গতকাল সোমবার মারা গেছেন দুই বাংলার জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক সমরেশ মজুমদার। দীর্ঘকাল ধরে তাঁর উপন্যাসের অজস্র চরিত্র আচ্ছন্ন করে রেখেছিল বাংলার আপামর পাঠককে। কেন পাঠকের এত আপন হয়ে উঠেছিল সমরেশের চরিত্ররা?
সমরেশ মজুমদারের উপন্যাসের কথা বলতে গেলে মানুষ বাম রাজনীতির কথা বলেন। অনিমেষের গোঁড়ামি আর মাধবীলতার দৃঢ়তার কথা বলেন। জয়িতাদের বিপ্লবের কথা বলেন। তবে সব ছাপিয়ে আমার কাছে স্পষ্ট হয় টুকরো কিছু ছবি। আংরাভাসায় জল এল, জলের নিচে লাল চিংড়ির দল। চাপ চাপ কুয়াশা, বাদশাহি মেজাজে তারা ভেসে যায় খুঁটিমারীর জঙ্গলের দিকে। গাছভর্তি তীব্র লাল কৃষ্ণচূড়া, সে গাছের ডালে ঝোলানো চা–বাগানের প্রথম রেডিও স্পিকার। আদর্শবাদী দীপা-অনিমেষ-মাধবীলতাদের অবশ্য একবয়সে বড় মনে ধরেছিল। এখন তাদের সঙ্গে দশ দিগন্তের ফারাক। ইদানীং বরং হাতের মুঠোয় কুঁচো চিংড়ি ধরে রাখা অনির মুখটাই বেশি মনে পড়ে। অথবা তীব্র ব্যথায় কুঁকড়ে গিয়ে ফ্রকের কোনা চেপে রাখত যে দীপা, তাকেও।
দীপাবলির সঙ্গে যখন পরিচয়, আমার বয়সটাও তখন ঠিক দীপারই সমান। ‘সাতকাহন’-এর প্রথম পাতার দীপার কথা বলছি। যে দীপা সন্ধ্যাবেলায় মায়ের ভয়ে পা টিপে টিপে বাড়ি ফেরে, যে দীপা হঠাৎ নারীত্বের আবির্ভাবে হকচকিয়ে যায়। আমিও তখন খানিকটা হকচকানো সময়ই পার করছি। তেরো-চৌদ্দ বছর বয়সকে ‘হকচকানো সময়’ ছাড়া আর কী-ই বা বলা যায়!
দীপাবলি কি আমাকে মুগ্ধ করেছিল? বোধ হয় না। তবে আমি দীপাবলিতে তীব্রভাবে আচ্ছন্ন হয়েছিলাম। সে যখন চা–বাগানের ওপর জমে থাকা কুয়াশা দেখছে, আমি তখন ধানমন্ডির পুরোনো বাড়ির ছাদে জমে থাকা কুয়াশা দেখতে শিখেছিলাম। সত্যসাধন মাস্টার বা রমলা সেন যা কিছু দীপাকে বলেছে, তার সবটাই তো খানিকটা সচেতনে, খানিকটা অবচেতনে, আমিও প্রাণে ধারণ করেছি। দীপা মনোরমার অযৌক্তিক কথার পিঠে তর্ক করেছিল বলে আমি খুব ছোট বয়সে জেনে গিয়েছিলাম—যা আমাকে রোধ করবে, তার প্রতিরোধও আমাকেই করতে হবে। বহু বছর পর, এই যে ইদানীংকালে দীপাবলিকে আবার ফিরে দেখলাম।
এখন কেন যেন তাঁর চরিত্রের খাদগুলোই বড্ড বেশি করে চোখে পড়ে। বড় হয়ে যাওয়ার এই এক দোষ! মনটা কুটিল হয়, চোখটা জটিল হয়। আগের মতো সাদাচোখে দীপার প্রতিরোধকে আর দেখতে পাই না। তাকে বড্ড বেশি ‘আইডিয়ালিস্টিক’ মনে হয়, খানিকটা স্বার্থপরও। তাকে খানিকক্ষণ নানা রকম ফেমিনিজমের ছকেও ফেলার চেষ্টা করি। দীপা কি ‘র্যাডিকেল ফেমিনিস্ট’? লেখক কি দীপার কথা বলতে গিয়ে অন্য চরিত্রদের তেমন গভীরতা দিলেন না? নাকি দীপাকে বড় বেশি ‘গ্লোরিফাই’ করলেন? বাকি সব চরিত্রে তো কত রকম ধূসরতা আছে!
রমলা সেনের কথাই ধরুন। তাকে তো লেখক স্রেফ আদর্শবাদী নারী স্বাধীনতার প্রতীক বানিয়ে ছাড়েননি। সে আত্মবিশ্বাসী, স্বনির্ভর নারী বটে, তবে তার চরিত্রেও খামতি আছে। রমলা সেনের দুর্বলতা, হীনম্মন্যতা বরং তাকে পাঠকের কাছে আরও প্রাসঙ্গিক, আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে। এমন ধূসরতা দীপার চরিত্রে পাই না বলেই হয়তো উপন্যাসের শেষ ভাগে এসে তাকে বড্ড দূরের মনে হয়।
সে যা হোক, উপন্যাসের সমালোচনা করতে তো আসিনি। এসেছিলাম স্মৃতির কথা বলতে। যমুনার তোড়ে ভেঙে যাওয়ার আগে আমার একটা দাদাবাড়ি ছিল। সেখানে খড়ের ঘ্রাণ ছিল, আমগাছের ডালে বাঁধা দোলনা ছিল আর ছিল একটা ঘর, যাকে আমরা ‘বড় ঘর’ নামেই চিনতাম। যেবার প্রথম ‘উত্তরাধিকার’ পড়েছিলাম, সেবার অবচেতনেই সেই বড় ঘরকে কল্পনা করেছিলাম সরিৎশেখরের ঘর হিসেবে। কোনো রকম চেষ্টা-চরিত্র ছাড়াই পড়তে পড়তে স্পষ্ট দেখেছিলাম, বড় ঘরের দরজা দিয়ে সরিৎশেখর ঢুকল। আরামকেদারায় বসতে বসতে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে হাতের লাঠিটা দেয়ালে হেলান দিয়ে রাখল।
শুধু শব্দের সঙ্গে শব্দ জোড়া দিয়ে যিনি এমন স্পষ্ট ছবি সম্পূর্ণ অপরিচিত কারও মাথার ভেতর আঁকতে পারেন, তাঁকে এড়াব কী করে! এড়াতে পারিনি। এমনকি তিনি যখন বিদেশি গোয়েন্দা কাহিনির নির্লজ্জ অনুকরণ করে, নিতান্তই দুর্বল রহস্যের জাল বিছিয়ে ‘অর্জুন’ লিখেছেন, তখনো তাঁকে এড়াতে পারিনি। কারণ, জলপাইগুড়ি শহরজুড়ে যখন ঝুমবৃষ্টি আর অর্জুনের গায়ে যখন বর্ষাতি, আমার মাথার ভেতরও তখন ঘোর বর্ষণ। সেই বৃষ্টির শব্দ আমি শুনতে পাই, বৃষ্টির ঘ্রাণ মেশানো হাওয়া আমাকেও আঁকড়ে ধরে!
একেই কি ‘স্ট্রেন্থ অব স্টোরিটেলিং’ বলে? এই যে আমি কোনো দিন ডুয়ার্সে যাইনি, স্বর্গছেঁড়া চা-বাগান চোখেও দেখিনি। তবু কেন সাদার ওপর কালো ছাপা অক্ষরে চোখ বোলালেই মনে হয়, আমি আদতে দীপার বারান্দায় বসে আছি? সেই বারান্দা থেকে সন্ধ্যাবেলায় চা-বাগান দেখতে কেমন হয়, সে তো আমি এত বছরেও ভুলিনি।
এই লেখা লিখতে গিয়েও আমার নতুন করে আবার ‘সাতকাহন’ বা ‘উত্তরাধিকার’ খুলে দেখতে হয়নি। স্মৃতির ডানায় ভর করেই আমি দীপার বারান্দা থেকে স্পষ্ট দেখছি, অল্পবয়সী কামিনের দল দ্রুতপায়ে বাড়ি ফিরছে। পাশের বাড়ির বারান্দায় কেউ আলো দিয়ে গেল। বড় রাস্তা ধরে কেউ ফিরছে সাইকেল নিয়ে, খোকন নাকি? শিরীষগাছের মাথায় জমে থাকা সন্ধ্যাটা ঝুপ করে পুরো চা–বাগান ঢেকে দিল, এবার ঘরে যাব? যা অদেখা, যা অচেনা, তার এমন খুঁটিনাটিসমেত স্পষ্ট ছবি আমি কেমন করে দেখছি?
আমার যুক্তি হলো, যাঁরা খুব ভালো লেখেন, তাঁরা শব্দের সঙ্গে শব্দ গেঁথে ছবি তৈরি করতে জানেন। সেই গাঁথুনিও এত সহজ-সরল আর ঝরঝরে হয় যে পাঠক নিজের অজান্তেই পুরো ছবিটা চোখের সামনে দেখতে পান। আর ওই ছবিও এমন মায়াময় হয় যে অনায়াসে তা পাঠকের মন ও মস্তিষ্কে জায়গা করে নেয়, বহু দিনের জন্য।
এই যে আমি কোনো দিন ডুয়ার্সে যাইনি, স্বর্গছেঁড়া চা–বাগান চোখেও দেখিনি। তবু কেন সাদার ওপর কালো ছাপা অক্ষরে চোখ বোলালেই মনে হয়, আমি আদতে দীপার বারান্দায় বসে আছি? সেই বারান্দা থেকে সন্ধ্যাবেলায় চা–বাগান দেখতে কেমন হয়, সে তো আমি এত বছরেও ভুলিনি।
অনিমেষ-দীপা-মাধবীলতারা নিতান্তই কাল্পনিক চরিত্র। অথচ মাঝেমধ্যে মনে হয়, কৈশোরের খানিকটা বোধ হয় এদের সঙ্গেও কাটিয়েছি। শুধু উপন্যাস পড়েই তো ইস্তফা দিইনি। নিজে পড়েছি, বন্ধুর জন্মদিনে উপহার দিয়েছি। টিফিন পিরিয়ডে ঘাড়ের রগ ফুলিয়ে দাবি করেছি, অনিমেষ সম্পূর্ণ ঠিক, অর্কটাই যত নষ্টের গোড়া! নতুন প্রেমে পড়া প্রেমিকের সঙ্গে পরিকল্পনা করেছি, আরেকটু বড় হয়ে জলপাইগুড়িতে যাব, কেমন! তারপর জলপাইগুড়িতে হয়তো যাইনি, অনিমেষকেও হয়তো আর সঠিক মনে হয়নি। তবে স্মৃতির অনেকটাজুড়ে এরা ঠিকই রয়ে গেছে। সেই রয়ে যাওয়া এমন তীব্র যে আমার অবচেতন মন বোধ হয় বিশ্বাসই করে আঙরাভাসা আদতে তার নিজের শৈশবে হারিয়ে ফেলা নদী।
একসময় আমি প্রশ্নের তালিকা করতাম। সুনীলের সঙ্গে দেখা হলে জানতে চাইব, নবীন কুমার আসলে কে বলুন তো? কালীপ্রসন্ন সিংহের সঙ্গে তার অমন মিল কেন? হার্পার লির দেখা পেলে জিজ্ঞাসা করব, আপনারও কি একজন অ্যাটিকাস ছিল? সে–ই কি আপনাকে পড়তে শিখিয়েছিল? তেমনি এই অনি-দীপা-মাধবীলতার স্রষ্টা সমরেশ মজুমদারের জন্যও আমার কত রকম প্রশ্ন জমা, স্বর্গছেঁড়া আসলে কোথায়? আপনি কি আঙরাভাসার তীরে থাকতেন? অনিমেষ কি আপনার মতো নাকি আপনি অর্কের মতো? আপনার লেখার সঙ্গে আমি কেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার মিল পাই? আসলেও কি মিল আছে? নাকি পুরোটা আমার নিরেট মস্তিষ্কের বেখাপ্পা কল্পনা? যে বয়সে তাঁদের লেখা পড়তে শুরু করেছিলাম, সে বয়সে ধরেই নিয়েছিলাম, তাঁরা কাছের মানুষ। এখন না হোক, বড় হয়ে নিশ্চয়ই একদিন দেখা হবে। বাড়ির ড্রয়িংরুমে না হোক, হয়তো লোকের ভিড়ে, বইমেলায়, সাহিত্য উৎসবে বা অন্য কোথাও। তবে নিশ্চিত ছিলাম যে এমন আপনজনদের সঙ্গে নিশ্চয়ই দেখা হয় ও হবে।
কৈশোরে মানুষ কত অদ্ভুত কথাই তো ভাবে! এদিকে সময় ছুটছে স্রোতের মতো। লেখা পড়েই কিশোরী মন একদিন যাঁদের আপন ভেবে নিয়েছিল, একে একে তাঁরা এখন যোগ দিচ্ছেন নক্ষত্রের মিছিলে। সেই নক্ষত্র হওয়ার খবরটা এলে এই ব্যস্ত-ত্রস্ত জীবনের মধ্যে কেমন বোকার মতো থমকে যাই। যেমন গতকালও থমকে গিয়েছিলাম।
বিদায় সমরেশ মজুমদার! ভালো লেখকের সংজ্ঞা তো আমি জানি না। তবে মনের মধ্যে যিনি ছবি তৈরি করে দিতে জানেন, বিনা তর্কে তিনিই নমস্য।