মোহাম্মদ রফিকের ফেরা না-ফেরা

৬ আগস্ট প্রয়াত হয়েছেন ষাটের দশকের অন্যতম কবি মোহাম্মদ রফিক। ‘সব শালা কবি হবে’—একদা এই পঙ্‌ক্তি লিখে আপামর মানুষের কাছে পৌঁছেছিলেন তিনি। তাঁকে নিয়ে আয়োজন

উত্তরার বাসায় মোহাম্মদ রফিক, ২১ অক্টোবর ২০২২

৬ আগস্ট কবি মোহাম্মদ রফিক বিদায় নিলেন। বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী দিনটি ২১ শ্রাবণ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিদায় নিয়েছিলেন ২২ শ্রাবণ, তাঁর এক দিন পর। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এমনই বর্ষা ছিল সেদিন। সারা দিন অবিশ্রাম বৃষ্টি। ৮২ বছর পর এমনই একটি দিন আমাদের মধ্য থেকে নিয়ে গেল আরেকজন কবিকে। অদ্ভুত যোগাযোগ!

এটুকু লিখে থামলাম। ভাবতে চাইলাম, এ রকম একটি যোগাযোগের কথা মোহাম্মদ রফিককে বলতে গেলে কী করতেন তিনি? দেখতে পাচ্ছি, তাঁর বড় বড় চোখ থেকে ঝরে পড়ছে নির্জলা কৌতুক। কফিল ভাই (কফিল আহমেদ) বা পিয়ালকে (মাহবুব পিয়াল) ডেকে বলছেন, কী লেখিছে দেখিছ?

নিশ্চিতভাবেই আমার এই ভক্তিমূলক হরোস্কোপিক প্রচেষ্টার ওপর হো হো করে হেসে উঠতেন তিনি। বলতেন, এত আবেগপ্রবণ, এত পেলব, এত রোমান্টিক! এসব বাদ দাও তো। সোজাসুজি লেখো।

এই হচ্ছে তাঁর ‘খোলা কবিতা’র দর্শন। এলিয়ে-পড়া ভাব-ভাবনার ঘোর বিরোধী ছিলেন এই কবি। কম করে হলেও ছয় বছর সকাল-সন্ধ্যা আড্ডা দিয়েছি তাঁর সঙ্গে। কোনো দিন তিনি বিষণ্ন ছিলেন না, হতাশা দেখাননি, দুঃখভারাক্রান্ত হয়ে ওঠেননি। যদি তেমন কোনো কিছু তাঁকে তাড়িয়ে ফিরত, তিনি অন্যমনস্ক থাকতেন আড্ডায়। তারপর হয়তো উঠে যেতেন, বলতেন, আজ বাদ দিই, কাল এসো।

কাল যথারীতি তিনি আনন্দমুখর, বাগ্‌বিস্তারী, কৌতুকপ্রবণ, বীরপূজারি।

মোহাম্মদ রফিকের প্রিয় রং লাল। প্রিয় কবির জায়গায় তিনি লোরকা কিংবা রিলকের চেয়ে নেরুদাকে অনেক বেশি আমল করতেন। আমাদের লোরকা-প্রেম তাঁর পছন্দ হতো না। বলতেন, আচ্ছা, তোমরা কি মিগুয়েল হেরনান্দেজ পড়েছ? পড়ো, লোরকা ভুলে যাবে। কালেক্রমে তাঁর নেরুদা-প্রেম আমার মধ্যে সঞ্চারিত হয়। সকাল-সন্ধ্যা নেরুদা নেরুদা করি। মোহাম্মদ রফিক একদিন বললেন, নেরুদা ভালো, কিন্তু এইমে সেজেয়ার আর সেসার ভায়েহো পড়ে দেখো। নেরুদা ভুলে যাবে।

একইভাবে আমরা যখন হুয়ান রুলফো আর মার্কেস দিয়ে আবিষ্ট ছিলাম, তিনি আমাদের ওপর ঢেলে দিলেন কর্তাজার, বোর্হেস, ইয়োসা আর আরগুইরাস। তাঁর পাঠকসত্তার নাগাল পাওয়া আমাদের মতো টিনএজারদের জন্য নিতান্ত কঠিনই ছিল। আমরা কেবল বিস্মিতই হতে পারতাম। তিনিও সেটা উপভোগ করতেন।

মোহাম্মদ রফিক তাঁর নিজের কবিতা নিয়ে নিজে থেকে কোনো আলাপ পাড়তেন না। আমরাই তুলতাম। আমাদের পছন্দ ছিল কীর্তিনাশা। কিন্তু তিনি চাইতেন আমরা যেন কপিলা বেশি পছন্দ করি। কপিলার মধ্যে একটা মহাকাব্যিক আয়োজন আছে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই চরিত্রকে তিনি তাঁর সময়ের পদ্মার পাড়ে যেভাবে পুনরাবিষ্কার করেছিলেন, সেটি বিস্ময়করই ছিল। কিন্তু সেই মহাকাব্যে যে ঝনাৎ ঝংকার আছে—কি আবহে, কি ছন্দে, কি মতাদর্শিক প্রণোদনায়—তার মধ্যে আমি আমার ক্ষুদ্র সত্তাটিকে হারিয়ে ফেলতাম। ফলে ফিরে ফিরে আসতাম কীর্তিনাশার পাড়ে। কবি আমাকে করুণার চোখে দেখতেন।

এই ছিলেন মোহাম্মদ রফিক। লিরিক কবিতার চেয়ে মহাকাব্য তাঁর বেশি পছন্দের ফর্ম ছিল। নিদেনপক্ষে দীর্ঘ কবিতা। দামোদর-এর দ্বিতীয় সংখ্যাটিকে দীর্ঘ কবিতা সংখ্যা করার পেছনে তাঁরই বেশি উৎসাহ ছিল। আমার দীর্ঘ কবিতা ঠিক আসত না। টেনেটুনে বিশ-পঁচিশ লাইন লিখতে পারতাম। কবি হাসতেন, চোখে কৌতুক। বলতেন, এত কমে দম ফুরায়ে গেলে চলবে? কবি হচ্ছে লম্বা রেসের ঘোড়া।

এভাবে আমার ছয় বছরের জাহাঙ্গীরনগরের জীবনে মোহাম্মদ রফিকের ‘কবি’টিকে চেনার চেষ্টা করেছি। ঋজু, যৌক্তিক, সাহসী, মতাদর্শিক ও সংগ্রামী। পয়ারে অনাগ্রহী, বরং গদ্য ছন্দ বা মিশ্র ছন্দে প্রয়াসী। লিরিকপন্থী মোটেও নয়, বরং মহাকাব্যিক। মহাভারত-এর কৃষ্ণ-অর্জুন ন্যারেটিভে তাঁর বেশি বিচরণ। ফলে আমি গোপনে গোপনে আমার কাব্যিক বিদ্রোহ জারি রাখতাম। আমি লিরিকপন্থী, বিষাদগ্রস্ত, উপমাপ্রয়াসী, এলিজি-আক্রান্ত দুর্বল এক কবি। অর্জুনের চেয়ে মহাভারত-এর কর্ণ আমাকে বেশি টানত। তাঁকে পড়তাম, কিন্তু আমল করতাম তাঁরই ছাত্র, অল্প বয়সে আত্মহত্যা করা কবি সুনীল সাইফুল্লাহকে। তিনি আমাকে বুঝতেন। তাঁর মতো হতে চাপ দিতেন না। তাঁর অসীম ঔদার্যে আমার নন্দনভাবনা ছাড় পেয়ে যেত। প্রকৃত বীরের মতোই তিনি আমাকে ডিঙিয়ে ঘোড়া ছোটাতেন তাঁর স্মৃতি ও মতাদর্শের ভেতর। যে স্মৃতিটুকু তিনি তাঁর শৈশব থেকে কুড়িয়ে এনেছেন। আর তাকে সিজনড করেছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতাদর্শিক ল্যান্ডস্কেপ দিয়ে।

মোহাম্মদ রফিকের কবিতায় এই-ই এক বিস্ময়কর ব্যাপার। তাঁর কবিতা প্রায় কখনোই কীর্তিনাশা কিংবা গাওদিয়ার পাড় থেকে নিজেকে বিযুক্ত করেনি। এমনকি যখন তিনি স্বৈরশাসক এরশাদকে নিয়ে ‘খোলা কবিতা’ করছেন, তখনো। এতখানি প্রখর স্মৃতির ভেতর আর কোনো কবিকে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। ব্যক্তিগত আড্ডায় তিনি কথার তুবড়ি ফোটাচ্ছেন জাদুবাস্তবতা নিয়ে, ষাটের দশক নিয়ে, ঢাকার-কলকাতার সাহিত্য নিয়ে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে, আইয়ুবের শাসনামলে ছাত্র আন্দোলন নিয়ে, স্বৈরশাসক এরশাদ নিয়ে; কিন্তু কবিতা যখন লিখছেন, তখন তিনি প্রমত্ত পদ্মার পাড়ে, তাঁর শৈশবের নায়ক খালেক উঠে যাচ্ছে নারকেলগাছে, হাউমাউ বৃষ্টি ছ্যাঁকা, ঘেয়ো কাদা, পাড়া থেকে পাড়া, ঘর থেকে ঘর!

একদিনের কথা মনে পড়ে। এক মেঘলা দিনে বিকেলবেলায় আমি আর পিয়াল তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসায় গেলাম। দরজায় টোকা দেওয়ার বেশ খানিকটা পর তিনি দরজা খুললেন। হাতে একটা জুতা, চোখে ঘুমভাঙা বিরক্তি। বললেন, সরো। বলেই দরজার কাঠের ফ্রেমে জুতা দিয়ে আঘাত করলেন। একটা ব্যাঙ পড়ে গেল। আমরা ঘরে ঢুকে গেলাম। অচিরেই বোঝা গেল, দরজার ফ্রেমে বসে বসে ব্যাঙটা ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ ডাকছিল, তাতে কবির দিবানিদ্রা ব্যাহত হচ্ছিল। কদিন পরেই তিনি একটি কবিতা শোনালেন:

বেড়ালটাকে এভাবে হত্যা করার কী যে প্রয়োজন ছিল

বিরক্ত করেছিল, এটুকুই...

২০-২৫ লাইনের খুব মনোজ্ঞ একটি কবিতা। ঠিক রফিকীয় পোয়েটিক ডিকশনের সঙ্গে পুরোপুরি যায় না। আমাদের দামোদর-এ ছাপা হলো। আমি আর পিয়াল বহুদিন ভাবলাম, কবি ব্যাঙ মেরে বিড়াল মারার দাবি আনলেন কেন? ব্যাঙ মারাতে কি যথেষ্ট গিল্ট তৈরি হয় না কবিতায়? কবির অপরাধবোধ তৈরি হওয়ার জন্য নিহত প্রাণীটিকে বিড়ালগোত্রীয় হতেই হবে?

পিয়াল একদিন কথাচ্ছলে জিজ্ঞেস করল, স্যার, কবিতার এই বিড়ালটাই কি সেদিনের ব্যাঙটা? কবি কিঞ্চিৎ খেপে গেলেন। বললেন, তোমরা খুব বেশি জেনে ফেলছ। তোমাদের এখন থেকে কম কম আসতে দিতে হবে। বলেই আবার হো হো করে হেসে উঠলেন।

মাহবুব পিয়ালকে তিনি খুব পছন্দ করতেন। বলতেন, ওর মধ্যে আমি আমার বাল্যকালটা দেখি। পিয়ালও মোহাম্মদ রফিক দিয়ে অসম্ভব প্রভাবিত ছিল। জলদাস নামে দীর্ঘ যে কবিতাটি লিখেছিল, মোহাম্মদ রফিক সেটির খুব প্রশংসা করেছিলেন। মোহাম্মদ রফিকের প্রশংসা আর নিজের এথনোগ্রাফিক প্রতিভার কারণে পিয়ালের কবিতাগুলো দীর্ঘতর হয়ে উঠত। আর এই দুজনের মহাকাব্যিক পায়চারির মধ্যে আমি আমার ইন্দ্রিয়ঘন কবিতাচর্চা নিয়ে সংকুচিত আর ম্রিয়মাণ হয়ে থাকতাম।

মোহাম্মদ রফিকের পোয়েটিক ডিকশন নিয়ে একটা লম্বা আলাপ পাড়ার ইচ্ছা আমার অনেক দিনের। কয়েকটি প্রকল্পনা ঠিক করেছি এই আলাপের, আজকে সংক্ষেপে তুলে রাখি। প্রথমত, তাঁর কাব্যিক ডিকশন সাংঘাতিক রকমের সুচিন্তিত। বাংলা কবিতায় কেবল সুধীন দত্ত ও বিষ্ণু দের মধ্যে এই প্রবণতা দেখা গেছে। কিন্তু তিনি কবি হিসেবে সুধীন্দ্রনাথ নন, বরং বিষ্ণু দের নন্দনঘনিষ্ঠ। নেরুদা যেভাবে তাঁর শেষ দিকের কবিতাকে নিরাভরণ করে তুলতেন বা যে ভাষায় সেজার ভায়েহো লিখেছেন, রফিক তারই সাধনা করতেন। দ্বিতীয়ত, টি এস এলিয়টের চিন্তার লিগ্যাসি হিসেবে কবিতায় মিথের ব্যবহার, পুনরুক্তি, মিশ্র ছন্দ, ইন্টারটেক্সচুয়ালিটি—এসব বিষয়ও মোহাম্মদ রফিকের চর্চার মধ্যে ছিল। ষাটের দশকের কমবেশি সবার মধ্যেই ছিল। কিন্তু মোহাম্মদ রফিক নিটোলভাবে এর চর্চা করেছেন। সচেতনভাবে এর চেয়ে ইনস্ট্রুমেন্টালি সাউন্ড কবিতা লেখা খুব কঠিন। এ বিষয়ে রফিকের পৌরাণিক অধ্যবসায় ছিল। এটা কেবল যাঁরা তাঁকে কাছ থেকে দেখেছেন, তাঁরাই জানেন।

তবু তিনি যে তাঁর সমসাময়িক অনেকের থেকে খানিকটা কম পঠিত ও আলোচিত থেকে গেলেন, এর কারণ কী হতে পারে? বাঙালি পাঠকের চিত্তদৌর্বল্য? মোহাম্মদ রফিকের কবিতাবিশ্বকে পারসোনালাইজ করা যায় না বলে? আমাদের চিরনৈসর্গিক পয়ার-প্রেম, যাকে মোহাম্মদ রফিক সচেতনভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন? নাকি বাংলা কবিতার আত্মমুখী নগরায়ণ?

কবিতার রাজনীতি নিয়েও একটা অনুমান করা যায়। মোহাম্মদ রফিকের কবিতার যে রাজনীতি, সেটি সামরিক শাসন-উত্তর সময়ে আর হালনাগাদ হয়নি। সামরিক শাসকের বিরুদ্ধে তাঁর যে রাগী পঙ্‌ক্তিমালা, সেটি বিপুল পাঠকপ্রিয় হয়েছে। এরপর তিনি আবার ফিরে গেছেন তাঁর পুরোনো ল্যান্ডস্কেপে, তাঁর নিজের মিথোলজির ভেতর। এরশাদ-পরবর্তী গণতন্ত্রে আমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হয়নি। কিন্তু মোহাম্মদ রফিকের পাঠক তাঁর কাব্য থেকে সে রকম কোনো দিশা জোগাড় করতে পারেননি। তিনি জেদি ছিলেন, অন্যমনস্ক ছিলেন, স্মৃতিভারাতুর ছিলেন, এটা তাঁর একার সমস্যা ছিল না। এরশাদ-পরবর্তী যুগ একই সঙ্গে সোভিয়েত-পরবর্তী যুগও। এই নবযুগে মোহাম্মদ রফিকের মার্ক্সীয় বিশ্ববীক্ষা নতুন ভাষাভঙ্গির ভেতর রপ্ত করেনি নিজেকে।

মোহাম্মদ রফিক মৃত্যুর পর ঢাকায় ফিরতে চাননি। তাঁর মায়ের কবরের পাশে তাঁকে সমাহিত করা হয়। তাঁর যে সামাজিক-ঐতিহাসিক গুরুত্ব, সে অনুযায়ী তাঁর মৃতদেহ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, শহীদ মিনারসহ নানা স্থানে তাঁর ভক্তদের জন্য প্রদর্শিত হওয়ার কথা। এটি তিনি হতে দেননি। খুব নীরবে ফিরে গেছেন সেই ল্যান্ডস্কেপে, যাকে তিনি সারা জীবন ধরে কবিতায় এঁকেছেন। বন্ধুবাৎসল্য, ছাত্রবাৎসল্য সত্ত্বেও তিনি ছিলেন নিঃসঙ্গ একজন কবি। সোভিয়েত-উত্তর দুনিয়া তাঁকে হয়তো মতাদর্শিকভাবেও নিঃসঙ্গ করে ফেলেছিল। কবি হিসেবে তিনি তো নিজের স্মৃতির ভেতরই বেঁচে ছিলেন সারা জীবন, আর এখন বহু মানুষের স্মৃতির ভেতর নানাভাবে বেঁচে থাকবেন।