বাদাঘাটে, এই আষাঢ়ে

অলংকরণ: আরাফাত করিম
অলংকরণ: আরাফাত করিম

সুজন মিয়ার সন্তানভাগ্য খারাপ, কথাটা বাদাঘাটের দু-তিনজন বয়স্ক লোক বলে। জমি-জিরাত আছে, বাজারে একটা মনিহারি দোকানও আছে, স্ত্রীর স্বাস্থ্যও ভালো, কিন্তু একটা মাত্র ছেলে। সুজন মিয়া এ জন্য বুড়োদের, এমনকি তার বয়সীদের এড়িয়ে চলে। বাজারের বিকিকিনি শেষে সন্ধ্যার আলো জ্বললে সে হিসাবের খাতা বন্ধ করে। তারপর আলতাফ মাস্টার আর রাজু কবিরাজের সঙ্গে চা খেতে খেতে গালগল্প করে। এ দুজন বয়সে কম, যদিও একজন মাস্টারি করে, অন্যজন রোগী দেখে দেখে একটা ভারিক্কি ভাব এনেছে চেহারায়। কিন্তু এখানে এলে তারা প্রচুর হাসে। দুনিয়ার খবর শোনায়, চুটকি বলে, আষাঢ় এলে আষাঢ়ে গল্প ফাঁদে, সুজন মিয়া সেসব গল্প শুনে বলে, ও মিয়ারা, আজগুবিরও একটা সীমা আছে। তারা অবশ্য সুজন মিয়ার সন্তানভাগ্য নিয়ে কোনো কথা বলে না, বরং রতনকে নিয়ে উদ্বেগ দেখায়। সুজন মিয়ার স্ত্রী কমলা বানু রতনকে মাথায় তুলে রেখেছে, আহ্লাদে-আদরে ভাসিয়েছে। আলতাফের দুঃখ, ছেলেটা পড়াশোনা করল না। রাজু বলে, ছেলেটা দেখতে সুন্দর, মাথায় উঁচা, সে তো অফিসার হতে পারত।

সুজন মিয়া লম্বা শ্বাস ছাড়ে। তার মনে দুঃখ। স্ত্রীকে ভালোবাসে, কোনো দিন তাকে কটু কথা বলেনি। কিন্তু একদিন দুঃখ করে বলল, ছেলেটাকে তুমি শেষ করে দিলে। এখন কী হবে?

কমলা বানু প্রবল প্রতিবাদ জানাল। কে বলেছে আমার রতন শেষ হয়ে গেছে? ভালো পাস না দেওয়া মানে শেষ হয়ে যাওয়া?

সুজন হাসল। ভালো পাস কেন, ছোটখাটো পাসও তো দিতে পারল না। স্কুলটা শেষ করল?

মায়ের আশকারা পেলেও বাবা যে তাকে নিয়ে হতাশ, রতন তা বোঝে। পড়াশোনায় ইস্তফা দিয়ে সে বাবার সঙ্গে কাজে নেমেছে, কিন্তু দূরত্বটা রেখে। দুপুর পর্যন্ত বাবা খেতখামার তদারকি করে, সে থাকে দোকানে। সুজন খেয়ে দোকানে গেলে রতন বাড়ি আসে। কোনো দিন তদারকিতে যায়, কোনো দিন না।

একদিন সে মাকে বলল, আমি লিবিয়া যাব।

মা জিজ্ঞেস করল, লিবিয়া কোন পরগনায়? বাদাঘাট থেকে কত দূর?

সুজন মিয়া শুনল, বালিজুড়ির দরস মিয়ার সঙ্গে রতনকে দেখা গেছে। দরস মিয়ার বাবা হারিছ মিয়া একসময় মানুষকে লন্ডন পাঠাত, এখন দরস পাঠায় লেবাননে, লিবিয়ায়। সে রতনকে সরাসরি জিজ্ঞেস করল, তোমার কী মতলব?

লিবিয়া যাব। চার লাখ টাকা দেবেন। দরস ভাই চাকরি ঠিক করে রেখেছেন। এক বছরে ফেরত দেব।

রতন কথা বলে কাটাকাটা, তা-ও যেটুকু বলতে হয়।

সুজন মিয়া স্ত্রীর কাছে রতনের এই হঠাৎ খেয়ালের কথা জানতে চাইল। স্ত্রী তাকে বলল, পাগল ছেলে, যেতে চাইছে যাক, কিছুদিন পর ফিরে আসবে।

সুজন মিয়া জানত না কমলা বানুকে রতন বুঝিয়েছে লিবিয়া ছাতকের ধারেকাছে এবং সে কাজ করবে সিমেন্ট ফ্যাক্টরিতে। সুপারভাইজার হবে।

সুজন চেষ্টা করল ছেলেকে বোঝাতে, কিন্তু দরস মিয়ার কাছে পরাস্ত হলো। লম্বা শ্বাস ছেড়ে ওপরওয়ালাকে ডাকল, বলল, তুমিই মালিক।

রতন বলল, সে বেনগাজি যাবে। বেনগাজির সিদি হোসেনে ভাতগাঁওয়ের অচিন্ত্য আছে। তার সঙ্গেই থাকবে।

বাবা থেকে যা সে গোপন করল: অচিন্ত্য তাকে বেনগাজি থেকে নৌকায় তুলে দেবে। নৌকায় সে যাবে মাল্টা। মাল্টা থেকে সিসিলির সিরাকুসায়। সেখানে তাকে নিতে আসবে বালিজুড়ির আইনুদ্দিন।

তারপর তার সুখের দিনের শুরু। দরস বলল, তুই এখনো বিয়েশাদি করিসনি। ভাবিস না। ইতালির মেয়েরা ডানাকাটা পরি।

দরস যা গোপন রাখল রতন থেকে, বেনগাজিতে তাকে এক মাছ ধরা নৌকায় তুলে দেওয়া হবে। তারপর চার লাখ টাকার দায় শোধ।

দুই. 

বেনগাজি থেকে বাবাকে ফোন করল রতন, পনেরো দিন পর। বলল, ভালো আছি। কিন্তু সুজন বুঝল, সে ভালো নেই, গলাটা বিপর্যস্ত। ফোনে সে মাকে চাইল, বলল, মা দোয়া করো। খাজা খিজিরের নামে শিন্নি দিয়ো। তারপর সে কাঁদল।

কমলা বানু ভাবল, ছেলে মাকে ছেড়ে কষ্টে আছে। সে বলল, শিন্নি দেব। একটু অবাক অবশ্য হলো, খাজা খিজিরের দোয়া তো চায় তুফানের মৌসুমে নাও ভাসানো মাঝিমাল্লারা।

আরও পনেরো দিন গেল। রতনের কোনো খবর নেই। উদ্বিগ্ন সুজন মিয়া বালিজুড়ি গিয়ে দরসকে খুঁজে বের করল। দরস বলল, লিবিয়ায় গৃহযুদ্ধ। ফোনের নেটওয়ার্ক নেই। ভয় পাবেন না, রতন ঠিক আছে।

কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে ফিরল সুজন। কিন্তু সন্ধ্যায় চা খেতে এসে আলতাফ মাস্টার সব শুনে বলল, ওকে বিশ্বাস করা যায় না।

রাজু কবিরাজ বলল, ওকে ডেকে পাঠান। ও কথা লুকাচ্ছে।

দুদিন পর আলতাফ মাস্টার প্রথম আলো হাতে সুজন মিয়ার দোকানে ঢুকল। বলল, খবর ভালো নয়।

সুজন মিয়া জানল, বেনগাজি থেকে ইতালি যাচ্ছিল এক নৌকাভর্তি উদ্বাস্তু। বেশির ভাগ আফ্রিকার। তবে সঙ্গে তিন বাংলাদেশিও ছিল। সবার বাড়ি সুনামগঞ্জ। সাগরের মাঝখানে নৌকা ডুবেছে। একজনের নাম পাওয়া গেছে। তাহিরপুরের মকিম। বাকি দুজনের কোনো খোঁজ নেই।

সুজন শুনল। তার চোখ বন্ধ হয়ে গেল। সে ওপরওয়ালাকে বলল, রতনের মাকে কথাটা কীভাবে জানাই, তুমি বলে দাও।

তার মনে হলো রতন নয়, সে–ই ডুবছে। তার নাক-মুখ দিয়ে পানি ঢুকছে। শ্বাস আটকে যাচ্ছে।

সুজন মিয়াকে ডাক্তার দেখানো থেকে রতনের খোঁজখবর নেওয়া, সবই করল আলতাফ আর রাজু। কমলা বানুকে তারাই জানাল দুঃসংবাদটা। কমলা বানু জ্ঞান হারাল।

বাদাঘাটের দুই বয়স্ক লোক বলল, বংশের একটাই বাতি ছিল লোকটার, সে-ও গেল। তবে সে যে নিশ্চিতভাবে গেল, তা–ই–বা তারা কীভাবে জানল? রতনের তো লাশ পাওয়া যায়নি।

তিন. 

বাদাঘাটে আষাঢ় নামল কমলা বানুর চোখের পানিকে সঙ্গ দিতে। জাদুকাটা নদী কূল ছাপিয়ে বইতে শুরু করল। রাস্তাঘাট পানির নিচে। মাঠঘাট, ধানের খেত—সব জলে ডোবা।

রাজু একদিন সান্ত্বনা দিয়ে বলল সুজন মিয়াকে, রতনের দুঃখে আকাশ কাঁদছে।

আলতাফ বলল, সোনার ছেলে, পশু–পাখির জন্য কত ভালোবাসা ছিল!

বাদাঘাটে কোড়া পাখি শিকার বন্ধ করেছিল রতন, মনে আছে? রাজু বলল, জাদুকাটাতে মাঝেমধ্যে শুশুক এলে মাঝিরা যে বইঠা দিয়ে মারত কেন, কে জানে—তা-ও ঠেকিয়েছে রতন। 

সুজন মিয়া কাঁদতে ভুলে গেছে। পানিতে ডোবা মানুষ কোথায় আর চোখের পানি ফেলে।

চার.

সারা রাত বৃষ্টি ঝরেছে। সকালে একটুখানি যেন দম নিয়েছে আষাঢ়। সুজন মিয়া বেরোল, ছাতা হাতে। সে হাঁটবে, উদ্দেশ্যহীন। ঘরে থাকলে তার দম বন্ধ হয়ে যায়।

সে দেখল, একটি কোড়া পাখি এসে তার হাতে ধরা গোটানো ছাতাটায় বসল, বলল, চাচা, খবর আছে।

সুজন মিয়ার মনে হলো, বিজলির ফলা যেন গায়ে লাগল। কোড়াটা বলল, খবরটা রতন ভাইয়ের। তাকে আমাদের সালাম।

সুজন মিয়া এক পৃথিবী সমান অবিশ্বাস নিয়ে তাকাল কোড়াটার দিকে। কোড়াটা একটু হাসল, বলল, চাচা, তাজ্জব হবেন না। রতন ভাইয়ের সঙ্গে আমরা কথা বলতাম, তিনিও বলতেন।

রতনের কী খবর? সুজন জিজ্ঞেস করল। নিজেকে সে এখন অবিশ্বাস করতে শুরু করেছে।

খবর ভালো। তবে খবরের জন্য আপনাকে জাদুকাটাতে যেতে হবে। 

সুজন মিয়ার মনে পড়ল কেন সে বাড়ির বাইরে আসতে এত অস্থির হয়ে পড়েছিল। কারণটা কমলা বানু, সে বিড়বিড় করে কথা বলে আর চুল ছেঁড়ে, এ দৃশ্য তার কাছে নির্মম বেদনার। সে কোড়াকে বলল, কখন?

এখন, কোড়া বলল এবং ছাতাতেই বসে থাকল, যদিও বৃষ্টি আবার নেমেছে এবং সুজন মিয়া ভিজছে।

বাদাঘাটের বুড়োরা দেখলে দুঃখ পেত। বলত, লোকটা শেষ পর্যন্ত পাগলই হয়ে গেল।

পাঁচ.

জাদুকাটা টইটম্বুর, পাক দিয়ে দিয়ে পানির স্রোত বইছে। বৃষ্টি বেড়েছে, সে যেখানটায় গেল, সেখানে কিছু ইট আর নারিকেলের কাটাখণ্ড বিছিয়ে তিন সিঁড়ির একটা ঘাট বানিয়ে রেখেছে কেউ। ছাতাটা পাড়ে রেখে সে পানিতে নামল। কোড়াটা ছাতাতেই বসে থাকল, বলল, চাচা, ডুব দেন।

ডুব দিয়ে সে দেখল, তিন-চারটা শুশুক মুখ দিয়ে ঠেলে ঠেলে একজন মানুষকে পাড়ে নিয়ে আসছে। শুশুকগুলোকে দেখে মনে হলো তারা হাসছে। সুজন মিয়ার হঠাৎ মনে পড়ল, রতনের জন্মের পর দাইমা তাকে তার হাতে তুলে দিয়ে বলেছিল, ভাইজান, আজান দেন।

আজও কি কেউ তাকে তার হাতে রতনকে তুলে দিচ্ছে, বাইশ বছর আগের সেই বর্ষাদিনের মতো?

অবাক, পানির ভেতর দিয়ে সে ছেলের গায়ের ঘ্রাণ পেল। সে জানল, এই ঘ্রাণ বিলানো মানুষটা রতন। সে আস্তে ডাকল, রতন! বাবা!

রতন তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদল। তারপর তিন সিঁড়ির ঘাট বেয়ে উঠল। সুজন মিয়া দেখল, শুশুকগুলো পানির ওপরে লাফাচ্ছে আর হাসছে। একটা বলছে, বাই বাই, রতন ভাই। ভালো থেকো।

রতন বলল, আবার দেখা হবে এবং বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, আমরা চল্লিশজন যে নৌকায় উঠেছিলাম, তাতে বড়জোর কুড়িজনের জায়গা ছিল। ঘণ্টা চারেক চলার পর নৌকাটা পড়ল ঢেউয়ের পাল্লায়। আমরা ডুবলাম। মরেই যেতাম, যদি না অনেকগুলো শুশুক এসে আমার নিচে জাজিমের মতো বিছিয়ে যেত। তারা আমাকে বেনগাজির জুলিয়ানা বিচে ফিরিয়ে নিয়ে এল।

সুজন মিয়া বলল, এখানে এলে কীভাবে?

অচিন্ত্য আমাকে প্লেনে তুলে দিল। ওর কাছে আমার টিকিট আর পাসপোর্ট ছিল।

তারপর? সুজন মিয়াকে মনে হলো দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ধাঁধার সামনে পড়েছে।

তারপর বাদাঘাট। আমার তো শুশুকগুলোকে একটা কিছু বলার ছিল। মনে হলো, জাদুকাটাতে নেমে বলতে পারি। তারা আমার জন্য অপেক্ষা করবে।

ছেলের কাঁধে হাত রেখে হাঁটছিল সুজন, ছাতাটা তুলে নিতে ভুলে গেছে। বৃষ্টিতে দুজনই ভিজছে। তার মনে হলো, রতনের গা থেকে নুনে ভেজা একটা গন্ধ তার নাকে লাগল।

নাকি তোমাকে ওই শুশুকেরাই জাদুকাটা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেছে?

কী যে বলেন বাবা, রতন বলল, মাথাটা আপনার নষ্ট হয়ে গেছে।

সুজন হাসল। ছেলের ভেজা মাথায় আঙুল বোলাল। একটা আঙুল কেন জানি একটুখানি জিভে লাগাল। নোনতা।

সুজন মিয়া আকাশের দিকে তাকাল। উল্টানো কালি লেপা পাতিলের মতো আকাশ। আষাঢ়ের এখন ভরা যৌবন। সেই আকাশে চোখ মেলে সে বলল, মালিক, আষাঢ়টা তুমি ফিরিয়ে নিয়ো না। কোনো দিনও না।