ঢাকার নিউমার্কেটের পুরোনো ছবি অবলম্বনে কোলাজ
ঢাকার নিউমার্কেটের পুরোনো ছবি অবলম্বনে কোলাজ

আমাদের স্মৃতি কেন ফেসবুক মেমোরিজ

নগর কেবল নতুন খোঁজে। নতুন রাস্তা, নতুন দালান, নতুন বাজার আর কেবলই উন্নয়ন ঘটতে থাকে। তাই অনেক ‘পুরাতন’কে মানুষের ভুলে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। আসলেই কি তাই? আমাদের স্মৃতিগুলো কি আসলেই ফেসবুক মেমোরিজ হয়ে যাচ্ছে?

‘লাইট কনফেকশনারি’ শব্দবন্ধ লিখে গুগলে সার্চ দিলে আপনি কিছু খুঁজে পাবেন না। কিন্তু আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে, নিউমার্কেটের ১ নম্বর গেট দিয়ে ঢুকে হাতের বাঁ দিকে এগোলে দুই দোকানের সমান আয়তন নিয়ে ছিল বড় দোকানটি। কাচের বাক্সে রাখা থাকত কেক। সেসব কেকের ওপর দেওয়া থাকত চিনির মিহি প্রলেপ, যাকে ‘সুগার আইসিং’ বলে, এমনটা পরে জেনেছি। কিছু কেকের ভেতরে থাকত ক্রিমের ঘূর্ণি, ‘সুইস রোল কেক’ বলে তাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমরা নিউমার্কেটে ঘুরতে যেতাম আর এক পিস কেক দুই বন্ধু ভাগাভাগি করে খেতাম।

আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের পালা শেষ হওয়ার আগেই দোকানটা বন্ধ হয়ে যায়। এমন অনেক দোকানই এখন আর নেই। আমার স্মৃতি থেকেও দোকানটা ধীরে ধীরে ‘নাই’ হওয়ার পথে। ইদানীং নিউমার্কেটে গেলে অলিম্পিয়া পার হয়ে দোকানটা কখনো ছিল, এমন মনেও পড়ে না। ১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠিত জিনাত বুক স্টোরও বন্ধ হয়ে গেছে। বেইলি রোডের সাগর পাবলিশার্সও বন্ধ। ঢাকা শহরের অলিগলি–রাস্তা থেকে এমন অনেক কিছুই মুছে যাচ্ছে আমাদের অগোচরেই, হয়তো আমাদের স্মৃতি থেকেও।

পুরান ঢাকার বাংলাবাজার এলাকায় চৌরাস্তার কোনায় ছোট্ট একটি দোকান আছে—নিউ ক্যাফে কর্নার। সেখানে ৭০ বছর ধরে বিক্রি হচ্ছে মাটন কাটলেট। সেই দোকানের এক কর্মচারীকে একবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কত বছর এখানে কাজ করছেন? তিনি হেসে বললেন, ‘৩০ বছর তো হইল।’ দশকের পর দশক ধরে তাঁরা কেবল একটি খাবারের পদ নন, স্মৃতি আর ইতিহাসও পরিবেশন করে চলেন নতুন নতুন প্রজন্মের পাতে। শৈশবের ঠোঙা হাতে আমরা পথ হাঁটি। কিন্তু সে পথ ক্রমে বদলাতে থাকে আর ঠোঙা গড়িয়ে যায়।

নিউমার্কেটের ঠেলাগাড়ির চালকেরা, ১৯৬৫

‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’–এ টি এস এলিয়ট লিখেছিলেন, ‘এই টুকরাগুলো জমিয়েছি আমার ধ্বংসস্তূপের বিপরীতে…’।  নগর কেবল নতুন খোঁজে। নতুন রাস্তা, নতুন দালান, নতুন বাজার আর কেবলই উন্নয়ন ঘটতে থাকে। তাই অনেক ‘পুরাতন’কে মানুষের ভুলে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।

‘কমিউনিস্ট পার্টি অব ক্যামপোচিয়া’ ১৯৭৫ সালের ১৭ এপ্রিল কম্বোডিয়ায় ‘ইয়ার জিরো’ বা ‘শূন্য বছর’ ঘোষণা করে। খেমের রুজ বাহিনী কম্বোডিয়ার রাজধানীর পানম পেন দখলের পরপরই এই শূন্য বছর ঘোষিত হয়। তারা তখন বলতে চেয়েছিল, একটি সমাজের ভেতরে অস্তিত্বশীল সব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করতে হবে এবং একটি নতুন বিপ্লবী সংস্কৃতি সে শূন্যস্থান পূরণ করবে। অর্থাৎ শূন্য বছরের আগে যেকোনো জনগোষ্ঠীর ইতিহাস ও সংস্কৃতি পুরোপুরি অপ্রাসঙ্গিক বিবেচিত হবে এবং তা বর্জন করতে হবে। একটি শ্রেণিহীন প্রাক্‌–শিল্পসমাজ গড়ে তোলার চেষ্টায় খেমের রুজ সে সময় কম্বোডিয়ার মানুষের স্মৃতি মুছে ফেলার চেষ্টা করেছিল। শূন্য বছরের আগের কোনো জ্ঞান বা শিক্ষা যেন নথিবদ্ধ অবস্থায় না থাকে, সে জন্য পোড়ানো হতে থাকে বই। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে কম্বোডিয়া পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এমনকি বাতিল করা হয় মুদ্রা ব্যবস্থাও। নাগরিকদের শ্রমশিবিরে পাঠানো হয়। এই শুদ্ধীকরণ প্রক্রিয়ায় ১৫ থেকে ২০ লাখ মানুষের প্রাণ যায়।

পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় এই শূন্য বছর বারবার ঘটতে থাকে। উন্নয়ন আর অগ্রগতির সংস্কৃতি নতুন নতুন সমাজকে গ্রাস করে, ঘোষণা করে শূন্য বছর। দীর্ঘদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা জীর্ণ ছাপাখানার জায়গায় গ্যারেজ হয়ে যায়। লাইব্রেরি সরিয়ে বসে দোকান। নানা ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হয়ে থাকা দালান ভেঙে হয় অ্যাপার্টমেন্ট ভবন। আর এভাবেই আমরা ঐতিহ্যহীন এক ক্রেতাসমাজ হিসেবে আরও পোক্ত হতে থাকি। আর আমাদের স্মৃতি হয়ে থাকে কেবল ফেসবুক মেমোরিজ এবং তা দেখায় এক বছর আগে আমরা কী করেছি।
ঢাকার নিউমার্কেট, ১৯৬৫

পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় এই শূন্য বছর বারবার ঘটতে থাকে। উন্নয়ন আর অগ্রগতির সংস্কৃতি নতুন নতুন সমাজকে গ্রাস করে, ঘোষণা করে শূন্য বছর। দীর্ঘদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা জীর্ণ ছাপাখানার জায়গায় গ্যারেজ হয়ে যায়। লাইব্রেরি সরিয়ে বসে দোকান। নানা ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হয়ে থাকা দালান ভেঙে হয় অ্যাপার্টমেন্ট ভবন। আর এভাবেই আমরা ঐতিহ্যহীন এক ক্রেতাসমাজ হিসেবে আরও পোক্ত হতে থাকি। আর আমাদের স্মৃতি হয়ে থাকে কেবল ফেসবুক মেমোরিজ এবং তা দেখায় এক বছর আগে আমরা কী করেছি।