চরকিতে মুক্তি পেয়েছে মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর চলচ্চিত্র ‘সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’। এই ছবি কেন আর্দ্র করল মানুষের মন, কথাসাহিত্যিক ও চিত্রনাট্যকার শিবব্রত বর্মন খুঁজেছেন প্রশ্নটির উত্তর।
‘সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’ আমি দেখি দক্ষিণ কোরিয়ার সৈকতশহর বুসানে। সেখানে এটির প্রথম প্রদর্শনী হয়েছিল, গত অক্টোবরে, ওই শহরের বিখ্যাত হয়ে ওঠা চলচ্চিত্র উৎসবে।
আমাদের পরবর্তী ছবির আন্তর্জাতিক সহ-প্রযোজক খুঁজতে আমি তখন ওই শহরে অবস্থান করছি। সারা দিন একের পর এক বৈঠক করি দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা প্রযোজক ও পরিবেশকদের সঙ্গে। বিচিত্র মানুষজন। বিচিত্র তাঁদের কৌতূহল। দিন শেষে ক্লান্ত হয়ে হোটেলকক্ষে ফিরি। আর কোনো কোনো সন্ধ্যায় ক্লান্তি কাটিয়ে, রাত্রিকালীন পার্টির হাতছানি উপেক্ষা করে ঢুঁ মারি উৎসব প্রাঙ্গণে। এলোমেলো ছবি দেখি আর মুখ গম্ভীর করে বের হই। বড় বেশি আর্টি, বড় বেশি গল্পহীন। আমার টাইপ নয়।
একদিন দেখতে গেলাম মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’।
আমি কোনো প্রত্যাশা নিয়ে ফারুকীর নতুন ছবি দেখতে বসিনি। বরং উল্টোটা। নিজ ছবির মুখ্য চরিত্রে নির্মাতার নিজেই আবির্ভূত হওয়ার খবর আমাকে কিছু পরিমাণে সন্দিহান করে তুলেছিল যে বোধ হয় এইটুকু গিমিক ছাড়া ওতে আর কিছু নেই। এমনিতে সর্বশেষ দেখা তাঁর ‘ডুব’ সিনেমাটি তেমন মনঃপূত হয়নি আমার। ফলে প্রত্যাশা কমিয়েই ঢুকেছিলাম।
১ ঘণ্টা ২২ মিনিটের ছবি। পুরোটা সময় আমি চেয়ারের সঙ্গে লেপ্টে থাকলাম এক অদ্ভুত অভিযাত্রায়। এটা ফারুকীর এযাবৎকালের সেরা ছবি। আর এটা আমার দেখা সেরা ছবিগুলোর একটা হয়ে থাকবে চিরকাল। আমি বহুদিন পর্দার সঙ্গে এভাবে আঠার মতো লেপ্টে থাকিনি।
প্রায় থ্রিলার ছবির গতিসম্পন্ন এ ছবির কোনো দৃশ্যই আধা মিনিটের বেশি দীর্ঘ নয়। অথচ এ রকম গতিশকটে চড়ে ফারুকী যে গল্প বলছেন, সেটা খুব মামুলি এক কাহিনি। বলতে কি, এটা এতই মামুলি এক গল্প যে এ নিয়ে সিনেমা তৈরির কথা খুব কম নির্মাতার মাথাতেই আসবে। এতে নিষ্ঠুর শহরে একলা নারীর জীবনসংগ্রাম নেই, আধুনিকতার সঙ্গে একটা জনপদের সাংস্কৃতিক গোঁড়ামির দ্বন্দ্ব নেই, ধর্মীয় উন্মাদনার পেছনে বিশ্বরাজনীতির কূটচাল আবিষ্কারের দার্শনিকতা নেই কিংবা নেই নিঃসঙ্গ লেখকের অন্তর্জগৎ অনুসন্ধান। এটা ফারুকীর জীবনের একান্ত ব্যক্তিগত এক অধ্যায়ের কাহিনি। এ অতি ব্যক্তিগত সিনেমা। এতই ব্যক্তিগত যে দর্শকের মধ্যে ভয়ারিজম বা দরজার ফাঁক গলে উঁকি দেওয়ার অস্বস্তি জাগবে।
এ ছবি দম্পতি ফারুকী আর তিশার ভেতর-বাড়ির কাহিনি। এখানে ফারুকী ঘটনাচক্রে এক নির্মাতা আর তিশা ঘটনাচক্রে এক জনপ্রিয় অভিনেত্রী। তা না হলে এটা উঁচু-নিচু দরদালানের শহরে অযুত-সহস্র পরিবারের চিরকালীন কাহিনি, যে কেউ অবলীলায় ফারুকী অথবা তিশার জুতায় পা গলিয়ে দেবেন। আর পুরো কাহিনির কেন্দ্রে আছে অপত্য স্নেহ বা বাৎসল্য। তবে এ বাৎসল্য পিতৃস্নেহ হিসেবেই বেশি প্রতিভাত। অনাগত সন্তানের জন্য পিতার উদ্বেগ, সংগ্রাম আর ত্যাগ। কী ত্যাগ? সর্বস্ব? না। সর্বস্বের চেয়েও বেশি। অনেক অনেক বেশি।
এ ছবি দম্পতি ফারুকী আর তিশার ভেতর-বাড়ির কাহিনি। এখানে ফারুকী ঘটনাচক্রে এক নির্মাতা আর তিশা ঘটনাচক্রে এক জনপ্রিয় অভিনেত্রী। তা না হলে এটা উঁচু-নিচু দরদালানের শহরে অযুত-সহস্র পরিবারের চিরকালীন কাহিনি, যে কেউ অবলীলায় ফারুকী অথবা তিশার জুতায় পা গলিয়ে দেবেন।
অবাক লেগেছে, এ ছবিতে ফারুকী সিনেমার তিন অঙ্কের ধ্রুপদি কাঠামো প্রায় নিখুঁতভাবে অনুসরণ করেছেন বা করতে পেরেছেন। একটা সংকট শুরু হয়, সেটার সমাধান আরেকটা সংকটকে ডেকে আনে। কাহিনি একবার আধা চূড়ায় উঠে নেমে আসে আরেকটা বড় চূড়ায় ওঠার জন্য। মাঝামাঝি জায়গায় এসে দর্শকের মনে হবে, ছবিটা বোধ হয় দিগ্ভ্রান্ত হয়ে একেবারে অন্য দিকে চলে গেল। একটা স্নেহসুধামাখা পারিবারিক আবহের মধ্যে কোথা থেকে থ্রিলারের উপকরণ আমদানি হলো। কিন্তু কিছু দূর গিয়ে ভুল ভাঙবে। ওই স্নায়ুক্ষয়টুকু কাহিনির আরও বড় একটা বুনোনের অংশ। কোনো কিছুই অতিরিক্ত নয়।
ফারুকীর ছবির সবচেয়ে দৃষ্টিগ্রাহ্য দিক হলো তাঁর ছুরির ফলার মতো ধারালো সংলাপ। এখানেও তা আছে। ছোট ছোট, ভাঙা ভাঙা সংলাপ। তাতে অভিনেতার কথনভঙ্গি উপস্থিত। বিশেষ করে ফারুকীর কথনভঙ্গি খুব স্পষ্ট করেই হাজির। আর হাজির তাঁর লিকলিকে শরীর নিয়ে বুক চিতিয়ে হনহন করে হাঁটার ভঙ্গি।
ফারুকীর সিনেমার চরিত্রের মধ্যে অনেক লুকানো স্তর থাকে, যা তাঁদের রক্তমাংসের মানুষে পরিণত করে। তখন আর চরিত্রগুলোকে একটা বড় প্লট বাস্তবায়নের ঘুঁটি মনে হয় না। যেমন ধরা যাক তিশা (ছবিতে তিথি) স্বামীকে উদ্ধারে তাঁর এমন এক প্রভাবশালী বন্ধুর সহায়তা চান, যে বন্ধু একদা তাঁর প্রতি মুগ্ধতা বহন করতেন। আর ওই বন্ধু (ইরেশ যাকের) যখন এ নিয়ে আলাপের ছলে অপ্রত্যাশিতভাবে তিশার বাসায় এসে হাজির, তখন ওইটুকু সংক্ষিপ্ত সাক্ষাতের আগে তিশা কিছুটা সেজে নেন। এমনভাবে সাজেন যেন মৃদু লাস্য বজায় থাকে। স্বামী সমূহ সংকটে। আলাপ অতি গুরুতর। তবু মুগ্ধের চোখে পুরোনো মুগ্ধতা অটুট রাখার যত্নটুকু হারিয়ে যায় না।
কিংবা ধরা যাক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সিমেন বা বীর্যের নমুনা দিতে গিয়ে ভক্ত ডায়াগনস্টিক কর্মীর উপস্থিতিতে ফারুকীর (এখানে ফারহান) অস্বস্তি যে লোকটা তো কল্পনা করছে বাথরুমে কী প্রক্রিয়ায় বীর্যের নমুনা সংগ্রহ হচ্ছে।
এ রকম অজস্র স্তরের ইশারা ছড়িয়ে থাকে ফারুকীর ছবিতে। বরাবর।
শেষ দিকের একটা দৃশ্যের কথা না বললেই নয়। ডিপজলের বাসার দরজায় ঘণ্টা বাজিয়েছেন ফারুকী বা ফারহান। দরজা খোলার আগে পাশের বাসার একটা দরজা খুলে যায়। একটা বাচ্চা মেয়ে কৌতূহলে উঁকি দিয়ে সরে যায়। একবার চোখাচোখি হয় শুধু শিশুটার সঙ্গে। প্লটের সঙ্গে সম্পর্কহীন বাড়তি একটা দৃশ্য। কিন্তু দুই মিনিট পরে যা ঘটতে যাচ্ছে, তার ভার বহন করার জন্য ওইটুকু খুঁটি যে কী জরুরি, তা কোনো ওস্তাদ রাজমিস্ত্রির পক্ষেই আন্দাজ করা সম্ভব। চলচ্চিত্র নির্মাতার কাজটা কিছু পরিমাণে এ রকম রাজমিস্ত্রির মতোই। ভবনের কোন অংশের ভার কোন দিকে পড়বে, সেই হিসাবে পাকা হতে হয়।
ফারুকী অভিনয় কেমন করলেন? প্রথম কথা হলো, ফারুকীর ছবিতে কেউ অভিনয় করে না। ফলে ফারুকীও অভিনয় করেননি। ওই পরচুলাটুকুই তাঁর অভিনয়। আর অভিনয় ফারহান নাম গ্রহণ। এর বাইরে বাকিটুকু আমাদের চিরচেনা ফারুকী। অন্তত দুই জায়গায় তাঁর চোখে যে অসহায় একটা চাহনি আমি দেখেছি, সেটা অন্য কোনো পাকা অভিনেতাকে দিয়ে কখনোই আনা সম্ভব ছিল না। একবার বিয়েবাড়ির চিলেকোঠায় আটকে থেকে জানালার শিকে হাত দিয়ে, আরেকবার গরাদের ওপারে যখন তার কাছে অদ্ভুত এক প্রস্তাব নিয়ে তিশা হাজির হয়। এ ছবিতে ফারুকী চেয়ে উপযুক্ত কোনো অভিনেতা এখন আর কল্পনা করা সম্ভব নয়।
কথা হলো, নির্মাতার নিজের জীবনের ঘটনা, কিন্তু নাম কেন ফারুকী না হয়ে হলো ফারহান? তিশা কেন তিথি হয়ে গেল? ফারুকী এখানে ফারুকী হিসেবে হাজির হলে কী সমস্যা ছিল? আমার মতে, এটাই ঠিক আছে। দিন শেষে এটা সিনেমাই। ফারুকী একটা গল্পই বলতে বসেছেন। উপকরণ নিজের জীবন থেকে কুড়িয়েছেন বলে তাতে কোনো বাড়তি দায় বর্তায় না। আর একদিক থেকে দেখলে সব ছবিই শেষতক আত্মজৈবনিক। তা ছাড়া নির্মাতারা ছবির আনাচকানাচে নিজের জীবনের নানান টুকরো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখেন, রাখতে ভালোবাসেন।
ফারুকীর ছবির সবচেয়ে দৃষ্টিগ্রাহ্য দিক হলো তাঁর ছুরির ফলার মতো ধারালো সংলাপ। এখানেও তা আছে। ছোট ছোট, ভাঙা ভাঙা সংলাপ। তাতে অভিনেতার কথনভঙ্গি উপস্থিত। বিশেষ করে ফারুকীর কথনভঙ্গি খুব স্পষ্ট করেই হাজির। আর হাজির তাঁর লিকলিকে শরীর নিয়ে বুক চিতিয়ে হনহন করে হাঁটার ভঙ্গি।
লেখকেরা হামেশাই আত্মজীবনী লেখেন। না লিখলেও পাঠকের দিক থেকে লেখার চাপ থাকে। কেউ কেউ লেখেন আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। সে তুলনায় চলচ্চিত্র নির্মাতাদের আত্মচরিত চর্চার রেওয়াজ কম। যেটুকু আছে, বেশির ভাগই কামিং অব এজ বা শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে পা রাখার কাহিনি। গত বছরই স্পিলবার্গ তাঁর শৈশব আর ফিল্মমেকার হয়ে ওঠার বয়সের গল্প শুনিয়েছেন। ফারুকী শোনালেন তাঁর মধ্যবয়সের গল্প, যখন তিনি ক্যারিয়ারের মধ্যগগনে। সেদিক থেকে জরাঁতেও এটা বিরল।
ছবি দেখার পর থেকে একটা কথা খচখচ করছে। ছবির নামটা। এ ছবি যে কেউ দেখলেই বুঝতে পারবে এটা তিশা-ফারুকীর জীবনের গল্প। সে ক্ষেত্রে এ ছবি যে কিছু পরিমাণে আত্মজৈবনিক, সে কথাটা নামের মধ্যে জাহির না রেখে অন্য কোনো নাম রাখলে কী দাঁড়াত? সেই নামের ভার গল্পটাকে কিছুটা ভিন্ন দিকে কাত করে রাখত। একটা চতুর্থ মাত্রার দিকে। নামটা ছবিতে কিছু যোগ করেনি।