আজ ৩১ আগস্ট ভারতীয় চলচ্চিত্রকার ঋতুপর্ণ ঘোষের জন্মদিন। বারবার সিনেমার মাধ্যমে মানুষের জীবনের মর্মমূলে ঘা দিতে চেয়েছেন তিনি। ‘শুভ মহরৎ’ চলচ্চিত্রে যেমন বলেছিলেন, ‘একসঙ্গে দুজনকে ভালোবাসা যায় না?’। তাঁর অন্য কাহিনিচিত্রগুলোতেও এ বিষয়ের প্রতিফলন রয়েছে। সিনেমা থেকে সিনেমায় কেন তিনি একসঙ্গে দুজনকে ভালোবাসার কথা বলতে চেয়েছেন?
ঋতুপর্ণ আমার কাছে ষড়্ঋতুর বাইরের আরেক ঋতু—সঞ্জীবনী ঋতু। ঋতুপর্ণ ঘোষ আগাগোড়া সিনেমার মানুষ ছিলেন। পড়াশোনা করেছেন অর্থনীতিতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাঁকে আমার ভালো লাগে। কারণ, তাঁর জীবন আগাগোড়াই রবীন্দ্র–প্রভাবিত ছিল। রবীন্দ্রনাথকে মননে ও ক্যামেরায় আর কে, কবে ধারণ করতে পেরেছিল ঋতুপর্ণের মতো!
ঋতুপর্ণ ঘোষের সিনেমার কথা মনে হলে প্রথমেই মনে পড়ে ‘শুভ মহরৎ’-এর কথা। প্লট, সিনেমার কাজ, অভিনয়—সবকিছুর তুখোড় সংমিশ্রণ রয়েছে এ সিনেমায়! তবে ‘শুভ মহরৎ’ ঠিক কী কী কারণে আমার প্রিয়, সেটা ভেবেছি বহুবার বা ভাবতে বাধ্য হয়েছি। একদিন দুপুরের অল্প রোদ নিভে যাওয়ার সময় হঠাৎ বোধের জানালায় উঁকি দিল নতুন প্রশ্ন—‘শুভ মহরৎ’ আমার প্রিয়, না শর্মিলা ঠাকুর, নন্দিতা দাসের তুখোড় অভিনয় ছাড়িয়ে এ সিনেমা আমার প্রিয় হয়ে উঠেছে এর ভেতরের অন্তর্দর্শনের জন্য? মানুষের জীবনের চিরন্তন কনফ্লিক্ট!
‘একসঙ্গে দুজনকে ভালোবাসা যায় না?’—সাধারণ জিজ্ঞাসা, প্রশ্ন। এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে প্রতিনিয়ত আমাদের ইগোর সঙ্গে সুপার ইগোর দ্বন্দ্বের মুখোমুখি হতে হয়। রোজকার ঘটনাবহুল জীবনে সবাই সবার মতো অসুখী। এটাই এ সিনেমায় ভীষণ চমৎকারভাবে দেখিয়েছেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। শর্মিলা ঠাকুরের মতো সংবেদনশীল নারী চরিত্রকে আমরা ভেঙে যেতে দেখি ক্লাইমেক্সের তীব্রতায়। আবেগের দোলাচলে যখন হৃদয় দুমড়েমুচড়ে একাকার হয়ে যাচ্ছে, তখন ব্যাকগ্রাউন্ডে ধীর, স্থিরভাবে বেজে যাচ্ছে—‘জীবনও মরণের সীমানা ছাড়ায়ে, বন্ধু হে আমার রয়েছ দাঁড়ায়ে...’
‘শুভ মহরৎ’ চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছিল আগাথা ক্রিস্টির গল্প ‘দ্য মিরর ক্র্যাকড ফ্রম সাইড টু সাইড’ অবলম্বনে। আগাথা ক্রিস্টি এই নাম নিয়েছিলেন লর্ড টেনিসনের ‘লেডি অব শ্যালট’ থেকে। যেখানে টেনিসন মূলত দেখিয়েছিলেন জীবনের সঙ্গে আর্টের চিরায়ত লড়াই। ‘লেডি অব শ্যালট’-এ যখন বলা হচ্ছে ‘আ’ম হাফ সিক অব শ্যাডো’। আমার মনে হয় ঋতুপর্ণকেই দেখতে পাচ্ছি আমি, নয় কি?
ঋতুপর্ণের ‘চিত্রাঙ্গদা’ সিনেমায় যীশু সেনগুপ্ত আর ঋতুপর্ণ ঘোষের রসায়ন ছিল মারাত্মক। ‘চিত্রাঙ্গদা’ রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্য, মহাভারতাশ্রয়ী গল্প। সেখানে চিত্রাঙ্গদা মণিপুরের রাজকন্যা। রাজার ইচ্ছা ছিল ছেলে হবে, কিন্তু তার স্ত্রী জন্ম দেয় মেয়ে। সেই মেয়েকেই রাজা পুত্রসন্তানের মতো বড় করে। তারপর সেই ছেলেরূপী চিত্রাঙ্গদা প্রেমে পড়ে অর্জুনের এবং নিজের সত্তার টানে ব্যাকুল হয়ে পড়ে। পরবর্তী কাহিনি আপাতত মহাভারতেই থাকুক।
সিনেমার শেষের দিকে এসে দেখা যায়, অনন্যা চ্যাটার্জির সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে ওঠে অনিকেতের ছেলের। অনন্যা চ্যাটার্জি রেলিংয়ে হেলান দিয়ে যীশু সেনগুপ্তকে বলেন, ‘প্রেম করবেন আমার সাথে?’ যীশু সম্ভবত সর্বোত্তম উপায়ে সেই প্রেম প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন, ‘না, আপনি তো কেবল প্রেম করবেন। ভালো তো আর বাসবেন না।’
ঋতুপর্ণর ‘চিত্রাঙ্গদা’ ওই রকম পুরুষ শরীরে বড় হওয়া এক নারীর লড়াই। সেখানে রুদ্র ভালোবাসে পার্থকে। অর্জুনের আরেক নাম পার্থ। পার্থর ভালোবাসার কাছে ক্রমশ অবনত হতে থাকে রুদ্র। এখানে দেখা যায় নারী মনের এক প্রবল চাওয়া। সবকিছুর পরও পুরুষের দখলদারি চরিত্রই টানে বেশি। তারপর এ সিনেমার সবচেয়ে প্রিয় ‘বঁধু কোন আলো লাগল চোখে...’ গানের দৃশ্য। রুদ্র হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে নাচের মুদ্রায় হাত নাড়াচ্ছেন। আচমকা উজ্জ্বল আলো এসে চোখ ঢেকে যায় তার। আরেক অন্তিম মুহূর্ত নিজের পরিচয়ের।
‘চিত্রাঙ্গদা’কে যতখানি চলচ্চিত্র বলে মনে হয়েছে, তারও অধিক মনে হয়েছে ঋতুপর্ণ ঘোষের আত্মজীবনী বলে। ‘অসমাপ্ত দালানকেও কেন কেবল দালানই বলা হয়?’/ ‘কারণ পৃথিবীতে কোনো কিছুই সম্পূর্ণ নয়, সবকিছুই প্রক্রিয়াধীন।’ ‘চিত্রাঙ্গদা’র সবচেয়ে চুম্বকীয় সংলাপ। এই প্রক্রিয়াধীন অবস্থাতেই আমরা নির্মাণ করি, ভেঙে ফেলি, পুনরায় নির্মাণ করি।
ঋতুপর্ণ ঘোষের আরও এক অনবদ্য সিনেমা ‘আবহমান’। সম্পর্কের টানাপোড়েনই এ সিনেমার প্রধান বিষয়। অনেকেই বলে থাকেন ‘আবহমান’ সত্যজিৎ রায় আর মাধবী মুখার্জির প্রেমের সম্পর্ককে কেন্দ্র করে রচিত। সম্পর্ক যে ছিল, সে ব্যাপারে পরিষ্কার করে কিছু বলা নেই। আবার সম্পর্ক থাকারও নানা রকম ইঙ্গিত রয়েছে। এ সিনেমার প্রধান চরিত্র অনিকেত চৌধুরী। তার মৃত্যুকে কেন্দ্র করেই কাহিনি আবর্তিত হয়েছে। অনিকেতের মৃত্যুতে আবারও মুখোমুখি হন মমতা শংকর আর অন্যন্যা চ্যাটার্জি। একজনের পরিচয় স্ত্রী, আরেকজনের কোনো পরিচয় নেই। দুই নারীতে যোজন যোজন দূরত্ব কিন্তু মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এক হয়ে যাচ্ছে, যেন সবচেয়ে গভীরতম বেদনার কাছে।
সিনেমার শেষের দিকে এসে দেখা যায়, অনন্যা চ্যাটার্জির সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে ওঠে অনিকেতের ছেলের। অনন্যা চ্যাটার্জি রেলিংয়ে হেলান দিয়ে যীশু সেনগুপ্তকে বলেন, ‘প্রেম করবেন আমার সাথে?’ যীশু সম্ভবত সর্বোত্তম উপায়ে সেই প্রেম প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন, ‘না, আপনি তো কেবল প্রেম করবেন। ভালো তো আর বাসবেন না।’ আসলেই কী করে প্রত্যাখ্যান? জানি না। তখনো বাজছিল সম্ভবত—
‘পিনহ চারু নীল বাস
হৃদয়ে প্রণয়ও কুসুম রাশ।’
আমরা ‘চোখের বালি’ সিনেমায় দেখি এক পরিণতিহীন ভালোবাসাবাসির গল্প। পুরো সিনেমাজুড়ে বাজে—‘ওরা সুখের লাগি করে প্রেম, প্রেম মেলে না, শুধু সুখ চলে যায়...’। রবীন্দ্রনাথ যেন ওনার এই চরিত্রগুলোর জন্যই লিখেছিলেন এ গান। বিনোদিনী, আশালতা, বিহারি, মহেন্দ্র। সিনেমাটিতে একটা সাধারণ দৃশ্য—সাবান দিয়ে রাইমা সেনের মুখ ধোয়ার অংশটুকু। কোনো সংলাপ নেই এখানে। সেখানে বিনোদিনীর অভিব্যক্তির দিকে তাকিয়ে যেন কেবল আকাশ–বাতাস ছাপিয়ে প্রবল কান্না উথলে ওঠে।
তারপর আরেক সিনেমা ‘নৌকাডুবি’, যেখানে রমেশ ভালোবাসে হেমনলিনীকে কিন্তু সংসার করতে হয় কমলা নামের এক তরুণীর সঙ্গে। এখানে একজনকে ভালোবাসা, আরেকজনকে বিয়ে, অতঃপর আবার আরেকজনের সঙ্গে সংসার! এই চরম দ্বান্দ্বিকতা ক্যামেরায় সার্থকভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। নিয়তির দায়ে যখন সম্পর্কের সুতাগুলো আর ধরে রাখা যাচ্ছে না, তখন আচমকা বাজে—‘তরী আমার হঠাৎ ডুবে যায়...’। সমস্ত ভুলভ্রান্তি শেষে রমেশ যখন হেমের মুখোমুখি দাঁড়াতে যায়, সমস্ত ঘরজুড়ে হাওয়ায় দোল খায় সম্ভবত কসমস ফুল। হেম খালি গলায় গেয়ে ওঠে—‘সত্য সুন্দরও...’।
ঋতুপর্ণের যে নির্মাণের কথা না বলে শেষ করলে মনে শান্তি পাব না তা হলো ‘দোসর’। কৌশিক আর কাবেরী জুটিকেও কখনো কখনো অতিক্রম করে গেছে বৃন্দা আর ববি। পুরো সিনেমাই সাদাকালো। গল্পের আবহ ক্রিয়েশনের জন্য সাদাকালোই প্রয়োজন ছিল এখানে। অসুখী দাম্পত্যের টানাপোড়েনে বৃন্দা ভালোবাসে ববিকে। কিন্তু একটা সময় এসে দেখতে পাই, আমরা সংসারের জন্যও যেন এক পিছুটান কাজ করে ববির।
কাবেরী, বৃন্দা, ববি—তিন বন্ধু। একদিন আলাপে ববি বলে, ‘তোমাকে সিকিউরিটি দেওয়ার জন্য কিছু সময় চাই আমার।’ তখন কাবেরীর মুখে শোনা যায় সেই সংলাপ, ‘একই কথা তো বৃন্দার স্বামীও বলতে পারে যে তোমাকে ভালোবাসার জন্য কিছু সময় চাই আমার।’ এবং তার সপক্ষে যুক্তি দিয়ে বলে, ‘একটা সম্পর্ক মেইনটেইন করতে অনেকখানি এফোর্ড, রিহার্সাল, সময় প্রয়োজন।’ আসলেই তো, ভালোবাসার জন্য আমরা কাউকে সেই সময়টুকু তো দিই না। ‘ভুল মানুষ’ আখ্যা দিয়ে চলে যাই। ঋতুপর্ণ তাঁর বিভিন্ন চলচ্চিত্রে বারবার একটা কথার প্রতিধ্বনি করেছেন, তা হলো—‘একসঙ্গে দুজনকে ভালোবাসা যায় না?’ আর এ প্রশ্ন উত্থাপনের মধ্য দিয়ে প্রকারান্তরে মানুষের মনের গোপন কুঠুরিকে যেন সামনে তুলে ধরেছেন তিনি।
হ্যাঁ, এসব নিয়েই তো ঋতুপর্ণ ঘোষ। যাঁকে নিয়ে ভেবে একটা সুদীর্ঘ বিকেল কাটানো যায়। শুভ জন্মদিন সঞ্জীবনী ঋতু।