কবি মাকিদ হায়দার
কবি মাকিদ হায়দার

যাঁর সঙ্গেই মিশেছেন, তাঁকেই আপন করে নিয়েছেন

আজ ১০ জুলাই সকালবেলা মারা গেছেন সত্তর দশকের অন্যতম কবি মাকিদ হায়দার। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা। এই কবিকে আগামীকাল পাবনায় তাঁর মা-বাবার কবরের পাশে দাফন করা হবে।

মাকিদ হায়দার, কবি এবং আপাদমস্তক কবি। কবির জীবনে তারুণ্য খেলা না করলে তিনি বৃদ্ধ হয়ে পড়েন, শব্দে ও চিন্তায়ও। দীর্ঘ সময় কবিতায় পথচলা বেশ কঠিন ও একপেশে হয় যায়, যদি কবি শব্দে ও চিন্তায় নতুনত্বের সন্ধান না দিতে পারেন। মাকিদ হায়দার অফুরন্ত তারুণ্যে ভরপুর জীবন যাপন করেছেন। এমন তারুণ্যভরা প্রাণের খুব কম দেখা মেলে। তাই কাব্য করে বলা যায়, আমাদের এই মেঘাচ্ছন্ন প্রতিবেশে মাকিদ হায়দার রোদে ভেজা এক শুভ্র প্রাণ; মূলত যাপিত জীবনে হাস্যোজ্জ্বল এ কবি পারিপার্শ্বকে দারুণভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছেন। তরুণ লেখক-শিল্পীরা মাকিদ হায়দারের কবিতা ও ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হননি, এমনটা প্রায় বিরল। যাঁর সঙ্গেই তিনি কথা বলেছেন, মিশেছেন, তাঁকেই আপন করে নিয়েছেন। তাঁকেই তাঁর সদা হাস্য প্রাণে আপ্লুত করতে পেরেছেন।

আমাদের সেই হাস্যোজ্জ্বল কবি আজ ‘নেই’ হয়ে গেলেন, পাড়ি দিলেন অসীমে।

মাকিদ হায়দার

তাঁর সঙ্গে কত যে স্মৃতি! স্মৃতিগুলো একটার পর একটা মনে পড়ছে ঘুম থেকে উঠে তাঁর মৃত্যুসংবাদ শোনার পর থেকে। তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় লেখালেখি সূত্রেই, তাঁকে ডাকতাম ‘মাকিদ ভাই’ বলে। তো, মাকিদ ভাইকে নিয়ে পারিবারিক একটি ঘটনার কথা স্মরণে আসছে। একদিন মধ্যরাতে আমার স্ত্রী উমা বণিক ‘উত্তরাধিকার’ পত্রিকা উল্টেপাল্টে দেখছিল। সেখানে ছাপা হওয়া মাকিদ ভাইয়ের একটা কবিতা পড়ে হঠাৎ সে আমাকে বলে উঠল, ‘এই মাকিদ হায়দারের মতো কবিতা লিখতে পারো না?’
এরপর সে আমাকে পড়তে দিল কবিতাটি। বুঝলাম, এত সরল শব্দে কবিতার যে অটুট গাঁথুনি, সেটা করবার মেধা, যোগ্যতা ও কবিত্ব আমার নেই!

মাকিদ হায়দার এভাবেই সাধারণ পাঠকের মনে আসন নিয়েছেন। মাকিদ হায়দারের কবিতায় কেমনভাবে সারল্য খেলা করে? ‘অদূরের নাগরদোলায়’ কবিতার একটি চরণ থেকে তার দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক:
‘কেন যে সম্মতি দিলাম তার প্রস্তাবে
যেতে হবে সাথে নিয়ে তাকে
দেখবেন তিনি
চৈত্রসংক্রান্তির মেলা।
গিয়ে দেখি শহরের সব লোকজন
উঠে বসে আছে
নাগরদোলায়।’

মাকিদ হায়দার

তাঁর কবিতা যেন দেখা থেকে লেখা। জীবনের নানা ঘটনা ও অভিজ্ঞতা কবিতায় খুব সাধারণভাবে ধরে রাখতে পারেন তিনি। আঁকতে পারেন দৃশ্য। ফলে তাঁর কাব্য-শব্দভাষ্যে পারিপার্শ্ব হয়ে ওঠে প্রকট আর জীবন্ত। এমন জীবনঘনিষ্ঠ শব্দশর খুব কম কবির পক্ষেই ব্যবহার করা সম্ভব। দারুণ সব সাধারণ শব্দচয়নে তিনি গড়ে তুলেছেন শব্দসৌধ, শিল্পঋদ্ধ কবিতার বহর, যা একান্তই তাঁর নিজের। বোধ করি, সহজ সারল্যে শিল্পকে ধারণ করতে পারার সক্ষমতাই তাঁর কবিতাকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করে তুলেছে।

মাকিদ ভাইয়ের সঙ্গে আরেকটি স্মৃতির কথা বলি। বগুড়া লেখক চক্রের কবিসম্মেলনে তাঁর সঙ্গে বগুড়ায় একবার দেখা হলো ২০১৮ সালে। এই সংগঠন সে বছর আমাকে কবিতায় পুরস্কার দেয়। মাকিদ হায়দার যে আমার কবিতা পড়েছেন, তা টের পেলাম তাঁর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে! বিশেষত ১৯৯৯ সালে বেরোনো আমার কাব্যগ্রন্থ ‘অবচেতন মনে আগুনের ছোঁয়া’ পাণ্ডুলিপির যে বিচারক তিনিই ছিলেন, ২০ বছর পর তাঁর মঞ্চের বক্তৃতায় জানতে পারলাম তথ্যটি।

মাকিদ হায়দারের তারুণ্য স্পর্শ করেনি, এমন তরুণ লেখক পাওয়া যাবে খুব কম। তরুণদের তিনি ‘তুই’ করে সম্বোধন তো করতেনই, উপরন্তু প্রথম পরিচয়েই আপন করে নেওয়ার দারুণ ক্ষমতা ছিল তাঁর। এই কবির মধ্যে কোনো ভণিতা ছিল না, মানুষকে ভালোবেসে আলিঙ্গন করার সৎ সাহস ছিল তাঁর সব সময়। কত গল্পই তো আছে তাঁকে নিয়ে, গল্প-আড্ডায় মজে যাওয়া এক মজলিশি মানুষ ছিলেন মাকিদ ভাই। এ ভুবনে এমন মানুষের দেখা মেলা ভার।

মাকিদ হায়দারের তারুণ্য স্পর্শ করেনি, এমন তরুণ লেখক পাওয়া যাবে খুব কম। তরুণদের তিনি ‘তুই’ করে সম্বোধন তো করতেনই, উপরন্তু প্রথম পরিচয়েই আপন করে নেওয়ার দারুণ ক্ষমতা ছিল তাঁর। এই কবির মধ্যে কোনো ভণিতা ছিল না, মানুষকে ভালোবেসে আলিঙ্গন করার সৎ সাহস ছিল তাঁর সব সময়। কত গল্পই তো আছে তাঁকে নিয়ে, গল্প-আড্ডায় মজে যাওয়া এক মজলিশি মানুষ ছিলেন মাকিদ ভাই। এ ভুবনে এমন মানুষের দেখা মেলা ভার।

তিনি ছিলেন তর্কবিতর্কহীন নিপাট এক সাধারণ মানুষ, কিন্তু কবিতার শব্দে দারুণ শক্তিশালী। মাকিদ হায়দার যতটা সহজ শব্দে সাধারণ পাঠকের বুকে বিঁধে রয়েছেন, ততটা নিশানাসিদ্ধ হয়ে ওঠা প্রায় অসাধ্য। এই কবির শারীরিক অন্তিমযাত্রার বিপরীতে তাঁর শিল্প অভিক্ষেপ অনেক বেশি অনন্ত ও অনিঃশেষ। যেখানেই থাকেন, ভালো থাকবেন, মাকিদ ভাই।