বলিউড অভিনেতা ইরফান খান ছিলেন অন্যদের চেয়ে আলাদা। কেন আর সবার চেয়ে পৃথক হয়ে উঠেছিলেন তিনি? তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে এই প্রশ্নের তত্ত্বতালাশ।
গতকাল ছিল ভারতীয় অভিনেতা ইরফান খানের মৃত্যুবার্ষিকী। ভারতীয় ও পশ্চিমা—দুই ধরনের সিনেমাতেই ভীষণ জনপ্রিয় হওয়া এই অভিনেতাকে নিয়ে ইন্টারনেটজুড়ে চলছে অগুনতি স্মৃতিকথন।
ইরফান কেন অন্যদের চেয়ে ব্যতিক্রম ছিলেন? ভারতীয় সিনেমার তথাকথিত হ্যান্ডসাম আর মাচো ম্যানদের ভিড়ে তিনি কেন এতটা লোকপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন?
প্রশ্নটির উত্তর খোঁজার আগে একটু ‘ধান ভানতে শিবের গীত’ গাওয়া যাক। চলুন কথা শুরু করি, বলিউডের এই অভিনেতার অভিব্যক্তিমূলক অভিনয় নিয়ে।
‘চোখ যে মনের কথা বলে’, বাংলা ভাষায় এই বাক্য রীতিমতো প্লেটোনিক প্রেমের আবেগপ্রবণ কাব্যের মতো শোনালেও একটা ক্ষেত্রে তা পুরোপুরি আপ্তবাক্য। অভিনয়।
বিশ্বে পুঁজির ধরন বদলেছে। এখন সিনেমা নির্মাণ ও দর্শক হিসেবে কোরিয়া আর জাপানের মতো এশীয় দেশের পাশাপাশি ভারতীয় উপমহাদেশের ভাগ বেড়েছে। আর এই ভাগ শুধু তথাকথিত বাণিজ্যিক সিনেমার জন্যই প্রযোজ্য তা নয়, বরং স্ট্রিমিংভিত্তিক ওয়েব সিরিজের কারণে শিক্ষিত মধ্যবিত্তশ্রেণিও এর বড় অংশ।
শেকস্পিয়ার বলতেন, ‘এই পৃথিবীটা একটা রঙ্গমঞ্চ আর আমরা সবাই অভিনেতা।’ আর যোগাযোগবিশেষজ্ঞরা বলেন, আমাদের ভাবের আদান–প্রদানের শতকরা ৯০ ভাগই নাকি নন–ভারবাল তথা শব্দহীন।
সেই যোগাযোগমাধ্যমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে চোখ। এই একটি অঙ্গ আমাদের যাবতীয় আবেগ-উচ্ছ্বাস, বিহ্বলতা, হতাশা, উদ্বেগ, কামনা, জিঘাংসাকে ফুটিয়ে তোলে।
আর সিনেমাও তো আমরা দেখি লেন্স তথা ক্যামেরার চোখ দিয়েই। ফলে, সিনেমার কোনো চরিত্র যখন অভিনয় করে, তার শরীরী ভাষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে দাঁড়ায় চোখের ব্যবহার।
অভিনয়ের ব্যাপারটাকে একদম চুলচেরা বিশ্লেষণ করে পিন পয়েন্ট করলে, তা ছিল আজীবন এই অভিনেতার চোখ। ন্যাশনাল ড্রামা স্কুলের গ্র্যাজুয়েট, অভিনেতাকে পেশা ও নেশা হিসেবে নেওয়া অতি সাধারণ চেহারার এই মানুষটা চোখের ব্যবহার করেছেন সর্বোচ্চ মুনশিয়ানায়।
ইরফানের স্মৃতিচারণায় উঠে আসছে কীভাবে তিনি বছরের পর বছর সংগ্রাম করেছেন। ভারতীয় সিনেমার ধারা অনুসারে নিজের সাধারণ চেহারা আর বেশভূষা নিয়ে করে গেছেন তথাকথিত চরিত্রাভিনেতার ভূমিকা। আরও উঠে আসছে কীভাবে তিনি একের পর এক চরিত্রে লোকপ্রিয়তা পেয়েছেন। ভারতীয় দর্শকদের অতি আপন হয়ে উঠেছেন।
চার্লি চ্যাপলিন বলতেন, ‘আমাদের আশপাশে থাকা সাধারণ মনে হওয়া মানুষগুলোর ভূমিকায় অভিনয় করাই সবচেয়ে অসাধারণ। আরও বিশেষত সেগুলো দেখে যখন মনে হবে না তা অভিনয়, বরং আমাদের নিত্যদিনেরই গল্প। ইরফানের এই গুণটা ছিল। তাঁকে মনে হতো আমাদের দৈনন্দিন জীবনেরই কেউ।
কিন্তু, ইরফানের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার আর সংগ্রাম নিয়ে এই লেখা নয়। তা নিয়ে ইন্টারনেটে বহু আলাপ পাওয়া যায়। এমনকি কিংবদন্তী অভিনেতা নাসিরুদ্দিন শাহ যে বলেন, ‘ভালো অভিনয় হচ্ছে তা–ই, যা দেখে দর্শক বলে ওঠে এ আমার দ্বারা কখনোই সম্ভব নয়, খানের অভিনয়ের সেই অবধারিত ব্যাপার নিয়েও নয়।’
নাসিরুদ্দিনের প্রসঙ্গ যখন এলই তখন আরেকটি বিষয়ের অবতারণাও করা যাক।
অভিনয়ের দারুণ মুনশিয়ানায় ভারতবর্ষ কখনোই পিছিয়ে ছিল না। কিন্তু পশ্চিমে ভারতকে সব সময় দেখা হতো ‘এক্সোটিক’ বা অদ্ভুত হিসেবে। ভারতীয় পুরুষ অভিনেতাদের এই কারণে দেখানো হতো অদ্ভুত কিংবা স্পিরিচুয়াল চরিত্র হিসেবে, প্রোটাগনিস্ট বা মূল চরিত্রে নয়। চলচ্চিত্র পরিচালকদের ক্ষেত্রেও বিষয়টি সত্য। যে কারণে সত্যজিৎও স্বীকৃতি পান বড়জোড় লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট হিসেবে, নির্দিষ্ট সিনেমায় সেরা পরিচালকের জন্য নন।
কিন্তু বিশ্বে পুঁজির ধরন বদলেছে। এখন সিনেমা নির্মাণ ও দর্শক হিসেবে কোরিয়া আর জাপানের মতো এশীয় দেশের পাশাপাশি ভারতীয় উপমহাদেশের ভাগ বেড়েছে। আর এই ভাগ শুধু তথাকথিত বাণিজ্যিক সিনেমার জন্যই প্রযোজ্য তা নয়, বরং স্ট্রিমিংভিত্তিক ওয়েব সিরিজের কারণে শিক্ষিত মধ্যবিত্তশ্রেণিও এর বড় অংশ।
ফলে, ইরফানের মতো সুদক্ষ অভিনেতা এখন আর কেবল স্ক্রিনের এক কোনায় পড়ে থাকেন না, তাঁকে ঘিরেই সিনেমা নির্মাণ হয় পশ্চিমেও।
এর মানে এই নয় যে নামের মধ্যে একটি বাড়তি ‘আর’ লাগানো এই দারুণ অভিনেতার মুনশিয়ানাতে কোনো ঘাটতি ছিল, বরং বিশ্বসেরা হওয়ার গুণাবলি ছিল বলেই তিনি সেই আসন নিতে পেরেছিলেন। বিশ্বায়নের ফলে আসা সুযোগটা পুরোপুরি কাজে লাগিয়ে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটা উদাহরণ ও রাস্তা তৈরি করে গেছেন।
ইরফানের চোখের দিকে গভীরভাবে তাকালে আমরা সেই বার্তাই পাই।