অতি সম্প্রতি তামিম ইকবালকে নিয়ে আমরা যেভাবে আবেগে ভেসেছি, তার পেছেনে কারণ কি শুধুই জাতীয় আবেগ, নাকি এর নেপথ্যে কাজ করে অন্য কোনো কিছু? বাংলার জনসংস্কৃতিতে বীরের প্রতি মানুষের ভালোবাসা আছে বলেই কি ক্রিকেট নিয়ে তাঁরা এমন উন্মাদনা দেখান?
আধুনিক যুগে যুদ্ধ হয় না। সেই জায়গাটা এখন নিয়েছে আন্তর্জাতিক খেলা। বাংলাদেশের বাস্তবতায় সেই লেখার নাম ক্রিকেট। আর এই ক্রিকেটকে কেন্দ্র করে গেল কয়েক দিন ধরে এখানকার মানুষেরা আবেগ–উত্তাপে একাকার হয়ে রয়েছেন। শুধু তো এখন নয়, অতীতেও অজস্রবার ঘটেছে এমন ঘটনা।
কিন্তু কেন এমন ঘটে? আদতে বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসা বড় বিচিত্র। তাঁরা একবার কাউকে ভালোবাসলে তাঁর প্রায় কোনো দোষই দেখতে পান না। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। ভালোবাসার মানুষের যৌক্তিক সমালোচনাকেও প্রতিবাদ করেন রীতিমতো উন্মত্ত জিঘাংসা নিয়ে। আবার দেখা যায়, একবার ভালোবাসা বন্ধ হয়ে গেলে সেখানে হাজির হয় তীব্র অভিমান। ষড়্ঋতুর এই বদ্বীপের মতো এই দেশের মানুষের আবেগও যেন পরিবর্তন হয় রীতিমতো জোয়ার–ভাটার মতো।
মহাভারতে এই অঞ্চল সম্বন্ধে তাই সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। এই অঞ্চলের আবহাওয়ার মতো এখানকার মানুষের মানসিকতাও একেবারেই অপরিবর্তনশীল। কখনো বর্ষার জলে ভিজিয়ে দেয় তো কখনো ভাদ্র মাসের ভয়াবহ উত্তাপে। বলা হয়, লাতিন আমেরিকার মানুষ নাকি তাঁদের পরিবেশের মতো সবচেয়ে আবেগপ্রবণ। সুতীব্র তাঁদের প্রকাশ। এ নিয়ে সেখানকার লেখকেরা অগণিত সাহিত্য রচনা করেছেন। সুগভীর গদ্য, তীব্র পদ্যর ছড়াছড়ি ‘ম্যাজিক রিয়েলিটি’ বা জাদুবাস্তবের সেই দুনিয়ায়। কিন্তু আমাদের বদ্বীপের ম্যাজিক রিয়েলিটি আরেকটু ভিন্ন ধরনের। এখানে যোগ হয় বর্ষাকালের ঢল, নদীর সর্বগ্রাসী মমতা আর পলিমাটি।
শুধু তাই না, এই অঞ্চলের পুঁথিপাঠের ঐতিহ্যের পাতায় পাতায় বীরদের গল্প। এই অঞ্চলের মানুষ বারবার দখলের শিকার হয়েছে। ‘সকল দেশের রানি সে যে আমার জন্মভূমি’ বলা এই অতীব উর্বর ভূমি বারবার দখলদারদের হাতে গিয়েছে। মাথা নিচু করে এই অঞ্চলের মানুষ বাধ্য হয়েছে ঔপনিবেশিকতার জালে আটকা পড়তে।
এর ফলে এ অঞ্চলে যখনই কেউ প্রতিবাদের ডাক দিয়েছেন, যখনই কেউ বিদেশিদের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছেন, তিনি হয়েছেন বীর। এই অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য নিয়ে সেই বীরকে মাটির সন্তানেরা দেবতার আসনে বসিয়েছে পরম ভালোবাসায়।
বাংলা অঞ্চলের মানুষ বীর ভালোবাসেন বলেই কি ক্রিকেট নিয়ে এমন উন্মাদনা দেখান? যেহেতু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অধুনা কিছু সাফল্যের মুখ দেখেছে বাংলাদেশ। তাই স্বভাবতই ক্রিকেটাররা দেশের মানুষের কাছে বীর হিসেবেই প্রতিভাত হয়েছেন। ক্রিকেটারদের প্রতি মানুষের এই আবেগের পেছনে জাতীয় আবেগ যে কাজ করছে তা তো বলাই বাহুল্য। ফলে ক্রিকেট এখন আমাদের জনসংস্কৃতিতেও মিশে গেছে। আর তাই এই মেঘ এই বৃষ্টির মতো কোনো ক্রিকেটারকে নিয়ে এই আমরা আকাশে তুলে উন্মাদনায় মাতি, পরক্ষণেই আবার তাকে মাটিতে নামাতেও দ্বিধা করি না।
অতি সম্প্রতি তামিম ইকবালকে নিয়ে আমরা যেভাবে আবেগে ভেসেছি, তার পেছেনে কারণ কি শুধুই জাতীয় আবেগ, নাকি এর নেপথ্যে কাজ করে অন্য কোনো কিছু?
খেলাধুলায় সমর্থন মানব চরিত্রের এক অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য। সমাজবিজ্ঞানী আর মনস্তাত্ত্বিকরা বলেন, অতি ছোটবেলাতেই খেলোয়াড়ের জার্সি, কোনো একটা বিশেষ খেলায় তাঁর নৈপুণ্য, পরিবারের কারও প্রভাবে কেউ কেউ আজীবন খেলোয়াড় বা দলের সমর্থক হয়ে পড়েন। এরপর সুখে-দুখে, জেতায়-হারায় তাঁদের পক্ষেই থাকেন।
প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী আশীষ নন্দীর দ্বারস্থ হওয়া যেতে পারে। তিনি বলেছিলেন, ক্রিকেট খেলাটা ভারতীয় উপমহাদেশে রামলীলার মেলার মতো। রাম থাকবে, রাবণ থাকবে। বীরপূজা হবে আবার বীরকে ভিলেন বানিয়ে বিসর্জন হবে। ক্রিকেট খেলায় জাতীয়তাবাদ প্রবেশের পর এই রামলীলার মাত্রা আরও ছাড়িয়ে যায়, যেন এর ওপরই নির্ভর করে জাতির সব অর্জন।
আর প্রায় সব দিকেই ব্যর্থ বিপুল জনসংখ্যা এবং আবেগের এই জাতি ক্রিকেট দিয়েই যেন সব জয় করতে চায়। ক্রিকেটের জয়েই মুছে দিতে চায় বাকি সব গ্লানি, ক্রিকেটের হারে গেল গেল রব করে।
কিন্তু আর সবের মতো ক্রিকেটারদের প্রতি ভালোবাসা আর ঘৃণাটাও সব যৌক্তিকতার বাইরে চলে যায়। ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরী বলতেন, ভারতের লোকের ইনসাফ কম মুহাব্বত বেশি আর পশ্চিমে মুহব্বত কম ইনসাফ জেয়াদা।
খেলাধুলায় সমর্থন মানব চরিত্রের এক অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য। সমাজবিজ্ঞানী আর মনস্তাত্ত্বিকরা বলেন, অতি ছোটবেলাতেই খেলোয়াড়ের জার্সি, কোনো একটা বিশেষ খেলায় তাঁর নৈপুণ্য, পরিবারের কারও প্রভাবে কেউ কেউ আজীবন খেলোয়াড় বা দলের সমর্থক হয়ে পড়েন। এরপর সুখে-দুখে, জেতায়-হারায় তাঁদের পক্ষেই থাকেন।
কিন্তু রায়চৌধুরীর ভাষায় বলতে হয়, অন্যদের চেয়ে এই অঞ্চলের মানুষের বিচারবোধটা আলাদা। তাঁরা এতটাই আবেগপ্রবণ যে হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে ফেলেন, ইনসাফের থোড়াই কেয়ার করেন। দেবতাকে সব সময় পূজার বেদিতে রাখেন যেকোনো অবস্থায়।
এর সঙ্গে আছে চোখের পানি। চোখের পানিতে এই বদ্বীপের মানুষ আবেগপ্রবণ হয়ে যায়। খুনি এরশাদ সিকদারের ফাঁসির আগে তাঁর গান শুনে অনেকেই আবেগাপ্লুত হয়ে গিয়েছিলেন।
এই জাতি সর্বনাশ হবে জেনেও অন্যের চোখের পানিতে ডুবে যায়। আর বেদিতে বসানো দেবতা হলে তো কথাই নেই। আর যদি এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে জাতীয়তাবাদী জোশ! তাহলে মাভৈঃ মাভৈঃ।
ঠিক এ কারণেই এই তল্লাটে খেলাসহ প্রায় কোনো কিছুতেই যৌক্তিক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো সেভাবে দাঁড়ায় না। প্রতিযোগিতাতেও চলে অন্ধ আবেগ। আর সেই আবেগটা হারাতে চান না বলে যেকোনো মূল্যে নিজেদের অবস্থান আঁকড়ে ধরতে চান রাজনীতিবিদ, খেলোয়াড়সহ প্রচারের আলোয় থাকা ব্যক্তিরা।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়, বয়সের অভিমান। এই অঞ্চলে বয়োবৃদ্ধদের সম্মান করা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রথা। যেকোনো পেশাতেই অভিজ্ঞতা খুব জরুরি, কিন্তু বার্ধক্য যদি অভিজ্ঞতাকে ছাপিয়ে যায়, তা বিপজ্জনক হয়ে পড়ে। কোনো কোনো তাত্ত্বিক মনে করেন, দীর্ঘদিন উপনিবেশের শাসনে থাকায় পদ আঁকড়ে ধরে রাখা আমাদের হীনম্মন্যতায় আমরা জাতিগত ভাবেই ভুগি। বহু আগের অর্জন কিংবা উপার্জন ভেঙে খাওয়ার ‘বাড়িওয়ালা’ মনোবৃত্তি আমাদের অসাড় করে দেয়।
সে এক বড় আলোচনা। তবে এ কথা বলা যায় যে পলিমাটির এই দেশে আজ যিনি দেবতার আসনে, তাঁকে বিসর্জন দিতেও সময় নেয় না আবেগপ্রবণ জনতা। এই বদ্বীপে ‘ম্যাজিক রিয়েলিটি’তে দেবতার আসন আদতেই এক বিচিত্র ঠুনকো বেদী।