১৪ মে জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মৃত্যুবার্ষিকী। টমাস নিউবোল্ড যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে ‘সমাজবিজ্ঞান, সত্তা, সংস্কৃতি ও সমাজ’ বিষয়ের টিচিং ফেলো। বঙ্গে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাস তাঁর গবেষণার অন্যতম বিষয়। অনুবাদ করেছেন শারফিন শাহ
নিতান্তই অতীতের অভ্যন্তরীণ চাপে কিছু কিছু উত্তরাধিকার পরের সম্ভাব্য প্রজন্মের কাছে বাহিত হয়ে আসে। আরেক রকমের উত্তরাধিকারগুলো অদৃশ্য, এমনকি কখনো কখনো অবাঞ্ছিত। কাউকে কাউকে উঠে দাঁড়িয়ে সেগুলোর দাবি করতে হয়। সেসব উত্তরাধিকার অর্জনসাপেক্ষ, তাই সত্যিকার অর্থে আরও বেশি নিজস্ব। অধিকারের বৈধতা নির্ধারণের সাক্ষীসাবুদ কিংবা সত্য বা কল্পিত ভিন্নমত পোষণের কোনো অবলম্বন না থাকা সত্ত্বেও একাকী ও দুঃসাহসিক ঝুঁকি নিয়ে অপ্রত্যাশিত উত্তরাধিকারীরা সে দাবি করে থাকেন। কোনো ঐতিহ্যের তাৎপর্যই অতীত থেকে নিছক চলে আসে না; আসে ভবিষ্যতের দায় থেকে, যখন কেউ তা কল্পনা করতে সাহসী হয়, তখন।
সেই ১৯৫৫ সালে প্রয়াত অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের প্রথম প্রচেষ্টা ছিল বাংলা সাহিত্যের একটি ইতিহাস রচনা করা। সে লক্ষ্যে উদীয়মান এই সাহিত্য সমালোচক (বয়স তখন মাত্র ১৮) অস্বাভাবিক একটি ঘটনার বিশ্লেষণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ‘সাম্প্রদায়িক প্রশ্ন’ (দেশভাগের কারণে তাঁর পরিবার কলকাতা থেকে খুলনায় চলে এসেছিল) এবং ঐতিহাসিক বস্তুবাদের সম্ভাবনায় তাড়িত ও অনুপ্রাণিত (স্বল্প সময়ের জন্য তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে এসেছিলেন)আনিসুজ্জামান সাম্প্রদায়িকতা ও সাহিত্যের মধ্যে সম্পর্কের নতুন রূপরেখা তুলে আনার চেষ্টা করেছেন এবং উনিশ শতকের বাংলার ‘রেনেসাঁ’র সঙ্গে যুক্ত আধুনিক বাংলা সাহিত্যের উত্তরাধিকারীদের তত্ত্বতালাশ করেছেন।
যুবক আনিসুজ্জামান পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের এক বিশেষ সমাবেশে তাঁর প্রবন্ধটি উপস্থাপন করেন। উপস্থাপিত প্রবন্ধে তিনি তিনটি আধুনিক সমস্যার ওপর গুরুত্ব দেন: ১. সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, ২. উপনিবেশবিরোধী রাজনীতি, ৩. আধুনিক বাংলা উপন্যাস। প্রবন্ধটি তিনি লিখেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের (১৮৩৮-১৮৯৪) উনিশ শতকের বিতর্কিত ‘ক্ল্যাসিক’ আনন্দমঠ নিয়ে। লেখাটি পরে সংবাদ পত্রিকার বিশেষ ঈদসংখ্যায় প্রকাশিত হয়।
আনিসুজ্জামান আনন্দমঠ-এর বিশ্লেষণ করেন বঙ্কিমচন্দ্রের অসাধারণ প্রতিভার পথ ধরেই। বঙ্কিমচন্দ্র একদিকে ছিলেন আধুনিক বাংলা উপন্যাসের জনক এবং বাংলার গৌরবময় উপনিবেশবিরোধী রাজনীতির অগ্রদূত। উল্টো দিকে তাঁকে দেখা হয়েছে বাংলাভাগের জন্য দায়ী সংকীর্ণ গোষ্ঠীতান্ত্রিক ও গরিষ্ঠতাবাদী রাজনীতির অভিশপ্ত প্রবক্তা হিসেবেও। এই দ্বৈত সত্তার কারণে বঙ্কিমচন্দ্র আগে যেভাবে সমালোচিত ছিলেন, তখনো তা–ই ছিলেন। তাঁর লেখার প্রতিক্রিয়া মেলে বিশ শতকের গোড়ায় প্রকাশিত নবনূর পত্রিকায়। নবাব ও মোগলদের নিয়ে অনভিপ্রেত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ‘বঙ্কিমবাবু’র বক্তব্যগুলো ইতিহাসের পথরেখা বদলে দিয়েছিল। আনিসুজ্জামানের পারিবারিক সাহিত্য–অভিজ্ঞতা (তাঁর দাদা শেখ আবদুর রহিম মোসলেম ভারত–এর এককালীন সম্পাদক ছিলেন) বঙ্কিমের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে তীক্ষ্ণ সমালোচনা ও নতুন সৃষ্টিশীল কাজের দিকনির্দেশক হিসেবে জোরালো ভূমিকা রাখে।
বাঙালি মুসলমানদের জন্য তিনি রেখে গেছেন মূল্যবান উত্তরাধিকার। তিনি যা–ই লিখেছেন, তা বাঙালির। সবার উচিত এগুলো নিজের করে নেওয়া।
বঙ্কিমের উত্তরাধিকার আরও ব্যাপক হয়ে ওঠে পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে। আনন্দমঠ-এর বিপ্লবীদের গাওয়া বন্দনাগীতি ‘বন্দে মাতরম’কে আনুষ্ঠানিকভাবে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠের চূড়ান্ত রাজনৈতিক স্লোগান হিসেবে ১৯৩৭ সালে হিন্দু মহাসভা অনুমোদন দেয়। সে বছরই বঙ্কিমের জন্মশতবর্ষ উদ্যাপনের মঞ্চে তাঁর বিভিন্ন সাহিত্যকর্ম পোড়ানোর মতো বিতর্কিত ঘটনার জন্ম দেন কিছু বিক্ষুব্ধ নেতা–কর্মী।
বঙ্কিমের এই বিতর্কিত সত্তার বিপরীতে আনিসুজ্জামান আশ্চর্যজনকভাবে হয়ে উঠেছেন একজন অনুকম্পায়ী আলোচক। বঙ্কিমের উপন্যাস কীভাবে বাঙালি মুসলমানের আলোচনার জন্য গ্রহণযোগ্য বিষয় হতে পারে, তা হাসান হাফিজুর রহমানের* (১৯৩২-১৯৮৩) বিস্ময় উদ্রেক করেছে। তাঁর আশঙ্কা ছিল যে আনিসুজ্জামানের প্রবন্ধ বিদ্বেষ ও উদ্বেগ বাড়িয়ে তুলবে এবং বঙ্কিমের একাডেমিক অনুসন্ধান নানা প্রশ্নের জন্ম দেবে। লোকসাহিত্যিক মুহম্মদ মনসুরউদ্দীনের (১৯০৪-১৯৮৭) সরাসরি বিরোধিতা করে আনিসুজ্জামানকে পাকিস্তান ছাড়ার কথা বলেছিলেন। আনিসুজ্জামান পরে এ বক্তব্যের জবাবে বলেছিলেন যে তিনি পাকিস্তানের আশ্রয় প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং দেশটি ত্যাগ করেছেন।
বঙ্কিমের দ্বারা বর্জিত ও তাঁর অনুসারীদের দ্বারা বহুলাংশে উপেক্ষিত বাঙালি মুসলমান পাঠকদের ওপর ‘রেনেসাঁ’ একটি সাহিত্যিক স্ববিরোধ চাপিয়ে দিয়েছিল। সাংবাদিক ও সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমদের (১৮৯৮-১৯৭৯) ব্যঙ্গরচনায় আছে এর স্মরণীয় নিদর্শন, ‘বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতীয় বিশ্বে কতবার শারদীয়া “আনন্দময়ী মা” এসেছে, গিয়েছে। কিন্তু এক দিনের তরেও সে বিশ্বের আকাশে ঈদ মোহররমের চাঁদ ওঠেনি।’
এমন হতাশাজনক সূচনাপটে বাঙালি মুসলমান বুদ্ধিজীবীরা এমন সাহিত্য সৃষ্টির প্রচেষ্টা করলেন, যার জন্মসনদের জন্য কলকাতার তথাকথিত অসম্মানের মুখাপেক্ষী হতে হবে না। সাহিত্যে সিদ্ধিলাভের জন্য তাঁরা নতুন নতুন পথের অনুসন্ধান করলেন। ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে ঢাকায় সূচিত সাহিত্যপ্রচেষ্টার নানা ধারা আছে। এ সময়ের পণ্ডিত ও ভাষাবিদেরা প্রাগাধুনিক বাংলার সাহিত্যসম্পদের দিকে হাত বাড়ালেন। ঝুঁকে পড়লেন দৌলত কাজী ও আলাওলের মতো কবিদের দিকে। তাঁদের সাহিত্যকর্ম থেকে অনুপ্রেরণা নিলেন। অন্যদের মধ্যে মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন প্রেরণা গ্রহণ করলেন ‘লোক–ঐতিহ্যে’। ১৯৪২ থেকে ১৯৬৭ সালের মধ্যে তিনি প্রকাশ করলেন লালন ও কানাইলালের কালানুক্রমিক গানের সংগ্রহ, হারামনি ইত্যাদি। এসব সত্ত্বেও অবশিষ্টরা দাবি করলেন আধুনিকতাবাদের নবীনতা ও উদ্দীপনা। তাঁরা নতুন সাহিত্যশৈলীর নিরীক্ষায় গেলেন। কেউ কেউ নতুনের খোঁজ, পুরাতনের উজ্জীবন ও লোকসাহিত্যের অনুসন্ধানকে একাত্ম করলেন।
আনিসুজ্জামানের মৌলিকত্ব এসব কল্পনার একেবারে বিপরীতে। তাঁর অপরাজেয় মানস ছিল এই যে ইতিমধ্যে যা কিছু হয়েছে, তার দমনমূলক অস্বীকৃতি দিয়ে মুক্তি অর্জিত হবে না। ২০১৪ সালে প্রথম আলোয় সাজ্জাদ শরিফকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আনিসুজ্জামান তাঁর বঙ্কিমসংশ্লিষ্টতা নিয়ে বলেছেন, ‘বাংলা সাহিত্যের সবটুকু যদি আমার হয়, তাহলে বঙ্কিমচন্দ্র আমার নয় কেন?’ এ সাক্ষাৎকারে তাঁর ভাষা ব্যবহারে ১৯৫৫ সালে সাহিত্যিক অনুসন্ধানের বিষয় হিসেবে বঙ্কিমকে বেছে নেওয়ার কারণ উঠে এসেছে। সে সময় হাসান হাফিজুর রহমানের* দ্বিধার জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘বঙ্কিমচন্দ্র আমাদের ঐতিহ্য।’ এ মন্তব্যে তাঁর বামপন্থী বন্ধুরা, এমনকি বন্ধুবৎসল সমালোচকেরাও অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। কেউ কেউ এই ভেবে হতাশা প্রকাশ করেছিলেন যে আনিসুজ্জামান কেন বঙ্কিমচন্দ্রের বিতর্কিত উত্তরাধিকারের সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করছেন?
উত্তরাধিকারের এমন অপ্রত্যাশিত ও পীড়াদায়ক প্রতিক্রিয়ার বিশদ বিবরণ আনিসুজ্জামান দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত তাঁর পিএইচডি অভিসন্দর্ভে; ১৯৬৪ সালে মুসলিম–মানস ও বাংলা সাহিত্য বই হয়ে প্রকাশের পর ক্রমেই যা ক্ল্যাসিকের মর্যাদা লাভ করেছে। ‘মুসলিম–মানস ও বাংলা সাহিত্য’ নামটি তিনি নিয়েছিলেন ১৯৫১ সালে প্রকাশিত অরবিন্দ পোদ্দারের বঙ্কিম–মানস বইটি থেকে। সহিষ্ণুতার সঙ্গে বইটি পড়ে আনিসুজ্জামান অনুভব করেছিলেন, এমন একজন মানুষকে বাদ দিয়ে কীভাবে কারও পক্ষে আধুনিক সাহিত্যের মানচিত্রে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব? এর অপ্রত্যাশিত উত্তরসূরি হয়ে নিজের সুনির্দিষ্ট ইতিহাসের সংশ্লেষ ঘটিয়ে একে আরও সর্বজনীন করে না তুলে কীভাবে তা পারা যাবে?
আনিসুজ্জামান—এবং তাঁর অগ্রজপ্রতিম ও সুহৃদ মুনীর চৌধুরী (১৯২৫-১৯৭১)—একই সঙ্গে এটা ভেবেও শঙ্কিত হয়েছিলেন যে আধুনিকতাপূর্ব বাংলা সাহিত্যের ভান্ডারে রক্ষিত বাঙালি মুসলমানদের অমূল্য সাহিত্যসম্পদ তারা ভুলতে বসেছে। সেসব সাহিত্য যে নতুন আঙ্গিকে আধুনিক সাহিত্যে স্থান করে নিয়েছে, সে সম্পর্কেও তারা অবগত নয়। এর ফল হয়েছিল স্ববিরোধী। ‘রেনেসাঁ’ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে গিয়ে বাঙালি মুসলমান লেখকদের হাতে রচিত ভরপুর ফসলকেও তাঁরা সম্পূর্ণত মূল্যহীন যদি না–ও ভেবে থাকেন, নিদেনপক্ষে অবজ্ঞা করেছিলেন।
আধুনিক সাহিত্যশৈলীর সঙ্গে আধুনিকতাপূর্ব সাহিত্যের যোগসূত্র কোথায়, সমকালীন সমস্যা থেকে মুখ ঘুরিয়ে রাখার কারণে বুদ্ধিজীবীরা বুঝতে ব্যর্থ হন। এই দ্বিধার মধ্যে উভয় ধরনের উত্তরাধিকার আর আধুনিক সাহিত্যে এদের প্রবেশ নিয়ে যাঁরা সন্দিগ্ধ ছিলেন, তাঁদের দিকে আনিসুজ্জামান নতুন চিন্তাধারা মেলে ধরলেন।
১৯৫০ ও ১৯৬০–এর দশকে মুসলিম সাহিত্য ও আধুনিকতার সম্পর্কটি ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন। অনেকে মনে করতেন যে আধুনিক সাহিত্য অনেকটাই অর্জিত এবং কিছুটা অতীত থেকে আহরিত; অথচ আধুনিকতা হারিয়ে যাচ্ছে, এর পুনরুজ্জীবন দরকার। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ১৯১১ সালে তাঁর আধুনিক সাহিত্যের আলোচনায় বলেছেন, আধুনিক বাংলা সাহিত্য অনিবার্যভাবে বাঙালি মুসলমানের ধারাবাহী। এই ধারণা অনেকটা ধনী আত্মীয়ের বিয়েতে গরিব আত্মীয়দের উপস্থিতির মতো লজ্জাকর অনুভূতির উদ্রেক করে।
আনিসুজ্জামান সৃষ্টিশীল ও জোরালোভাবে এই অনুমান যাচাই করে নতুন তথ্য-উপাত্তের আলোকে মত দেন যে ‘রেনেসাঁ’-উদ্ভূত আধুনিক বাংলা সাহিত্যশৈলী উপনিবেশবিরোধিতার সাক্ষ্য বহন করছে। আনিসুজ্জামান আরও যুক্তি দিয়েছেন যে বাংলা সাহিত্যে বাঙালি মুসলমানদের আধুনিকতা অর্জিত হয়েছে স্বতন্ত্র উপায়ে। ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের উপনিবেশায়ন বাঙালি হিন্দুদের আধুনিক সাহিত্যের ক্ষেত্র সৃষ্টি করে থাকলে বাঙালি মুসলমানদের আধুনিক বাংলা সাহিত্যে সম্পৃক্ততা উনিশ শতকের ‘রেনেসাঁ’য় প্রভাবিত; আনিসুজ্জামান বলেন, আমাদের নিজেদের হাতে সৃষ্ট। বাংলার ‘রেনেসাঁ’ এর ঔপনিবেশিক উন্মেষ ও সীমার দ্বারা কালিমালিপ্ত সূচিত, এই মর্মে কলকাতার বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের উত্তরোত্তর সমালোচনার বিপরীতে বাঙালি মুসলমানদের অদ্ভুত একটি মুক্তির দাবি থেকে গেল। তাঁরা বললেন, আধুনিক আঙ্গিকের সঙ্গে তাঁদের বিলম্বিত যোগ নির্বাচিত ও স্বেচ্ছাপ্রণোদিত।
আনিসুজ্জামান মীর মশাররফ হোসেনকে তাঁর সাহিত্যিক ইতিহাসের প্রধান নায়ক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, যা আগে কাউকে করতে দেখা যায়নি। মীর মশাররফের সূচনা ‘অনতিবিখ্যাত’ উপন্যাস রত্নাবতী (১৮৬৯) দিয়ে। ক্যালকাটা রিভিউতে এর সমালোচনা বেরোয়। সমালোচকেরা ভেবেছিলেন, কোনো হিন্দু লেখক এটি ছদ্মনামে লিখেছেন!
মশাররফের ভিত গড়ে উঠেছিল হিন্দু সাহিত্যবলয় থেকে। তিনি আধুনিক বাংলা সাহিত্যে নতুন ধারা নিয়ে এসেছিলেন। আনিসুজ্জামান দেখিয়েছেন, কীভাবে মীর মশাররফ সচেতনভাবে সব রীতি ভেঙে নিজের পথ নির্মাণ করেছেন। ১৮৭৩ সালে তাঁর লেখা বসন্তকুমারী নাটকের সূচনাদৃশ্যের সংলাপ বলে দেয়, মুসলমানেরাও আধুনিক সাহিত্য রচনা করতে পারেন। ক্যালকাটা রিভিউর কুৎসার জবাব মশাররফ দিয়েছিলেন সাহিত্যেই। নাটকের সূচনায় নটী বলে, ‘ছি ছি! এমন সভায় মুসলমানের নাটকের নাম কল্লেন!’ নট বলে, ‘কেন? মুসলমান বলে কি একেবারে অপদস্থ হলো?’ নটী বলে, ‘এই সভায় কি সেই নাটকের অভিনয় ভালো হয়? হাজার হোক মুসলমান!’ এসব সংলাপেই মশাররফ জানিয়ে দেন, সাহিত্যিক হিসেবে তিনি কতটা আধুনিক, মননশীল ও প্রগতিশীল।
আনিসুজ্জামানের বর্ণনায় মীর মশাররফের বিষাদ–সিন্ধু (১৮৮৫-১৮৯১) আরেকটি অভূতপূর্ব সাহিত্যকর্ম। এটি বঙ্কিমের আনন্দমঠ-এর সমসাময়িক। বিষাদ–সিন্ধু কারবালা ট্র্যাজেডির মহাকাব্যিক বিবরণ, যেমনটা দেখা যায় শাহ গরীবুল্লাহর জঙ্গনামাতেও। এটি ছিল প্রকৃত অর্থেই আধুনিক সাহিত্য।
আনিসুজ্জামান জোর দিয়ে বলেছেন যে মীর মশাররফ কখনোই পাঠকদের একই ধারার সাহিত্য উপহার দেননি। এমনকি তিনি যখন কারবালা ট্র্যাজেডির গল্প বলেন, তখনো তিনি সর্বজনীন। মীর মশাররফ বাঙালি মুসলমানের অতীতের সাহিত্য নিয়ে একটি ভবিষ্যৎ কল্পনা করেছিলেন এবং বাংলা উপন্যাসের সর্বজনীন রীতি গঠনের চেষ্টা করেছিলেন। প্রয়াত আনিসুজ্জামানও সাহিত্যের ইতিহাস রচনায় একই পথ অনুসরণ করেছেন। বাঙালি মুসলমানদের জন্য তিনি রেখে গেছেন মূল্যবান উত্তরাধিকার। তিনি যা–ই লিখেছেন, তা বাঙালির। সবার উচিত এগুলো নিজের করে নেওয়া।
ঈষৎ সংক্ষেপিত
* লেখক সম্ভবত এখানে নামটি ভুল করেছেন। হাসান হাফিজুর রহমানের পরিবর্তে ব্যক্তিটি সৈয়দ আলী আহসান হতে পারেন। আনিসুজ্জামানের আত্মজীবনী কাল–নিরবধি দ্রষ্টব্য।