সমৃদ্ধির নাগাল পাওয়ার আশায় এ অঞ্চলের বহু মানুষ রাবারের নৌকায় করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপের উপকূলে গিয়ে প্রাণ হারাচ্ছে। অথচ ৫০০ বছর আগে এমন সমৃদ্ধির লোভে ইউরোপের ভাগ্যান্বেষীরা কাঠের জাহাজে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে এশিয়া ও ভারতবর্ষে ছুটে আসত। গত ৫০০ বছরের পালাবদলে সমৃদ্ধির কম্পাস ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে ইউরোপের দিকে চলে গেছে। কয়েক শ বছরজুড়ে সেই পালাবদলের প্রধান খেলোয়াড় ছিল স্পেন, পর্তুগাল, হল্যান্ড, ফ্রান্স, ইংল্যান্ডের মতো দেশগুলো। এগুলোর মধ্যে শেষ পর্বে মাঠে নেমেও সবচেয়ে সফল খেলোয়াড় হয়ে উঠেছিল ইংল্যান্ড।
দুর্বল অর্থনীতির এই দেশ কোন জাদুতে বাকি সব দেশকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গিয়েছিল?
জাদুর কাঠিটা আসলে প্রথম স্পর্শ করেছিলেন ষোড়শ শতকে জন্ম নেওয়া ইংল্যান্ডের এক রাজকন্যা। তাঁর নাম এলিজাবেথ। সম্রাট আকবরের শাসনামলে তিনি ভারতের সঙ্গে প্রথম বাণিজ্যিক যোগাযোগের সূত্রপাত করেছিলেন।
ইংল্যান্ডে যখন রানি এলিজাবেথের শাসনকাল শুরু হয়, তার দুই বছর আগে ভারতে শুরু হয়েছিল সম্রাট আকবরের শাসনকাল। কাকতালীয়ভাবে দুজনের আয়ুষ্কাল ও শাসনকাল প্রায়ই একই। দুজনই নিজ নিজ সাম্রাজ্যে নতুন যুগের সূচনা করে অমর হয়ে আছেন। তবে দুজনের জীবন একেবারেই বিপরীতমুখী। সম্রাট আকবর জন্ম থেকেই ছিলেন পরম সৌভাগ্যের বরপুত্র, এলিজাবেথ ছিলেন এক দুর্ভাগা রাজকুমারী।
সম্রাট আকবরের সঙ্গে রানি এলিজাবেথের মাত্র একবার পত্র যোগাযোগ হয়েছিল। ইংল্যান্ডের রানি ভারতের সঙ্গে ইংরেজদের বাণিজ্য করার সুযোগের আবেদন জানিয়ে ভারতসম্রাটের কাছে একটি চিঠি লিখেছিলেন। সেই ছোট্ট চিঠি তখন নিষ্ফল বলে বিবেচিত হলেও দেড় শ বছর পর রানি এলিজাবেথের স্বাক্ষর করা এক রাজকীয় সনদের সুবিধা নিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতবর্ষের আপাদমস্তক গ্রাস করে ফেলতে সক্ষম হয়।
সেই পর্বে যাওয়ার আগে দুঃখিনী রাজকন্যা এলিজাবেথের গল্পটা শুনে নেওয়া যাক।
রানি অ্যান বোলেনের নিষ্ঠুর নিয়তি
আকবরের জন্য সম্রাট হুমায়ুনের সিংহাসন যে রকম নির্ধারিত ছিল, এলিজাবেথের জন্য পিতা অষ্টম হেনরির সিংহাসনটি সেভাবে বরাদ্দ ছিল না। ১৫৪৭ সালে অষ্টম হেনরির মৃত্যুর প্রায় এক যুগ পর অনেক অনিশ্চয়তার পথ পাড়ি দিয়ে, অসম্ভবের শিকল ছিঁড়ে সিংহাসনে বসার অপ্রত্যাশিত সুযোগ পেয়েছিলেন এলিজাবেথ। এর আগে দীর্ঘ সময় ধরে তাঁর ভাগ্যটা ঘুরপাক খাচ্ছিল নিয়তির বিচিত্র জটাজালের মধ্যে। তখন তিনি উত্তরাধিকারবঞ্চিত পরিত্যক্ত রাজকন্যা। তাঁর বঞ্চিত হওয়ার ঘটনাটি ইংল্যান্ডের রাজপরিবারের ইতিহাসের একটা মর্মান্তিক অধ্যায়, যেখানে জড়িত ছিল তাঁর মা অ্যান বোলেনের সঙ্গে রাজার বৈবাহিক সম্পর্কের জটিলতা।
১৫২৩ সালে রাজা অষ্টম হেনরি যখন কিশোরী অ্যান বোলেনকে প্রথম দেখেন, তখন তিনি প্রথম স্ত্রী ক্যাথরিন আরগনের সঙ্গে বিবাহিত এবং মেরি নামের একটা কন্যাসন্তানের জনক। রাজপ্রাসাদের একটা অনুষ্ঠানে ষোড়শী অ্যান বোলেনকে দেখে রাজা মোহমুগ্ধ হয়ে তাঁকে কাছে পাওয়ার চেষ্টা করেন। বয়স কম হলেও বুদ্ধিমতী অ্যান খুব আত্মসচেতন ছিলেন। তিনি বিয়ে ছাড়া রাজার কাছে ধরা দিতে রাজি হননি। আবার রাজার পক্ষে হুট করে কাউকে বিয়ে করাও সম্ভব ছিল না। সবচেয়ে বড় বাধা ছিল ইংল্যান্ডের আইন—এক স্ত্রী থাকতে অন্য স্ত্রী গ্রহণ করা পুরোপুরি আইনবিরুদ্ধ। প্রথম বিয়েটা বাতিল না করলে আরেকটা বিয়ে করা যাবে না।
রাজা অষ্টম হেনরি অ্যানকে বিয়ে করার জন্য প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ চাইলেন। কিন্তু ইংল্যান্ডের চার্চ তাতে সম্মতি দিল না। রাজা মরিয়া হয়ে ইংল্যান্ডের আইন বদলে চার্চকে নিজের অধীন নিয়ে এলেন। তাতেও অ্যানকে বিয়ে করার পথ পরিষ্কার হলো না। কারণ, ইংল্যান্ডের চার্চ ভ্যাটিকানের পোপের অধীন। পোপের সম্মতি ছাড়া এই বিয়ে সম্ভব নয়। তিনি পোপের অনুমোদন চাইলেন। কিন্তু ভ্যাটিকানের পোপও অনুমতি দিলেন না।
এবার অষ্টম হেনরি ভ্যাটিকান পোপের সঙ্গেও সম্পর্ক ছেদ করলেন এবং ইংল্যান্ডের চার্চের ওপর প্রভাব বিস্তার করে প্রথম স্ত্রী ক্যাথরিনের সঙ্গে বিয়েটা বাতিল করলেন। তারপর অ্যানকে বিয়ে করে রাজপ্রাসাদে তুলে আনার সুযোগ পেলেন ১৫৩৩ সালে। তত দিনে ১০ বছর পেরিয়ে গেছে। অ্যান বোলেন ১৪ বছরের কিশোরী থেকে ২৪ বছরের পরিপূর্ণ রমণী।
যে চপলা কিশোরীকে দেখে অষ্টম হেনরি মুগ্ধ হয়েছিলেন, ১০ বছর পর সে যখন পরিণত নারী, তখন রাজার মুগ্ধতায় ভাটা পড়েছিল। নইলে এত কাণ্ড করে বিয়ে করার এক বছরের মধ্যে অশান্তির সূত্রপাত হতো না। তিনি অ্যানকে বিয়ে করার জন্য যেমন মরিয়া ছিলেন, তেমনি মরিয়া ছিলেন একটি পুত্রসন্তানের জন্য। তিনি অ্যানকে বিয়ে করার পর রাজজ্যোতিষীরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, অষ্টম হেনরি শিগগিরই এমন এক পুত্রসন্তানের জনক হতে যাচ্ছেন, যার রাজত্বে ইংল্যান্ডের ইতিহাসের মোড় ঘুরে যাবে।
সে স্বপ্ন ধাক্কা খেল, যখন অ্যানের গর্ভে একটি কন্যাসন্তানের জন্ম হলো। তবু অষ্টম হেনরি কন্যাসন্তানটিকে মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তী দুই বছরে অ্যান যখন আরও দুটি মৃত কন্যাসন্তান প্রসব করলেন, তখন আর সহ্য করতে পারলেন না। তিনি এমন একটি সিদ্ধান্ত নিলেন, যা ইংল্যান্ডের রাজপরিবারের ইতিহাসে কলঙ্কিত ঘটনা হিসেবে বিবেচিত। তিনি বললেন, অ্যান ব্যভিচারিণী ও বিশ্বাসঘাতক। একাধিক পুরুষের সঙ্গে তাঁর অবৈধ সম্পর্ক আছে, যাঁদের মধ্যে তাঁর আপন ভাইও আছে। এ রকম অবিশ্বাস্য ও অবান্তর কিছু অভিযোগ তুলে তিনি অ্যানকে কারারুদ্ধ করলেন। তারপর ফ্রান্স থেকে আনা বিশেষ ধারালো তরবারি দিয়ে অ্যানের শিরশ্ছেদের হুকুম দিলেন। সঙ্গে আরও ছয়জনের শিরশ্ছেদ করা হয়। তাঁদের মধ্যে অ্যানের ভাইও ছিলেন। যে নারীকে পাওয়ার জন্য তিনি সারা পৃথিবীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন, সেই নারী বিয়ের তিন বছরের মধ্যে এমন মর্মান্তিক পরিণতি বরণ করবেন, সেটা কেউ কল্পনাও করেনি। অ্যানের শিরশ্ছেদের পর তাঁর তিন বছর বয়সী শিশুকন্যাটিরও উত্তরাধিকার বাতিল হয়, চরম অনিশ্চয়তার কবলে পড়ে যায় তার জীবন।
নিয়তির অদ্ভুত সমীকরণে সেই বঞ্চিত কন্যাটি এক যুগ পরে ইংল্যান্ডের সিংহাসনে বসে নতুন যুগের সূচনা করেন। তাঁর নাম এলিজাবেথ।
অপ্রত্যাশিত মুকুট
অ্যানের শিরশ্ছেদের মাত্র ১১ দিন পর অষ্টম হেনরি আবার বিয়ে করেন। যাঁকে বিয়ে করেন, জেন সেম্যুর নামের সেই তরুণী ছিলেন অ্যানের প্রাসাদের একজন সহকারী। অষ্টম হেনরি যখন তাঁকে বিয়ে করেন, জেন তখন গর্ভবতী। বিয়ের পরপর জেন একটি পুত্রসন্তানের জন্ম দেন। অষ্টম হেনরি সেই ছেলেকে চতুর্থ এডওয়ার্ড নামে উত্তরাধিকারী নির্বাচিত করেন। এডওয়ার্ডের মা সন্তানের জন্ম দেওয়ার পরপরই অসুস্থ হয়ে মারা গেলে অল্প সময়ের মধ্যে রাজা আবারও বিয়ে করেন।
রাজা অষ্টম হেনরির পুত্রসন্তানের সাধ পূর্ণ হওয়ার পরও তিনি আরও তিনটি বিয়ে করে ইংল্যান্ডের রাজাদের মধ্যে সর্বোচ্চ ছয়টি বিয়ের রেকর্ড করে করেন। তিনি অ্যানের পরে একই ধরনের অভিযোগে আরও একজন স্ত্রীর শিরশ্ছেদ করেন। অষ্টম হেনরির বিচিত্র বৈবাহিক সম্পর্কগুলো পরবর্তীকালে ইতিহাসে গবেষণার বিষয় হয়েছিল।
অষ্টম হেনরি সর্বশেষ বিয়ে করেন ১৫৪৩ সালে। তাঁর ষষ্ঠ স্ত্রীর নাম ক্যাথরিন পার। তারপর অবশ্য তিনি আর বিয়ে করার সুযোগ পাননি। ষষ্ঠ বিয়ের বছর তিনেক পরে তাঁর মৃত্যু না হলে ইংল্যান্ডের ওই রাজার বিয়ে ও উত্তরাধিকারীর সংখ্যা আরও বাড়তে পারত।
১৫৪৭ সালে অষ্টম হেনরির মৃত্যুর পর তাঁর সাবেক তিন রানির গর্ভে জন্ম নেওয়া তিনটি সন্তান জীবিত ছিল। কিন্তু বৈধ উত্তরাধিকারী ছিল মাত্র একজন, তিনি ষষ্ঠ স্ত্রীর গর্ভে জন্ম নেওয়া ১১ বছর বয়সী পুত্র চতুর্থ এডওয়ার্ড।
রাজা অষ্টম হেনরির মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসানো হয় ১১ বছর বয়সী বালক চতুর্থ এডওয়ার্ডকে। বয়স কম বলে রাজার অভিভাবক নির্বাচিত করা হয় তাঁর মামা টমাস সেম্যুরকে। এডওয়ার্ড সিংহাসনে বসার পর টমাস সেম্যুর বিয়ে করেন হেনরির বিধবা স্ত্রী ক্যাথরিনকে। বিয়ের পর তিনি ক্যাথরিনকে নিয়ে চেলসির এক প্রাসাদে গিয়ে ওঠেন। তিনি সেই প্রাসাদে যাওয়া সময় এডওয়ার্ডের সৎবোন ১৪ বছর বয়সী এলিজাবেথকে সঙ্গে নিয়ে যান। টমাস সেম্যুরকে মতলববাজ বলে মনে করা হতো। তিনি চেলসির ওই প্রাসাদে যাওয়ার পর এলিজাবেথের সঙ্গে একটা অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। ঘটনাটা জানাজানি হলেও টমাস সেম্যুরের কোনো সমস্যা হয়নি। কারণ, উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার পর এলিজাবেথের জীবন ছিল অনেকটাই অবহেলিত।
তবে টমাস সেম্যুরের কপালে ভিন্ন একটা দুর্ভোগ লেখা ছিল। বছর দুয়েক পর তিনি ভাগনে এডওয়ার্ডের বিরুদ্ধে একটা গোপন তৎপরতায় লিপ্ত হয়ে হাতেনাতে ধরা পড়েন। তাঁকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। কেউ কেউ অনুমান করেন, এলিজাবেথ টমাস সেম্যুরের সঙ্গে সম্পর্কের কারণে বাকি জীবন কুমারীই থেকে যান।
কিশোর রাজা চতুর্থ এডওয়ার্ড বেশি দিন রাজত্ব করতে পারেননি। ১৫৫৩ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে তিনি অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। আবারও সিংহাসনের উত্তরাধিকারসংকট দেখা দেয়। তখন প্রিভি কাউন্সিলের পরামর্শক্রমে অষ্টম হেনরির প্রথম স্ত্রী ক্যাথরিন আরগনের গর্ভে জন্ম নেওয়া কন্যা মেরিকে নতুন রানি হিসেবে নির্বাচিত করা হয়।
৩৭ বছর বয়সী কুমারী মেরির জন্য এটা খুব অপ্রত্যাশিত প্রাপ্তি ছিল। রানি হওয়ার পরের বছর তিনি বিয়ে করেন স্পেনের রাজপুত্র ফিলিপকে। ভিনদেশি রাজপুত্রকে বিয়ে করে রানি মেরি খুব সমালোচিত হয়েছিলেন। এমনকি রাজপ্রাসাদে একটা বিদ্রোহের ঘটনাও ঘটেছিল। সেই ঘটনায় জড়িত থাকার সন্দেহে রানির সৎবোন এলিজাবেথকে কিছুদিনের জন্য বন্দী করে রাখা হয়েছিল। কিন্তু মেরির কপালেও বেশি দিন রাজত্ব ছিল না। পাঁচ বছর রাজত্ব করার পর ১৫৫৮ সালে তিনি নিঃসন্তান অবস্থায় অসুস্থ হয়ে মারা যান।
প্রিভি কাউন্সিলকে এবার একটা ধাঁধার মধ্যে পড়তে হয়। পরবর্তী উত্তরাধিকারী নিয়ে অনেক বিচার-বিবেচনা করে যাঁকে নির্বাচিত করতে হয়, তিনি হেনরির পরিত্যক্ত কন্যা এলিজাবেথ। নিজের বাবা যাঁকে বাতিল করে দিয়েছিলেন, সেই এলিজাবেথের হাতেই অবশেষে ইংল্যান্ডের সিংহাসন এসে ধরা দেয়।
ইংল্যান্ডের ভাগ্যাকাশে নতুন তারকা
এলিজাবেথ ক্ষমতায় বসার সময় শাসনকার্যে অনভিজ্ঞ ছিলেন, তবে তাঁর তীক্ষ্ণ দূরদৃষ্টি, অদম্য মনোবল আর দুঃসাহসী সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ছিল। সেই ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে তিনি নিজের দেশ ছাড়িয়ে দৃষ্টি প্রসারিত করেছিলেন বাকি পৃথিবীর দিকে। তাঁর দেশ আগে কখনো যে প্রতিযোগিতায় নামেনি, তিনি তাকে সেই প্রতিযোগিতায় শামিল করেন। বিশ্ববাণিজ্য দখল করার প্রতিযোগিতায় স্পেন ও পর্তুগালের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার কাজে এগিয়ে যান। বিশ্বজুড়ে সমুদ্রজয়ের প্রতিযোগিতায় বাকি দেশগুলোর চেয়ে অনেক বিলম্বে নেমেও তিনি অভাবনীয় সাফল্যের পরিচয় দেন। সূচনা করেন বিশ্বখ্যাত এলিজাবেথিয়ান যুগের। পরের দুই শতকের মধ্যে বিশ্বের প্রধান সাম্রাজ্যবাদী শক্তিতে পরিণত হবে ইংল্যান্ড। পৃথিবীর অর্ধেক মানচিত্র তাদের হাতে চলে আসবে।
সেই ঘটনাপর্বে যাওয়ার আগে মধ্যযুগে ইউরোপ ও এশিয়ার অর্থনীতির চিত্রের তুলনামূলক চিত্রটা দেখে নেওয়া যাক।
এখানে যে ছকটি দেওয়া হয়েছে, সেটি বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিবিদ অ্যাঙ্গাস ম্যাডিসনের গবেষণা থেকে নেওয়া তথ্য দিয়ে তৈরি করা। ষোড়শ শতাব্দীর পর থেকে সারা পৃথিবীর অর্থনৈতিক পরাশক্তিগুলোর অবস্থানে যে পরিবর্তন আসে, সেটা এই পরিসংখ্যানে পরিষ্কার। বোঝার সুবিধার্থে ইউরোপ ও এশিয়াকে আলাদা করে দেখানো হয়েছে।
ইউরোপের প্রধান দেশগুলোর অর্থনীতি এবং এশিয়ার প্রধান তিনটি দেশের অর্থনীতির অবস্থা খুব স্পষ্ট করেই বলে দিচ্ছে এশীয় সম্পদ ৩০০ বছর ধরে কীভাবে ইউরোপকে ধনী করেছিল। ষোড়শ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের ২ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি বিংশ শতাব্দীতে গিয়ে ১২৪ গুণ বেড়ে ৩৪৭ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছিল। ষোড়শ শতাব্দীতে ইংল্যান্ড যখন সামান্য ২ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির দেশ, তখন ভারতবর্ষের অর্থনীতি ছিল ৬০ বিলিয়ন ডলারের ঘরে। ষোড়শ শতকে সারা পৃথিবীর মোট জিডিপির ২৪ শতাংশ ছিল ভারতবর্ষের। সমগ্র ইউরোপের জিডিপি ছিল ১৮ শতাংশ। একই সময়ে ইংল্যান্ডের জিডিপি ছিল মাত্র ১ দশমিক ১ শতাংশ। ইউরোপের মধ্যেও দুর্বল অর্থনীতির একটি দেশ ছিল ইংল্যান্ড। ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালির সঙ্গে তুলনাই চলে না। স্পেন ও পর্তুগালের সঙ্গে কিছুটা তুলনা করা গেলেও আবিষ্কারের যুগের কান্ডারি হিসেবে এশীয় বাণিজ্যপথের ওপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে স্পেন-পর্তুগালও তখন ইংল্যান্ডের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিল। বিশ্ববাণিজ্যে ইংল্যান্ডের তেমন কোনো অংশ ছিল না বললেই চলে। মোদ্দাকথা, এলিজাবেথের ক্ষমতা গ্রহণের প্রাক্কালে ইংল্যান্ড প্রায় হতদরিদ্র অর্থনীতির দেশ ছিল।
এলিজাবেথ ক্ষমতায় বসার অল্পকাল পরেই পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে। তিনি পূর্ববর্তী শাসকদের চেয়ে ব্যতিক্রমী কিছু সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করেন। সেখানেই অন্যদের সঙ্গে তাঁর পার্থক্য গড়ে উঠতে থাকে। রাজত্ব শুরু করার এক দশক না পেরোতেই তিনি প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার পথ খুঁজতে শুরু করেন। তবে তিনি কাজটা যেভাবে শুরু করেছিলেন, সেটাকে মোটেও স্বাভাবিক বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড বলা যাবে না। তাঁর সময়ে পৃথিবীর সব মহাসাগরে জেঁকে বসা দুই শক্তি স্পেন ও পর্তুগালের বাণিজ্যবহরের ওপর হামলার কার্যক্রমের মাধ্যমে ইংল্যান্ডের বিশ্বজয়ের সূত্রপাত ঘটেছিল।
এলিজাবেথ প্রথম পর্বের আক্রমণের সূচনা করেন স্পেনের বাণিজ্যবহরের ওপর। তখন স্পেনের রাজত্ব দ্বিতীয় ফিলিপের হাতে। ১৫৫৪ সালের পর তিনি কয়েক বছরের জন্য ইংল্যান্ডের রাজত্ব করেছিলেন এলিজাবেথের সৎবোন মেরিকে বিয়ে করার মাধ্যমে। মেরি যখন ইংল্যান্ডের রানি, তখন ফিলিপ স্পেনের রাজপুত্র। ফিলিপ ইংল্যান্ডের রাজত্ব শুরু করার ২ বছর পর ১৫৫৬ সালে স্পেনের রাজার মৃত্যু হলে তাঁকে স্পেনের রাজত্বের ভারও নিতে হয়। সেই দুই বছর তিনি স্পেন ও ইংল্যান্ড উভয় দেশের রাজা ছিলেন। কিন্তু মেরির আকস্মিক মৃত্যুর কারণে ফিলিপের ইংল্যান্ডে রাজত্বের অবসান ঘটে। রাজত্ব বজায় রাখতে তিনি অবশ্য শ্যালিকা এলিজাবেথকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু এলিজাবেথ সেটা গ্রহণ করেননি। তবু দুই রাজ্যের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় ছিল।
মহাসাগরে দুঃসাহসী অভিযান
১৫৭০-এর দশকে স্পেন যখন ইউরোপের দ্রুতবর্ধনশীল অর্থনৈতিক শক্তি, তখন ইংল্যান্ডের দুর্বল অর্থনীতি নিয়ে এলিজাবেথের নাভিশ্বাস উঠেছিল। স্পেন-পর্তুগালের উন্নতিতে উৎসাহিত হয়ে এলিজাবেথও সিংহাসনে বসার এক দশক পর থেকে সমুদ্র অভিযানকে উৎসাহিত করতে শুরু করেন। এশীয় বাণিজ্যের পথ তখনো ইংল্যান্ডের নাগালের বাইরে ছিল। এলিজাবেথের আমলে ইংল্যান্ডের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য শুরু হয়েছিল আফ্রিকার দাস ব্যবসা দিয়ে। ইংল্যান্ডের বেশ কিছু বণিক আফ্রিকা থেকে দাস কিনে আটলান্টিকের পশ্চিম প্রান্তে স্পেনের নতুন উপনিবেশে সরবরাহ করার কাজে লিপ্ত ছিল। সেই ব্যবসায় রানি এলিজাবেথেরও অংশ ছিল। তাঁর নিজের মালিকানাধীন কয়েকটি জাহাজ তিনি অভিযানের কাজে লাগাতে শুরু করেন। প্রাথমিক পর্বে সেসব কার্যক্রম আটলান্টিক মহাসাগরে সীমাবদ্ধ ছিল।
১৫৭০-এর দশকে এক ইংলিশ জাহাজ আমেরিকার স্প্যানিশ কলোনিতে লুটতরাজের ঘটনায় অংশ নিলে স্পেনের সঙ্গে ইংল্যান্ডের বিরোধের সূত্রপাত ঘটে। ইংরেজ বাহিনী স্প্যানিশদের পাল্টা হামলায় মার খেয়ে দেশে ফিরে আসে। তখন থেকে ইংল্যান্ডের জাহাজগুলো আটলান্টিক মহাসাগরে স্প্যানিশ জাহাজের ওপর প্রতিশোধমূলক দস্যুবৃত্তি শুরু করে। সেই দস্যুবৃত্তির কারণে স্পেনের রাজা দ্বিতীয় ফিলিপের সঙ্গে তাঁর সাবেক শ্যালিকা রানি এলিজাবেথের সম্পর্কে ফাটল ধরে।
এ রকম পরিস্থিতিতে রানি এলিজাবেথ একটা নতুন দুঃসাহসী পরিকল্পনায় যোগ দেন। আমেরিকার স্প্যানিশ কলোনিতে যারা হামলা চালিয়েছিল, তাদের একটা দল ১৫৭৭ সালে প্রথমবারের মতো এক দূরবর্তী অভিযানের পরিকল্পনা করে। তার অর্ধশতক বছর আগে ফার্দিনান্দ মাগেলান যে পথে এশিয়ার সন্ধান পেয়েছিলেন, ইংরেজদের লক্ষ্য ছিল সেই পথ ধরে দক্ষিণ আমেরিকার দক্ষিণ প্রান্ত পেরিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের পথ ঘুরে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করার অভিযান।
মধ্যযুগের সমুদ্র অভিযানগুলো চালাত প্রাইভেটিয়ার বলে কথিত বিভিন্ন বেসরকারি বাহিনী, প্রশিক্ষিত সৈনিক ও নাবিকদের সমন্বয়ে গঠিত ভাড়াটে গুন্ডা বাহিনী। তাদের সরকারিভাবেও মদদ দেওয়া হতো। ইংল্যান্ডের প্রাইভেটিয়ার বাহিনীগুলো স্পেনের বিরুদ্ধে সব অভিযানে অংশ নিত। তাদের মধ্যে প্রথম যে অভিযান ইংল্যান্ডকে নতুন যুগের আলো দেখিয়েছিল, তার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন স্যার ফ্রান্সিস ড্রেক।
ফ্রান্সিস ড্রেকের পৃথিবী প্রদক্ষিণ
ফ্রান্সিস ড্রেক তখনো ‘স্যার’ উপাধি পাননি। তাঁর জীবিকা শুরু হয়েছিল আটলান্টিক মহাসাগরে দাস ব্যবসার মাধ্যমে। ১৫৬২ সাল থেকে তিনি ইংলিশ নেভাল কমান্ডার জন হকিন্সের সঙ্গে আফ্রিকার উপকূল থেকে দাস কিনে আটলান্টিকের পশ্চিম তীরের স্প্যানিশ কলোনিতে সরবরাহ করতেন। কিন্তু হকিন্সের সঙ্গে একসময় ড্রেকের বিরোধ লেগে যায়। রানি এলিজাবেথের কাছে হকিন্স অভিযোগ করেন পানামায় একটা স্প্যানিশ জাহাজ লুট করার পর সেই টাকার সবটা মেরে দিয়েছিলেন ড্রেক। রানির কাছে সে অভিযোগ ধোপে টেকেনি। তিনি ফ্রান্সিস ড্রেকের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। ১৫৭৭ সালে প্রশান্ত মহাসাগর অভিযানের জন্য তিনি তাঁকে নেতা নির্বাচিত করেন।
তখনো ইংরেজদের কাছে সেই পথের স্পষ্ট কোনো নিশানা ছিল না। ইউরোপের অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞ নাবিকদের ভাড়া করে অভিযানের পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়। সেই সময় ইংল্যান্ডের রাজকীয় নৌবাহিনীর মালিকানায় ছিল মাত্র ২৪টি জাহাজ, লোকবল ছিল ৭ হাজার। সবচেয়ে বড় জাহাজটা ছিল ১ হাজার টনের; তার সঙ্গে ৯০০ টনের দুটি, ৮০০ টনের দুটি আর পাঁচটি ছিল ৬০০ টনের। বাকি সব জাহাজ ছিল ৬০০ টনের নিচে।
অভিযানের কয়েক দিন আগে ৬ নভেম্বর ফ্রান্সিস ড্রেক রানি এলিজাবেথের কাছে একটি চিঠি পাঠান। সেই চিঠিতে পরিষ্কার দেখা যায় তিনি কীভাবে রানির কাছে জলদস্যুতার অনুমতি চাইছেন। চিঠিটার অংশবিশেষ এ রকম:
মহামান্য রানির উদ্দেশ্যে এই বলে শুরু করছি যে সর্বশক্তিমান ঈশ্বর যাদের কাছ থেকে আপনার দূরত্ব সৃষ্টি করেছেন, তাদের সঙ্গে কোনো আপস করার দরকার নেই। আপনাকে সর্বদা চেষ্টা করতে হবে যাতে নিজের শক্তি বাড়িয়ে তাদের দুর্বল করা যায়। আপনি তাদের সঙ্গে খোলাখুলিভাবে যুদ্ধ করতে পারেন সমুদ্রে, কিংবা অন্য উপায়েও তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারেন।
আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি, আপনি আমাকে অনুমতি দিলে আমি অস্ত্রসজ্জিত জাহাজ নিয়ে নতুন আবিষ্কৃত দেশগুলোর উদ্দেশ্যে অভিযান চালাতে পারি, যেখানে ফ্রান্স, স্পেন ও পর্তুগালের বড় বড় জাহাজ ছড়িয়ে আছে। আমি তাদের ওপর হামলা চালিয়ে সেরা জিনিসগুলো নিয়ে আসতে পারি, বাকি সব পুড়িয়ে ফেলতে পারি। আপনি চাইলে জলদস্যু হিসেবে আমাদের কাজ করার সুযোগ দিতে পারেন। আমি তাদের সমুদ্রশক্তি বিনাশ করে দিতে পারি। কারণ, আমি জানি, তারা তাদের নৌশক্তির জন্য জেলেদের ওপর নির্ভর করে। আমি জানি, আপনি এটা নৈতিকভাবে সমর্থন করতে পারেন না, কিন্তু শয়তানের বিরুদ্ধে আইনানুগ পদক্ষেপ না নেওয়াও খ্রিষ্টীয় নীতি নয়। কারণ, আপনি দেখতে পাচ্ছেন, ঈশ্বর নিজেই এই কলহে আমাদের পক্ষে আছেন। আপনার অনুগ্রহে আমরা তাঁর শত্রুদের বিনাশ করতে পারি।
আপনাকে কেউ কেউ বলতে পারে, এটা আমাদের বাণিজ্য ধ্বংস করে দেবে। আপনি ওসব কথায় কান দেবেন না। আমরা সমুদ্রে আমাদের প্রাধান্য বিস্তার করব। আপনি যদি আমাদের এই অভিযানের অনুমতি দেন, তাহলে আমরা পরবর্তীকালে স্পেনের কাছ থেকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ কেড়ে নেব। আপনি সোনা ও রুপার খনির মালিক হবেন এবং সেই মাটি থেকে প্রাপ্ত সব লাভের অংশীদার হবেন। আপনি সমুদ্রের সম্রাজ্ঞী হবেন এবং সব ধরনের বিপদ থেকে মুক্ত থাকবেন। আপনি আমাকে অনুমতি দিলে আমি আপনার জন্য সেই সৌভাগ্য নিয়ে আসব। আপনি শুধু অবিলম্বে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দিন।
(র্যালফ ফিচ: ইংল্যান্ড’স পাইওনিয়ার টু ইন্ডিয়া, জে হর্টন রাইলি, লন্ডন, ১৮৯৯, পৃ. ২১)
কোনো সন্দেহ নেই যে এটা ছিল সরাসরি ডাকাতির প্রস্তাব। কিন্তু রানি এলিজাবেথ তাতে সায় দিলেন কেন? র্যালফ ফিচের সূত্রে বলা হয়েছে, এলিজাবেথ ভালো করেই জানেন, তিনি তাঁর অবস্থানে থেকে এমন একটা দুর্বৃত্তপনার কাজে অনুমতি দিতে পারেন না। তাঁর রাজ্য তখন নেতৃস্থানীয় ইউরোপীয় শক্তিগুলোর সঙ্গে বিরোধে লিপ্ত ছিল। তিনি প্রথমে আড়ালে থেকে এই অভিযানে সমর্থন জুগিয়েছিলেন। পরে ধীরে ধীর প্রকাশ্যে সমর্থন দিতে শুরু করেন।
এলিজাবেথ একসময় বেপরোয়া হয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে দুঃসাহসিকতার সঙ্গে এ ধরনের দস্যুতার প্রকল্পগুলো এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। তার ফলে তিনি নিজে লাভবান হয়েছিলেন, তার চেয়ে বড় কথা, তিনি পরবর্তী প্রজন্মগুলোর জন্য, পুরো ইংল্যান্ডের ভবিষ্যতের জন্য বিরাট এক অর্জনের দুয়ার খুলে দিয়েছিলেন।
ফ্রান্সিস ড্রেক রানি এলিজাবেথের অনুমতি পেয়ে পাঁচটি জাহাজের বহর নিয়ে যাত্রা শুরু করেন ১৫৭৭ সালের ডিসেম্বরে। অভিযানের শুরুতে কেপ ভার্দে দ্বীপপুঞ্জের কাছে সান্তা মারিয়া নামের একটা স্প্যানিশ জাহাজ ছিনতাই করে তার কাপ্তানকে জিম্মি করা হয়। সেই কাপ্তান দক্ষিণ আমেরিকার জলপথ সম্পর্কে অভিজ্ঞ ছিলেন। ড্রেক বাহিনী তাঁকে পথ দেখানোর কাজে ব্যবহার করে মাগেলান প্রণালি অতিক্রম করে। কাজটা খুব দুঃসাধ্য ছিল। প্রণালির কাছে ঝড়ের কবলে পড়ে কয়েকটা জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত হলে অধিকাংশ নাবিক বেঁকে বসেছিল, জাহাজে একাধিক বিদ্রোহের ঘটনাও ঘটেছিল। কয়েকটা জাহাজ পুরোপুরি ধ্বংস হওয়ার পরও তিনি অদম্য মনোবল নিয়ে গোল্ডেন হিন্দ নামের এক জাহাজ নিয়ে এগিয়ে যান। অবশেষে ১৫৭৮ সালের সেপ্টেম্বরে দক্ষিণ আমেরিকার সর্বদক্ষিণ প্রান্তের ভয়ানক দুর্গম সমুদ্র অতিক্রম করে প্রথম ইংরেজ হিসেবে প্রশান্ত মহাসাগরের দেখা পান।
তারপর উপকূল ধরে উত্তর দিকে যেতে যেতে কয়েক মাসের মধ্যে পেরুর কাছে পৌঁছান। সেখানে তিনি এক বড় শিকার পেয়ে যান। একটা স্প্যানিশ জাহাজ ওই এলাকা থেকে মূল্যবান পণ্যসামগ্রী নিয়ে দেশে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। প্রশান্ত মহাসাগরে তখন স্প্যানিশ ছাড়া আর কোনো জাহাজ প্রবেশ করত না। তাই সেই জাহাজ এদিকে কোনো বিপদের আশঙ্কা করেনি। ফ্রান্সিস ড্রেকের জাহাজ সাধারণ বাণিজ্য জাহাজের ছদ্মবেশে স্প্যানিশ জাহাজের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। অপ্রস্তুত স্প্যানিশ জাহাজটির ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে লুট করে নেয় ২৫ হাজার পেসোর পেরুভিয়ান মুদ্রা এবং ৩৭ হাজার ডুকাট স্প্যানিশ মুদ্রা (এ যুগের হিসাবে ৭ মিলিয়ন পাউন্ড)।
ফ্রান্সিস ড্রেক প্রথম স্প্যানিশ জাহাজটি লুট করার কিছুদিন পর আরও একটি স্প্যানিশ জাহাজের দেখা পান। আবারও অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে সেই জাহাজ থেকে ৩৬ কেজি সোনা, ১৩ বাক্স রৌপ্যমুদ্রা ও ২৬ টন রুপা লুট করেন। এই দুই ডাকাতির মাধ্যমে যে পরিমাণ সম্পদ লুট করা হয়, তা কোনো বাণিজ্যিক অভিযানের কয়েক গুণ।
অঙ্কটা তখনকার মতো যথেষ্ট ছিল বলে ড্রেক এশিয়ার উদ্দেশ্যে পাল না তুলে আবারও মাগেলান প্রণালি দিয়ে ইংল্যান্ডে ফিরে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সে পথে বড় ধরনের দুটি বিপদ ছিল। প্রথমত, মাগেলান প্রণালি প্রাকৃতিকভাবেই বেশ বিপৎসংকুল। দ্বিতীয়ত, ওদিকে স্প্যানিশ জাহাজের মুখোমুখি হওয়ার ভয় ছিল। তারা নাগালে পেলে তাদের জাহাজ লুটের প্রতিশোধ না নিয়ে ছাড়বে না।
অতএব ফ্রান্সিস ড্রেক পূর্বপরিকল্পনায় ফিরে গেলেন—সরাসরি প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে এশিয়া পৌঁছাবেন। যে পথে মাগেলানের পর অর্ধশতাব্দীকাল আর কেউ যায়নি, সেই পথ অতিক্রম করে তিনি মালাক্কা অঞ্চলে পৌঁছে যেতে সক্ষম হন। মালাক্কা অঞ্চল তখন পুরোপুরি পর্তুগিজদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। স্পেন ও পর্তুগাল উভয় দেশই ইংরেজদের শত্রু ছিল। ফলে ফ্রান্সিস ড্রেক মালাক্কা অঞ্চলে গিয়ে পর্তুগিজদের আক্রমণের মুখে পড়েন। মালাক্কার সুলতানের সাহায্য নিয়ে সেই বিপদ থেকে কোনোমতে উদ্ধার পান। তারপর দেরি না করে ভারত মহাসাগর পেরিয়ে ইংল্যান্ডের পথে রওনা দেন। আরও এক বছর পর উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে তিনি ইংল্যান্ড ফিরতে সক্ষম হন ১৫৮০ সালে।
প্রায় চার বছর পর লন্ডনে পৌঁছে ফ্রান্সিস ড্রেক রানিকে লুটের ভাগ বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। অভিযানের শুরুতে রানির সমর্থন গোপন রাখা হলেও বিপুল সাফল্যের পর এলিজাবেথ অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলেন এবং প্রকাশ্যেই ফ্রান্সিস ড্রেককে একটা রত্নখচিত মুকুট উপহার দিয়েছিলেন।
সেই অভিযানে ফ্রান্সিস ড্রেক সর্বমোট কী পরিমাণ সম্পদ লুট করেছিলেন, ইংরেজরা তা কখনো প্রকাশ করেনি। কিন্তু স্পেনের রাজা দ্বিতীয় ফিলিপ দাবি করেছিলেন, তাঁদের দেড় মিলিয়ন ডুকাটের সমপরিমাণ সম্পদ লুট হয়েছিল। সেই হিসাবে এটা ছিল ইতিহাসের অন্যতম বৃহত্তম ডাকাতি। রাজা দ্বিতীয় ফিলিপ জলদস্যুতার জন্য ড্রেকের শাস্তি দাবি করেছিলেন। জবাবে রানি এলিজাবেথ ড্রেককে নাইট উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। ফ্রান্সিস ড্রেক পৃথিবীর প্রথম নাইট উপাধি পাওয়া জলদস্যু।
আকবরকে রানি এলিজাবেথের চিঠি
মধ্যযুগে বিশ্ববাণিজ্যের দুই পথের একটি ছিল মধ্যপ্রাচ্যের ওপর দিয়ে চীন পর্যন্ত বিস্তৃত সিল্করুট বা রেশমপথ। অন্যটা মহাসাগরের বিস্তৃত সামুদ্রিক বাণিজ্যপথ। অটোমান সাম্রাজ্যের দাপটে দুই শতক ধরে রেশমপথের পথ বন্ধ ছিল। অন্যদিকে সারা দুনিয়ার সমুদ্রপথগুলো নিয়ন্ত্রণ করছিল স্পেন ও পর্তুগাল। ফ্রান্সিস ড্রেকের অভিযানে যেটুকু সাফল্য এসেছিল, তাতে ইংল্যান্ডের বাণিজ্যে সুফল মেলেনি। ড্রেকের অভিযান পুরোদস্তুর ডাকাতি। তাই এবার রানি এলিজাবেথ সত্যিকারের বাণিজ্যপথ খোলার জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা শুরু করেন।
সেই চেষ্টার অংশ হিসেবে তিনি তুরস্কের অটোমান সুলতানের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। ১৫৮০ সালে তিনি তাঁদের সঙ্গে এক সমঝোতা চুক্তি করতে সক্ষম হন। চুক্তি অনুসারে ইংরেজ বণিকদের অটোমান সাম্রাজ্যের ওপর দিয়ে এশিয়ার সঙ্গে ব্যবসা করার সুযোগ দেওয়া হবে। তারপর রানি এলিজাবেথের পক্ষ থেকে তুরস্কে একজন বাণিজ্যিক দূত নিয়োগ করা হয়। সেই দূতের যাবতীয় ব্যয় বহন করার জন্য এগিয়ে আসে লন্ডনের বিখ্যাত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান লেভান্ট কোম্পানি। এই কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা এডওয়ার্ড অসবোর্ন রানি এলিজাবেথের বিশেষ অনুগ্রহপ্রাপ্ত ছিলেন। তিনি রানির অনুমোদন নিয়ে বেশ কয়েক বছর ধরে এশিয়ার মসলা বাণিজ্যের পথ উন্মোচনের চেষ্টা করছিলেন।
অটোমান সুলতানের সঙ্গে রানি এলিজাবেথের সমঝোতা চুক্তির ভিত্তিতে লেভান্ট কোম্পানি ১৫৮৩ সালে অটোমান সাম্রাজ্যের মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষ ও চীনে তাদের কয়েকজন বাণিজ্যদূত পাঠায়। তাঁদের দলনেতা ছিলেন জন নিউবেরি, তাঁর সঙ্গে আরও ছিলেন জন এলডার্ড, উইলিয়াম লিডস, জেমস স্টোরি ও র্যালফ ফিচ। তাঁদের হাতে রানি এলিজাবেথের লেখা দুটি চিঠি দেওয়া হয়। একটা চিঠি সম্রাট আকবরের জন্য, অন্যটা চীনের সম্রাটের জন্য।
সম্রাট আকবরের কাছে লেখা রানি এলিজাবেথের চিঠিটা ইতিহাসের একটা মাইলফলক। ভারতের সঙ্গে ইংল্যান্ডের বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনের লক্ষ্যে প্রথম রাজকীয় যোগাযোগের প্রচেষ্টা হচ্ছে সেই চিঠি। রানি এলিজাবেথ সম্রাট আকবরের উদ্দেশে লেখেন:
ঈশ্বরের অসীম অনুগ্রহে এলিজাবেথ এই পত্রখানি লিখছে সর্বোচ্চ সম্মানিত এবং শক্তিশালী রাজপুত্র জালালউদ্দিন আকবরকে, যিনি কেম্বে রাজ্যের অবিসংবাদিত সম্রাট। দূরবর্তী রাজ্য আবিষ্কার এবং তাদের সঙ্গে বাণিজ্য করার ব্যাপারে আমাদের প্রজাদের গভীর আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য জন নিউবেরি ও তাঁর সঙ্গে একদল সাহসী অভিযাত্রীকে আপনার রাজ্যের সীমান্তের ভেতরে পাঠানোর ব্যাপারে আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছে। মহামান্য, আমাদের কোনো সন্দেহ নেই যে আপনার রাজকীয় অনুগ্রহে আপনি তাঁদের সাদরে বরণ করে নেবেন। আমরা বিনীতভাবে আপনার নিকট তাঁদের জন্য একটি সহৃদয় অভ্যর্থনার ব্যবস্থা করার অনুরোধ জানাচ্ছি। এটা শুধু আমাদের স্বার্থেই নয়, আপনার রাজকীয় মহিমার প্রতি তাদের গভীর কৃতজ্ঞতাবোধ সৃষ্টির জন্যও প্রয়োজন। আমরা প্রয়োজন মনে করলে প্রাণের আকুতি জানিয়ে আমাদের আবেদন আরও দীর্ঘ করতে পারতাম। কিন্তু পৃথিবীর ওই সুদূর প্রান্তে আপনার রাজকীয় অনুগ্রহ ও উদারতা কত সম্মানিত এবং কত ব্যতিক্রমী, সে কথা আমরা জানতে পেরেছি।
ফলে আমাদের দীর্ঘ আবেদন লেখার বোঝা ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। আমরা আপনার কাছে সংক্ষিপ্তভাবে আমাদের আবেদনটা জানাতে পারছি। আমরা শুধু আশা করব যে আমার প্রজাদের আন্তরিকতা ও সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করা হবে। আমরা মহামান্যকে অনুরোধ করছি, ওই দূরবর্তী স্থানে পৌঁছানোর জন্য তাঁরা যে কঠিন যাত্রাপথ বেছে নিয়েছেন, তা বিবেচনা করে আপনি সব ধরনের সুযোগ-সুবিধাসহ আপনার দেশে তাঁদের ভ্রমণের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা প্রদান করুন। যদি এই অনুরোধে আপনার রাজকীয় মহিমায় আমাদের প্রজাদের প্রতি আপনি এটুকু দয়া প্রদর্শন করেন, তাহলে আমরা রাজকীয় সম্মান অনুসারে অত্যন্ত কৃতজ্ঞতার সঙ্গে তার উপযুক্ত প্রতিদান দেওয়ার চেষ্টা করব। এটুকু বলে আমি আমার বক্তব্য শেষ করে মহামান্যকে বিদায় জানালাম।
(র্যালফ ফিচ: ইংল্যান্ড’স পাইওনিয়ার টু ইন্ডিয়া, জে হর্টন রাইলি, লন্ডন, ১৮৯৯, পৃ. ৪৪)
চিঠিটি পড়ে প্রাথমিকভাবে অনুমান করা যায়, ইংরেজরা তখনো ভারতবর্ষ সম্পর্কে বেশি কিছু জানত না। রানি এলিজাবেথ আকবরকে কেম্বে রাজ্যের সম্রাট হিসেবে সম্বোধন করেছেন। কেম্বে তখন ভারতের একটি বন্দর হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিল। সেই বন্দরে বাণিজ্য করার সুযোগ পেতেই ইংল্যান্ডের রানির এই আবেদন।
জন নিউবেরির নেতৃত্বে র্যালফ ফিচের দলটি রানি এলিজাবেথের এই চিঠি নিয়ে প্রথমে টাইগার নামে একটি জাহাজে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে তুরস্কে পৌঁছায়। তুরস্ক থেকে স্থলপথে আরব পাড়ি দিয়ে হরমুজ বন্দরে পৌঁছায়। তারপরই ভারতবর্ষের হাতছানি। কিন্তু হরমুজ বন্দরে তাঁদের দল একটি বিপদে পড়ে। হরমুজ তখন পারস্যের এক সমৃদ্ধ নগরী। সেখানে পর্তুগিজদের একটি দুর্গ ছিল। সে দুর্গের পর্তুগিজ বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন র্যালফ ফিচ। পর্তুগিজ বাহিনী ভেবেছিল, তিনি ভেনিসের গুপ্তচর। সেই সময় ভেনিসের বণিকদের ওপর পর্তুগিজরা খুব ক্ষিপ্ত ছিল। তাদের কারণে ইউরোপে পর্তুগিজদের একচেটিয়া ব্যবসা ক্ষুণ্ন হচ্ছিল। র্যালফ ফিচকে আটক করে তাঁকে তারা শাস্তি দেওয়ার জন্য ভারতের গোয়া পাঠায়।
ফিচের ভাগ্য ভালো ছিল। তিনি গোয়া পৌঁছানোর পর স্টিভেনস নামের এক ইংরেজ যাজকের অনুগ্রহে পর্তুগিজদের হাত থেকে মুক্তি পান। স্টিভেনস ছিলেন ভারতে পা রাখা প্রথম ইংরেজ। মুক্তি পাওয়ার পর র্যালফ ফিচ তাঁর দলের অন্যদের খুঁজে বের করেন। তারপর পুরো দল নিয়ে দিল্লির উদ্দেশে যাত্রা করেন।
দিল্লি পৌঁছে জন নিউবেরি সম্রাট আকবরের কাছে রানির চিঠিটা হস্তান্তর করেন। তাঁর দল আকবরের দরবারে বেশ সমাদর পেয়েছিল। কিন্তু সম্রাট আকবর রানি এলিজাবেথের চিঠির উত্তরে কোনো চিঠি লিখেছিলেন কি না, তা জানা যায়নি। জন নিউবেরি ও তাঁর দল দিল্লি ও ভারতের কিছু অঞ্চল ভ্রমণ করে। তারপর নিউবেরি হঠাৎ একা ইংল্যান্ড ফেরার সিদ্ধান্ত নেন। স্থির হয়, জন নিউবেরি ফিরে যাবেন। আর র্যালফ ফিচ চীনা সম্রাটকে লেখা রানি এলিজাবেথের চিঠিটা পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব পালন করবেন।
র্যালফ ফিচ ভারতের দিল্লি, আগ্রা, পাটনা, কোচবিহার, বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণ করার একপর্যায়ে ভারতের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের বন্দর চট্টগ্রামে পৌঁছান। চট্টগ্রাম থেকে একটা পর্তুগিজ জাহাজে করে পৌঁছান মালাক্কা অঞ্চলে। তাঁর পরিকল্পনা ছিল, তিনি চীনা সম্রাটের কাছে রানি এলিজাবেথের লেখা চিঠিটা নিয়ে মালাক্কা থেকে চীনে যাবেন; কিন্তু পর্তুগিজ-অধ্যুষিত মালাক্কা থেকে চীনে যাওয়ার কোনো সুযোগ পাননি। বিফল হয়ে তিনি দেশে ফেরার উদ্দেশ্যে আবার ভারতে আসেন।
লেভান্ট কোম্পানি যখন নিশ্চিত ধরে নেয় যে জন নিউবেরির দলের সবাই মারা গেছেন, সে সময় ১৫৯১ সালে র্যালফ ফিচ একা দেশে ফিরে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। তত দিনে আটটি বছর পার হয়ে গিয়েছিল।
জন নিউবেরির নেতৃত্বে র্যালফ ফিচের সেই অভিযানের মূল উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়েছিল। ফিচ এশিয়া থেকে জাহাজ ভরে মসলা কিনে আনার জন্য বেরিয়ে প্রাণ নিয়ে শূন্য হাতে ফিরে আসতে পেরেছিলেন। দলনেতা জন নিউবেরি ফেরার পথে কোথাও নিখোঁজ হয়ে যান। তিনি কোথায় নিখোঁজ হন বা মারা পড়েন, সে কথা জানা যায়নি। সম্রাট আকবর এলিজাবেথের চিঠির জবাব দিয়েছিলেন কি না, সে প্রশ্নের উত্তরও তাঁর সঙ্গে হারিয়ে যায়।
র্যালফ ফিচ শূন্য হাতে ফিরে গেলেও তাঁর লাভের খাতায় ছিল ভারতবর্ষ ও মালাক্কা অঞ্চল সম্পর্কে অমূল্য অভিজ্ঞতা ও গল্পের ঝুড়ি। সেসব গল্প লন্ডন শহরে এমন জনপ্রিয়তা পেয়েছিল যে শেক্সপিয়ারের ম্যাকবেথ নাটকে তাঁদের অভিযানে ব্যবহৃত সেই টাইগার জাহাজের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল।
জেমস ল্যাঙ্কেস্টারের ব্যর্থ এশিয়া অভিযান
র্যালফ ফিচের দলের ফেরার আশা ছেড়ে দিয়ে লেভান্ট কোম্পানি এশিয়ার উদ্দেশে আরেকটি অভিযান পাঠিয়েছিল। সেই অভিযানের নেতা ছিলেন স্যার জেমস ল্যাঙ্কেস্টার। অভিযানটা পাঠানো হয়েছিল উত্তমাশা অন্তরীপ দিয়ে। এতকাল ওই জলপথ পর্তুগিজ জাহাজ বাদে বাকি সবার জন্য নিষিদ্ধ ছিল। নিষেধাজ্ঞাটা স্পেন-পর্তুগালের মধ্যকার তর্দেসিলাস চুক্তির ফসল, যে চুক্তি প্রায় এক শতাব্দী বহাল ছিল। রানি এলিজাবেথ সিদ্ধান্ত নেন, সেই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে অভিযান চালানো হবে। প্রশান্ত মহাসাগর পেরিয়ে ফ্রান্সিস ড্রেকের অভিযানের পর ব্রিটিশরা যেকোনো পথে সমুদ্র অভিযান চালানোর ব্যাপারে আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছিল। ইংরেজ নাবিকেরা প্রশান্ত মহাসাগরের পথে স্প্যানিশ বাধা অতিক্রম করেছিল, এবার দক্ষিণ আফ্রিকার উত্তমাশা অন্তরীপের পথে পর্তুগিজ শক্তিকেও চ্যালেঞ্জ করল।
১৫৯১ সালে জেমস ল্যাঙ্কেস্টার প্রথমবারের মতো উত্তমাশা অন্তরীপ দিয়ে মালাক্কায় এক দুঃসাহসিক অভিযান পরিচালনা করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য ইংরেজদের পিছু ছাড়েনি। তাদের তিনটি জাহাজ এশিয়ায় পৌঁছাতে পারলেও বিপুল বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়ে তিন বছর পর ১৫৯৪ সালে অল্প কয়েকজন মৃতপ্রায় নাবিককে নিয়ে মাত্র একটা জাহাজ ফিরতে পেরেছিল। জাহাজটি যেসব মসলাপাতি নিয়ে ফিরেছিল, তা-ও ছিল অভিযানে যাওয়ার পথে এক পর্তুগিজ জাহাজ থেকে লুট করা। বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল শূন্য। অভিযানটি যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছিল, তাতে যথেষ্ট পুঁজি না থাকলে লেভান্ট কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে যেত।
এদিকে জেমস ল্যাঙ্কেস্টারের অভিযানের ফলাফল জানার আগেই রানি এলিজাবেথ আরও একটা অভিযানের পরিকল্পনা করেছিলেন। এটাকে সমুদ্র অভিযান বলা হলেও আসলে ছিল বড় ধরনের জলদস্যুতা। ১৫৯২ সালে রানি এলিজাবেথ স্পেন-পর্তুগালের যৌথ সাম্রাজ্যের আইবেরিয়ান বাণিজ্য জাহাজগুলোর ওপর একটা বড় যৌথ আক্রমণ চালানোর সিদ্ধান্ত নেন। সেটাকে বলা যেতে পারে পণ্যবাহী জাহাজে ডাকাতি করার রাজকীয় আয়োজন। সেই অভিযানের অভূতপূর্ব ফলাফল ইংল্যান্ডের ভবিষ্যৎ নিয়তির গতিপথ নির্ধারণ করে দেয়।
লুটতরাজের উপাখ্যান
ইতিহাসের পাতায় ঘটনাটি অ্যাংলো-স্প্যানিশ যুদ্ধ হিসেবে ব্যাটল অব ফ্লোরেস নামে অভিহিত। কিন্তু সেটা আদৌ কোনো যুদ্ধ ছিল না, অভিযানটি কোনো যুদ্ধজাহাজের বিরুদ্ধে চালানো হয়নি। সেটা ছিল যুদ্ধের ছদ্মবেশে একটা বাণিজ্যিক জাহাজবহরের ওপর দলবদ্ধ প্রাইভেটিয়ার অভিযান। ১৬টি জাহাজ নিয়ে পরিচালিত সেই অভিযানে প্রাইভেটিয়ারদের পাশাপাশি ইংল্যান্ডের নৌবাহিনীও যুক্ত ছিল। ছিল রানির নিজের মালিকানাধীন দুটি জাহাজও। অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিল আটলান্টিক মহাসাগর দিয়ে পরিবহনকৃত এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে আসা স্পেন-পর্তুগালের বাণিজ্যিক পণ্য লুট করা। আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজে স্প্যানিশ উপনিবেশে হামলা চালানোরও পরিকল্পনা করা হয়।
১৫৯২ সালের ৬ মে ইংরেজ বাহিনী ইংল্যান্ডের ডার্টমাউথ বন্দর থেকে ১৬টি জাহাজের বহর নিয়ে রওনা দেয়। অভিযানের নেতা স্যার ওয়াল্টার রেলেই। অভিযান শুরু হয় সান্তা ক্লারা নামের ৬০০ টনের একটা স্প্যানিশ জাহাজ লুট করে পুড়িয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে। স্পেনের রাজা দ্বিতীয় ফিলিপ সেই খবর পেয়ে ইংরেজ বহরের ওপর হামলা চালানোর উদ্দেশ্যে একটা স্প্যানিশ আরমাদা বা সামরিক নৌবহর পাঠান। ইংরেজ নৌশক্তির কাছে সেই আরমাদা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়।
এরপর ইংরেজ নৌবহর আরও দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয় এবং ২৫ জুন আফ্রিকার পশ্চিম উপকূলে সান্তা ক্রুজ নামের এক পর্তুগিজ জাহাজের দেখা পায়। জাহাজটা ভারত থেকে মসলা নিয়ে ফিরছিল। ইংরেজ নাবিকেরা পর্তুগিজ জাহাজটা দেখামাত্র ধাওয়া শুরু করলে সেটা আফ্রিকার পশ্চিম উপকূলের দিকে কোরভো দ্বীপে নোঙর করে এবং নাবিকেরা পালানোর চেষ্টা করেন। ইংরেজ নাবিকেরা তাদের পাকড়াও করে নির্যাতন শুরু করলে তারা প্রাণ রক্ষার তাগিদে তাদের আরও বড় এক শিকারের সন্ধান দেয়। তারা তাদের বলে যে কিছুদিন পর ভারত থেকে মূল্যবান পণ্যসামগ্রী নিয়ে কয়েকটা জাহাজ এই পথে আসবে। ইংরেজরা সেখানে ওত পেতে থাকে।
৩ আগস্ট তাদের পাহারাদার জাহাজের দুরবিনে দেখা যায়, দক্ষিণ দিগন্ত থেকে একটা জাহাজ এগিয়ে আসছে। সেটা কাছে এলে ইংরেজ নাবিকেরা দেখে, সে এক বিশাল জাহাজ। অত বড় জাহাজ ইংল্যান্ডে কেউ কখনো দেখেনি। জাহাজটা ছিল স্প্যানিশ। তাতে ৩২টি কামান ছিল। প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ছিল বেশ শক্তিশালী। কিন্তু নাবিকেরা আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল না। তাদের ধারণাই ছিল না, কেউ তাদের আক্রমণ করার জন্য ওত পেতে থাকতে পারে। ইংরেজদের জাহাজগুলো অনেক ছোট ছিল বটে, কিন্তু তারা অভিযানে বেরিয়েছিল আক্রমণ করার উদ্দেশ্যেই। কামান, গোলাবারুদ ইত্যাদির পর্যাপ্ত মজুত নিয়ে তারা প্রস্তুত ছিল। স্প্যানিশ জাহাজটা আরও কাছাকাছি এলে কয়েকটা ইংরেজ জাহাজ সেটাকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে ঝটিকা আক্রমণ চালায়। অপ্রস্তুত স্প্যানিশ নাবিকেরা ইংরেজদের অতর্কিত আক্রমণের মুখে আত্মরক্ষার সুযোগ পায় না। ইংরেজরা খুব দ্রুত তাদের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করে জাহাজটার দখল নিয়ে নেয়।
সেই জাহাজের নাম ছিল মাদ্রে দে দিয়াস। সেটা ছিল ওই সময় পর্যন্ত স্পেনের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক জাহাজ। সেটি ওই পথে যাচ্ছিল আরও কয়েকটি ছোট জাহাজের সঙ্গে। ইংরেজদের হাতে আক্রান্ত হওয়ার সময় জাহাজটিতে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ মূল্যবান পণ্য ছিল।
ইংরেজরা স্প্যানিশ জাহাজটি দখল করে আধা বিধ্বস্ত অবস্থায় টেনে নিয়ে যায় ইংল্যান্ডের ডার্টমাউথ বন্দরে। দূর থেকে জাহাজটি দেখতে পেয়ে উপকূলে কৌতূহলী জনতার ভিড় জমে যায়। তারা আগে কখনো এত বড় জাহাজ ওই বন্দরে ভিড়তে দেখেনি। জাহাজটি বন্দরে ভেড়ার আগেই অনেক মানুষ নৌকায় করে গিয়ে সেটাতে লুটতরাজ চালায়। ইংরেজ নাবিকদের পক্ষে সেই গণলুটতরাজ ঠেকানো সম্ভব হয়নি। রানি এলিজাবেথ এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। কিন্তু লুটতরাজে অংশগ্রহণকারী মানুষের সংখ্যা এত বেশি ছিল যে তাদের চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। তারা লুটের মালামাল নিয়ে সটকে পড়েছিল। দলনেতা স্যার ওয়াল্টার রেলেই যখন তাঁর বাহিনী দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হন, ততক্ষণে অনেক মূল্যবান পণ্য-সম্পদ লুট হয়ে যায়। তারপরও যা অবশিষ্ট ছিল, তার পরিমাণও কম ছিল না।
মাদ্রে দে দিয়াস থেকে উদ্ধার করা পণ্য-সম্পদের মধ্যে ছিল বহুমূল্য রত্নপাথর, সোনা, রুপার মুদ্রা, ঢাকাই মসলিনসহ উন্নত মানের বস্ত্রসামগ্রী, ৪২৫ টন গোলমরিচ, ৪৫ টন লবঙ্গ, ৩৫ টন দারুচিনি, ৩ টন জায়ফল এবং ৫০ টন সুগন্ধি দ্রব্য ও অন্যান্য মসলাপাতি। সব মিলিয়ে প্রায় ৫ লাখ পাউন্ড মূল্যের সামগ্রী, যা সেই সময়ে ইংল্যান্ডের রাজকোষের অর্ধেকের সমান। অভিযানের দ্বিতীয় প্রধান নেতা জন বারো মালামালের হিসাব শেষ করে আত্মতৃপ্তির সঙ্গে লিখেছিলেন, ‘আমাদের জাতির প্রতি ঈশ্বরের অশেষ কৃপা, তিনি এই ক্রয়সামগ্রী আমাদের হস্তগত করার মধ্য দিয়ে সেসব গোপন বাণিজ্য ও ভারতীয় ধনসম্পদের অস্তিত্ব প্রকাশ্যে উন্মোচন করেছেন, যা এতকাল বিস্ময়করভাবে আমাদের অগোচরে ছিল, চাতুর্যের সঙ্গে আমাদের কাছ থেকে যা লুকিয়ে রাখা হয়েছিল।’
১ হাজার ৬০০ টন ধারণক্ষমতাসম্পন্ন স্প্যানিশ জাহাজ মাদ্রে দে দিয়াস ১৫৮৯ সালে নির্মাণ করা হয়েছিল পর্তুগালের লিসবনে। ইংরেজরা দখলে নেওয়ার আগে জাহাজটি মাত্র একবার বাণিজ্যিক পণ্য নিয়ে নির্বিঘ্নে দেশে ফিরতে পেরেছিল। দ্বিতীয় যাত্রাতেই তার জীবনাবসান ঘটে। সেই জাহাজ লুটতরাজের অভিযানে অংশ নেওয়া জাহাজগুলোর মধ্যে দুটি ছিল রানি এলিজাবেথের মালিকানাধীন। একটির নাম ছিল গারল্যান্ড, অন্যটির ফোরসাইট।
জাহাজটি লুটের পর থেকে ইংল্যান্ডের চোখে ভারত একটি লোভনীয় বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে ধরা দেয়। এই অভিযানের সঙ্গে যুক্ত বণিক ও নাইটহুড পাওয়া লোকেরা পরবর্তী সময়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গঠনের পথে এগিয়ে যান।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্ম
মাদ্রে দে দিয়াস লুটের ঘটনার দুই বছর পর ১৫৯৪ সালে জেমস ল্যাঙ্কেস্টারের বাণিজ্যবহর যখন সর্বস্ব হারিয়ে জীর্ণশীর্ণ অবস্থায় ফিরে আসে, তখন তা ইংরেজদের জন্য সত্যিই এক বেদনাদায়ক ব্যাপার ছিল।
মাদ্রে দে দিয়াস অভিযান থেকে ইংল্যান্ড আর্থিকভাবে সাময়িক লাভবান হলেও বিষয়টি মোটেও সম্মানজনক ছিল না। স্পেনের রাজা দ্বিতীয় ফিলিপ তো সেই ফ্রান্সিস ড্রেকের অভিযানের পর থেকে ইংল্যান্ডকে ক্রমাগত ‘ডাকাত’ বলে অভিহিত করে অভিযোগ করে যাচ্ছিলেন। কিন্তু রানি এলিজাবেথ এসব অভিযোগ একেবারেই আমলে নেননি।
ইংরেজদের নতুন মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছিল ক্রমবর্ধমান ওলন্দাজ বাণিজ্য। স্পেনের কবজা থেকে ১৫৭৯ সালে স্বাধীনতা লাভের পর ওলন্দাজ শক্তি স্পেনের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এশিয়ার সঙ্গে মসলাবাণিজ্য শুরু করেছিল। সেই বাণিজ্য ইংল্যান্ডের লেভান্ট কোম্পানিকে প্রতিযোগিতায় ফেলেছিল।
ওলন্দাজ বাণিজ্যের পরিমাণ ক্রমে এত বেড়ে গিয়েছিল যে একসময় দেশটির বণিকদের জাহাজের ঘাটতি দেখা দিয়েছিল। জেমস ল্যাঙ্কেস্টার ইংল্যান্ড ফেরার কয়েক বছর পর ওলন্দাজ বণিক সমিতি একটা বড় বাণিজ্যবহর পাঠানোর জন্য ইংল্যান্ডের কাছে কিছু জাহাজ ধার চেয়েছিল। ইংরেজ বণিকেরা বিরক্ত হয়ে ওলন্দাজদের বলেছিলেন, ওদের ধার দেওয়ার মতো কোনো জাহাজ তাঁদের নেই। কারণ, তাঁরা নিজেরাই এশিয়ায় একটা বড় বাণিজ্য অভিযান পাঠানোর পরিকল্পনা করছেন। আসলে সেটা ছিল মিথ্যা কথা, অক্ষমের আস্ফালন। তখন পর্যন্ত ইংরেজ বণিকদের সে রকম কোনো পরিকল্পনা ছিল না। তাঁরা ওলন্দাজদের প্রত্যাখ্যান করেছিলেন বাণিজ্যিক ঈর্ষাবশত।
তবে কিছু ইংরেজ বণিক তার কয়েক দশক আগে থেকে নিজেদের উদ্যোগে ভারতে যাওয়ার জলপথ আবিষ্কারের চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। লন্ডনের বণিকেরা ১৫৫৩ সালে মাস্কোভি নামের একটা কোম্পানি গঠন করেন, যা ছিল পৃথিবীর প্রথম জয়েন্ট স্টক কোম্পানি। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধের দুটি বাণিজ্যপথ—উত্তমাশা অন্তরীপ ও মাগেলান প্রণালি—এড়িয়ে উত্তর গোলার্ধে একটা নতুন বাণিজ্যপথ আবিষ্কার করা এবং এশীয় বাণিজ্যের নাগাল পাওয়া। উত্তর দিকের সমুদ্র কত দূর বিস্তৃত ছিল, সে সম্পর্কে কোনো ধারণা ছাড়াই উচ্চাভিলাষী কোম্পানিটি গঠন করা হয়েছিল।
কিন্তু মাস্কোভি কোম্পানির উদ্দেশ্য সফল হয়নি। ইউরোপের উত্তর দিকে কোনো সমুদ্রপথ আবিষ্কার করা যায়নি। সেই মাস্কোভি কোম্পানিই বিবর্তিত হয়ে রানি এলিজাবেথের আমলে লেভান্ট কোম্পানি নামে পরিচিতি পায়।
১৫৯৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে যখন ইংরেজ বণিকদের এশিয়ার সঙ্গে সমুদ্রবাণিজ্য চালু করার উপায় অন্বেষণের প্রাথমিক আলোচনা চলছিল, তখন ওলন্দাজদের আরও একটি বড় বাণিজ্য জাহাজের চালানের খবর আসে। সে বছরের জুলাই মাসে এশিয়া থেকে আসা সেই চালানে ৮০০ টন গোলমরিচ, ২০০ টন লবঙ্গসহ অনেক মূল্যবান বাণিজ্যিক পণ্য ছিল। ওলন্দাজদের এক চালানেই এত বিপুল মুনাফার অঙ্ক দেখে লেভান্ট কোম্পানি নিজেদের একটা বাণিজ্যবহর পাঠানোর জন্য মরিয়া হয়ে। হল্যান্ডের মতো সদ্য স্বাধীন দেশ যদি এত বিপুল বাণিজ্য করার সাহস রাখে, তাহলে ইংল্যান্ড কেন পিছিয়ে থাকবে? অতএব লেভান্ট কোম্পানি লন্ডনের বড় ব্যবসায়ীদের নিয়ে ওলন্দাজদের কায়দায় একটি বাণিজ্যিক সিন্ডিকেট গড়ে তোলার পরিকল্পনা করে। সেই পরিকল্পনা অনুসারে ১৫৯৯ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর লন্ডনের ফাউন্ডার হলে একটা সভা বসে। সেই সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন লন্ডনের মেয়র স্যার স্টিভেন সোয়ামি। তাঁর সঙ্গে ছিলেন লন্ডনের বিশিষ্ট ব্যবসায়ীরা।
সভাটি যাঁর উদ্যোগে বসেছিল, তিনি স্যার টমাস স্মিথ, লন্ডন শহরের অডিটর এবং লেভান্ট কোম্পানির মূল পরিচালক। বলা হয়েছিল, এই সভার উদ্দেশ্য ভারতের উদ্দেশে একটা সমন্বিত বাণিজ্যবহর পাঠানো। সভার প্রস্তাবের ভাষায় উদ্দেশ্যটি ছিল, ‘বাণিজ্য করার লক্ষ্যে ইস্ট ইন্ডিজ, অন্যান্য দ্বীপ ও দেশের উদ্দেশে সমুদ্রযাত্রা; তারা যেসব জিনিসপত্র, মণিরত্ন ও শিল্পপণ্য উৎপাদন করে বা কেনাবেচা করে, সেগুলো ক্রয় করা কিংবা বিনিময়-পদ্ধতিতে আহরণের মাধ্যমে বাণিজ্য পরিচালনা (যা আমাদের প্রভুর সন্তুষ্টি বিধান করবে…)।’
বিষয়টি নিয়ে সবচেয়ে বেশি ভাবিত ছিলেন অডিটর স্মিথ। তিনি কয়েক দিন আগে লন্ডনের কিছু সম্পন্ন ব্যবসায়ীকে কোম্পানি গঠনের পরিকল্পনা ব্যাখ্যা করেন এবং কোম্পানি গঠনের জন্য প্রত্যেকের কাছে ১০০ থেকে ৩,০০০ পাউন্ড পর্যন্ত চাঁদা আহ্বান করেন। প্রাথমিকভাবে ১০১ জন ব্যবসায়ী সেই আহ্বানে সাড়া দেন। তিনি দুই দিনের মধ্যে ৩০ হাজার ১৩৩ পাউন্ড চাঁদা তুলতে সক্ষম হন। যাঁরা চাঁদা দিয়েছিলেন, তাঁদের সবাই সেদিন ফাউন্ডার হলে উপস্থিত ছিলেন।
সদস্যদের সম্মতিক্রমে কোম্পানি গঠনের জন্য রানি এলিজাবেথের অনুমোদনের আবেদন করা হয়। কিন্তু সে সময় স্পেনের সঙ্গে ইংল্যান্ডের একটা শান্তি আলোচনা চলছিল। স্পেনের রাজা দ্বিতীয় ফিলিপের মৃত্যুর পর দুই দেশের সম্পর্কের উন্নতি হয়েছিল। সেই পরিস্থিতিতে ইংল্যান্ডের প্রিভি কাউন্সিল চায়নি এই ধরনের উদ্যোগের খবর স্প্যানিশদের কানে পৌঁছাক। তাই কোম্পানি গঠনের প্রস্তাব তখনকার মতো স্থগিত রাখা হয়।
কয়েক মাস পর শান্তি আলোচনা ভেস্তে গেলে লন্ডনের বণিক সমিতি আবার আশান্বিত হয়ে ওঠে। প্রথম আবেদনের এক বছর পর ১৬০০ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর প্রিভি কাউন্সিল ঘোষণা করে, রানি এলিজাবেথ বণিকদের কোম্পানি গঠনের আবেদন অনুমোদন করেছেন। তত দিনে কোম্পানি গঠনে আগ্রহী বণিকের সংখ্যা ১০১ থেকে বেড়ে ২১৮ জনে উন্নীত হয়। অবশেষে ১৬০০ সালের ৩১ ডিসেম্বর লন্ডনের বণিকদের একটি কোম্পানি গঠনের রাজকীয় সনদ স্বাক্ষরিত হয়। সেই সনদ অনুসারে গঠিত হয় ‘গভর্নর অ্যান্ড কোম্পানি অব মার্চেন্টস অব লন্ডন ট্রেডিং টু দ্য ইস্ট ইন্ডিজ’। সেটিই পরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।
কোম্পানি গঠনের সময় ২১৮ জন সদস্যের মধ্যে জন হকিন্স ও জেমস ল্যাঙ্কেস্টারের মতো উল্লেখযোগ্য কয়েকজন ছিলেন আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরে দুর্ধর্ষ জলদস্যুতার নায়ক। ১৬০১ সালে রেড ড্রাগন নামের এক জাহাজ নিয়ে কোম্পানির প্রথম অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন স্যার জেমস ল্যাঙ্কেস্টার। এর পরের ঘটনা সবার জানা। রাজকীয় অনুগ্রহ পাওয়া একদল জলদস্যু বণিকের উদ্যোগে গঠিত কোম্পানিটি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নিয়ে ভারতবর্ষসহ এশিয়ার বিশাল অংশে ২০০ বছরের উপনিবেশ কায়েম করে।
রাজকীয় সনদের একটি ধারা
সামান্য একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বিশাল এক সাম্রাজ্য দখল করে পৃথিবীতে নজিরবিহীন ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল। তাদের ক্ষমতার মূল উৎস কী ছিল? সনদে রানি এলিজাবেথ তাদের কতটুকু অধিকার দিয়েছিল? ক্ষমতার বীজ আসলে লুকিয়ে ছিল রানি এলিজাবেথের স্বাক্ষর করা রাজকীয় সনদের কয়েকটি ধারার মধ্যে। সেই ধারাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী অংশটিতে দেওয়া রাজকীয় আশ্বাসে বলা হয়:
আমরা অনুমোদন দিচ্ছি এবং ঘোষণা করছি যে উল্লিখিত কোম্পানি এশিয়া, আফ্রিকা ও আমেরিকার যেসব অঞ্চলে বাণিজ্য পরিচালনা করবে, সেখানকার যেকোনো রাজরাজড়া বা জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ও শান্তি স্থাপনের সব ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব ভোগ করবে এবং উল্লিখিত কোম্পানির সুব্যবস্থাপনা ও তাদের বাণিজ্য প্রসারের প্রয়োজনে যাবতীয় পদক্ষেপ গ্রহণের অধিকার ও কর্তৃত্ব ভোগ করবে।
এই ধারার সারকথা হলো, এই কোম্পানি যেকোনো দেশে নিজস্ব দুর্গ গড়ে বিদেশি শক্তির সঙ্গে লড়াই করার জন্য সামরিক শক্তি ব্যবহার করতে পারবে এবং বাইরের শত্রুদের যেকোনো আক্রমণের বিরুদ্ধে রানি ও তাঁর উত্তরাধিকারদের তরফে প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করা হবে।
বাইরের শত্রুদের হাত থেকে কোম্পানির নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার আশ্বাস দেওয়ার সময় প্রিভি কাউন্সিল ও রানি এলিজাবেথ হয়তো ওলন্দাজদের কথাই ভেবেছিলেন। তবে আশ্বাসটি হয়তো প্রাথমিক পর্বে নেহাত কাগুজে সুবিধা ছিল। কিন্তু শতবর্ষ পরে সনদের এই ধারার সুবিধা প্রয়োগ করে কোম্পানি তার হাত কত দূর প্রসারিত করবে, তা হয়তো রানি কল্পনাও করতে পারেননি। হয়তো কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের কল্পনায়ও তা ছিল না।
এই সনদের সুবিধা নিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দুনিয়ার সব উপনিবেশের ওপর শক্তি প্রয়োগ করেছে, নিজেদের নামে মুদ্রা প্রকাশ করেছে, দুর্গ গড়ে তুলেছে, আইনের শাসন চালু করেছে, যুদ্ধবিগ্রহ করেছে, স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি তৈরি করেছে, আদালত গড়েছে, দোষীদের সাজা দিয়েছে, প্রজাদের গ্রেপ্তার করেছে এবং দেশে দেশে ইংরেজ উপনিবেশ গড়ে তুলেছে। মোটকথা, সনদের ওই ধারার সুবাদে কোম্পানি ভারতবর্ষসহ পৃথিবীর অর্ধেকটা এলাকা শাসন করেছে।
ইতিহাসবিদ উইলিয়াম ডালরিম্পলের মতে, রাজকীয় সনদের ওই ধারার সুবিধা কাজে লাগাতে ইংরেজদের আরও দেড় শ বছর লেগে গেলেও সনদটির মধ্যে শুরু থেকেই একটা সুপ্ত সাম্রাজ্যবাদী শক্তি লুকিয়ে ছিল। সেই শক্তিই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে একটা মহিরুহে পরিণত করেছিল।
১৫৮৩ সালে রানি এলিজাবেথ যখন সামান্য বাণিজ্যের অধিকার চেয়ে পত্র মারফত সম্রাট আকবরের অনুগ্রহ প্রার্থনা করেছিলেন, তখন কল্পনাও করেননি, দেড় শ বছর পর আকবরের গোটা সাম্রাজ্য গিলে ফেলার জন্য হাত বাড়াবে তাঁর স্বাক্ষরে জন্ম নেওয়া ছোট্ট একটি কোম্পানি।