বর্তমান দুনিয়ায় সাহিত্য, বিশেষ করে উপন্যাসের ক্ষেত্রে নতুন একটা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। একদল সমকালীন ঔপন্যাসিক দেশ–কাল ও ভূগোলের সীমানা ডিঙিয়ে বিশ্বজুড়ে তৈরি করছেন সর্বজনীন পাঠকগোষ্ঠী। কেন এমন ঘটছে?
ইংরেজিভাষী ঔপন্যাসিক জে এম কোটজে কিছুদিন ধরে অদ্ভুত এক কাণ্ড করছেন। তাঁর উপন্যাসগুলোর স্প্যানিশ অনুবাদ আগে বের করেছেন তিনি। ইংরেজি ভাষায় মূল বই প্রকাশেরও আগে।
কারণ কী? কোটজে বলেন, এই প্রক্রিয়ায় তিনি বিশ্বজুড়ে ইংরেজি ভাষার আধিপত্য খর্ব করতে চান। এদিক থেকে তাঁর নতুন উপন্যাসিকা দ্য পোল–এর কাহিনি লক্ষ করা যেতে পারে। সত্তরোর্ধ্ব এক পক্বকেশ পোলিশ পিয়ানোবাদকের সঙ্গে স্পেনদেশীয় মধ্যবয়সী এক নারীর অনুরাগ। একজন পোলিশভাষী। অপরজন হিস্পানি। বার্সেলোনায় তাঁদের পরিচয়। তারপর পত্র যোগাযোগ। এই চিঠি–চালাচালি চলছে ইংরেজিতে। এক ওপরভাসা দাপ্তরিক ‘গ্লোবাল’ ইংরেজি, যেটা যোগাযোগের অভিন্ন মাধ্যম হিসেবে এখন দুনিয়াজুড়ে সব ভাষার লোকের জবানে পরিণত হয়েছে। এই ইংরেজি চামড়া ভেদ করে মাংসে প্রবেশ করতে পারে না। এর ভেতর দিয়ে দুই অসমবয়সী ভিনদেশির হৃদয়ের উষ্ণতা বাহিত হতে চায়। কিছুটা পারে, কিছুটা পারে না। তা দুধের ওপর কেবলই সরের মতো ভেসে থাকে।
ভাষার যে একটা বিশ্বরাজনীতি আছে, সেটা দক্ষিণ আফ্রিকার সাদা চামড়ার এই লেখকের চেয়ে ভালো কে আর অনুভব করতে পারবেন?
তবে আমি এই ঔপন্যাসিকের আরেকটা দিকে নজর দিতে চাই। কিছুকাল হলো, কোটজে থাকছেন অস্ট্রেলিয়ায়। বই বের হচ্ছে আর্জেন্টিনা থেকে। তাঁর কাহিনির পাত্র–পাত্রীরা কোন দেশি হবে, আগে থেকে নিশানা করা মুশকিল। এই নোঙরহীন, অনিকেত কোটজে বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নন। তিনি নয়া জমানার এমন একসার লেখকের কাতারে দাঁড়িয়ে আছেন, যাঁরা কোন দেশে থাকেন আর কোন ভাষায় লেখেন, তা ক্রমে অধর্তব্য হয়ে পড়ছে। তাঁদের পাঠককুলের বিস্তার হন্ডুরাস থেকে হনুলুলু পর্যন্ত।
ওরহান পামুকের কথাই ধরা যাক। পামুক তুর্কি ভাষায় লেখেন বটে, কিন্তু তাঁকে এখন তুর্কি লেখক বললে সুবিচার হয় না। সালমান রুশদিকে কি ব্রিটিশ লেখক বলা যাবে? হারুকি মুরাকামি কতটা জাপানি?
কিছুদিন আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখি, বাংলাদেশের বিদ্বৎ–সমাজ হারুকি মুরাকামি ও হুমায়ূন আহমেদের তুল্যমূল্য বিচারে ভীষণ তর্কে লিপ্ত হয়েছে। এই তর্কে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে এমন পাঠক থাকা বিচিত্র নয়, যাঁরা মুরাকামির চেয়ে হুমায়ূন আহমেদ কম পড়েছেন।
সাহিত্যের ক্ষেত্রে দেশকাল ও ভাষার গণ্ডি পেরোনো নতুন কিছু নয়। গ্যেটে ১৮২৭ সালে যখন ‘weltliteratur’ বা ‘বিশ্বসাহিত্য’ কথাটা প্রথম তুলেছিলেন, তাঁর মাথায় ছিল সাহিত্যের দেশকালোত্তর এক অভিন্ন সত্তার অনুসন্ধান। কিন্তু শিগগিরই দেখা গেল, বিশ্বসাহিত্য কথাটা এমন নিরীহ গোছের কিছু নয়। এর মধ্যে নানা সমস্যা আছে। ভাষা ও সংস্কৃতির স্থানিক সীমানার বাইরে সাহিত্যের আদৌ কোনো বৈশ্বিক সত্তা সম্ভব কি না, এর মীমাংসা দুরূহ। এর সঙ্গে অনুবাদের অসম্ভাব্যতার প্রশ্নও মিশে গিয়ে জটিলতা বাড়িয়েছে। একজন ফরাসিভাষীর পক্ষে ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট পাঠ কিংবা একজন রুশভাষীর পক্ষে মাদাম বভারির পূর্ণ পাঠ কি আদৌ সম্ভব? এক সমাজের ধ্রুপদি সাহিত্যে আরেক সমাজের লোকেরা কী করে ভাগ বসাবে, এ প্রশ্নকে ধাঁধায় পরিণত করে ফেলেছেন একালের সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্ববিদেরা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে অভিজ্ঞতার স্থানিকীকরণ বরং সাহিত্যিকদের কাছে বেশি আদরণীয় হয়ে ওঠে।
কিন্তু বিশ্বসাহিত্যের অসাড়তা নিয়ে রাজনৈতিক তর্কের উল্টো পিঠে উপন্যাসের ক্ষেত্রে এক নতুন প্রবণতা যে দেখা দিয়েছে, সে ব্যাপারে চোখ বন্ধ করে রাখা মুশকিল। সমকালীন একদল ঔপন্যাসিকের উপস্থিতি আমরা লক্ষ না করে পারছি না, যাঁদের রস গ্রহণে ভাষা আর দেশকালের সীমানা কোনো বাধা হয়ে দেখা দিচ্ছে না। তাঁরা অনূদিত হচ্ছেন মূল গ্রন্থ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে। একটা সাহিত্যকর্ম ধ্রুপদি হওয়ার জন্য যে অবকাশ প্রয়োজন, তার আগেই মূলের সঙ্গে যুগপৎ ভাষান্তরিত হচ্ছেন তাঁরা।
প্রয়াত গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের শেষ উপন্যাস আনটিল অগাস্ট–এর ইংরেজি তরজমা প্রকাশিত হয় হিস্পানি ভাষায় মূল উপন্যাস প্রকাশের ছয় দিনের মাথায়। এটির প্রচার ও পাঠপ্রতিক্রিয়া যেভাবে ঘটেছে, তাতে মার্কেসকে কলম্বিয়ার হিস্পানিভাষী লেখক ভাবার অবকাশ কম। মার্কেস যেন প্রত্যেক পাঠকের পাশের শহরের বাসিন্দা।
কথা হলো, দেশকালের সীমানা ডিঙানো পাঠকগোষ্ঠীর উপস্থিতির ব্যাপারে এসব লেখক কি উদাসীন থাকেন বা থাকতে পারেন? এর কী প্রভাব পড়ছে তাঁদের লেখায়? একটা অনিবার্য প্রভাব হওয়ার কথা তাঁদের কাহিনি ও চরিত্রের স্থানিকতা বিসর্জন। তাঁদের সবার লেখায় তা ঘটছে, এমন রূঢ় সাধারণীকরণ করা যাবে না হয়তো, তবে তাঁদের কাহিনির ভরকেন্দ্র যে আগের মতো একই জায়গায় থাকছে, এমন কথাও হলফ করে বলা যাবে না। দুটি ব্যাপার তাঁদের লেখায় স্পষ্টই দেখা যায়; আর তা হলো, নানা রকম নিরীক্ষা ও জনরা রাইটিংয়ের খোলস গ্রহণ। এ দুটির আড়ালে স্থানিকতার দাগ ফিকে করার অভিপ্রায় দেখা যায় তাঁদের মধ্যে। ওরহান পামুকের সর্বশেষ উপন্যাস নাইটস অব প্লেগ–এর পটভূমি ১৯০১ সালে ওসমানি সাম্রাজ্যে পূর্ব ভূমধ্যসাগর–তীরবর্তী এক কাল্পনিক দ্বীপে ছড়িয়ে পড়া এক মহামারি। ঐতিহাসিক পটভূমি, তবে এরই মধ্যে কাঠামোটা কিছু পরিমাণে রহস্যকাহিনির খোলস নেয়।
হারুকি মুরাকামির ওয়ানকিউ এইটিফোর সহস্র পৃষ্ঠাজুড়ে জাদুবাস্তবতা, থ্রিলার আর বিজ্ঞান কল্পকাহিনির এক ধুন্ধুমার মিশ্রণ।
সালমান রুশদি গোড়া থেকেই জাদুবাস্তবতার পথ বেছে নিয়ে দেশকালহীন লেখার এক ধরণ তৈরি করেছেন। পরিণত জীবনে তিনি ঐতিহাসিক পটভূমির প্রতি আরেকটু বেশি ঝুঁকেছেন বলে মনে হতে পারে। বিশেষ করে ২০০৮ সালে এনচ্যানট্রেস অব ফ্লোরেন্স লেখার ১৫ বছর পর ২০২৩ সালে প্রায় কাছাকাছি পটভূমিতে ফিরে গেছেন তিনি ভিক্ট্রি সিটি উপন্যাসে। একটির পটভূমি ষোড়শ শতকে মোগল সম্রাট আকবরের দরবার। অপরটিতে চতুর্দশ শতকে দক্ষিণ ভারতের বিজয়নগর।
‘বিশ্বসাহিত্য’ নামক বিতর্কিত ধারণার বিপরীতে ‘বৈশ্বিক উপন্যাস’ নামে সাম্প্রতিক এই প্রবণতার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন আমেরিকান কবি ও সাহিত্য সমালোচক অ্যাডাম কার্শ তাঁর দ্য গ্লোবাল নভেল: রাইটিং দ্য ওয়ার্ল্ড ইন দ্য টোয়েন্টিফার্স্ট সেঞ্চুরি বইতে। তিনি মার্গারেট অ্যাটউড, হারুকি মুরাকামি, এলেনা ফেরান্তে, রবেরতো বোলানিও, মিশেল হুয়েলবেক প্রমুখের উপন্যাস ঘেঁটে দেখিয়েছেন, তাঁদের লেখায় বিশ্বমানবের এমন সব অভিন্ন অভিজ্ঞতার প্রকাশ ঘটে, যেগুলো সংস্কৃতির স্থানিক চৌহদ্দিতে এঁটে ওঠা কঠিন। কার্শের তর্কটি হলো, উপন্যাস যেহেতু মানুষের যাপিত জীবনের প্রকাশ ঘটায়, তাহলে সীমানা ছাপানো বিশ্বায়ন যে নতুন জীবনধারার জন্ম দিয়েছে, তার প্রতিফলন কেন উপন্যাসে পড়বে না? কথা হলো, এ রকম কোনো উপন্যাসধারা কি শনাক্ত করা সম্ভব? এদের মধ্যে অভিন্ন কোনো কাঠামো বা উপকরণ কি চিহ্নিত করা যাবে? হামিদ, ফেরান্তে আর পামুকের মধ্যে অভিন্ন কিছু কি আছে? নাকি বিশ্বময় ছড়িয়ে থাকা বহু জাতপাতে বিভক্ত পাঠককুলের এ অতুল সমাদর নিছকই দৈব?
কার্শ বলেন, বৈশ্বিক উপন্যাসের কোনো অভিন্ন ধারা বা উপকরণ শনাক্ত করা যাবে না। দেশকাল ডিঙানো মানুষের অভিজ্ঞতা মানে শুধুই শরণার্থীজীবনের বয়ান নয় বা নয় দুর্যোগ বা মহামারিতাড়িত উন্মূল মানবের অস্তিত্ববাদী সংকট। তবু অলক্ষ্যে কোথাও অনন্ত পাঠককে যুক্ত করার ব্যাপার ঘটে এসব উপন্যাসে।
দিস থিং কল্ড দ্য ওয়ার্ল্ড: দ্য কনটেমপোরারি নভেল অ্যাজ গ্লোবাল ফর্ম নামের গবেষণাগ্রন্থে দেবযানী গাঙ্গুলী আরও সুনির্দিষ্ট করে ১৯৮৯ সালের এক ভেদরেখা টেনে দিয়ে বলেছেন, ওই বছর শীতল যুদ্ধের অবসানের পর থেকে ‘বিশ্ব’ নামের এক নতুন চৈতন্য আমাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে। এ এক নতুন উদ্বেগ। অষ্টাদশ শতকে ইউরোপে উপন্যাসের জন্মই হয়েছিল পুরোনো বণিক সমাজের খোলস বদলে একটা নতুন ধনতান্ত্রিক দুনিয়ার আবির্ভাবের কালে। অনেকগুলো প্রাযুক্তিক পরিবর্তনও ঘটছিল সে সময়। তখনকার এই সব ওলট-পালটের নৈতিক অভিঘাত খোদিত হচ্ছিল উপন্যাস নামের নতুন এক শিল্পমাধ্যমের গায়ে। এখন দুনিয়াটা আরেক দফা খোলস বদলাচ্ছে। এর অভিঘাত উপন্যাসে প্রতিফলিত না হয়ে যায় না। কিংবা উপন্যাস তার খোলনলচে পাল্টে নতুন কোনো রূপ পরিগ্রহ করছে হয়তো।
মজার ব্যাপার, প্রথম যুগের আঁতুড়ঘরে ইউরোপীয় উপন্যাসের কাহিনি ছিল বৈশ্বিক। ফেরারি মানুষের অদেখা ভূখণ্ডে বিচরণ এবং বিচিত্রের অভিজ্ঞতা লাভই ছিল এসব কাহিনির কেন্দ্রে।
বৈশ্বিক উপন্যাস বলে কিছু যদি থেকে থাকে, তাহলে তার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে লেপটে আছে অনুবাদ বা ভাষান্তর। আর সেটা প্রায় ব্যতিক্রমহীনভাবে ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ। মুরাকামি বা এলেনা ফেরান্তে বা বোলানিও ইংরেজি ভাষার মধ্য দিয়ে বাহিত না হলে আলোচিত হয়ে উঠতেন না। তাঁরা প্রান্তের দিকে পড়ে থাকতেন। ফলে যে মৌলিক ভাষায় উপন্যাসগুলো লেখা হয়েছে, সেই ভাষা পরিধির দিকেই সরে থাকছে। ভাষাকে পরিধেয়র মতো ফেলে রেখে যেন এগিয়ে যাচ্ছে কাহিনি।
আমার নিজের মনে হয়, উপন্যাসের এই বৈশ্বিক প্রবণতার পেছনে বড় প্রকাশনা সংস্থাগুলোর বিশ্বায়ন ও একটির আরেকটিকে কিনে ফেলার কিছু যোগ থাকতে পারে। এসব প্রকাশনা জাতীয় সাহিত্যের বিপরীতে একধরনের আন্তর্জাতিক সাহিত্যকে উৎসাহিত করে। ফলে সেই সব লেখকই সামনের কাতারে আসতে থাকেন, যাঁদের মধ্যে অনূদিত হয়ে নির্যাস হারিয়ে ফেলার আশঙ্কা বা উপকরণ কম। ফলে বইয়ের বাণিজ্য নিজেই একধরনের ছাঁকনি হিসেবে কাজ করে সুনির্দিষ্ট কিছু প্রকরণের ডারউইনিয়ান উদ্বর্তন ঘটায়।
এভাবে দেখলে, এর উল্টো পিঠে কি জাতীয় সীমানার ভেতর উপন্যাসের অপরাপর স্থানিক প্রকরণগুলো শুকিয়ে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দিতে পারে? মনে হয়, পারে। জাপানি সাহিত্য সমালোচকেরা মুরাকামির গদ্যকে অগভীর গণ্য করেন এবং মনে করেন, তাঁর গদ্যের সরলতাই তাঁকে বাইরের বিশ্বে আদরণীয় করে তুলেছে। মুরাকামির সাফল্য জাপানের সাহিত্যধারায় একটি বহির্মুখী খাতের জন্ম যে দিচ্ছে না, কে বলতে পারে! কিংবা পামুকের খ্যাতি হয়তো তুরস্কের আরও প্রতিভাধর স্থানিক লেখকদের নিজ দেশেই দৃষ্টির আড়ালে ঠেলে দিচ্ছে।
আমাদের দেশে কোনো বৈশ্বিক ঔপন্যাসিকের অনুপস্থিতি সে ক্ষেত্রে হয়তো পুরোদস্তুর আফসোসের বিষয় নয়।