অবিভক্ত বাংলার অবিসংবাদিত নেতা আবুল কাশেম ফজলুল হক তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং দূরদর্শিতার জন্য ছিলেন সুপরিচিতি। তিনি ছিলেন অবিভক্ত বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী। সর্বভারতীয় রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক।
১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রহিত হয়ে গেল। ব্রিটিশের এই হীন বিশ্বাসঘাতকতা স্যার সলিমুল্লাহর প্রাণে শেলসম বিদ্ধ হলো। তিনি এমন ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে দরবার পরিত্যাগ করে চলে এলেন এবং উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের শত অনুরোধ সত্ত্বেও দিল্লি ত্যাগ করে বাংলায় ফিরে এলেন। বজ্রাহত বিরাট বটতরু অথবা তালতরুর মতো স্যার সলিমুল্লাহ জীবন্মৃত অবস্থায় অন্তিমের অপেক্ষা করছিলেন।
স্যার সলিমুল্লাহর একমাত্র চিন্তা হলো, তাঁর তিরোধানের পর মুসলিম বাংলার কান্ডারিবিহীন তরণির হাল কে ধরবে? কিন্তু ১৯১১ সালেই যখন দুর্ধর্ষ ফজলুল হক ব্রিটিশের অন্যায়ের প্রতিবাদে চাকরির মাথায় পদাঘাত করে হাইকোর্টে ওকালতি শুরু করার বাসনা প্রকাশ করলেন, তখন মুসলিম বাংলায় পড়ে গেল কী অপূর্ব সাড়া! স্যার সলিমুল্লাহর আনন্দের সীমা রইল না। তিনি মুসলিম বাংলার ভাগ্যাকাশে নব আশার অরুণোদয় দেখতে পেলেন।
গোলামির জিঞ্জির, দাসত্বের শৃঙ্খল ছিন্ন করে ফজলুল হক কলকাতায় আসছেন শুনে কলকাতায় জাগল বিপুল সাড়া। শিয়ালদহ স্টেশনে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে সারা কলকাতা যেন আনন্দে ফেটে পড়ল। দূরদর্শী নেতা স্যার সলিমুল্লাহর নির্দেশে নবাব আবদুল লতিফ, নবাব সেরাজুল ইসলাম, মি. আবুল কাসেম, নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী, মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ, মওলানা বেলায়েত হোসেন প্রমুখ কলকাতার যাবতীয় মুসলিম প্রধানের উদোগে শিয়ালদহ স্টেশন হলো লোকে লোকারণ্য। নেতৃত্বহীন সমাজ নেতা পাবে বলে জনগণ সেদিন দলে দলে ছুটে এসেছিল শিয়ালদহ স্টেশনে। মুসলিম বাংলার ভাগ্যাকাশে দেখা দিল তার পথের দিশারি ধ্রুবতারা।
অপূর্ব হূদয়বৃত্তিসম্পন্ন ক্ষণজন্মা ফজলুল হক দেশ ও সমাজের জন্য পাগল না হয়ে দয়ামায়া, প্রেমবর্জিত, স্বার্থপর জীবন যাপন করতে পারলে এবং জীবনভর শুধু ওকালতি করলে তিনি অবাধে কোটি কোটি টাকা ব্যাংকে জমা করে, শেষ বয়সে অবসরকালে দাবা খেলার মতো বেশ আরাম-আয়েশ-বিলাসে ডুবে থেকেও রাজনীতির দাবা খেলায় হাতযশ দেখাতে পারতেন; কিন্তু ফজলুল হকের ভাগ্যলিপি ছিল অন্যরূপ।
ফজলুল হকের চাকরিত্যাগ, কলকাতা আগমন, হাইকোর্টে যোগদান সেদিনকার একটা ঐতিহাসিক ব্যাপার। তাঁর ওজস্বিনী বাগ্মিতায়, সাহস ও বীরত্বে শুধু স্যার সলিমুল্লাহই আশ্বস্ত হলেন না, মুসলমান সমাজেও দেখা দিল এক নবজাগরণ, নবচেতনা, নবপ্রাণচাঞ্চল্য, নব-আশা, নব-আকাঙ্ক্ষা এবং সর্বোপরি দুর্জয় সাহস। দূরদর্শী নেতা স্যার সলিমুল্লাহর ইঙ্গিতেই স্যার হাসান ইমাম, আলী ইমাম, মওলানা আকরম খাঁ প্রমুখ কলকাতার মুসলিম প্রধানগণ ফজলুল হককে নাগরিক সংবর্ধনা জ্ঞাপন এবং নেতৃত্ব বরণের জন্য সেদিন পাঁচ-ছয় হাজার টাকা চাঁদা আদায় করে এক বিরাট আয়োজন করলেন। সেদিনের পাঁচ-ছয় হাজার টাকা বর্তমানের পঁচিশ হাজার টাকার কম হবে না। অতএব, কত বিপুল উত্সাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি হলে এমন বিরাট আয়োজন হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়।সে নাগরিক সংবর্ধনায় মুসলিম বাংলার অবিসংবাদিত নেতা স্যার সলিমুল্লাহ স্বয়ং সভাপতিত্ব করেন।
অপূর্ব হূদয়বৃত্তিসম্পন্ন ক্ষণজন্মা ফজলুল হক দেশ ও সমাজের জন্য পাগল না হয়ে দয়ামায়া, প্রেমবর্জিত, স্বার্থপর জীবন যাপন করতে পারলে এবং জীবনভর শুধু ওকালতি করলে তিনি অবাধে কোটি কোটি টাকা ব্যাংকে জমা করে, শেষ বয়সে অবসরকালে দাবা খেলার মতো বেশ আরাম-আয়েশ-বিলাসে ডুবে থেকেও রাজনীতির দাবা খেলায় হাতযশ দেখাতে পারতেন; কিন্তু ফজলুল হকের ভাগ্যলিপি ছিল অন্যরূপ।
ফজলুল হক ‘লু’ হাওয়ার ঘ্রাণ পেয়ে উষ্ট্রের মতো নেতিয়ে পড়লে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়বে কে? ফজলুল হক বিপদ দেখলে যদি সাবমেরিনের মতো ডুব দেবেন, তবে মসিবতের সামনে মুখোমুখি হয়ে দাঁড়াবে কে? ফজলুল হক যদি স্বার্থপর অর্থগৃধ্নু হবেন, তবে দান করে অন্যের দেনার ভারে দেউলিয়া হবে কে? ফজলুল হক যদি কঞ্জুস হবেন, তবে শত শত ছাত্রের সাহায্যের জন্য নিজের টাকা উজাড় করে আবার কাবুলির কাছে ঋণ করে পালিয়ে বেড়াবে কে? ফজলুল হক কৃপণ হলে, হূদয়হীন হলে স্কুল-মাদ্রাসা, কলেজ প্রতিষ্ঠায় অজস্র টাকা দান করবে কে? ফজলুল হক সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন হলে হিন্দু-ব্রাহ্মণের কন্যাদায় উদ্ধার করবে কে? ফজলুল হক অহংকারী হলে দীন-দরিদ্রের দরদি হতো কে? গরিবের মা-বাপ হতো কে? ভিক্ষুকদের নিয়ে একই সঙ্গে বসে খেত কে? এ কথা চিরসত্য যে ফজলুল হক হূদয়হীন ওকালতি এবং স্বার্থান্বেষী রাজনীতি করতে পারলে তাঁর মতো বিরাট প্রতিভাশালী ব্যক্তিকে জীবনে অত দুঃখ-কষ্ট ভোগ করতে হতো না।
১৯১৩ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কাউন্সিলের ঢাকা বিভাগীয় কেন্দ্রের শূন্য পদে সদস্য নির্বাচনের ব্যবস্থা হলো। তখনকার দিনে প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার ছিল না। খাজনা ও সেসের ভিত্তিতেই ছিল ভোটাধিকার। ভোটারদের শতকরা ৯৫ জনই ছিল হিন্দু। অধিকন্তু বঙ্গভঙ্গ রহিতের পর হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের ভেতর যথেষ্ট তিক্ততা দেখা দিয়েছিল। কোনো মুসলমানই এ নির্বাচনে পদপ্রার্থী হতে সাহস করল না। কিন্তু দুঃসাহসী ফজলুল হক স্যার সলিমুল্লাহর ইঙ্গিতে তাঁরই মনোনীত প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনসংগ্রামে অবতীর্ণ হলেন। ওকালতি ব্যবসা তুলে রেখে ফজলুল হক রাজনীতির ঘূর্ণাবর্তে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী রায়বাহাদুর কুমার মহেন্দ্র মিত্রকে পরাজিত করে ফজলুল হক তাঁর অপরাজেয় রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। মুসলমান হয়ে বর্ণহিন্দুর ভোটে বর্ণহিন্দু প্রার্থীকে পরাজিত করে নির্বাচনে জয়ী হওয়া একমাত্র ফজলুল হকের পক্ষেই সম্ভব হয়েছে। ১৯১৩ সালে ৪০ বছর বয়সেই জাতি-ধর্মনির্বিশেষে বাংলার জনগণের কাছে ফজলুল হক কত জনপ্রিয় নেতা ছিলেন, তা আজকের দিনে ধারণা করা যায় না।
শেরেবাংলা বি ডি হাবীবুল্লাহ্ প্রচ্ছদ ও অলংকরণ: মাসুক হেলাল, প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা প্রকাশকাল: নভেম্বর ২০১৬, ১৬৬ পৃষ্ঠা, দাম: ৩০০ টাকা।
বঙ্গীয় আইনসভায় প্রবেশ করে প্রথম অধিবেশনেই ফজলুল হক সারগর্ভ ওজস্বিনী বক্তৃতা দান করেন, তা আইনসভায় এমন বিস্ময় উত্পাদন করেছিল যে বাংলার লাট লর্ড কারমাইকেল সভাপতির উচ্চাসন থেকে নেমে এসে ফজলুল হকের সঙ্গে করমর্দন করেন এবং ভারতের তদানীন্তন সেরা বাগ্মী স্যার সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি ও বিপিনচন্দ্র পাল তাঁর বাগ্মিতার ভূয়সী প্রশংসা করেন। ১৭৬৫ সালে বিশ্ববিখ্যাত বাগ্মী এডমান্ড বার্ক যখন ব্রিটিশ পার্লামেন্টে তাঁর প্রথম বক্তৃতা করেন, তখনো উঠেছিল এমন প্রশংসা আর ধন্যবাদের ঝড়।
১৯১৩ সালে স্যার সলিমুল্লাহ যখন বঙ্গীয় মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট, তখন ফজলুল হক হলেন তাঁর সেক্রেটারি। এই সময় ফজলুল হক অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগেরও ছিলেন যুগ্ম সম্পাদক। এই বছরই তিনি মি. মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে তাঁর লীগে যোগদানের ব্যবস্থা করেন।
১৯১৪ সালে ইউরোপে প্রথম মহাযুদ্ধের দামামা বেজে ওঠার আগেই স্যার সলিমুল্লাহ কলকাতায় প্রাণত্যাগ করেন। অতঃপর মুসলিম বাংলার নেতৃত্বের গুরুদায়িত্বভার সম্পূর্ণভাবে এসে পড়ল দেশদরদি ফজলুল হকের স্কন্ধে। কিন্তু মহামানব কি এক সম্প্রদায়বিশেষের নেতা হতে পারেন? ফজলুল হক দেশের স্বাধীনতা-সংগ্রামের পুরোভাগে কখনো হয়েছেন সর্বভারতীয় কংগ্রেস নেতা—কখনো হিন্দু-মুসলমান উভয়ের নেতা। খেলাফত আন্দোলনের পুরোভাগে থেকে তিনি হয়েছেন খেলাফত নেতা। তিনি ইসলাম ও মুসলমানের দাবির জন্য হয়েছেন সর্বভারতের শীর্ষস্থানীয় লীগ নেতা। আবার সর্বহারা কৃষক-প্রজার মুক্তিসংগ্রামের অগ্রদূতরূপে তিনি চিরদিনই ছিলেন কৃষক-প্রজা নেতা, মজলুম নেতা, শ্রমিকের নেতা, পীড়িত, নিপীড়িত, লাঞ্ছিত, অপমানিতের নেতা।
মহামানবেরা সেবায়-সাহচর্যে চিরদিনই থাকেন জাত-কুলের সংকীর্ণতার বহু ঊর্ধ্বে। মানবতাই তাঁদের হৃদয়ের ধর্ম। দেশদরদি ফজলুল হক ১৯১২ থেকেই মুসলিম লীগে, ১৯১৪ থেকে কংগ্রেসে, ১৯১৫ থেকে প্রজা আন্দোলন শুরু করে ১৯১৯ সালে খেলাফত আন্দোলনে যোগদান করে সম্ভাব্য যাবতীয় উপায়ে দেশ ও জাতির সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। ১৯১৪ সালে ঢাকায় স্যার সলিমুল্লাহর সভাপতিত্বে ঢাকা ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল, অর্থাৎ বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে মুসলিম শিক্ষা সম্মেলনে ফজলুল হক এক ঐতিহাসিক ভাষণ দান করেন। সম্মেলনে যোগদানকারী ড. শহীদুল্লাহ বলেছেন, ‘সে বক্তৃতা না শুনলে ধারণা করা যায় না যে, ফজলুল হকের এক একটি বক্তৃতা বাংলার মুসলমানকে কতখানি জাগ্রত করেছে এবং এগিয়ে দিয়েছে।’
জার্মানির সর্বাধিনায়ক হিটলার বলেছেন, ‘বিশ্বের যাবতীয় বিপ্লব ও আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে মানুষের বাকশক্তির বলে।’ বস্তুত হিটলারের মহা তেজস্কর বক্তৃতা যেমন পরাজিত জার্মান জাতিকে বিশ্বজয়ে উদ্বুদ্ধ করেছিল, তেমনি ফজলুল হকের অনলবর্ষী বক্তৃতা, সুধাক্ষরা বাণী বাংলা তথা ভারতের নিপীড়িত মানবতাকে জীবনযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করে এনেছে মুক্তির স্বাদ, প্রতিষ্ঠিত করেছে মানবতার দাবি।