১৬ বছরের বিবাহিত জীবন, ৩ বছরের সংসার

স্ত্রী শান্তা চৌধুরীকে নিয়ে লিখেছেন অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী

স্ত্রী শান্তা চৌধুরী ও ছেলে শুদ্ধর সঙ্গে চঞ্চল চৌধুরী

২০০৫ সালের কথা। আমি মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর পরিচালনায় গ্রামীণফোনের বিজ্ঞাপনটা করে সবে পরিচিতি পেতে শুরু করেছি। সেই সময় আমার বাবা বাংলামোটরের একটি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। আমার বড় ভাই তখন পুরান ঢাকার ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজে পড়ান। শান্তা (শান্তা চৌধুরী) ছিল আমার ভাইয়ের ছাত্রী।

সেই সুবাদেই হয়তো বাবাকে হাসপাতালে দেখতে এসেছিল। সেই সময় আমাকেও দেখেছিল। আমার সেসব কথা মনে নেই। কতজনই তো দেখতে এসেছিল!

ফ্যান ওয়ান, ফ্যান টু...

এর কয়েক দিন পর একদিন আমার কাছে একটা ফোন এল—শান্তা, আমার এক ভক্ত। কোত্থেকে যেন আমার নম্বর জোগাড় করে ফোন করেছে। তখন আমাকে যদি কেউ ফোন করে জানাত যে সে আমার ভক্ত, আমার অমুক কাজটা দেখেছে, ভালো লেগেছে, খুব ভালো লাগত। সেসব ভক্তের নম্বর ফ্যান ওয়ান, ফ্যান টু...এভাবে সেভ করে রাখতাম। শান্তার নম্বরও সেভাবেই সেভ করা ছিল। মাঝেমধ্যে ফোন দিত।

একদিনের ঘটনা। সারা দিন শুটিং শেষে গভীর রাতে বাসায় ফিরেছি। অনেক ক্লান্ত। ঘুমিয়ে পড়েছি প্রায়। এ সময় শান্তার ফোন এল। আমি রাগারাগি করে রেখে দিলাম। সে-ও সরিটরি বলল।

সকাল ১০টা/১১টা পর্যন্ত ঘুমালাম। ঘুম থেকে উঠে মনে পড়ল, রাতে ঘুমের ঘোরে একজনের সঙ্গে বেশি খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছি। তাড়াতাড়ি ফোন বের করে কল ব্যাক করলাম। সেদিনই জানতে পারলাম, সে মেডিকেল কলেজে পড়ে, আমার ভাইয়ের ছাত্রী।

‘আচ্ছা, আপনি কি আমাকে বিয়ে করবেন?’

বাঙালি নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হয়েছি। বয়স হলে আর দশটা বাবা-মায়ের মতো আমার বাবা-মাও বিয়ের জন্য উতলা হয়ে উঠলেন। সন্তান শান্তিতে থাকুক, অশান্তিতে থাকুক, তাতে কিছু আসে যায় না, বিয়ে দিতে পারলেই তাঁরা খুশি। আমার তখন মনে পড়ল শান্তার কথা। মনে হয়েছিল, সে আমাকে পছন্দ করে। তখন আমি ভবের হাট নাটকের শুটিংয়ে। শান্তার ফোন এল। কথায় কথায় আমি বলে ফেললাম, ‘আচ্ছা, আপনি কি আমাকে বিয়ে করবেন?’ ও রাজি।

শুটিং শেষ করেই মনে হলো, আমি তো একটা মেয়েকে কথা দিয়েছি যে বিয়ে করব। তার সঙ্গে তো একবার দেখা করা দরকার। পরে আমরা দেখা করলাম।

একবার নয়, দুবার বিয়ে!

কিছুদিন পরই আমরা বিয়ে করে ফেলি। শান্তার পরিবার রাজি ছিল না। ওর মা-বাবা ডাক্তার মেয়ের জন্য ডাক্তার জামাই চেয়েছিলেন। আসলে ডাক্তার মেয়েকে উঠতি অভিনেতার সঙ্গে বিয়ে দিতে কোন বাবা-মা রাজি হয়! আমার বাবা-মায়ের অমত ছিল না। আমি যে বিয়ে করছি, এতেই তাঁরা খুশি। সেই সময় মনপুরার শুটিং করছি। এর মধ্যে ২০০৭ সালের ২২ আগস্ট আমরা কোর্ট ম্যারেজ করি। আর ২৭ আগস্ট মন্দিরে গিয়ে ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা সারি। তাই আমাদের বিয়ের দিন-তারিখ আসলে দুটি।

শান্তার আত্মত্যাগেই আমি

সংসারে প্রেম-ভালোবাসার পাশাপাশি দ্বিমত-সংঘাতও ছিল। দুজনের অনেক কিছু আমরা পছন্দ করতাম, আবার অনেক কিছু করতাম না। ২০০৯ সালে শুদ্ধের জন্মের পর আমাদের সংসারজীবন চলতে লাগল শুদ্ধকে কেন্দ্র করে। আস্তে আস্তে শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক সহজ হয়ে এল। শ্বশুর মারা গেলেন। শাশুড়ি আমাকে মেনে নিলেন। শুদ্ধ বড় হতে লাগল। আমি আমার পেশাজীবনে ডুব দিলাম। শান্তা সন্তান, সংসার আর চাকরি সামলে এগোতে লাগল।

আমার ১৬ বছরের বিবাহিত জীবনে আমি কেবল করোনাকালের তিন বছর সংসার করেছি। তিনজনে বসে সিনেমা দেখেছি। পরিবারকে সময় দিয়েছি। সেই সময় হয়তো তালিকা দেখে সুপারশপে গিয়ে তিন-চার দিন বাজার করেছি। এর বাইরে কোনো দিন বাজারটাও করতে পারিনি। শান্তাই ভোরে উঠে প্রতিদিন বাজার করেছে। ও আমার জীবনের ধরন মেনে নিয়েছে, মানিয়ে নিয়েছে। অভিনয়শিল্পী হিসেবে আমার যা অর্জন, এর পেছনে আমার যতটুকু অবদান, শান্তার অবদান তার চেয়ে কম নয়। সংসারে ওর আত্মত্যাগ আমাকে ক্যারিয়ারে এগোতে অনেক সাহায্য করেছে।

অনুলিখন: জিনাত শারমিন