জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ভাষাবিজ্ঞানী মহাম্মদ দানীউল হক মারা গেছেন গতকাল ৭ অক্টোবর, সন্ধ্যায়। তাঁকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন তাঁর ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক তারিক মনজুর।
যাঁরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে পড়েছেন, তাঁদের প্রত্যেকের দানীউল হককে নিয়ে গল্প আছে। একটা গল্প নয়, অনেক গল্প। আর যাঁরা বাংলা বিভাগে পড়েননি, কিন্তু জাহাঙ্গীরনগরে পড়েছেন, তাঁদেরও কারো কারো দানীউল হককে নিয়ে গল্প আছে। সেসব গল্প এক করলে এমন এক অধ্যাপকের অবয়ব তৈরি হয়, যিনি প্রবল কঠোর এবং অসম্ভব নিয়মানুবর্তী। আর তাই শিক্ষকদের গাড়ির পেছনে কোনো শিক্ষার্থীকে বসে থাকতে দেখলে তিনি অবলীলায় নামিয়ে দিতে পারেন। নিতান্ত প্রয়োজনে বাধ্য হয়ে যে শিক্ষার্থী শিক্ষকদের গাড়িতে ওঠেন, তিনি অচিরেই জেনে যান, এই শিক্ষকের নাম ‘দানীউল হক’। ভবিষ্যতে ওই শিক্ষার্থী বিশেষ প্রয়োজনে শিক্ষকদের গাড়িতে করে ঢাকায় যাওয়া বা ক্যাম্পাসে আসার সময়ে বুঝে নিতে চেষ্টা করেন, গাড়িতে দানীউল হক আছেন কি না!
দানীউল হক ক্লাসেও খুব কঠোর, নিয়মানুবর্তী ছিলেন। তাঁর ক্লাসে অনুপস্থিত থাকা যেত না। কোনো কারণে অনুপস্থিত থাকলে যে ‘হ্যাপা’ সামলাতে হতো, তা শিক্ষার্থীর বাকি জীবনের জন্য জ্বলজ্বলে স্মৃতি হয়ে থাকত। দানীউল হক নিজেও কখনো ক্লাস বাদ দিতেন না, এমনকি ক্লাসে আসতেও দেরি করতেন না। এক হাতে কফির মগ নিয়ে, আর অন্য হাতে হাজিরা খাতা পেতে ধরে তিনি ক্লাসে ঢুকতেন। সেই পেতে ধরা হাজিরা খাতার ওপরে থাকত একটা ডাস্টার আর রংবেরঙের চক ভরা একটা বাটি। একেক রঙের চক দিয়ে একেক ধরনের লেখা লিখতেন। ব্ল্যাকবোর্ডে তাঁর সুন্দর হস্তাক্ষর ঝকঝক করত।
মাঝে মাঝে ক্লাসে নিয়ে আসতেন বড় কোনো চার্ট কিংবা অডিও প্লেয়ার। চার্টে হয়তো থাকত তাঁর নিজ হাতে আঁকা বাগ্যন্ত্রের ছবি। সেই ছবি দেখিয়ে তিনি বুঝিয়ে দিতেন ধ্বনি উৎপাদনে বাগ্যন্ত্রের ভূমিকা। কিংবা অডিও প্লেয়ার বাজিয়ে হয়তো শোনাতেন ব্রিটিশ ধ্বনিবিজ্ঞানী ড্যানিয়েল জোন্সের কণ্ঠে কার্ডিনাল স্বরধ্বনির উচ্চারণ। রেকর্ড বাজানোর পর দানীউল হক নিজের কণ্ঠে আবার স্বরধ্বনিগুলোকে উচ্চারণ করে শোনাতেন। অনেক শিক্ষার্থী তাই দানীউল হককে আড়ালে ‘ড্যানিয়েল জোন্স’ বলতেন। নতুন শিক্ষার্থীদের সেটা আবার দানীউল হক নিজেই জানিয়ে দিতেন!
এই অধ্যাপকের ক্লাস নেওয়ার দক্ষতা ছিল অবিশ্বাস্য। তিনি ভাষাবিজ্ঞানের কঠিন আলোচনা সহজ করে বোঝাতে পারতেন। বোঝানো শেষ হওয়ার পর আবার একে-ওকে প্রশ্ন করে যাচাই করতেন। কখনও কখনও সামনে ডেকে বোর্ডে লিখতে দিতেন। এসব ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের মুখে ‘পারব না’ এ ধরনের কথা তিনি শুনতেই চাইতেন না। প্রাসঙ্গিক কিছু-না-কিছু ওই শিক্ষার্থীকে বলতেই হতো। তাই শিক্ষার্থীরা বাধ্য হয়েই ক্লাসে মনোযোগী থাকতেন।
শিক্ষকদের গাড়ির পেছনে কোনো শিক্ষার্থীকে বসে থাকতে দেখলে তিনি অবলীলায় নামিয়ে দিতে পারেন। নিতান্ত প্রয়োজনে বাধ্য হয়ে যে শিক্ষার্থী শিক্ষকদের গাড়িতে ওঠেন, তিনি অচিরেই জেনে যান, এই শিক্ষকের নাম ‘দানীউল হক’। ভবিষ্যতে ওই শিক্ষার্থী বিশেষ প্রয়োজনে শিক্ষকদের গাড়িতে করে ঢাকায় যাওয়া বা ক্যাম্পাসে আসার সময়ে বুঝে নিতে চেষ্টা করেন, গাড়িতে দানীউল হক আছেন কি না!
পরীক্ষা নেওয়ার ক্ষেত্রে দানীউল হকের নিজস্ব কিছু প্রক্রিয়া ছিল। যেমন, একটি প্রশ্নপত্রে তিনি কয়েক ধরনের ছোট ছোট প্রশ্ন রাখতেন। আর খাতা দেখে নম্বর দেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি সূক্ষ্ম মানদণ্ড অনুসরণ করতেন। দশমিকের পরে দু্ই ঘরকে বিবেচনায় নিয়ে তিনি নম্বর দিতেন ৫.৬৫, ৭.২০ কিংবা এ রকম কিছু। খাতাও দেখতেন কয়েক রঙের কালি দিয়ে। খাতার উপরে বিশেষ রঙে মন্তব্য লিখতেন, কোনো কোনো জায়গায় পেনসিল দিয়ে যথাযথ উত্তরটি লিখে দিতেন। এত পরিশ্রম তিনি কখন করতেন কিংবা কেনই বা করতেন, সেটি শিক্ষার্থীদের কাছে বরাবরই বিস্ময় হয়ে থেকেছে।
দানীউল হক ভালো শিক্ষক হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন। তাঁর ভাষাবিজ্ঞানে, বিশেষ করে ধ্বনিবিজ্ঞানে যে বিদ্যা ছিল, তা দিয়ে অনায়াসে আরো বড় বড় কাজ করতে পারতেন। কিন্তু শ্রেণিকক্ষে যতটুকু সময় দিয়েছেন, তার চেয়ে বেশি সময় তিনি অন্য কিছুতে দেননি। ১৯৭০ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময়েই হুমায়ুন আজাদ আর তিনি বাংলা বিভাগের শিক্ষক হয়ে আসেন। পরে হুমায়ুন আজাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যান। আর দানীউল হক সুযোগ পেয়েও জাহাঙ্গীরনগরে থেকে যান। তবে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে পড়িয়েছেন।
পড়ানোর সময়ে তিনি ব্যক্তিগত জীবন বা অপ্রাসঙ্গিক কোনো বিষয় নিয়ে আলাপ তুলতেন না। তাই দানীউল হক সবসময়ই শিক্ষার্থীদের কাছে ‘অচেনা’ হয়ে রয়ে গেছেন। তাঁর ‘অতি কঠিন’ রূপের আড়ালে একটা ‘অতি কোমল’ রূপও ছিল। এটা কেবল তাঁরাই জানেন, যাঁরা কোনো বিশেষ কারণে তাঁর নিবিড় সান্নিধ্যে আসতে পেরেছিলেন। নিজের কথা, এমনকি নিজের কাজের কথাও তিনি সহজে বলতেন না। খুব বিরল মুহূর্তে কোনো প্রিয় শিক্ষার্থীর কাছে হয়তো কথায় কথায় বলে ফেলেছেন, ‘তুমি হয়তো জানো না, একসময়ে আমি জাহাঙ্গীরনগর ক্যাম্পাসে ভেসপা চালাতাম!’
কথাবার্তায় তাঁর ছিল দারুণ পরিমিতিবোধ। ঘড়ি ধরে নির্দিষ্ট সময়ে তিনি বক্তৃতা শেষ করতে পারতেন। খাওয়া-দাওয়ার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন খুব সতর্ক। খাওয়ার সময় না হলে তিনি খেতেন না। বেশভুষায় তিনি ছিলেন পরিপাটি। আবহাওয়া বুঝে কাপড় পরতেন। তিনি প্রচুর সভা-সেমিনারে ভাষা বিষয়ক আলোচনায় অংশ নিয়েছেন। তবে যে কোনো অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার আগে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সে সম্পর্কে জেনে নিতেন।
দানীউল হক লেখালেখির শুরুর দিকে কিছু গল্প ও রম্যরচনা লেখেন। পরে হাওয়াই ও লসএঞ্জেলেস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাষাবিজ্ঞানে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে ফিরে এসে ভাষা বিষয়ক লেখালেখিতে মনোযোগী হন। বাংলাদেশে ভাষাবিজ্ঞানের আধুনিক ধারার প্রবক্তাদের মধ্যে তিনি একজন। তাঁর ভাষাবিজ্ঞানের বই ‘ভাষাবিজ্ঞানের কথা’ (২০০২) শিক্ষার্থীদের কাছে বহুলভাবে সমাদৃত হয়েছে। ভাষা-যোগাযোগের বিভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে লিখেছেন ‘ভাষাবিজ্ঞানের সূক্ষ্মতর প্রসঙ্গ’ (১৯৯৪)। শিশু কীভাবে ভাষা আয়ত্ত করে, এ নিয়ে লিখেছেন ‘ভাষা আয়ত্তকরণ ও শিখন: প্রাথমিক ধারণা’ (২০০৭)। ‘নির্বাচিত ভাষাবিজ্ঞান প্রবন্ধ’ (২০১১) গ্রন্থটি বিভিন্ন সময়ে লেখা ভাষাবিজ্ঞান বিষয়ক লেখার সংলকলন। এছাড়া বাংলা সাহিত্যের সাধারণ পরিচিতি ও তথ্য নিয়ে লিখেছেন দুটি বই—‘বাংলা ভাষা-সাহিত্যের উল্লেখ্য’ (২০০৬) ও ‘সাহিত্য-কথা অনুবেদন’ (২০১৩)।
পড়ানো আর লেখালেখির বাইরে দানীউল হকের একটা শখের কাজ ছিল। তিনি ফটোগ্রাফি করতে ভালোবাসতেন। খুব সম্ভব জাপানি পেনট্যাক্স কে-১০০০ মডেলের একটা ক্যামেরা ছিল তাঁর। সেটি দিয়ে তিনি বিভিন্ন আয়োজন-অনুষ্ঠানের ছবি তুলতেন। নিজের ছবি তুলতে মোটেও আগ্রহী ছিলেন না; তবে শিক্ষার্থীদের ছবি তুলতেন খুব আগ্রহ নিয়ে। অনেক শিক্ষার্থীর কাছে দানীউল হকের তোলা ছবি এখনও আছে।
নিজেকে চিরদিন আড়াল করে রাখা এই মানুষটি চির-আড়ালে চলে গেলেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি কর্মময় ছিলেন। এ কারণেই মনে হচ্ছে, তিনি হঠাৎ করে চলে গেলেন।