ছুটি শেষে আবার কর্মস্থলে ফিরতে শুরু করেছে মানুষ
ছুটি শেষে আবার কর্মস্থলে ফিরতে শুরু করেছে মানুষ

দীর্ঘ ছুটিও কেন খুব দ্রুত শেষ হয়ে যায়

ঈদ ও বাংলা নববর্ষের ছুটি শেষে নাড়ির টানের ‘বাড়ি’ থেকে আবার কর্মস্থলে ফিরতে শুরু করেছে মানুষ। এবারের ছুটি বেশ দীর্ঘই ছিল। কিন্তু তারপরেও মনে হয়, ছুটিটি যেন দ্রুতই শেষ হয়ে গেল! কেন এমন মনে হয় আমাদের?

‘শেষ ট্রেন ধরবো বলে এক রকম ছুটতে ছুটতে ষ্টেশনে পৌঁছে দেখি/ নীলবর্ণ আলোর সংকেত। হতাশার মতন হঠাৎ/ দারুণ হুইসেল দিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে।/ যাদের সাথে শহরে যাবার কথা ছিল তাদের উৎকণ্ঠিত মুখ/ জানালায় উবুড় হয়ে আমাকে দেখছে। হাত নেড়ে সান্ত্বনা দিচ্ছে।’

ছুটি শেষে বাড়ি ফেরার কথা মনে হলেই আমার মনে পড়ে আল মাহমুদের ‘প্রত্যাবর্তনের লজ্জা’ কবিতার এই লাইনগুলো। মনে হয়, এভাবেই যদি ট্রেনটা ছুটে যেত এবং আর কখনো ফিরতে না হতো! পায়ে পেরেক গেঁথে নিয়ে চলার পথটুকু যদি থামিয়ে দিতে পারতাম! যদিও ভাবনাটাই শুধু, এর বেশি কিছু নয়। এরপর সব ভুলে যেতে হয় এবং আবার ফিরতে হয়। সেভাবেই ফিরতে হয়, মেঘের জাল গুটিয়ে আকাশে যেভাবে ফিরে যায় মল্লার।

এই তো ছুটি শেষ করে ঢাকায় আসতে শুরু করেছে কয়েক দিন আগে হুল্লোড় তুলে বাড়ি যাওয়া মানুষেরা। ফেরার জন্য কত সংগ্রাম, ভাবা যায়! রীতিমতো লড়াই করে টিকিট পাওয়া, এরপর রাস্তায় হালাকু খাঁর মতো ভয়ংকর জ্যামকে মোকাবিলা করে ৬ ঘণ্টার ভ্রমণ ১৬ ঘণ্টায় শেষ করা! ছুটিতে ঈদ করতে বাড়ি যাওয়ার ঘটনাকে রীতিমতো ‘মিরাকল’ই বলা যায়।

কাজের শহরে ফিরছে মানুষ

তবে শেষ পর্যন্ত বাড়ি ফেরার আনন্দই ভুলিয়ে দেয় সব যন্ত্রণা। আপনজনের সঙ্গে সময় কাটানো, চায়ের দোকানে বা পুকুরের পাড়ে বসে তুমুল আড্ডা অথবা দুপুরের পর বিছানা বালিশ ডুবিয়ে ঘুম দেওয়া, ছুটিতে আমাদের বাড়ি ফেরার গল্পগুলো কমবেশি এমনই।

কিন্তু এসব দিন যেন বড্ড দ্রুতগামী। কয়েকটা দিন যেন কয়েকটা মুহূর্ত। আসা ও যাওয়ার মাঝখানে একটা চিরকুটও সে দিয়ে যায় না। এসেই বলে যাই! ছুটির তাই সবচেয়ে বেদনাদায়ক দিক হচ্ছে, ছুটি খুব তাড়াতাড়িই শেষ হয়ে যায়। এবারের ছুটিটা অবশ্য একটু দীর্ঘই ছিল। ঈদের সঙ্গে নববর্ষ মিলিয়ে ছয় দিনের ছুটি। তবে ডাবল উৎসব শেষে বাড়ি থেকে ফেরা মানুষগুলোর বেদনাও কি দ্বিগুণ নয়! আর এই শেষ হওয়া ছুটি নিয়ে আপনি কোনো অভিযোগও করতে পারেন না। কেবল বিষণ্ন ও বেদনাহত হৃদয় নিয়ে ফিরে আসতে হয় আপনাকে। এই নিয়তিকে খণ্ডাতে পারে না কেউই।

এসব দিন যেন বড্ড দ্রুতগামী। কয়েকটা দিন যেন কয়েকটা মুহূর্ত। আসা ও যাওয়ার মাঝখানে একটা চিরকুটও সে দিয়ে যায় না। এসেই বলে যাই! ছুটির তাই সবচেয়ে বেদনাদায়ক দিক হচ্ছে, ছুটি খুব তাড়াতাড়িই শেষ হয়ে যায়।

ছুটি বললে আমার আরও একটি গল্পের কথা মনে পড়ে। হ্যাঁ, আমাদের সবার পড়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছুটি’ গল্পের কথাই বলছি। ‘ছুটি’ গল্পের প্রধান চরিত্র ফটিক ছুটিতে বাড়ি ফিরতে চেয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাড়ি ফেরা হয়নি ফটিকের। যেমন ছুটির জন্য বেরিয়েও শেষ পর্যন্ত বাড়ি যাওয়া হয় না অনেকের। নানা দুর্ঘটনা ছুটির আনন্দকে পরিণত করে চিরন্তন বিষাদে। এমন ছুটি আমরা না চাইলেও কারও না কারও জীবনে চলেই আসে। তবে অনাকাঙ্ক্ষিত এই আশঙ্কাও দমাতে পারে না মানুষের বাড়ি ফেরার ইচ্ছাকে। যেভাবেই হোক ফিরতে হবে। আর এভাবে বাড়ি গিয়ে যখন আবার উল্টোরথে চড়তে হয়, তখন সেই বেদনাও হয় সীমাহীন।

সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে মানুষের ভিড়

আজ যেমন বাড়ি থেকে ফিরে অফিসগামী মানুষগুলোর মুখের দিকে তাকানো যাবে না। অদ্ভুত এক বিষণ্নতা আরও কিছু দিন ঝুলে থাকবে তাদের মুখে। নাড়ির টান কাজের প্রতি মনোযোগেও নিশ্চিতভাবে ব্যাঘাত ঘটাবে। থিতু হতেই পার হয়ে যাবে কয়েক দিন। একেকবার মনে হবে, সব ছেড়েছুড়ে আবার ফিরে যাই সেই পুকুরের ঘাটে কিংবা নদীর তীরে অথবা বাজারের কোনায় আড্ডা দেওয়ার দোকানটায়।

কিন্তু বাস্তবতা তো এত সরল নয়! যখনই এমন বৈরাগ্য আর উদাসীনতা মাথাচাড়া দেবে, তখনই বাস্তবতা তার শিকল ছড়িয়ে দেবে। উচ্চ দ্রব্যমূল্য, উচ্চ তাপমাত্রা কিংবা উচ্চ রক্তচাপ আপনাকে ধীরে ধীরে ভুলিয়ে দেবে ছয় দিনে জমা হওয়া সব বৈরাগ্য।

কটা দিন গেলেই সবকিছু আবার আগের মতো হয়ে যাবে। আবার সেই কাজে ডুবে যাওয়া ও যাপনের যন্ত্রণায় ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে পড়া। এরপরও অবশ্য অবচেতনকে ঘিরে ধীরে ধীরে বড় হতে থাকবে অপেক্ষার এক দেবদারুগাছ। আরেকটি ছুটির অপেক্ষা। আরেকবার সেই বাড়ি ফেরার অপেক্ষা। সেই মানুষগুলোর কাছে ফেরার অপেক্ষা, যারা দাওয়ায় বসে আপনার জন্য দিন গুনছে। সেই গাছগুলোর কাছে ফেরার অপেক্ষা, যারা আপনি আসবেন বলে ধীরে ধীরে হয়ে উঠছে ফলবতী। নদীটাও কি আরেকটু ফুলে উঠছে না! আপনি ফিরবেন বলেই বাজারের কোনায় চায়ের দোকানটাও যেন প্রতিদিন একটু একটু সরগরম হয়ে উঠছে। এই তো আর কটা দিন!