এ মাসে ছিল কাজী নজরুল ইসলাম সম্পাদিত ধূমকেতু পত্রিকা প্রকাশের শতবর্ষ। পত্রিকাটি ব্রিটিশবিরোধী বাঙালির জীবনে যেমন, তেমনি নজরুলের সাহিত্যজীবনেও প্রভাব রেখেছিল। বিদ্রোহী কবির প্রয়াণবার্ষিকী উপলক্ষে চোখ ফেরানো যাক নজরুলের ধূমকেতু–অধ্যায়ে
জীবদ্দশায় একই সঙ্গে পুষ্পমাল্যে অভিষিক্ত হওয়া আর সমালোচনার শরশয্যায় ক্ষতবিক্ষত হওয়ার ভাগ্য নিয়ে জন্মেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। সমকালে কবিতার জন্য, প্রতীকী অর্থে বীরের অভিধা পেয়েছিলেন, আবার কবিতার জন্যই প্রায় নিঃশব্দে শহীদ হয়েছিলেন বলা যায়। ১৯২১ ও ১৯২২ সাল নজরুলের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ১৯২১ সালে তিনি লেখেন কালজয়ী কবিতা ‘বিদ্রোহী’ আর এর এক বছর পর ১৯২২ সালে তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় অর্ধসাপ্তাহিক পত্রিকা ধূমকেতু। সেই হিসাবে এ বছর ধূমকেতু প্রকাশের শতবর্ষ। এক শ বছর পর পেছন ফিরে তাকালে দেখা যাবে পত্রিকাটি নজরুলকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছে।
ধূমকেতু নামটি নজরুলের দেওয়া। আর পত্রিকাটি প্রকাশের পর এর সাহসী ভূমিকার জন্য এটি যেমন আলোচিত হয়, একইভাবে নজরুলও আলোচিত হন।
কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদ ও নজরুল দুজনেই স্বাধীনভাবে রাজনৈতিক বক্তব্য প্রচারের লক্ষ্যে এই অর্ধসাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। তবে মুজফ্ফর আহ্মদ প্রয়োজনীয় পুঁজির অভাবে এর নিয়মিত প্রকাশ নিয়ে দ্বিধান্বিত ছিলেন। কিন্তু জনৈক হাফিজ মাসুদ আড়াই শ টাকা নিয়ে এগিয়ে এলে নজরুল তাতেই রাজি হয়ে যান।
আফজালউল হক প্রকাশনার দায়িত্ব নিলে পত্রিকাটির প্রকাশ সহজ হয়ে যাবে বলে নজরুল মনে করেছিলেন। এই আফজালউল হক ছিলেন সেকালের মোসলেম ভারত পত্রিকার সম্পাদক মোজাম্মেল হকের পুত্র। এর আগে নজরুলের বাঁধনহারা উপন্যাসটি মোসলেম ভারত থেকেই ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছিল। ধূমকেতুর ঠিকানা হলো ৩২ কলেজ স্কয়ার। ছাপা হবে ৭৯ বলরাম দে স্ট্রিটের মেটকাফ প্রেস থেকে। পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১১ আগস্ট ১৯২২। প্রতি সংখ্যার মূল্য ১ আনা, বার্ষিক গ্রাহক চাঁদা ৫ টাকা। সম্পাদক নজরুল, যিনি নিজেকে ‘সারথি’ (সম্পাদক) বলে উল্লেখ করেছেন। সপ্তম সংখ্যা পর্যন্ত তিনি পত্রিকাটির সঙ্গে স্বনামে সম্পাদক হিসেবে যুক্ত ছিলেন। ম্যানেজার ছিলেন শান্তিপদ সিংহ।
এই পত্রিকার প্রকাশ উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাণীও সংগ্রহ করা হয়, যা ষষ্ঠ সংখ্যা পর্যন্ত প্রথম পৃষ্ঠায় এবং সপ্তম সংখ্যা থেকে তৃতীয় পৃষ্ঠায় ছাপা হতে থাকে। রবীন্দ্রনাথের হাতে লেখার হুবহু প্রতিলিপি হিসেবে এই আশীর্বাণী প্রকাশিত হতো:
‘আয় চলে আয় রে ধূমকেতু,
আঁধারে বাঁধ্ অগ্নিসেতু,
দুর্দিনের এই দুর্গশিরে
উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন!
অলক্ষণের তিলক রেখা
রাতের ভালে হোক্ না লেখা,
জাগিয়ে দেরে চমক্ মেরে,
আছে যারা অর্ধচেতন!’
ধূমকেতুর গদ্য, বিশেষ করে সম্পাদকীয়র ভাষা ছিল তীব্র জ্বালাময়ী। প্রথম সম্পাদকীয় গদ্যেই ধ্বংসের মধ্য দিয়ে নতুন সৃষ্টির কথা বলা হয়েছিল: ‘মাভৈঃ বাণীর ভরসা নিয়ে “জয় প্রলয়ংকর” বলে ধূমকেতুকে রথ করে আমার আজ নতুন পথে যাত্রা শুরু হল।
আমার কর্ণধার আমি। আমার পথ দেখাবে আমার সত্য।… ধূমকেতু কোনো সাম্প্রদায়িক কাগজ নয়। মানুষ-ধর্মই সবচেয়ে বড়ো ধর্ম। হিন্দু-মুসলমানে মিলনের অন্তরায় বা ফাঁকি কোনখানে তা দেখিয়ে দিয়ে এর গলদ দূর করা এর অন্যতম উদ্দেশ্য। মানুষে মানুষে যেখানে প্রাণের মিল, আদত সত্যের মিল, সেখানে ধর্মের বৈষম্য, কোনো হিংসার দুশমনির ভাব আনে না। যার নিজের ধর্মে বিশ্বাস আছে, যে নিজের ধর্মের সত্যকে চিনেছে, সে কখনো অন্য ধর্মকে ঘৃণা করতে পারে না।’
নজরুলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অনেকেই জানিয়েছেন পত্রিকাটি তরুণদের মধ্যে অভাবনীয় জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। পত্রিকা সংগ্রহের জন্য তারা রাস্তার মোড়ে মোড়ে অপেক্ষা করত। তারপর হুড়োহুড়ি কাড়াকাড়িতে কয়েক মিনিটের মধ্যে তা নিঃশেষ হয়ে যেত। কেন পত্রিকাটি এ রকম জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, নিজের স্মৃতিচারণায় সে কারণ উল্লেখ করেছিলেন অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, ‘কালির বদলে রক্তে ডুবিয়ে লেখা’ হতো এর সম্পাদকীয় প্রবন্ধগুলো। বোঝাই যায়, নজরুলের লেখাগুলো আলোড়ন তুলেছিল। সেই সম্পাদকীয়র আরেকটি নমুনা:
‘...সর্বপ্রথম ধূমকেতু ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়। স্বরাজটরাজ মানি না।… ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশও বিদেশির অধীনে থাকবে না। যারা এখন রাজা বা শাসক হয়ে এ দেশে মোড়লি করে দেশকে শ্মশানভূমিতে পরিণত করছেন, তাদের পাততাড়ি গুটিয়ে, বোঁচকা-পুঁটলি বেঁধে সাগরপারে পাড়ি দিতে হবে।’
ধূমকেতু প্রকাশের সময় মুজফ্ফর আহ্মদ পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। কিন্তু পরে কংগ্রেস ও গান্ধীর রাজনীতির প্রতি নজরুলের অনুরাগ দেখে তিনি নজরুলকে একটা চিঠি লেখেন, যাতে নজরুলের কী কর্তব্য, সে সম্পর্কে কবিকে তিনি রাজনৈতিক নির্দেশনা দেন। মুজফ্ফর আহ্মদ চেয়েছিলেন, পত্রিকাটি ‘ভদ্দর লোকদের’ না হয়ে কৃষক–শ্রমিকের কথা বলুক। চিঠিতে তিনি প্রশ্ন তোলেন, ‘কৃষক ও শ্রমিকের কথা কখনও ভেবেছ কি?’ নজরুল প্রত্যুত্তরে গান্ধীর পক্ষে সাফাই গাইলেন। আসলে মুজফ্ফর আহ্মদের শ্রমিক-কৃষক সর্বহারার সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক দর্শনের পুরোপুরি অনুগামী নজরুল ছিলেন না। তিনি চাইতেন ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসকেরা ভারত ছেড়ে চলে যাক, কিন্তু তাঁর সেই উপলব্ধির অনেকটাই ছিল ভাবালুতা ও আবেগতাড়িত। পরে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলার জন্য তাঁকে কারাগারে যেতে হলো। কবির নিজের কথায়, ‘আমার কারাশুদ্ধি হইয়া গেল।’ ধূমকেতুর ইতিহাসে এই কারাশুদ্ধির ঘটনা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য।
ঔপনিবেশিক শাসকেরা ধূমকেতুতে প্রকাশিত নজরুলের গদ্যগুলোকে সহ্য করলেও ‘আগমনী’ নামে একটি কবিতাকে সহ্য করতে পারলেন না। ৮৯ পঙ্ক্তির এই দীর্ঘ কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল ধূমকেতুর ২২ সেপ্টেম্বরের পূজা সংখ্যায়। এতে নজরুল ইঙ্গিতে সমকালীন রাজনীতি ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের ব্রিটিশবিরোধী ভূমিকা ও কর্মকাণ্ড তুলে ধরেছেন। গান্ধী, অরবিন্দ, চিত্তরঞ্জন, সুরেন্দ্রনাথ, বারীন্দ্রকুমার, পুলিনবিহারীসহ ছোট–বড় অনেক নেতার বিপ্লবী ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানান। রবীন্দ্রনাথের কথাও এখানে উল্লেখ করা হয়েছে, যে রবীন্দ্রনাথ জনসাধারণের মধ্যে চৈতন্যের শিখা ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন। প্রথম স্তবকটিতেই নজরুল তীব্র শ্লেষ ও ঈষৎ তির্যক বিদ্রূপাত্মক ভঙ্গিতে জিজ্ঞাসু কণ্ঠে লেখেন:
‘আর কতকাল থাকবি বেটী মাটির ঢেলার
মূর্তি-আড়াল
স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী
শক্তি-চাড়াল।
দেবশিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবাদের
দিচ্ছে ফাঁসি
ভূভারত আজ কসাইখানা—আসবি কখন
সর্বনাশী?’
ব্রিটিশ সরকার বিদ্রোহের বিপ্লব ও বিদ্রোহের ইঙ্গিত পেয়ে ধূমকেতুর ওই সংখ্যা বাজেয়াপ্ত করে এবং রাজদ্রোহের ‘অপরাধ’–এ কুমিল্লা থেকে নজরুলকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর কলকাতার চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট সুইনহোর আদালতে শুরু হলো তাঁর বিচার। বিচারাধীন অবস্থায় আত্মপক্ষ সমর্থন করে নজরুল লিখলেন তাঁর সেই বিখ্যাত আত্মপক্ষীয় বয়ান ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’। এই জবানবন্দি ব্রিটিশ ভারতে রাজবন্দীদের বিচারের ইতিহাসে নিঃসন্দেহে অভূতপূর্ব একটি ঘটনা। সুইনহোর বিচারে নজরুলের এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়। কিন্তু ওই জবানবন্দিতে দেশমুক্তির অপরাধে বিচারের নামে প্রহসনকে নজরুল যেভাবে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন, ভারতের ইতিহাসে তার দ্বিতীয় কোনো নজির নেই। জবানবন্দিটি দীর্ঘ, টুকরা টুকরা কিছু অংশ উদ্ধৃত করি, যা ১২ মাঘ ধূমকেতুতে প্রকাশিত হয়:
‘আমার উপর অভিযোগ, আমি রাজবিদ্রোহী। তাই আমি রাজকারাগারে বন্দী এবং রাজদ্বারে অভিযুক্ত। একধারে—রাজার মুকুট, আরধারে ধূমকেতুর শিখা। একজন রাজা, হাতে রাজদণ্ড, আরজন সত্য, হাতে ন্যায় দণ্ড।…
আমার বাণী সত্যের প্রকাশিকা, ভগবানের বাণী। সে বাণী রাজবিচারে রাজদ্রোহী হতে পারে, কিন্তু ন্যায় বিচারে সে বাণী ন্যায়দ্রোহী নয়, সত্যদ্রোহী নয়।...
আজ ভারত পরাধীন। তার অধিবাসীবৃন্দ দাস। এটা নির্জলা সত্য। কিন্তু দাসকে দাস না বললে, অন্যায়কে অন্যায় বললে, এ রাজত্বে তা হবে রাজদ্রোহ। এ তো ন্যায়ের শাসন হতে পারে না। এই যে জোর করে সত্যকে মিথ্যায়, অন্যায়কে ন্যায়, দিনকে রাত বলানো—এ কি সত্য সহ্য করতে পারে? এ শাসন কি চিরস্থায়ী হতে পারে? এত দিন হয়েছিল, হয়তো সত্য উদাসীন ছিল বলে। কিন্তু আজ সত্য জেগেছে, তা চক্ষুষ্মান জাগ্রত আত্মামাত্রই বিশেষরূপে জানতে পেরেছে। এই অন্যায়-শাসন-ক্লিষ্ট বন্দী-সত্যের পীড়িত ক্রন্দন আমার কণ্ঠে ফুটে উঠেছিল বলেই কি আমি আজ রাজদ্রোহী?...
আমি পরম আত্মবিশ্বাসী। আর যা অন্যায় বলে বুঝেছি, অত্যাচারকে অত্যাচার বলেছি, মিথ্যাকে মিথ্যা বলেছি,…আমি সত্য-রক্ষার, ন্যায় উদ্ধারের বিশ্বপ্রলয়-বাহিনীর লালসৈনিক।’
জেলে থাকতেই রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে তাঁর ‘বসন্ত’ গীতিনাট্য উৎসর্গ করেন। নজরুল রাজবন্দীদের সঙ্গে নির্মম আচরণ ও অব্যবস্থার প্রতিকার চেয়ে শুরু করেন অনশন। অন্তরীণ থাকা অবস্থায় তিনি লেখেন তার সেই অবিস্মরণীয় গণসংগীত : ‘কারার ঐ লৌহকবাট/ ভেঙে ফেল্ কর্ রে লোপাট…।’ নজরুলের গণসংগীত রচনার সেই তো সূচনা, পরবর্তী জীবনের এই ধারাতেই তিনি লেখেন বেশ কিছু কালজয়ী গণসংগীত।
এক তালিকা থেকে জানা যায়, ১৯২২ সালের ১১ আগস্ট থেকে ১৯২৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ধূমকেতুতে সম্পাদকীয়-গদ্য ও কবিতা মিলিয়ে নজরুলের ২৮টির মতো রচনা প্রকাশিত হয়েছিল। ধূমকেতুর এই পর্ব নজরুলের জীবন এবং উপনিবেশবিরোধী রাজনীতির ইতিহাসে এক উজ্জ্বল অধ্যায় হয়ে আছে। বাংলা সংবাদপত্রের ইতিহাসেও এর গুরুত্ব কম নয়। বাংলা ভাষায় নজরুলই প্রথম সাংবাদিক ও সংবাদপত্র সম্পাদক, যিনি একটি কবিতা লেখা ও প্রকাশের দায়ে কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। তাঁর সাংবাদিক–সত্তা কবিসত্তারই পরিপূরক বা সমান্তরাল দিক।
নজরুলের সংগ্রামী চেতনার প্রথম উন্মেষ দেখা গিয়েছিল অগ্নিবীণা কাব্যগ্রন্থে। প্রাতিস্বিক আত্মঘোষণা ঘটেছিল ‘বিদ্রোহী’তে। কিন্তু সেই ঘোষণা ছিল ব্যক্তিক আত্মঘোষণা, বিদ্রোহের বীজ তাতে লক্ষ করা গেছে। কিন্তু ধূমকেতুর সম্পাদকীয় গদ্যের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক ভাষ্যকার হিসেবে তাঁর আবির্ভাব ঘটে। পরাধীন ভারতবাসীকে স্বদেশমন্ত্রে উজ্জীবিত হওয়ার আহ্বান জানান তিনি, স্বরূপ উন্মোচন করেন ব্রিটিশ শাসকদের। ‘আগমনী’ কবিতাটিও নজরুলমানসের আরেকটি দিকের সূত্রপাত ঘটিয়েছিল, সেটা হলো এই কবিতার মাধ্যমেই সরাসরি ও স্পষ্ট স্বরে তাঁর রাজনৈতিক কাব্যধারার সূচনা ঘটে। পরবর্তী জীবনে এই দুটি ধারাই নজরুলের কবিতা ও গদ্যে বহমান থেকেছে। তিনি স্পষ্টতই বুঝেছিলেন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের স্বরূপ। নজরুল সাহিত্যের যে প্রধান দিক—পরাধীনতার অবসান ঘটানো, মানবিক অবমাননার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, অত্যাচারীর মুখোশ উন্মোচন, নিপীড়িত মানুষের পক্ষে দাঁড়ানো, যাবতীয় সংস্কারের মূলোৎপাটন, অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ—এসবের স্পষ্ট সূচনা ঘটে এই ধূমকেতু পত্রিকার গদ্যে-পদ্যে। এর আগে তিনি এই লক্ষ্যেই নবযুগ পত্রিকায় যোগ দিয়েছিলেন অন্যতম সম্পাদক হিসেবে। কাজ করেছিলেন সেবক-এ। ওই সময়ই কবিতায় তাঁর রাজসিক অভিষেক ঘটে, কিন্তু ধূমকেতুতে বাঙালি পাঠকেরা পেল আরেক নজরুলকে, যেখানে তার বিষয়বস্তু সুস্পষ্ট, গদ্য গতিশীল, আবেগকম্প্র ও ভাষাসৌন্দর্যে উজ্জ্বল। সম্পাদকীয় গদ্যে নজরুল যে গদ্য ব্যবহার করতেন, তা মান্য চলিত বাংলা। এর ভেতর দিয়েই তিনি চলিত গদ্যের শক্তিকে বৃদ্ধি করেছিলেন। যে স্বাধীন ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখতেন তিনি, তা–ও ব্যক্ত করেছিলেন ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’তে।
নজরুলের ধূমকেতু অধ্যায়টি আসলেই ছিল তাঁর দ্রোহী কবিসত্তারই অংশ। ‘ধূমকেতু’ প্রকাশনার শতবর্ষপূর্তির মুহূর্তে এই ধরনের পত্রিকার প্রাসঙ্গিকতা যে ফুরিয়ে যায়নি, সে কথা বলা যায় নিঃসন্দেহে।