একটি সিনেমা নিয়ে নানা বয়সী মানুষ স্বেচ্ছায় ঘণ্টাব্যাপী আলোচনা করছেন—এ দৃশ্য আমাদের শশব্যস্ত শহরে বিরলই বলা চলে। তেমনই ঘটনা ঘটল ২৬ আগস্ট শনিবার বিকেলে বাজধানীর ইএমকে সেন্টারে। ‘মন, মেঘ, মোহ’ নামে এক আয়োজনে দেখানো হলো ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘তিতলি’ সিনেমাটি। পরে এই চলচ্চিত্র নিয়ে কথা বললেন এ প্রজন্মের তরুণেরা। সেদিন কী বলেছিলেন তাঁরা, আজ ঋতুপর্ণ ঘোষের জন্মদিনে জানা যাক সেসব।
‘সিনেমা দেখে আমি নায়কের মতো হতে চাইব। নায়িকার ঘরের দেয়ালে যে রং দেখেছি, সে রং আমার দেয়ালেও আনতে চাইব। মোট কথা, সিনেমা দেখে আমরা বেশির ভাগ সময় সিনেমার মতো হতে চাই। অথচ ঋতুপর্ণের সিনেমায় আমি প্রথম দেখলাম, আমার চারপাশ যেমন, আমার মা যেভাবে কথা বলেন, সেসব নিয়েই গল্প,’ বলছিলেন হামীম ইসলাম। হামীমের বয়স এখন একুশ। বাংলা সিনেমা তেমন নিয়মিত তাঁর দেখা হয় না। তবে ২৬ আগস্ট শনিবার ঢাকার ইএমকে সেন্টারে ‘মন, মেঘ, মোহ’ নামে এক ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন ইভেন্টে ঋতুপর্ণ ঘোষের সিনেমা ‘তিতলি’ দেখার পর এভাবেই নিজের অনুভূতি প্রকাশ করলেন তিনি। হামীমের ভাষ্যমতে, জীবনের সাধারণত্বকে উদ্যাপন করে ঋতুপর্ণ ঘোষের সিনেমা। পুরোনো ক্যালেন্ডারের পাতায়, ফুলদানিতে ফুল বদলের অভ্যস্ততায়, কিশোরীর হাতে পেপার কাটিংয়ে ঋতুপর্ণ সৌন্দর্য খুঁজে পান, যা বাংলা সিনেমায় কম দেখা যায়।
এমন নানা উপলব্ধি, ভালো লাগা ও ভালোবাসার কথাই হলো ‘মন, মেঘ, মোহ’ নামের এই ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন ইভেন্টে। ‘ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন ইভেন্ট’ কথাটি শুনতে বড় ভারী। তাই আয়োজকদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, কেন এই আয়োজন? কী এর উদ্দেশ্য? উত্তরে আয়োজক তাসনীম ইসলাম বলেন, ‘আমরা তো ঢাকায় কেবল ছুটছি আর ছুটছি। এর মধ্যেই হয়তো হলে বসে বা ল্যাপটপে একটু সিনেমা দেখছি, জ্যামে বসে দু–পাতা বই পড়ছি। কিন্তু সেসব নিয়ে একটু শান্ত হয়ে ভাবার বা কথা বলার ফুরসত আমরা এই নাগরিক জীবনে তেমন একটা পাই না। তাই সবাই মিলে একসঙ্গে বসে সিনেমা নিয়ে, সিনেমা দেখার পরের অনুভূতিটুকু নিয়ে কথা বলার উদ্দেশ্যেই এই আয়োজন।’ তাসনীমের কথা শুনতে শুনতে চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম। প্রথম সারিতে বসে আছেন এক কর্মজীবী মা, সঙ্গে তার ১০ বছর বয়সী মেয়ে। তাঁদের ঠিক পাশেই যাঁরা, তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী। পেছনের সারিতে দেখলাম, বসে আছেন কিছু সিনেমাটোগ্রাফার ও চলচ্চিত্রকর্মী। নানা বয়সের, নানা পেশার, নানা রকম মানুষ একসঙ্গে বসে সিনেমা দেখার এ রেওয়াজ তো আমাদের সিনেমা হল বা থিয়েটারেও আছে। তবু এই আয়োজন আলাদা করে চোখে পড়ল। কারণ, সিনেমা শেষ হওয়ার পর এসব মানুষ তাঁদের ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিশ্লেষণ করলেন সিনেমাটিকে। কারও কাছে মনে হলো, ‘তিতলি’ আদতে কালিদাসের ‘মেঘদূত’–এর পুনর্বয়ান বা রিটেলিং, কেউ আবার বললেন, ঋতুপর্ণ যে মেয়েদের কী ভীষণ ভালো বোঝেন, তারই সুন্দরতম প্রতিফলন এ চলচ্চিত্র। ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের শিক্ষার্থী নাহিয়ান জামাল ব্যাখ্যা করলেন সিনেমার মূল চরিত্রের পোশাকের রঙে কীভাবে মনস্তত্ত্বের ছাপ তুলে ধরা হয়েছে। অন্যদিকে আলোকচিত্রী তামজীদ চৌধুরীর আলোচনায় উঠে এল, কেমন দুর্দান্ত মুনশিয়ানায় বর্ষার দার্জিলিং উঠে এসেছে সিনেমাটিতে। বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মারওয়ার কাছে আবার ‘তিতলি’ অনন্য হয়ে ওঠার ভিন্ন কারণ আছে। তাঁর মতে, সে সময়ের অন্যান্য সিনেমার মতো এখানে নারী কেবল মা বা স্ত্রী নন। নারী চরিত্রের এখানে নিজস্ব সত্তা আছে, সেই সত্তার নিজস্ব আকাঙ্ক্ষা আছে, অতীতের মায়া আছে, আবার বর্তমানে বসবাস করা কিছু স্বপ্নও আছে।
একটি সিনেমা নিয়ে নানা বয়সী মানুষ স্বেচ্ছায় ঘণ্টাব্যাপী আলোচনা করছেন-এ দৃশ্য আমাদের শশব্যস্ত শহরে বিরলই বলা চলে। শুনতে শুনতে তাই আবারও আয়োজকদের কাছে ফিরি। জানতে চাই, এমন আয়োজন আগামীতে আরও হবে কি না! আয়োজক তাবাসসুম ইসলাম জানান, ‘আমরা খুব ছোট পরিসরে প্রথম আয়োজনটা করলাম। ধীরে ধীরে সাহিত্য, চিত্রকলা, গান—এসব নিয়েও আমরা বসতে চাই, কথা বলতে চাই। শিল্পকে উদ্যাপনের ভেতর দিয়ে আমরা এ শহরের মানুষের মধ্যে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের মধ্যে যোগাযোগটা বাড়াতে চাই।’
তাবাসসুমের আশাবাদী প্রতিশ্রুতি নিয়ে ঘরে ফিরি আমরা। ফেরার পথে ভাবি, আমাদের ব্যস্ত নাগরিক জীবনে শিল্পের আস্বাদন ও বিশ্লেষণের ফুরসত মিলুক।