গতকাল ১৩ মার্চ মারা গেছেন বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী সাদি মহম্মদ। তাঁর সঙ্গে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক ছিল গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব খ ম হারূনের। সাদি মহম্মদের অকস্মাৎ প্রয়াণের পর তিনি লিখেছেন এই লেখা।
সাদি এভাবে চলে যাবে, মেনে নেওয়া সত্যিই কষ্টকর। সে শুধু বাংলাদেশের একজন গুণী সংগীতশিল্পীই ছিল না, ছিল অসাধারণ মেধাবী একজন সংগীত পরিচালক ও সুরকার। সাদা মনের এই মানুষটির সঙ্গে আছে আমার কত কত স্মৃতি!
সাদির সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় কাশ্মীরে। এক মাসের জন্য কাশ্মীরে ১৯৭৭ সালের জুলাই মাসে আইসিসিআর সামার ক্যাম্পে আমরা অংশগ্রহণ করি। সেই ক্যাম্পে শান্তিনিকেতনের বেশ কজন বাঙালি ছাত্রের সঙ্গে পরিচয় হয়। তারা সবাই–ই ছিল সংগীত ভবনের ছাত্র। প্রথম দেখাতেই সাদি আমাকে অনেক আপন করে নেয়। এক শ বিদেশি ছাত্রছাত্রীর মাঝখানে আমরা বাঙালিরাও সেখানে একটি আলাদা সাংস্কৃতিক প্ল্যাটফর্ম দাঁড় করিয়েছিলাম, যার নেতৃত্বে ছিল সাদি মহম্মদ। মনে আছে শ্রীনগর দূরদর্শন কেন্দ্রে আমরা একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও অংশ নিয়েছিলাম।
সাদি এরপর শান্তিনিকেতনে ফিরে যায়। আমি তখন দিল্লিতে। নিয়মিত যোগাযোগ রাখত সে। তার আন্তরিক ইচ্ছায় আমি একবার ওকে দেখতে শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলাম। সেখানে পরিচয় হয় বাংলাদেশের আরও অনেকের সঙ্গে। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, শম্পা রেজা, নিঝু, তপন বৈদ্য, মৃদুল, সমীরসহ অনেকে।
১৯৮০ সালে বিটিভিতে যোগ দেওয়ার পর আমার প্রযোজিত প্রায় সব সংগীতানুষ্ঠানকে জনপ্রিয় করার পেছনে সাদি মহম্মদের ছিল এক বিশেষ ভূমিকা। অনেক নতুন নতুন শিল্পীকে সে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল আমার সঙ্গে। ‘প্রচ্ছদ’ অনুষ্ঠানে অনেক জানা–অজানা ‘হারানো দিনের গান’ পরিবেশন করে সে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে দুই বাংলায়। তার দরাজ মায়াবী কণ্ঠ সমস্ত দর্শককে আলোড়িত করত।
শান্তিনিকেতনের মায়াবী পরিবেশে আড্ডা দিয়ে দুটো দিন অত্যন্ত দ্রুত ও আনন্দের মধ্য দিয়ে কেটে যায়। তখন কি জানতাম, এই সব শিল্পীর অনেকেই আমার টেলিভিশন–জীবনকে সমৃদ্ধ করবে পরবর্তী কয়েক দশক।
বাংলাদেশে ফিরে সাদি গড়ে তুলেছিল ‘রবিরাগ’ নামে একটি সংগীত শিক্ষা কেন্দ্র। যে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কলিম শরাফীসহ অনেক বরেণ্য রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী জড়িত ছিলেন। সাদি তার মেধা ও আদর্শ দিয়ে অনেক নতুন প্রতিভাকে সংগীত ভুবনে প্রতিষ্ঠা করেছিল।
১৯৮০ সালে বিটিভিতে যোগ দেওয়ার পর আমার প্রযোজিত প্রায় সব সংগীতানুষ্ঠানকে জনপ্রিয় করার পেছনে সাদি মহম্মদের ছিল এক বিশেষ ভূমিকা। অনেক নতুন নতুন শিল্পীকে সে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল আমার সঙ্গে। ‘প্রচ্ছদ’ অনুষ্ঠানে অনেক জানা–অজানা ‘হারানো দিনের গান’ পরিবেশন করে সে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে দুই বাংলায়। তার দরাজ মায়াবী কণ্ঠ সমস্ত দর্শককে আলোড়িত করত।
সাদির বড় পরিচয় সে একজন শহীদের সন্তান। তার বাবা মহম্মদ সলিমুল্লাহকে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ মহম্মদপুরে নিজ বাসায় হত্যা করে পাকিস্তানি দালালেরা। সাদি তখন স্কুলের ছাত্র। লুকিয়ে থেকে নিজের চোখের সামনে সে তার বাবার মৃত্যুদৃশ্য দেখেছে। এই স্মৃতি তাকে সারা জীবন তাড়িত করেছে।
বিটিভিতে পঁচিশে বৈশাখ, বাইশে শ্রাবণ, ছাব্বিশে মার্চ, ষোলোই ডিসেম্বর—এই সব বিশেষ দিবসের অনুষ্ঠান হলেই আমি সাদির সঙ্গে যোগাযোগ করতাম। নতুন নতুন গানের খোঁজ পেতাম তার কাছ থেকেই। পেতাম অনেক নতুন তথ্য। ‘প্রজন্ম একাত্তর’–এর সদস্যদের নিয়ে অনেক অনুষ্ঠান আমি করেছি সাদির পরামর্শে।
১৯৯৬ সালের পর পনেরোই আগস্টকে কেন্দ্র করে নির্মাণ করেছি বেশ কিছু অনুষ্ঠান। সেই সব অনুষ্ঠানে কত যে হৃদয়স্পর্শী গানের সৃষ্টি হয়েছে সাদির অক্লান্ত প্রচেষ্টায়। একটা গানের কথা বারবার মনে পড়ে—
‘সেদিন আকাশে শ্রাবণের মেঘ ছিল
ছিল না চাঁদ,
ভোরের আকাশে সূর্যের আলো ঢেকে
তোমার রক্ত মিশে গেল সমুদ্র সমতল।
স্বপ্ন সাধনা সোনার বাংলা কী যে ভালোবাসি
চেয়েছিলে তুমি দুখী মানুষের মুখে হাসি,
সারাটা জীবন দিয়ে মরণেরে করে গেলে জয়
স্বদেশের বুক জুড়ে আজও তাই কত যে অশ্রুজল।’
এই গান আমি নির্মাণ করলেও গানটির কৃতিত্ব দিতে চাই সাদি মহম্মদকে। পিতা হারানো একজন মেধাবী সংগীতশিল্পী তার প্রাণের সব আবেগ আর হৃদয় নিংড়ানো সুর দিয়ে সৃষ্টি করেছে এই গান। যে গানের মধ্য দিয়ে সাদি বেঁচে থাকবে আমাদের মাঝে।
সাদি মহম্মদ ও শিবলী মহম্মদ—তারা দুজনেই ছিল আমার ছোট ভাইয়ের আসনে। কী এমন অভিমান ছিল সাদি তোমার? তাই বলে কি এভাবে চলে যেতে হয়!