তাঁকে বলা হতো ট্রাকচালকদের শিল্পী। ভারতের এক লোকসংগীতশিল্পীর জীবন এবার পর্দায় তুলে এনেছেন পরিচালক ইমতিয়াজ আলি। আর ১২ এপ্রিল নেটফ্লিক্সে মুক্তি পাওয়ার পর থেকে ‘অমর সিং চামকিলা’ নামের এ ছবি নিয়ে চলছে জোর আলোচনা। ছবিটি আসলে কোন সফরের কথা বলে?
স্মৃতির বিনির্মাণ কি সম্ভব? সামষ্টিক অবচেতনের গভীরে গেঁথে থাকা স্মৃতি, যার ওপর বছরের পর বছর জমেছে—মোট হিসাবে ৩৬ বছর। ঘরোয়া জটলায়, পাড়ার আড্ডায়, কানকথায় বা ফিসফাসে ভেসে ভেসে স্মৃতি কি রূপকথা হয়ে যায়? স্মৃতি থেকে কি রূপকথা জন্ম নেয়? সম্প্রতি নেটফ্লিক্সে মুক্তি পাওয়া ‘অমর সিং চামকিলা’ ছবিতে নির্মাতা ইমতিয়াজ আলি যেন তা–ই করে দেখালেন।
অমর সিং চামকিলার আসল নাম ধানি রাম। দলিত–শিখ হওয়ায় সমাজের নানা শ্রেণির কাছে মানুষটি ‘অস্পৃশ্য’ ও ‘অগ্রহণযোগ্য’। ভারতের লুধিয়ানার ডুগরি গ্রামে দারিদ্র্য আর বঞ্চনার মধ্যে বেড়ে ওঠা এই ছেলে যে পাঞ্জাবের ‘এলভিস প্রিসলি’ হয়ে উঠবেন, সে কথা কেউ ভুলেও ভাবেননি। মার্কিন সংগীতশিল্পী এলভিস প্রিসলির মতোই শ্রোতাদের মোহাবিষ্ট করে খ্যাপাটে ভালোবাসা ও খ্যাতি পেয়েছেন অমর সিং চামকিলা। তবে শ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধ করলেও তিনি পাননি সামাজিক স্বীকৃতি; বরং জীবনের শেষ ‘অর্জন’ হিসেবে গেল শতকের আশির দশকের শেষার্ধে তাঁর কপালে জুটেছিল আততায়ীর গুলি। হ্যাঁ, এই তারকার জীবন ছিল নাটক–সিনেমার চেয়েও নাটকীয়।
পাঞ্জাবি লোকগান গাইতেন অমর সিং চামকিলা। এটি অনেকটা আমাদের এ অঞ্চলের পালাগানের মতোই—কাহিনির বাতাবরণে গাওয়া হয় কথোপকথনের ঢঙে। আর পাঞ্জাবি লোকগানের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, এটি অবশ্যই দ্বৈত কণ্ঠে যুগলবন্দী হতে হবে। বিভিন্ন পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠান কিংবা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে পয়সা নিয়ে আয়োজন করা হতো ‘আখাড়া’র। ‘আখাড়া’ মানে হলো গানের আসর। বলা ভালো, এসব আসর জমাতে জুড়ি ছিল না চামকিলার। দিনে তিনটি করেও ‘আখাড়া’ করেছেন। চামকিলাকে নিয়ে এক গবেষকের দাবি, বছরের ৩৬৫ দিনে ৩৬৬টি আখাড়া করেছেন তিনি, ভাবা যায়! প্রতিটি আসরের জন্য সেই আশির দশকেই চামকিলা নিতেন চার হাজার রুপি, বর্তমান বাজারে যা লাখো রুপির সমান। কিন্তু চামকিলার এই তুমুল জনপ্রিয়তার নেপথ্যের কারণ কী?
অন্যতম কারণ হিসেবে ধরা হয় তাঁর গানের কথাকে। কামনা–বাসনা, যৌনতা, পরকীয়া, অভিসার, মদিরা—এগুলোকে গানের বিষয়বস্তু করে তুলেছিলেন এ শিল্পী। তবে মজার বিষয় হলো, তিনি ধর্মীয় গানের দুটি রেকর্ডও বের করেছিলেন এবং তা ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। পরিসংখ্যান বলছে, পাঞ্জাবে এযাবৎকালে সবচেয়ে বেশি ক্যাসেট বিক্রি হয়েছে যে শিল্পীর, তাঁর নাম অমর সিং চামকিলা। বলা হতো যে তিনি ট্রাকচালকদের শিল্পী। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, আমেরিকা, বাহরাইন, দুবাইয়েও হাউসফুল শো করেছেন এই লোকসংগীতশিল্পী। হাজারো মানুষ মাতোয়ারা হয়ে তাঁর গান শুনেছেন, তাঁর দরদি কণ্ঠের স্পর্শ নিতে ভেঙে পড়েছেন।
চামকিলার স্থায়ী সঙ্গী ছিলেন অমরজোত কউর। চামকিলা গান লিখতেন, সুর দিতেন এবং অমরজোতের সঙ্গে মিলেঝিলে ঠিক করতেন গায়কির ঢং। জুটি বেঁধে গান গাইতে গাইতেই একসময় তাঁরা হয়ে ওঠেন জীবনসঙ্গী। ১৯৮৮ সালের ৮ মার্চ পাঞ্জাবের জলন্ধরের মেহসামপুর গ্রামে আসরে গাইতে গিয়ে চামকিলার পাশাপাশি গুলিতে ঝাঁজরা করা হয় অমরজোতকেও।
এরপর তো কাহিনি শেষ। চামকিলার লীলা ফুরোল, নটেগাছটিও মুড়োল। কিন্তু না, সেই ‘নটেগাছ’কে ‘অমর সিং চামকিলা’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে আবার যেন জীবন্ত করে তুলেছেন ইমতিয়াজ আলি। আর সেই ছবি দেখার সূত্রেই আজকের এই লেখা।
২৭ বছর বয়সী গায়ক অমর সিং চামকিলার জীবনের গল্প তুলে ধরার কাজ ইমতিয়াজ আলি হাতে তুলে নিয়েছিলেন বটে, তবে ছবিটি দেখার পর বোঝা গেল, প্রথাগতভাবে এটি কোনো ‘বায়োপিক’ বা জীবনকাহিনি নয়, এ যেন স্মৃতি ও আকাঙ্ক্ষার সম্মিলিত এক আখ্যান। চলচ্চিত্রের শুরুতেই তাই কেন্দ্রীয় দুই চরিত্র চামকিলা ও অমরজোতের মর্মান্তিক মৃত্যু দেখিয়ে দেন নির্মাতা। যেন শুরুতেই বুঝিয়ে দিতে চান যে এখানে জমজমাট ‘ক্লাইম্যাক্স’-এর অপেক্ষা করে লাভ নেই। এই মৃত্যুর অস্বস্তি বয়ে নিয়েই পুরো সিনেমা দেখতে হবে দর্শকদের। এরপর ‘আখাড়া’র ঢঙে গানে গানে হয় সূচনা পর্ব। এখানে জানিয়ে দেওয়া হয় চামকিলার পরিচয়। কিন্তু সিনেমাজুড়েই প্রেক্ষাপটে থাকে চামকিলা আর অমরজোতের গুলিবিদ্ধ লাশ। প্রথমে সে লাশ পড়ে থাকে পথের ওপর। তারপর ট্রাকের পেছনে ফেলে নিয়ে যাওয়া হয় বাড়িতে। সেখানেও ফেলে রাখা হয় রাতভর। এই যে লাশ দুটি পড়ে আছে, এই প্রেক্ষাপটে কোনো স্বজনের আহাজারি নেই, কেবল দেখা যায় ভয় আর চাপা আতঙ্কের আগ্রাসন। তারপর পুলিশের কাছে দেওয়া ভাষ্যে উঠে আসতে থাকে ধানি রামের ‘চামকিলা’ হয়ে ওঠার গল্প।
ইমতিয়াজ আলির সিনেমা মানেই একটা আকর্ষণীয় ‘সফর’ বা যাত্রা। মনে পড়ে, তাঁর ‘তামাশা’ ছবিতে লাকি আলি গেয়েছিলেন ‘সফরনামা’—
‘এই যাত্রার বয়ান
প্রশ্নের বয়ান
তোমার থেকে শুরু, তোমাতেই শেষ
যাত্রার বয়ান...’
‘জব উই মেট’, ‘রকস্টার’, ‘হাইওয়ে’ বা ‘তামাশা’—ইমতিয়াজের ছবির চরিত্রগুলো যেন মুসাফির। তাদের যাত্রা নিজেকে জানার, জীবনকে জানার এবং সমাজকে জানার। সম্পর্কের অলিগলি দিয়ে হেঁটে তারা ফেরে নিজের কাছে। প্রথা, সংস্কার, ঐতিহ্য, ইতিহাস—যুগে যুগে কাহিনিগুলো তো একই রকম। একই রকম কাহিনি বইছে গঙ্গা, যমুনা, ফোরাত বা টেমসের ধারায়। ঘুরেফিরে সেই শুভ–অশুভ আর ঠিক–বেঠিকের দ্বৈরথ। কিন্তু কে ঠিক করে কোনটা ঠিক আর কোনটাই–বা বেঠিক? সেই অধিকার কে কাকে দিয়েছে?
চামকিলার বিরুদ্ধে অশ্লীল গান গেয়ে তরুণ সমাজকে বিপথগামী করার অভিযোগ উঠেছে, গানের কথায় নারী–পুরুষের যৌন আকাঙ্ক্ষা তুলে ধরায় ব্যাপক সমালোচনা ও নিন্দার মুখে পড়তে হয়েছিল তাঁকে। তাঁকে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়েছে, গণমাধ্যমে লেখালেখি হয়েছে, পঞ্চায়েতে ডেকে সতর্ক করা হয়েছে, এমনকি ধর্মগুরুরাও তাঁকে সাবধান করেছেন। কিন্তু গণমানুষের চাওয়ারই তো জয় হয় প্রতিবার, এখানেও হয়েছে। আমজনতা চামকিলার কাছে যে গান শুনতে চেয়েছে, তিনি সে গানই শুনিয়েছেন তাদের। তাঁর গান শুনতে এত মানুষ ভিড় জমিয়েছেন যে আশপাশের বাড়ির ছাদ ভেঙে পড়েছে। কিন্তু যে শিল্পীকে মানুষ এত ভালোবাসে, তাঁকে কে মারল?
নিম্নবর্গের এই গায়কের উত্থান বর্ণপ্রথাক্লিষ্ট ভারতের অনেকের জন্যই মেনে নেওয়া কষ্টকর ছিল। আবার গানে গানে তিনি তুলে আনছিলেন প্রান্তিক মানুষের অবদমিত আকাঙ্ক্ষা ও বাসনার বয়ান। তবে ‘ট্যাবু’ ভাঙার মাধ্যমে কি সামষ্টিক অবচেতনে সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদীদের সযত্ন গড়ে তোলা ভয়ের দেয়ালেও টোকা দিতে শুরু করেছিলেন চামকিলা? তিনি কি বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন, সামাজিক মান–মর্যাদার ঠুনকো খোলস ভেঙে প্রশ্ন তোলার অধিকার সব মানুষেরই আছে?
২৭ বছর বয়সী গায়ক অমর সিং চামকিলার জীবনের গল্প তুলে ধরার কাজ ইমতিয়াজ আলি হাতে তুলে নিয়েছিলেন বটে, তবে ছবিটি দেখার পর বোঝা গেল, প্রথাগতভাবে এটি কোনো ‘বায়োপিক’ বা জীবনকাহিনি নয়, এ যেন স্মৃতি ও আকাঙ্ক্ষার সম্মিলিত এক আখ্যান। চলচ্চিত্রের শুরুতেই তাই কেন্দ্রীয় দুই চরিত্র চামকিলা ও অমরজোতের মর্মান্তিক মৃত্যু দেখিয়ে দেন নির্মাতা। যেন শুরুতেই বুঝিয়ে দিতে চান যে এখানে জমজমাট ‘ক্লাইম্যাক্স’–এর অপেক্ষা করে লাভ নেই।
খালিস্তান আন্দোলনের সেই উত্তাল সময়ে যখন ভারতজুড়ে শিখরা বৈষম্য আর আগ্রাসনের শিকার হচ্ছে, সেই আতঙ্কের মধ্যে বিনোদনের খোরাক জুগিয়ে গেছেন চামকিলা। এ বিষয়কেও ভালো চোখে দেখা হয়নি। তাহলে চামকিলা–অমরজোতকে মারল কোন আততায়ী? সংগীতজগতের প্রতিদ্বন্দ্বী? খালিস্তানবাদী চরমপন্থী? সামাজিক মান–মর্যাদার ধারক ও বাহকেরা? নাকি অমরজোতের উচ্চবর্গীয় পরিবারের সদস্যরা?
ছবিতে রূপকথার রুটির গুঁড়া অনুসরণ করে ইমতিয়াজ আলি গেছেন চামকিলার ২৭ বছরের জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে। তাঁর শৈশবের গ্রাম, মহল্লার ঝগড়া, মদ্যপ বাবার মাতলামি, গান গাওয়ার জন্য দ্বারে দ্বারে ঘোরা, নিজের পায়ে দাঁড়ানো, তারপর তো শুধু গান আর গান।
এ সিনেমায় চামকিলার ভূমিকায় দিলজিৎ দোসাঞ্জ ও অমরজোতের চরিত্রে পরিণীতি চোপড়া শুটিংয়ের সময় লাইভ গান গেয়েছেন সেই সব স্থানে, যেখানে চামকিলা–অমরজোত জুটি ‘আখাড়া’ করতেন, গান গাইতেন। এমনকি ছবির মৃত্যুদৃশ্যও চিত্রায়িত হয়েছে সেই মেহসামপুর গ্রামে, যেখানকার মাটিতে মিশে আছে চামকিলা আর অমরজোতের রক্ত।
এ আর রহমানের সংগীতায়োজন ‘অমর সিং চামকিলা’ নামের সিনেমার সমান্তরালে গড়ে তুলেছে এক সুরেলা বয়ান। লেখার শেষ পর্যায়ে আবারও পালাগানের উদাহরণ টানতে হয়। সিনেমার গানগুলো যাত্রাপালার বিবেকের মতো বয়ান শুনিয়ে যায় আমাদের, চতুর্থ দেয়াল ভেঙে বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় দর্শককে। আর এসবের মধ্য দিয়েই পরিচালক ইমতিয়াজ আলি আমাদের টেনে নিয়ে যান নিজের ভেতরের সেই সফরে, যার কোনো গন্তব্য নেই।