ধারাবাহিক উপন্যাস, স্লোনেস: মিলান কুন্ডেরা, অনুবাদ: আনিসুল হক

ধীরে চলা

(চতুর্থ কিস্তি)
[আমরা উপন্যাসটি অনুবাদ করব, পড়ব এবং পড়তে পড়তে খানিক আলোচনাও করব। একটুখানি কাটাছেঁড়া করে দেখব, কুন্ডেরা এই উপন্যাসটা লিখছেন কী গঠনশৈলী অবলম্বন করে! আপনাদের মনে করিয়ে দিই, একজন লোক প্যারিস থেকে তার সঙ্গিনী ভেরাকে নিয়ে একটা হোটেলে উঠেছে। এই যাত্রার সামান্য বিবরণই আমরা পাই। তার চেয়ে বেশি পাই তত্ত্ব-আলোচনা। আমরা ভিভাঁ দেনোঁর ‘নো টুমরো’ (কোনো আগামীকাল নেই) উপন্যাস নিয়ে আলোচনা শুনি। আমরা ‘ডেঞ্জারাস লিয়াজোঁ’ নামের আরেকটা উপন্যাস, যা কিনা চিঠির আকারে লেখা, তা নিয়ে আলোচনা করি। এর মধ্যে ভেরা আর এই আমাদের নায়ক হোটেল রুমে এসেছে। টেলিভিশনের পর্দার ছবির সূত্র ধরে এবার আমরা শুনছি দুর্ভিক্ষ এবং আফ্রিকা বিষয়ে লেকচার। আসুন শুনতে থাকি]

সুতরাং এটা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক যে বড়দের নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে বড়দের নয়, ছোটদের বিদ্রোহ করা উচিত। এবং শিশুদের স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ততাসমেত তাদের উচিত এই বিখ্যাত প্রচারণাটা নতুন করে শুরু করা ‘ইউরোপের শিশুরা সোমালিয়ার শিশুদের জন্য চাল পাঠাচ্ছে।’ সোমালিয়া! অবশ্যই। সোমালিয়া! এই বিখ্যাত স্লোগানটি আমাকে ভুলে যাওয়া দেশের নামটিকে ফিরিয়ে দিল। আহা, কী করুণ ব্যাপার! পুরো ব্যাপারটা এরই মধ্যে বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছে! বাচ্চারা অসংখ্য বস্তা চাল কিনেছিল। অগণিত বস্তা। বাবা-মায়েরা তাঁদের সন্তানদের মধ্যে বৈশ্বিক সংহতি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তাঁরা টাকা দিয়েছিলেন। স্কুলগুলো এগিয়ে এসেছিল দুহাত বাড়িয়ে। স্কুলে স্কুলে চাল সংগ্রহ করা হচ্ছিল, বন্দরে পাঠানো হচ্ছিল, জাহাজে তুলে পাঠানো হচ্ছিল আফ্রিকার উদ্দেশে, আর প্রত্যেকেই অনুসরণ করতে পারছিল গৌরবময় চাউল-মহাকাব্যটাকে।

মুমূর্ষু শিশুদের পর এবার টেলিভিশনের পর্দা দখল করল দুই বালিকা, ৬ বছর আর ৮ বছর বয়সী। তাদের বড়দের মতো করে কাপড় পরানো হয়েছে। তাদের ভাবভঙ্গি বড়দের মতো। ফ্লার্টিং। ওহ। এটা কী সুন্দর, কী মর্মস্পর্শী, কী মজার! যখন ছোটরা বড়দের মতো ভাবভঙ্গি করতে থাকে। ছোট ছেলেমেয়েরা চুমু খায়। এবার এলেন এক ব্যক্তি, তিনি একটা শিশুকে দুহাতে কোলে নিয়ে বলছেন, কী করে তাঁর শিশুর এখনই ভেজানো ন্যাপি সহজে পরিষ্কার করা যাবে। এরপর এলেন একজন সুন্দর নারী, তাঁর জিব খুবই আবেদনময়ী, তিনি সেই জিব বাড়িয়ে দিলেন ন্যাপি পরিষ্কারক লোকটির সুশীল মুখে।

ভেরা বললেন, ঘুমুতে এসো। তিনি সব বাতি বন্ধ করে দিলেন।


আফ্রিকান বন্ধুদের দিকে ফরাসি শিশুদের সাহায্য করার জন্য ছুটে আসা আমাকে সব সময় মনে করিয়ে দেয় বুদ্ধিজীবী বার্কের মুখ। তখন ছিল তার গৌরবের দিন। পরাজয় প্ররোচিত করে গৌরব আনতে। আসুন স্মরণ করি: বিশ শতকের আশির দশকে, পৃথিবী কেঁপে উঠেছিল এক মহামারির আঘাতে, তার নাম ছিল এইডস, যা প্রধানত ছড়াত যৌন সংসর্গের মাধ্যমে এবং বেশি ছড়িয়েছিল সমকামীদের মধ্যে। ধর্মান্ধরা মনে করত যে এটা হলো স্বর্গীয় উপযুক্ত শাস্তি, তারা এইডস রোগীদের এড়িয়ে চলত যেন তারা প্লেগের রোগী, তারই প্রতিবাদস্বরূপ সহনশীল মানুষেরা এগিয়ে এসেছিল ভ্রাতৃত্বের ডাক নিয়ে, তারা কষ্ট স্বীকার করছিল এটা দেখাতে যে রোগীদের সঙ্গে মেলামেশা করলেই এইডস ছড়ায় না। তারই অংশ হিসেবে বুদ্ধিজীবী বার্ক এবং জাতীয় সংসদের দুবিউক একটা দামি ফরাসি রেস্তোরাঁয় এইডস রোগীদের সম্মানে মধ্যাহ্নভোজের অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। ভোজন পর্ব সুন্দর পরিবেশে এগিয়ে যাচ্ছিল। একটা উদাহরণ সৃষ্টি করার এই সুযোগ হারানো চলে না। তাই জাতীয় সংসদের ডেপুটি দুবিউক শেষের মিষ্টান্ন পরিবেশনের সময় ডেকে এনেছিলেন ক্যামেরা। ক্যামেরা দরজার সিঁড়িতে এসে পৌঁছেছে, তখনই দুবিউক একজন এইডস রোগীকে ধরে চেয়ার থেকে শূন্যে তুলে তার মুখে চুমু খেলেন। তার মুখে তখনো গলা চকলেট লেগে আছে। বার্ক তো তখন পিছিয়ে পড়েছেন। তিনি বুঝতে পারলেন, এই ঘটনা একবার যখন ধারণ করা হবে, চিত্রায়িত হবে, তখনই দুবিউকের এই মহান চুমু চিরকালের অমরতা লাভ করবে। বার্ক উঠে দাঁড়ালেন, তীব্রভাবে ভাবতে লাগলেন তিনিও কি একজন এইডস রোগীকে চুম্বন করবেন? কিন্তু এই হাতছানি থেকে দূরে রাখলেন নিজেকে, প্রথমত মনের গভীরে তিনি নিশ্চিত নন আসলেই এইডস রোগীকে চুমু খেলে সংক্রমণ হয় না কি হয় না। দ্বিতীয়ত, তাঁর মনে হলো, না, এটা নিরাপদ কি না তিনি জানেন না। কিন্তু তিন নম্বর কারণটাই তাঁকে চুম্বন না করতে প্ররোচিত করল, তিনি যদি চুমু খান ওই মুখে, তাহলে তা কখনোই অতটা মহান বলে বিবেচিত হবে না, কারণ তিনি নকল করছেন। তিনি ক্ষুদ্র হয়ে যাবেন, নকলকারী হবেন, তাঁর এই চুমু বরং আগে চুম্বনকারীকে আরও বেশি মহত্ত্ব দেবে। গৌরব দেবে। তিনি ঠিক করলেন, তিনি স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে থাকবেন এবং বোকার মতো হাসতে লাগলেন। কিন্তু তাঁর সিদ্ধান্তহীনতার সেই কয়েকটি মুহূর্ত তাঁর কাছ থেকে চড়া দাম আদায় করে নিল। ক্যামেরা ছিল সেখানে। রাতের খবরে সমগ্র ফ্রান্স তাঁর মুখে প্রতিফলিত তিন কিস্তির অনিশ্চয়তা পড়ে ফেলতে পারল। তারা একযোগে হাসি চাপার চেষ্টা করল। এরপর শিশুরা সোমালিয়ার শিশুদের জন্য চালের বস্তা সংগ্রহ করতে গিয়ে বার্কের উদ্ধারে এগিয়ে এল সঠিকতম মুহূর্তে। তিনি জনগণের উদ্দেশে এই স্লোগান ছুড়ে মারার প্রতিটা সুযোগ কাজে লাগালেন—‘বল শিশুরাই সত্যের মধ্যে বসবাস করছে।’ তিনি উড়ে গেলেন আফ্রিকার একটি দেশে, একটা মাছ ভনভন করা কালো বালিকামুখের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুললেন। তার সেই ছবি জগৎজোড়া বিখ্যাত হয়ে উঠল। এমনিক দুবিকিউয়ের চুমুর ছবির চেয়েও বার্কের ছবি বেশি বিখ্যাত হলো, কারণ একজন মরণাপন্ন শিশু একজন মরণাপন্ন বয়স্কের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এটা একটা স্বতঃসিদ্ধ সত্য। দুবিকিউ এই সুযোগ পাননি। কিন্তু তিনি মনে করলেন না যে তিনি হেরে গেছেন। তিনি ঠিক করলেন, তিনি একটা মোমবাতি আনবেন, তিনি একজন খ্রিষ্টান, তিনি জানেন যে বার্ক নাস্তিক, কিন্তু মোমবাতির সামনে যেকোনো অবিশ্বাসীও মাথা নুইয়ে ফেলে। তিনি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারের সময় পকেট থেকে মোমবাতি বের করলেন, তারপর সেটা প্রজ্বলিত করলেন, উদ্দেশ্য বার্ককে কোণঠাসা করা, বার্ক বিদেশের শিশুদের নিয়ে চিন্তিত, অথচ ফ্রান্সেই কত শিশু না খেয়ে আছে, আমাদের নিজেদের গরিব শিশুরা কত কষ্ট করছে, গ্রামে, উপশহরে। তিনি ডাক দিলেন, আসুন ভাইসব, আমরা একটা মিছিল করি, আমাদের শিশুদের জন্য, আমরা প্রত্যেকে হাতে করে আনব একটা করে মোমবাতি। তিনি (ভেতরের তামাশা গোপন রেখে) বার্ককে আহ্বান জানালেন সেই শোভাযাত্রায় নেতৃত্ব দিতে, মোমবাতি নিয়ে সামনে এসে দাঁড়াতে। বার্কের সামনে দুইটা রাস্তা, এক, এই শোভাযাত্রায় যোগ দিয়ে দুবিকিউয়ের দোহারের ভূমিকা নেওয়া, আর না হলে এটা থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়া এবং দুর্নামের ভাগি হওয়া। তিনি আরও সাহসী অপ্রত্যাশিত ভূমিকা নিলেন। তিনি উড়ে চললেন পৃথিবীর আরেক প্রান্তে, একটা এশিয়ান দেশে, যেখানে মানুষ অধিকার আদায়ের জন্য রাস্তায় মরণপণ লড়াই করছে, তিনি সেই দেশে যাচ্ছেন, তিনি মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে মানুষের অধিকারের পক্ষে সজোরে চিৎকার করবেন। কিন্তু তাঁর ভূগোলের জ্ঞান ছিল খুব খারাপ, তাঁর কাছে পৃথিবী দুই ভাগে বিভক্ত, ফ্রান্স আর ফ্রান্স-নয়। তিনি প্লেন থেকে পা রাখলেন আরেকটা শান্ত, ক্লান্তিকরভাবে শান্তিপূর্ণ দেশে। সেই দেশে আছে শীতল পর্বত, তা এতই ঠান্ডা যে উড়োজাহাজ বন্ধ রইল মূল্যবান আটটি দিন। তারপর তিনি সর্দিকাশি আর পেট ভরা খিদে নিয়ে ফিরে এলেন প্যারিসে।
‘বার্ক হলো নৃত্যশিল্পীদের শহীদ-রাজা।’ এই মন্তব্য পঁতেভির।

নৃত্যশিল্পী তত্ত্বটা পঁতেভির অল্পসংখ্যক বন্ধুরই জানা। এটা তাঁর সেরা আবিষ্কার। দুঃখের ব্যাপার, পঁতেভি কোনো দিনও এই তত্ত্ব নিয়ে কিছু লেখেননি, কিংবা কোনো আন্তর্জাতিক সেমিনারে পেপার পড়েননি। তাতে অবশ্য কিছু যায় না, তিনি সস্তা খ্যাতিতে বিশ্বাস করেন না। তাঁর বন্ধুরা আরও আনন্দ আর আগ্রহ নিয়ে তাঁর এসব তত্ত্বালোচনা শ্রবণ করে থাকে।

[প্রিয় পাঠক, আমরা একটা উপন্যাস পড়ছি। মিলান কুন্ডেরার স্লোনেস। এক লোক তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে একটা হোটেলে উঠেছেন। সে কথা আমরা ভুলতেই বসেছি। এতক্ষণ আমরা বার্ক আর দুবিকিউ, এক বুদ্ধিজীবী আর এক রাজনীতিকের মজার বাহাস দেখলাম। এখন শুরু হবে, ও আমার পাঠক, এখন শুরু হবে পঁতেভি নামের এক রেস্তোরাঁ কাঁপানো দার্শনিকের বড় বড় বুলি]
(চলবে)