে কিন্তু তার আর জায়গা হইব না কইলাম।’ মাকসুদা মুখে আঁচল চেপে মাথা নিচু করে। হুজুরের মুখটা আগের চেয়েও কুঁচকে আসে, ‘কী কামডা করল, নাউজুবিল্লাহ্, বিয়া না হইতেই বাইচ্চা?’
মাকসুদা হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। তারপর আঁচল টেনে মুখটা মুড়িয়ে নেয়। মেয়েটা তার আর মুখ দেখানোর উপায় রাখল না। ধীরে ধীরে হুজুরের সামনে থেকে সরে আসে। এত কিছুর মধ্যেও বহুক্ষণ খাবার পেটে পড়েনি, টের পায়। মুদির দোকানের সামনে বসে একটু মুড়ি চাইতেই দোকানের ছেলেটা খবরের কাগজ ছিঁড়ে ঠোঙা বানায়। মুড়িটা হাতে দিতে দিতে ঠোঙার ছবির দিকে ইশারা করে বলে, ‘এই দেখো, খালা, আরবের বাদশাহ আর আমাগো প্রধানমন্ত্রী কথা কইতেছে। শানশওকতটা দেখছ? তোমার মাইয়া না গেছে ওই দ্যাশে? জব্বর আছে মুনে কয়।’
ছেলেটা হাসে। মুঠের মুড়ি মুখে ছুড়ে দিয়ে চোয়াল আটকে যায় মাকসুদার। টলটলে চোখে ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকে। সোনার রঙের চেয়ার, হতে পারে সোনা দিয়েই বানানো। ওই দেশে অনেক সোনা, শেফালি বলেছিল। ওই চেয়ারে বসে তারা কি তার মেয়ের মতো মেয়েগুলোকে নিয়ে কথা বলে? তারা কি জানে শেফালির মতো মেয়েদের কথা?
আঁচল টেনে চোখ মুছে নেয় মাকসুদা। ছেলেটা কৌতূহলী হয়, মাইয়ার লাইগা মনডা খারাপ লাগে, না? তা একটু লাগবই। তয় অহন সমস্যা কী, চাইলেই ফোন করা যায়।
দোকানের ছেলেটা জানত না, জানত না মাকসুদাও—চাইলেই আর ফোনে শেফালির গলা শোনা যাবে না। সাত বছর ধরে মাকসুদা সকাল আটটায় ফোন করবে আর মুঠোর মধ্যে ফোনটাকে চেপে ধরে রাখবে। পরে জেনেছিল কারও কারও লাশ আসে। দোকানের ছেলেটা অবশ্য বলেছিল, মন্ত্রী নাকি বলেছেন, যতজন ওখানে যায় বেশির ভাগ ভালোই থাকে, খুব অল্প শ্রমিকের লাশ আসে। শুনে মাকসুদা বুঝেছিল, নিশ্চয় আরও কম মানুষের লাশটাও আসে না! তবে সেসব নিয়ে বেশি ভাবেনি সে, লাশ যখন আসেনি, আছে কোথাও মেয়েটা। কোনো দিন বলা নেই কওয়া নেই সকাল আটটায় মাকসুদার ফোনটা বেজে উঠবে, সে জানে।