অলংকরণ: আরাফাত করিম
অলংকরণ: আরাফাত করিম

বইমেলা, তুমি কই গ্যালা?

মাসব্যাপী একুশের বইমেলা এখন মাঝবরাবর। পাঠকের কেনাকাটা শুরু হয়েছে বেশ আগে। প্রতিদিনই মেলায় আসছেন অগুনতি মানুষ। বিকিকিনিও মন্দ নয়। তবু বইমেলা নিয়ে কারও কারও মনে কেন এখনো আক্ষেপ?

কৃষি মেলা, বাণিজ্য মেলা, বাড়িমেলা, শাড়িমেলা, গাড়িমেলা, জামাইমেলা, বউমেলা, সইমেলা, দইমেলার মতো বইমেলাও একটা মেলা।

মেলা মানে ম্যালা মানুষের বারোয়ারি ব্যাপার। মানে, যেখানে ঝোঁকের মাথায় বারো পদের লোক এসে জড়ো হয়। রং-তামাশা হয়। কেনাবেচা হয়।

বইমেলা এসবের বাইরের কিছু না। কারণ, এখানেও একইভাবে ‘রং’ হয়। তামাশা হয়। আদার ব্যাপারী আসেন। জাহাজের মালিকও আসেন।

তবে বইমেলা হলো মেলা; আড়ং নয়। মেলা আর আড়ং রঙে-ঢঙে প্রায় এক জিনিস হলেও ভড়ংয়ে আলাদা। মেলায় বাচ্চাকাচ্চা থেকে বড়দের খেলার জিনিস থেকে জুতো স্যান্ডেলের দোকান পাবেন। কিন্তু তার কাছে সার্কাসের প্যান্ডেল পাবেন না। কান ঝালাপালা করা কাশেম-মালার যাত্রাপালা পাবেন না। তাঁবুর তলেপুতুলনাচের ইতিকথা’ পাবেন না। এই সব যেখানে পাবেন, সেটাই হলো আড়ং।

তো বলছিলাম, বইমেলাও একটা মেলা। এই মেলার সব দৌড়ঝাঁপ বই নিয়ে। মেলা শুরুর আগে থেকেই মেলা নিয়ে প্রকাশকের ম্যালা টেনশন থাকে। স্টল পাওয়া নিয়ে ত্যালাতেলি-ঠেলাঠেলি থাকে। কবি-লেখকের আকুলিবিকুলি থাকে। পাঠকের আগ্রহ থাকে। অপাঠকের থাকে আদিখ্যেতা।

টেনশন, আগ্রহ, ত্যালাতেলি, ঠেলাঠেলি, আকুলিবিকুলি, আদিখ্যেতা—সব মিলিয়ে-ঝিলিয়ে একটা সরগরম অবস্থা তৈরি হলে বইয়ের ‘বিক্কিরি’ ভালো হয়। তখন বইমেলা আসল ‘মেলা’ হয়ে ওঠে।

সেই দিক থেকে এবারের বইমেলা চরম না হলেও নরম-সরম-গরম হয়ে উঠেছে। বেশ ভালো জমকালো সব স্টল বসেছে। নানা প্রজাতির কবি-লেখক গল্প-কবিতা-নভেল-নাটক নিয়ে পাঠকদের ‘আটক’ করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

বইমেলায় এসব এলেবেলে খেলা চলছেই চলছে!

  ২.

এক বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করলাম, এবার বউ নিয়ে বইমেলায় গেলি না?

বন্ধু বলল, বউ যায়নি, কিন্তু আমাকে পাঠিয়েছিল। বউয়ের কথায় বইমেলায় বই কিনতে গিয়ে কেলেঙ্কারির একশেষ হয়ে গেছে।

বললাম, সেকি! কী হলো আবার!

বন্ধু বলল, সেদিন বউ বাজারের ফর্দ দিয়ে বলল, ‘যাও, নিউমার্কেট থেকে এগুলো নিয়ে এসো।’ ফর্দ হলো—একখানা লংক্লথের থান, দুটো ভিনেগারের বোতল, দুটো ফিনাইলের বোতল, পাঁচ পোয়া আতপ চাল, তিন প্যাকেট গরমমসলা, এক প্যাকেট হলুদের গুঁড়া, একটা মরিচের প্যাকেট, ছাদে কাপড় শুকাতে দেওয়ার এক ডজন প্লাস্টিকের ক্লিপ, দুই প্যাকেট হালিমের মসলা মিক্স, একটা দাঁত মাজার ব্রাশ, একটা টয়লেটের কমোড মাজার ব্রাশ, বেড়াতে আসা শালীর মেয়ের জন্য একটা ফ্রক, একজোড়া জুতো, পাঁচ গজ মলমলের চুলের ফিতে, কাপড় শুকোতে দেওয়ার এক বান্ডিল নাইলনের দড়ি, কার টনসিল ফুলেছে তার জন্য কুকুরের গলার বেল্টের মতো একটা কলার বেল্ট, চুলা থেকে গরম কড়াই নামানোর তিন জোড়া লুছনি... ইত্যাদি। বাজারের লিস্টির একেবারে শেষে ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া এক অসম বয়সী দম্পতির প্রেম নিয়ে লেখা একটা উপন্যাসের নাম। উপন্যাসটির লেখক স্বয়ং স্বামী ভদ্রলোক। বাজারের লিস্টির মধ্যে মিষ্টি করে বইও আছে দেখে বউয়ের প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে গেল।

আমি বন্ধুর বউয়ের বাজারের ফর্দ শুনে হাঁ হয়ে রইলাম। আমার হাঁ করা গালের মধ্যে যে মাছিটা ঢুকে পড়তে যাচ্ছিল, সেটিকে হাত দিয়ে তাড়াতে তাড়াতে বন্ধু বলতে লাগল, নিউমার্কেট থেকে লিস্টিমতো সদাইপাতি কিনে দুটো স্বচ্ছ পলিথিনের ব্যাগে করে রিকশায় চড়ে বাংলা একাডেমির সামনে এলাম। ব্যাগ দুটো হাতে নিয়ে সেই সুপারহিট রোমান্টিক উপন্যাস কিনতে মেলায় ঢুকতে লাইনে দাঁড়িয়েছি। এক আনসার ভাই এসে আমার দুই হাতের ব্যাগ হাতড়ে-টাতড়ে আমাকে হকার ভেবে আটক করলেন। আমি যত বলি, ‘ভাই, আমি বই কিনব’, তিনি তত আমার ওপর চড়াও হন। রীতিমতো তুই-তুকারি করে তিনি টানা ৩০ মিনিট আমাকে বসিয়ে রাখলেন। তারপর চলে যেতে বললেন। বউয়ের জন্য সুপারহিট রোমান্টিক উপন্যাসটা আর কেনা হলো না।

ধাওয়া খেয়ে বন্ধুর বইমেলায় যাওয়া না হলেও আমার অন্তত হাওয়া খাওয়ার জন্য হলেও যাওয়া হয়েছে। গত কয় দিনে কাজে-অকাজে বইমেলায় গেছি। একবার মনে হয়েছে, মেলায় সব আছে; একবার মনে হয়েছে, কী যেন নেই, কী যেন নেই!

সেদিন এক প্রকাশক বন্ধুর সঙ্গে তাঁর প্রকাশনীর স্টলে বসে আছি। দেখি, একের পর এক পাঠক আসছেন। তাঁদের বেশির ভাগই একটা নির্দিষ্ট উপন্যাস নেড়েচেড়ে দেখছেন। কেউ কেউ বইটা কিনছেন।

বইটা হাতে নিয়ে লেখকের নাম দেখলাম। লেখককে চিনলাম না। কিন্তু যাঁরা কিনছেন, তাঁদের কথাবার্তা শুনে বুঝলাম, এই লেখক খুবই জনপ্রিয়। প্রকাশক বন্ধুকে বললাম, ঘটনা কী? জনপ্রিয় লেখকটিকে চিনতে পারছি না কেন? তিনি বললেন, ওনার ফেসবুক ফলোয়ার অনেক। উনি একজন ভাইরাল লেখক। কিছুদিন আগে ওনার একটি ফাঁস হওয়া গোপন ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল। এরপরই তিনি উপন্যাসটি লিখেছেন। এখন একেবারে মারমার কাটকাট অবস্থা চলছে। মানে, লেখার আগেই লেখক নাম ফাটিয়ে ফেলেছেন।

এ ধরনের ডজনখানেক লেখকের শুনলাম। একজন শুনলাম, মারাত্মক অপরাধে জেল খেটে বেরিয়ে ‘কারাগারের দিনগুলো’ টাইপের স্মৃতিকথা লিখে হিট লেখক হয়ে গেছেন। জেল থেকে বের হওয়া একজন অতি বিখ্যাত জল্লাদের লেখা কল্লা ঝোলানো-বিষয়ক বই এই মেলায় বেস্টসেলার হয়েছে।

আগে লোকে কবিতা-গল্প-উপন্যাস লিখে জননন্দিত কিংবা জননিন্দিত হতেন। সেলিব্রিটি হতেন। এখন সেলিব্রিটি হওয়ার পর বই লেখার চল শুরু হয়েছে। পাণ্ডুলিপি নিয়ে প্রকাশকের কাছে গেলে তিনি লেখককে জিজ্ঞেস করছেন, ‘ফেসবুকে অ্যাকটিভ আছেন? আপনার ফলোয়ার কতজন?’

আগে আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হক, হ‌ুমায়ূন আহমেদের মতো লেখকেরা বইমেলায় এসে হ্যামিলিনের বাঁশিওয়ালার মতো হাঁটতেন। তাঁদের পেছনে উপকথার ইঁদুরের মতো ছেলেপেলে পিলপিল করে চলত। এখন তারা ভাইরাল লেখকদের ঘিরে ধরছে। তারাই এখন মূলধারার তারা।

৩.

বাজারে আমার কিছু বই আছে। কিন্তু পাবলিক আমাকে চেনে না; তাই আমার বই কেনে না। কী করা যায়?

এক ছোট ভাই বলল, ‘ভাই, ভাইরাল হন।’

: কেমনে ভাইরাল হওয়া যায়?

: উল্টোপাল্টা কিছু একটা করেন। ডিগবাজি-টিগবাজি দিয়ে দেখতে পারেন।

: আমার ডিগবাজিতে কিছু হবে না। আমি তো খান বংশের লোক না।

: তাইলে এক কাজ করতে পারেন। টকটকা লাল রঙের একটা ল্যাঙ্গোট পইরা বইমেলার গেটের সামনে খাড়ান। আপনার এক হাতে একটা রামদা থাকবে। আরেক হাতে থাকবে আপনার লেখা বই। পাশে ভ্যানের ওপর কিছু ডাব থাকবে। আপনি নাগা সন্ন্যাসীর মতো খাড়ায়ে থাকবেন। আপনার গলায় ঝোলানো প্ল্যাকার্ডে লেখা থাকবে, ‘ডাব খান, বই পড়ুন।’ এরপর আপনার ডিউটি শ্যাষ। দুইন্যার সব মিডিয়া, ফেসবুকার, ইউটিউবার আইসা আপনার সাক্ষাৎকার নেবে। আপনি হিট, আপনার বইও হিট।

আইডিয়াটা মনে ধরেছিল। কিন্তু চরিত্রের প্রয়োজনে এতটা সাহসী হওয়ার সাহস পাচ্ছি না।