আতরাফের উত্থান এবং সুলতানের বীজমন্ত্র

আজ ১০ আগস্ট কিংবদন্তি চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের ১০০তম জন্মবার্ষিকী। তাঁকে শ্রদ্ধা

এস এম সুলতান (১০ আগস্ট ১৯২৩—১০ অক্টোবর ১৯৯৪)

আদমের সুরত তার আদ্যকথা বলে—অর্থাৎ তার জন্মসূত্রের কথা বলে। তবে কেবল সুরতই তার একমাত্র অতীতকথা নয়। আদম নারী ও পুরুষে বিভাজিত হলো, যা হিন্দু পুরাণে শিব–পার্বতীর আখ্যানে বিধৃত। অমন এক হতে দুইয়ে উত্তীর্ণ হওয়া এবং তারপর দুই হতে বহুত্বের দরজায় উপস্থিত হয়ে জনগোষ্ঠীতে রূপান্তর, এই বিবর্তনবাদ আদি সত্য। শিল্পী এস এম সুলতান, যাঁর জন্ম নড়াইলের এক নীরব পল্লিতে, যেখানে প্রকৃতি ও সমাজঘনিষ্ঠ জীবনযাপনের চিহ্ন হিসেবে তিনি এঁকে রেখে গেছেন তাঁর প্রিয় চিত্রা নদীর পাড়ের আখ্যান, মানব ইতিহাসের বা সভ্যতার আদিম এক সত্যকে ওই আখ্যানের বীজ হিসেবে গণ্য করেছেন। ব্যক্তিক বাস্তবতা থেকে সমাজের সত্য—এমন একরৈখিক বচনের মধ্য দিয়ে এই কিংবদন্তি শিল্পী তাঁর সভ্যতাবিষয়ক বয়ান জনসমক্ষে হাজির করেছেন। ঔপনিবেশিক বাস্তবতা ও বয়ানের বিপরীতে, আধুনিকতার সমাজ–প্রগতিবাদ থেকে দূরে দাঁড়িয়ে এক আদিম বা আদ্য সাম্যবাদী ধারণার ভিত্তিতে শিল্পের এই মহাজন তাঁর আপন সমাজকে চাক্ষুষ করে তুলেছেন।

জ্ঞান উত্পাদন ও জ্ঞান বিকিরণের যে ধারণা কলকাতাকেন্দ্রিক আধুনিকতায় বাঙালি ও অবাঙালি সবাই মিলে আমরা পেয়েছিলাম, তার মধ্যে যে অতি জরুরি কিছু বিষয়ের উপস্থিতি নেই। কারণ ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর মধ্যে আধুনিকতার গৎবাঁধা জ্ঞান যে সর্বদা কর্তৃত্বশীল, এমন অনেক সত্য সুলতানের কাজ ও জীবন সামনে নিয়ে আসে।

সব প্রশ্নের ভিড়ে কয়েকটি প্রশ্ন এখানে সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দেয়। মানবশরীর বা অস্তিত্ব কখন সহি বা সত্য হয়ে হাজির হয়; কখন একক শরীর বহুর সঙ্গে মুক্ত হয়ে সমাজে রূপান্তরিত হয়?

ব্যক্তি কোন ঐতিহাসিক মুহূর্তে সত্তার একক বিন্দু থেকে বহুত্বের সাগরে নিজের বাসনার স্বর্গ বা ভবিতব্য দেখতে পান? একাত্ব—অর্থাৎ বহু ব্যক্তির এক বাসনায় থিতু হওয়ার ঘটনা সুলতান ওরফে ‘লাল মিয়া’র শিল্পকর্মে যূথচারিতার সূত্রে ঘটে। তাঁর ছবিতে সভ্যতার আদি পর্বের মানব-মানবী কৃষির সূত্রে একত্র হয়ে সমবায়ী জীবন গড়ার বাসনায় এক বৃহৎ পরিবারের ধারণায় থিতু। এই ইতিহাস বা আদ্যকথায় কৃষক কর্তা হিসেবে হাজির।

কৃষকের যূথচারিতায় অধীনতা–স্বাধীনতার প্রশ্নটি জরুরি। তাঁদের সমবায়ী জীবনের এটি একটি মৌল ধারণা। সুলতানকে পাঠ করতে যদি তাঁর আদিম ‘মানবের বৃক্ষরোপণ’ থেকে শুরু করে গণজাগরণের বা বিদ্রোহের পর্বগুলোয় চোখ রাখা যায়, তবে আমাদের মনে তিনটি ধারণা ধরা দেয়। এক. দলবদ্ধতা ও স্বাধীনতার শক্তি, যা তাদের অস্বাভাবিক দেহগঠনে সুস্পষ্ট। দুই. সুলতানের কিষাণ–কিষাণি, বিশেষ করে ফসলের মাঠে বিদ্রোহের শক্তি প্রদর্শনকারী ভূমিপুত্ররা, তাদের চাষযোগ্য জমির দখল নিয়ে নিজেদের মালিকানার প্রশ্নটি সামনে নিয়ে আসেন। তিন. প্রকৃতি এক অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ হিসেবে হাজির হয়, যার সঙ্গে তাল মিলিয়ে মানুষ তার বেঁচে থাকার সংগ্রাম করে যায়।

ওপরের এই তিন প্রস্থ চিন্তার সঙ্গে আরও চিন্তা যুক্ত হতে পারে। সংস্কৃতি তখনই মাটির সঙ্গে সম্পৃক্ত যখন তা কৃষিকেন্দ্রিক, যখন যাপনের সীমা নির্ধারিত হয় ভূমিজ বিষয়াবলির সূত্রে—যেমন নদী নাব্য থাকে এবং তার পানি পানযোগ্য থাকে, চাষি জমি চাষাভুষাদের মালিকানায় থাকে এবং মানুষের জীবন ও নির্মাণকুশলতা আঞ্চলিক জ্ঞানের আওতায় আবর্তিত ও বিবর্তিত হয়। এখানে মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদ অর্থাৎ বাঙালি জাতীয়তাবাদ ওপরের এই তিনটি বিষয়ের আলোচনায় কখনো নাক গলায়নি। পতাকা, জন্মভূমি, ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে যে জাতীয়তার চিন্তাকাঠামো খাড়া করা গেছে, তাতে ইউরোপীয় আধুনিকতার ছায়া স্পষ্ট। সুলতান যখন ব্যাখ্যা দাঁড় করান, বাংলার গ্রামের রিলিফের সূত্রে পাওয়া ঢেউটিন ব্যবহার করে যে ঘরবাড়ি নির্মাণ করা হচ্ছে, তা আসলে ঔপনিবেশিকতার প্রতিফলন, তখন তাঁকে বাঙালি চিন্তক না বলে, বলতে হবে স্থানিক চিন্তক। তাঁর ছবিতে ঘরের চাতাল বি–ঔপনিবেশিক ভাবনার চিহ্ন যেমন বহন করে, তেমন যে ‘টেকনোলজি’ বা কারিগরি জনগোষ্ঠীর মানসে প্রবেশ করেনি, জীবনযাপনের সূত্রে পরিণতি পায়নি, তা সুলতানের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।

সুলতানের সংগ্রামের নেপথ্যে ‘অরূপের’ উপলব্ধি আছে, কিন্তু এ–বিষয়ক ধার্মিকতা নেই। কলকতার আধুনিকতার যে ধরনটি ভারতীয় বা বঙ্গীয় বলে চিহ্নিত হয়েছিল, সেই নব্যবঙ্গীয় ধারায় ধার্মিকতা একটি মৌল উপাদান হয়ে ফোটে।

ভূমিপুত্রের উত্থানে যে ক্ষাত্রশক্তি সুলতান তাঁর বৃহদাকার ক্যানভাসে দেখালেন, ওই শক্তি জাতীয়তার সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বের এক ‘ইমানি’ শক্তি। এই ‘ইমান’ ভূমির প্রতি আকাশ, বাতাস ও কৃষিসভ্যতার মৌল কিছু ধারণার প্রতি। সর্বোপরি এমন এক ভাবীকালের প্রতি যা ভবিষ্যৎ পৃথিবী গড়ার ইন্ধন জোগাবে। আদি সাম্যই এখানে মানবের খোদ পরিচয় নির্ধারণ করবে, বাকিটা মানুষ তার ক্ষেত্রবিশেষে সময়োপযোগী করে তৈরি করে নেবে।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ সুলতানের চিন্তার জগৎকে আলোড়িত করে। পঞ্চাশের দশকে তিনি পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন ভূদৃশ্যের শিল্পী হিসেবে। ক্রমে মানুষ তাঁর ধ্যানবিন্দুতে পরিণত হয়। ষাটের দশকে মা-শিশু কিংবা প্রতিকৃতিতুল্য ছবিতে যদি ভ্যান গঘসুলভ তুলির আঁচড় একপ্রকারের মায়াবী দৃষ্টি তৈরিতে সহায়ক হয়, তবে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শুরু হয় কিষাণ–কিষাণিকে আদি পিতা ও আদি মাতার আদলে আদ্যশক্তির প্রতীকরূপে অর্চনা।

এই সূত্রে সুলতানের নর-নারী মিথিক বা পৌরাণিক মাত্রা পেয়েছে। কিন্তু বাস্তব জীবনে তাদের সংগ্রামের সূত্রেও তারা দেহমনে বলশালী রূপে হাজির। এই সংগ্রামী চেতনা ১৯৭১–এর যুদ্ধ শেষে সমাজবদ্ধতার নতুন ধারণার তাপে জন্ম নিয়েছে। এর আখ্যানমূলক উপস্থাপনা শৈল্পিক ও স্থানিক বাস্তবতা, শ্রেণিচেতনা (যা কৃষকের প্রতিরোধের সংগ্রামকেন্দ্রিক) ও সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্নের এক অনবদ্য সমন্বয়।

‘চর দখল–২’ নামে ১৯৮৬ সালে তেলরঙে আঁকা এ ছবিতে শিল্পী এস এম সুলতান দেখিয়েছিলেন নিম্নবর্গীয় মানুষের উত্থান

কৃষকের আদল সৃষ্টিতে সিসটিন চ্যাপেলে বাইবেলের আখ্যান আঁকা শিল্পী মিকেলেঞ্জেলোর ছায়ার লক্ষণ পাওয়া যায়। কিন্তু সুলতান তো এখানে আদ্যকথা বলতে বাস্তব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ‘ট্রান্সসেনডেন্টাল’ বা অতিন্দ্রীয় জগতের দৃশ্য তুলে ধরেননি। তাঁর আদ্যকথা এ কারণে স্থানিক। সুলতান কৃষিপ্রধান জনগোষ্ঠীর ‘আর্কিটাইপ’ বা আদ্যছবি নির্মাণে তাঁর অভিজ্ঞতার জগৎকে খারিজ করে দেননি। তারেক মাসুদ নির্মিত আদম সুরত চলচ্চিত্রে সুলতানের আধো প্রতীকী, আধো বাস্তব ‘প্রায় উলঙ্গ’ কৃষক সম্পর্কে শিল্পবোদ্ধা আশরাফ আলী বলেন, ‘[তাদের] গ্রন্থিল পেশি তাদের দেহমনের দৃঢ়তাকেই বিধৃত করে। এ যেন তাদের আত্মশক্তির বহিঃপ্রকাশ।’ তিনি সুলতানের ছবিতে ‘স্বপ্নিল মহিমা’ চিহ্নিত করেছেন। এসব চিত্রের মধ্যেই রূপের পেছনের ‘অরূপ’ সত্যটি উপলব্ধ।

জয়নুল আবেদিন ও কামরুল হাসান যদি নিজ নিজ উপায়ে দৈনিক বাস্তবতার মধ্যে থেকে তাঁদের ‘পোস্ট–অরেটিক’ বা মহিমা-পরবর্তী শিল্পভাষা রচনা করে গিয়ে থাকেন, সুলতান তাঁর কৃষক প্রতিনিধির ওপর ‘অরা’ বা মহিমা আরোপ করে বাস্তবকে স্বর্গের সৌন্দর্য দেখতে পারে, এমন চোখে দেখেছেন।

সুলতানের সংগ্রামের নেপথ্যে তাই ‘অরূপের’ উপলব্ধি আছে, কিন্তু এ–বিষয়ক ধার্মিকতা নেই। কলকতার আধুনিকতার যে ধরনটি ভারতীয় বা বঙ্গীয় বলে চিহ্নিত হয়েছিল, সেই নব্যবঙ্গীয় ধারায় ধার্মিকতা একটি মৌল উপাদান হয়ে ফোটে।

সেখানে দেব-দেবী, পুণ্যাত্মা বিষয়ে মানবের যে মনোভাব, তার প্রকাশ দেখা যায়—যেমন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ভারত মাতা’ কিংবা গগনেন্দ্রনাথের প্রাসাদের অভ্যন্তরে আলো–ছায়ার মায়াবী পর্দার আড়ালে থাকা নারী ও নর। এসবই ‘মহিমা’ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে শিল্পকে ভিড়ের রুচি থেকে উন্নত এক স্থানে ভাসিয়ে রাখে। এটি মহৎ শিল্পের ধর্মীয় মাত্রা। সুলতান এমন ধর্মীয় মাত্রা অর্জন করার প্রয়াস পাননি। তিনি জল-মাটি–কাদার মধ্যেই মানবশরীরকে শ্রমের সূত্রে মহিমান্বিত করেছেন। শ্রম-ঘামের সঙ্গে মহিমার সম্পর্ক স্থাপনের মধ্য দিয়ে তিনি ভিড়ের সমাজ গড়ার শক্তিকে বড় করে তুলে ধরে মানবপ্রকৃতিকে যেমন প্রকৃতিঘনিষ্ঠ করে তুলেছেন, তেমনই অতিপ্রাকৃতিক মাত্রা দান করেছেন।

আজ বাংলাদেশে ছাত্র-জনতা যখন গত এক দশকের বেশি সময় ক্ষমতা দখলকারী স্বৈরাচারের পতন নিশ্চিত করল, তখন সুলতানের কৃষিসমাজভিত্তিক সমবায়ী দর্শনের আলোয় সব ‘সিউডোমিথ’ বা ছদ্ম–অখ্যানের অন্ধকার থেকে নতুন এক স্বদেশ গড়ার প্রেরণা মেলে। কৃষক জনগোষ্ঠির ওপর ভরসা রেখে সুলতান যা বলে গেছেন, তা প্রণিধানযোগ্য; ‘ওরা সময়কে ফেস করতে পারে, স্ট্রাগল করতে পারে, সে জন্য ওরা পেশিবহুল, যা প্রমাণ করে ওরা ঠিকই সুস্থ আছে এবং শারীরিক বলও আছে ওদের।’ সুস্থ মানবের যে সুস্থতা, তার সূত্রেই সুলতানের জগৎ রুচিবোধের মনোবেড়ি থেকে মুক্ত, সমাজে সমাজে ভিড়ের হৃদয়ে পরম্পরার ‘বোধ’ জাগানিয়া। ফলে তা আতরাফের উত্থানের বীজমন্ত্র।