আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের লেখা

হৃদয়ের পাতা ঝরতে শুরু করেছে বলে কি সব শেষ

২৫ জুলাই প্রাবন্ধিক ও বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ৮৪তম জন্মদিন। নিজের ৮০তম জন্মদিনের অনুষ্ঠানে এই অভিভাষণ দিয়েছিলেন তিনি। এখানে স্বভাবসুলভ সরস ভঙ্গিতে তিনি উন্মোচন করেছেন বার্ধক্যের সৌন্দর্য।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, ১৯ জুলাই ২০২৩
ছবি: কবির হোসেন

একটা গল্প মনে পড়ছে। গোপাল ভাঁড় একদিন মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে বললেন, ‘মহারাজ, এই যে সভাসদবৃন্দ সামনে বসে আছেন, এঁরা এ মুহূর্তে সবাই একসঙ্গে কী ভাবছেন, আমি বলে দিতে পারি।’ মহারাজ বললেন, ‘একি সম্ভব? পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষ আলাদা, তাদের মন-মানসিকতা, চিন্তাভাবনা আলাদা। তারা একই মুহূর্তে একসঙ্গে সবাই একই কথা ভাববে, একি হতে পারে?’ গোপাল বললেন, ‘আপনি আদেশ করুন, আমি দেখিয়ে দিচ্ছি।’ মহারাজ বললেন, ‘দেখাও।’ গোপাল সভাসদদের তখন ধমকে বলে উঠলেন, ‘এই যে সভাসদবৃন্দ, বলুন, আপনারা এই মুহূর্তে সবাই একসঙ্গে এ কথা ভাবছেন কি না যে মহারাজ দীর্ঘজীবী হোন?’ কার ঘাড়ে কটা মাথা যে বলবে, আমরা এ ভাবছি না। এই পর্ব শেষ হলে গোপাল আবার বললেন, ‘মহারাজ, এঁরা এই মুহূর্তে একসঙ্গে সবাই কী ভাবছেন আমি আর একবার তা বলে দিতে পারি।’ মহারাজ বললেন, ‘দেখি কেমন পারো!’ গোপাল তখন আগের মতোই হাঁক ছেড়ে বললেন, ‘এই যে সভাসদবৃন্দ, বলুন, আপনারা একসঙ্গে এই মুহূর্তে সবাই ভাবছেন কি না যে মহারাজের একটি পুত্রসন্তান হোক?’ সবাই জোরগলায় বলল, ‘এ কথাই তো ভাবছিলাম এতক্ষণ, এ কথাই তো...।’

আমার জন্মদিন, আমি সামনে, বক্তারা আমার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন, কার বুকের পাটা কতটা যে আমার প্রশংসা না করে কথা বলেন! আর এত ছাত্রও যে পড়িয়েছিলাম রে বাবা! যেদিকেই তাকাই, দেখি ছাত্রই আছে, মানুষ নেই। 

কতবার মৃত্যুর সম্ভাবনা জীবনকে যে বিপর্যস্ত করেছে! এ কেবল আমার নয়। প্রত্যেকটা মানুষই হয়তো জ্ঞাতে–অজ্ঞাতে ৩০–৪০ বার এভাবে মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে তারপর আসল মৃত্যুর দেখা পায়।
— আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ

যাহোক, একটু আগে মঞ্চে বসে উপস্থিত সুধীদের দেখে মনে মনে ভাবছিলাম, কী অদ্ভুত ব্যাপার। একজন মানুষ বুড়ো হচ্ছে, পায়ে পায়ে মৃত্যুর দিকে এগোচ্ছে, তা-ই দেখার উল্লাসে কত মানুষ এখানে একসঙ্গে জড়ো হয়ে গেছে! 

আমাদের ঘিরে জীবনে নানা সময় অনেক মানুষ আসে। আমরা যখন জন্মাই, তখন আসে, যখন বিয়ে করি তখন আসে, না এলে বেঁধে আনা হয়। বিয়ের দাওয়াত তো একটা শাঁখের করাত, ‘আসিতে–যাইতে কাটে’। দাওয়াত না দিলে পরিচিতেরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। উপেক্ষিতের গ্লানি অনুভব করেন। ‘বিয়ে করল, দাওয়াতটা পর্যন্ত দিল না! ওর বাড়িতে যদি আর গেছি!’ আবার দিলেও বলে, ‘খসালি তো টাকাগুলো। বিয়ে করে ফুর্তি করবি তোরা আর খেসারত দিতে হবে আমাদের।’ 

কবি কামাল চৌধুরী আমাকে কিছুক্ষণ আগে অশীতিপর বলেছে, বলেই পালিয়েছে। ও ভুল বলেছে। অশীতিপর হতে হলে আশি পার হতে হয়, কিন্তু আমি তো সবে আশিতে নবাগত। অশীতিপর তো হয় আশির এক বছর পর, যদি বেঁচে থাকে। কিন্তু বন্ধুগণ, ওই আশি-নব্বই আমাকে ধরতে পারবে না। তবে এ-ও মানি, আশি বছর বয়সটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীতে যে এত দিন বেঁচে থাকব, এ কোনো দিন কল্পনাও করিনি। কতবার যে কত রকম মৃত্যুর সম্ভাবনা পার হতে হয়েছে এতগুলো দিন বাঁচতে গিয়ে। 

মনে আছে, সেই ছেলেবেলায় আমার একবার টাইফয়েড হয়েছিল। আমাদের সময় অ্যান্টিবায়োটিক ছিল না। তখন যাদের টাইফয়েড হতো, তাদের হয় একটা পা, না হয় একটা চোখ, না হয় একটা কান—এ রকম একটা-না-একটা প্রত্যঙ্গ নষ্ট হয়ে যেতই। আমার টাইফয়েড চলল বিয়াল্লিশ দিন, কিন্তু আমি সেরে উঠলাম। সেরে উঠলাম কিন্তু মাত্র সাত দিনের জন্য। আবার হলো। কিন্তু আমার পা ঠিক আছে, কান ঠিক আছে, চোখও যায়নি। এই করে বেঁচে আছি এতকাল। 

একদিন সন্ধ্যায় আমি আর লেখক আবদুল মান্নান সৈয়দ রিকশায় করে পুরান ঢাকায় যাচ্ছি। আমরা দুজনই সিংহ রাশির জাতক। এ নিয়ে আমাদের দুজনের দম্ভও কম নয়। অনেক সময় অনেকে আমাকে জিগ্যেস করে, ‘কোন রাশি ভাই আপনার?’ আমি গর্বের সঙ্গে চোখ পাকিয়ে বলি, ‘কোন রাশি মনে হয়? মেষ-টেষ মনে হয় নাকি?’ ভয় পেয়ে বলে, ‘না।’ ধমক দিয়ে বলি, ‘কোন রাশি মনে হয় তাহলে।’ ভয়ে মিনমিন করে বলে, ‘সিংহ-টিংহ...?’ আমি বলি, ‘জি। এটাই।’
সামনে জলজ্যান্ত সিংহ দেখেও বুঝতে পারেন না কোন রাশি। 

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ

তো সেদিন সন্ধ্যায় আমি আর মান্নান রিকশায় করে যাচ্ছি। হঠাৎ মালবোঝাই মস্ত একটা ট্রাক মাতালের মতো টলতে টলতে আমাদের রিকশাকে প্রায় চাপা দিতে দিতে পাশ কেটে বেরিয়ে গেল। মান্নান আঁতকে উঠল, ‘এ কী হচ্ছিল! এ কী...?’ আমি বললাম, ‘মান্নান, ও বেকুবটা ওভাবে পালাল কেন জানো?’ মান্নান বলল, ‘কেন?’ আমি বললাম, ‘আসছিল আমাদের খাবার মতলবেই, কিন্তু দূর থেকে বুঝতে পারেনি যে দু-দুটো সিংহ রিকশায় বসে আছে। কাছে এসে চেহারা দেখে ‘ওরে বাপরে’ বলে হুড়মুড় করে দৌড়টা দিল কেমন দেখলে!’ তো সেদিনও তো মরতে পারতাম। 

একবার আর্মি ধরে নিয়ে গেল যুদ্ধের সময়, নারায়ণগঞ্জে। আমি ছাড়াও নানা দিক থেকে আরও সাতজনকে। ওই সাতজনের সবাইকেই গুলি করে ফেলে দিল ফতুল্লার পাশের নদীতে। বেঁচে গেলাম একমাত্র আমি। আমার একটা বই আছে—আমার উপস্থাপক জীবন। তার মধ্যে আমি এ গল্প পুরো লিখেছি। 

ছোটবেলায় কলকাতায় গেছি নানার বাড়িতে বেড়াতে, আমার বয়স তখন বছর ছয়েক। দিনকয়েক পর হঠাৎ দেখলাম, নানা আমাদের ওপর ভয়ংকর ক্রুদ্ধ। থেকে থেকে গর্জন করছেন, ‘এগুলোকে তাড়া এ বাড়ি থেকে—আজই। ওই জংলিদের এখানে রাখা যাবে না।’ নানার চেহারা প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত। তাঁর কথাগুলো আমার বুকের ভেতর গিয়ে লাগল। এইভাবে অপমান! আমি এর প্রতিশোধ নেওয়ার পথ খুঁজতে লাগলাম। শেষ পর্যন্ত একটা উপায় বেরোল। আমি একটা কাগজে লিখলাম, ‘আর কোনো দিন এই বাড়িতে আসিব না।’ লিখলাম, কিন্তু আতঙ্কে আমার শরীর ঠান্ডা হয়ে এল। নানার হাতে আমার কাগজটা যদি পড়ে যায়! এ আতঙ্কের কারণ আছে। নানা কলকাতায় থাকেন। কলকাতা মানে চিড়িয়াখানা, কলকাতা মানে আইসক্রিম, কলকাতা মানে নানা রঙের গাড়ি, সারি সারি দালান—আমাদের শৈশবের স্বর্গরাজ্য। আর আমরা থাকি প্রায় গ্রামে। কাগজটা নানার হাতে পড়ার মানে একটাই—এমন কলকাতা থেকে চিরকালের জন্য নির্বাসন, এককথায় স্বর্গ থেকে বিতাড়ন হওয়া। আতঙ্কে আমার শরীর ঠান্ডা হয়ে এল। শেষ পর্যন্ত একটা বুদ্ধি বের করলাম। কয়লার চুলা ধরানোর জন্য নানার বাড়ির একতলায় ছিল একটা চেরা কাঠের উঁচু ঢিবি। খুবই সন্তর্পণে তার একেবারে নিচে চিঠিটা ঢুকিয়ে দিলাম; যাতে অন্যায়ের প্রতিবাদও জানানো হলো অথচ নানাও কোনো দিন তার খোঁজ পাবেন না।

বড় হয়ে একবার গিয়েছিলাম সে বাড়িতে। ছাদে উঠে বুক ঠান্ডা হয়ে গেল। মনে পড়ল, তিনতলার ওই সরু কার্নিশকে গড়ের মাঠ ভেবে ওর ওপর আমি তো মনের আনন্দে এদিক-ওদিক দৌড়াতাম। নিচে রাস্তা। তিনতলা থেকে রাস্তায় পড়লে কী হতো! নিশ্চয়ই নানা আমার দৌড়ের দৃশ্যটা কোনোভাবে দেখে ফেলেছিলেন। তাই অত মধুর সম্ভাষণ। তখনো তো মরতে পারতাম। 

কতবার মৃত্যুর সম্ভাবনা জীবনকে যে বিপর্যস্ত করেছে! এ কেবল আমার নয়। প্রত্যেকটা মানুষই হয়তো জ্ঞাতে–অজ্ঞাতে ৩০–৪০ বার এভাবে মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে তারপর আসল মৃত্যুর দেখা পায়। 

মানুষ কী করে এসব নিয়ে বেঁচে থাকে পৃথিবীতে—এত বৈরিতা উতরে—খুবই আশ্চর্য ব্যাপার! প্রতিমুহূর্তে মৃত্যুর সম্ভাবনা, সবখানে বিপদের ফাঁদ। এত সব পার হয়ে আজ আমি ৮০ বছরে পা রেখেছি। একেই আমি জীবনের একটা সাফল্য মনে করি। হয়তো ৮০ বছর পার করেই এ কথা বলা উচিত, কিন্তু যদি সে সুযোগ না পাই; তাই আজকেই বলে রাখলাম। 

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ

দিন সাতেক আগে আমি লন্ডনে ছিলাম। সেখানে কিছু ছাত্রছাত্রী প্রায় জোর করে সাত দিন আগেই আমার জন্মদিন পালন করল। আমি তাদের বললাম, এত আগে যে আমার জন্মদিন পালন করলে, যদি ওই সাত দিন পর্যন্ত আমি বেঁচে না থাকি! তাহলে কিন্তু ভূত হয়ে ফিরে এসে তোমাদের ঘাড় মটকে যাব। 

৪০ বছর আর ৮০ বছর—এ দুটো বছর জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ৪০ বছর হলো জীবনের পরিণতির সূচনা। আর ৮০ বছর হচ্ছে জীবনের পরিণতির শেষ। ৮০ বছর মানে এরপর আর নতুন কিছুই হবে না। খালি পুনরাবৃত্তি, কোনো নতুনত্ব নেই। আপনারা সবাই রবীন্দ্রনাথের সেই কবিতাটা জানেন:

‘প্রথম দিনের সূর্য 

প্রশ্ন করেছিল

সত্তার নতুন আবির্ভাবে— 

কে তুমি?

মেলেনি উত্তর। 

বৎসর বৎসর চলে গেল

দিবসের শেষ সূর্য

শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল

পশ্চিম সাগর তীরে,

নিস্তব্ধ—সন্ধ্যায়

কে তুমি?

পেল না উত্তর।’

৮০ বছর হচ্ছে এই নিরর্থকতার শুরু। এর পরে মানুষের আর কিছু আছে বলে ধরা হয় না। কিন্তু আমি এটাতে বিশ্বাস করি না। এই যে জর্জ বার্নাড শ—কী দুর্ধর্ষ মানুষই না ছিলেন, তাঁর লেখার ধাক্কায় সারা পৃথিবী একদিন থরথর করেছে—৯২, না ৯৩ বছরে পৌঁছে হঠাৎ ঘোষণা দিয়ে বসলেন, তিনি কোনো দিন মরবেন না। সারা পৃথিবী ভীত হয়ে পড়ল। এমন দুর্বিনীত মানুষ বলছেন, কথাটা যদি সত্যি হয়ে যায়! পৃথিবীতে কেউ অমর হয় না, উনি হননি, কিন্তু ওই যে বিশ্বাস করে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি মরব না’, এর চেয়ে অপরাজেয় শক্তি মানুষের আর নেই। 

আমরা যে অসম্ভবে বিশ্বাস করতে পারি, একদিন আমরা তা হয়ে যাই। আমি নিৎশের লেখা পড়তে গিয়ে সেদিন দেখলাম, তিনি লিখেছেন, নৈরাশ্যবাদ দেখা দিলে বুঝতে হবে একটা ক্ষয় সেখানে কাজ করছে। সে তুলনায় আশাবাদ অনেক ওপরতলসর্বস্ব। কিন্তু ওপরতলের হলেও আমি আশাবাদীই হতে চাই। কেননা, আশাবাদ শক্তি জোগায়। আমার সঙ্গে এক বছরের একটা শিশুর কী পার্থক্য? আমিও বেঁচে আছি, সে–ও বেঁচে আছে। আমি তাই নিজেকে যেকোনো বয়সের সমবয়সী ভাবতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করি না। আবার জীবনকে ৮০ বছর না ভেবে তো পারছিও না। এ–ও তো জীবনের আরেক দিক। এর হাত থেকেও রেহাই কোথায়? 

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ

আমি মনে করি, জীবনকে আমরা যা আদেশ দিতে পারি, জীবন তা-ই নতমস্তকে মেনে নেয়। একটা কবিতা বলে আজকের কথা শেষ করি। একটা চীনা কবিতা। কবিতাটা অনুবাদ করেছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। খুবই সুন্দর অনুবাদ। কবিতাটা কবি লিখেছিলেন বার্ধক্যের নিঃস্বতা বোঝানোর জন্য। কিন্তু সেদিন পড়ে মনে হলো কবিতাটা পুরো বার্ধক্যবিরোধী একটা কবিতা। কবিতাটা এ রকম:

‘হাওয়া বয় শনশন

তারারা কাঁপে।

হৃদয়ে কি জং ধরে

পুরোনো খাপে।’

জীবন যখন বসন্ত-রঙিন হয়ে উঠেছে, আমার হৃদয়ে তখন জং-ধরা বিমর্ষতা। জং ধরেছে কোথায়? 

‘পুরোনো খাপে’—মানে এই বৃদ্ধ শরীরে।

‘কার চুল এলোমেলো,

কিবা তাতে এল গেল

কার চোখে কত জল

কী হবে মেপে।’

এবার আমার কথাটা বলি। মানছি জীবনে বার্ধক্য এসেছে। কিন্তু তাই বলে কি মেনে নিতে হবে আমার হৃদয়ও বৃদ্ধ? শুধু বুড়ো হয়েছি বলে ‘কার চুল এলোমেলো’, তাতে কি কিছুই যায়–আসে না? (তরুণদের উদ্দেশে) বলো তরুণেরা, এতে কি কিছু যায়–আসে? 

‘কার চোখে কত জল কী হবে মেপে’ বুড়ো হয়েছি বলে কি কার চোখে কত জল, সেটুকু মাপাও বন্ধ করে দিতে হবে? হৃদয়ের পাতা ঝরতে শুরু করেছে বলে কি সব শেষ?

জং-ধরা জীবনের নিঃস্বতা নিয়ে কবির সর্বশেষ কথা: 

‘জেনে কিবা প্রয়োজন

অনেক দূরের বন

রাঙা হলো কুসুমে 

না বহ্নিতাপে।’

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ

৮০ বছরের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আমি এরও প্রতিবাদ করি। বলি: বার্ধক্য এসেছে, জীবন জীর্ণ হয়েছে, তাই বলে অনেক দূরের বন ফুলে ফুলে রঙিন হলো, না আগুন লেগে রাঙা হলো, এটুকু জানার অধিকারও কি ছেড়ে দেব?

সবই যাবে কিন্তু জীবনকে যে যতটা ধরে রাখতে পারবে, জীবনকে সে ততটাই বেশি পাবে। সফল হই বিফল হই, চেষ্টা অন্তত এ ব্যাপারে থাকুক। ইকবালের একটা কবিতা থেকে তিনটি বেগবান লাইন বলে শেষ করছি:

‘দুর্বার তরঙ্গ এক বলে গেল তীর তীব্র বেগে

আমি আছি যতক্ষণ গতিমান আমি 

যখনি হারাই গতি সে মুহূর্তে আমি আর নাই।’

দেখুন, এ জন্যই পৃথিবীতে বৃদ্ধ দরকার। কিন্তু না, আপনারটাও ভাই সঠিক হয়নি। মুখে আমরা যুবক-যুবক করলেও বৃদ্ধ যে হয়েছি, তাতেও তো ভুল নেই। আমরা একজন ভুলে গেছি, একজন ভুল করেছি। মাথা থেকে বহু কিছুই ঝরে যাচ্ছে। ছেলেবেলায় শুনতাম, ৯০ বছর হলে নাকি স্বামী-স্ত্রীকে নতুন করে বিয়ে দিতে হয়; কারণ তত দিনে তারা নাকি আগের সবকিছু ভুলে যায়। সুতরাং নতুন করে বিয়ে হলে আবার নতুন করে পরিচয়, নতুন চেনাজানা, নতুন করে ‘ওগো, হ্যাঁগো’—এসব শুরু হয়। 

আমাদেরও হয়তো সবকিছু তেমনি নতুন করে শুরু হবে।

৮০ বছরে পড়েছি বলে কি ওই দুর্বার গতিও শেষ হয়েছে? আমি তো মনে করি, অন্য এক গতির জন্য এইবার সর্বশেষ যুদ্ধ। যৌবনে প্রকৃতি আমাকে যোদ্ধা বানিয়েছিল। এখন প্রকৃতি নেই, এবার আমিই নিজেই যোদ্ধা।