ঝড়, ঝোড়োরাত আমাদের মনে কি উসকানি দেয়? তা কি কেবল আমাদের স্মৃতি উসকে দেয়, নাকি আরও বেশি কিছু...?
গ্রীষ্মের তপ্ত দিনের শেষে গুমোট বিকেল শেষ হয়ে ঝড় নেমে আসার সম্ভাবনা নিয়ে আগত সন্ধ্যাগুলো কেন যেন আমার স্মৃতিতে তোলপাড় ঘটায়। এমন যে শুধু আমার ক্ষেত্রেই ঘটে, তা নয়। বাঙালিমাত্রই এমন হয়। ঝড়–বৃষ্টির সময় কেমন করে ওঠে মন। মনে পড়ে পুরোনো দিনের মন তছনছ করা কোনো এক বৈশাখী ঝড়। আর তখনই আমাদের মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথ। মনে পড়ে, ‘আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার...’
ঝড়ের সম্ভাবনায় শৈশবের বিস্ময় আর ভয়ের মতো আমার মনে পড়ে প্রথম যৌবনের প্রেমের স্মৃতি। এখনকার সময় থেকে হিসেব করলে সেটাও এক হিসেবে ‘ছোটবেলা’ই। কলেজে পড়ি, বয়স হবে বড়জোর সতের বা আঠারো। অকারণেই তখন বুকের ভেতর নানা রকম ঝড় উঠত, বহু আকাশকুসুম ভেবে নির্ঘুম রাত কাটত। কলেজে যাওয়ার পথে কড়ই ফুলের মৃদু সুবাস আর কৃষ্ণচূড়ার ঝরে পড়া পাপড়িতে লাল হয়ে থাকা টাউন হলের পিচের রাস্তা আগের রাতের ঝড়ের যত আলামতই দেখাত, মনে হতো সেসবই যেন আমার অন্তর্গত ঝড়ের সামনে খুব সামান্য আর তুচ্ছ।
এই ঝড় আসলে কী? এ কি মানব হৃদয়ের আনন্দ–বেদনার স্মৃতিকে কেবলি উসকে দেওয়ার ‘ষড়যন্ত্র’?
কোথায় যেন পড়েছিলাম, স্মৃতি মানেই তা বেদনার, ফেলে আসা দিন মানেই কষ্টের। দুঃখের স্মৃতি মনে পড়লে পুরোনো দুঃখে মন ব্যথায় আচ্ছন্ন হয়, সুখের স্মৃতিও বিষণ্ণ করে আমাদের মন। কেননা, সেই সুখের দিনগুলো আর নেই।
কিন্তু এত ব্যস্ত জীবনে প্রতিনিয়ত তীব্র বেগে সামনের দিকে ছুটে চলার অস্থির যাপনে স্মৃতিকাতর হওয়ার সময় এখন আমাদের কারই–বা আছে! সবাই–ই তো ভবিষ্যৎ গড়ছে রোজ, অতীতকে পেছনে ফেলে এগোচ্ছে।
অনেকের মতো আমার জন্যও স্মৃতি উসকে দেওয়া প্রথম ও প্রধান উপাদান হলো আবহাওয়া। প্রবল বর্ষায় ময়মনসিংহে আমাদের ব্রাহ্মপল্লীর বাড়ির উঠানে পানি জমে যেত, দুই একবার ঘরেও ঢুকে গিয়েছিল অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত এবং অপ্রতুল ড্রেনেজ ব্যবস্থার কারণে নামতে না পারা জল।
আর ঝড়–বৃষ্টি শেষে বসন্তে যখন কোকিল ডাকতে শুরু করে, মনে পড়ে হাইস্কুলের দিনগুলো, স্পোর্টসের প্রস্তুতির উছিলায় ক্লাস একদম হতো না। আমরা ঘুরেফিরে বেড়াতাম স্কুল কম্পাউন্ডের ভেতরেই, এখানে–সেখানে—বিদ্যাময়ী স্কুলের মাঠে কোনো একটা রেইনট্রি বা কৃষ্ণচূড়ার ডাল থেকে লুকিয়ে কোনো একটা পুরুষ কোকিল হয়তো সঙ্গিনীকে আকৃষ্ট করার জন্য কুহু কুহু ডাকত, তখন আব্বার মতো আমিও ভাবতাম, কোকিলের ডাক ‘ওভাররেটেড’। কাককে ঘর থেকে বের করে তার বাসায় ডিম ফোটানোর জন্য কাকের সঙ্গে আব্বার ভাষায়, ‘কাইজ্যা লাগাইবার লাইগ্যা’ ডাকছে একটা পাখি, আর তা নিয়ে কবিদের কত না অহেতুক আহ্লাদ!
তবে এই আহ্লাদের মানে বড় হলে বোঝা যায়। কেন হৃদয় ব্যাকুল হয় ঝড়–বৃষ্টির রাতে, কেন মনে হয় ‘এমন দিনে তারে বলা যায়’, তা আসলে বড়বেলাতেই ভালোভাবে বুঝতে পারে বাঙালিরা। মন কেমন করা সেই অনুভবের কথা তো কম–বেশি সবারই জানা। সেই অনুভূতির জন্য অবশ্য মার্চ–এপ্রিল লাগে না, ঝড়–বৃষ্টি অথবা নিদেনপক্ষে সামান্য দমকা হাওয়া বইলেই চলে।
এই ঝড়োরাত, ঝড়োরাতের অভিসার শুধু প্রেমের স্মৃতি নয়, জীবনের নানান রকম স্মৃতিই ডেকে আনে।
এই আহ্লাদের মানে বড় হলে বোঝা যায়। কেন হৃদয় ব্যাকুল হয় ঝড়–বৃষ্টির রাতে, কেন মনে হয় ‘এমন দিনে তারে বলা যায়’, তা আসলে বড় হলেই ভালোভাবে বুঝতে পারে বাঙালিরা। মন কেমন করা সেই অনুভবের কথা তো কম–বেশি সবাই–ই জানে। সেই অনুভূতির জন্য অবশ্য মার্চ–এপ্রিল লাগে না, ঝড়–বৃষ্টি বা নিদেনপক্ষে সামান্য দমকা হাওয়া বইলেই চলে।
মনে আছে, ১৯৯২ সালের কোনো এক এপ্রিলের রাতে সে কী ভীষণ ঝড় হলো! আমার দাদির বাড়ির এল শেপের টানা বারান্দার টিন গেল উড়ে। পুরোনো চাপকলের পেছনে স্বপন ভাইদের বাসার সীমানার দিকে ছিল একটা কড়ই আর একটা ডুমুর গাছ। পরদিন সকালে সে দুটোই পপাত ধরণীতল। একমাত্র দোতলা বাদে আমাদের ‘প্রায় নতুন বাড়ি’র সব জানলার কাচ ভেঙে চুরমার।
বস্তুপৃথিবীতে ঝড় যত চুরমার ঘটায়, মনের মধ্যেও তার চেয়ে কম কিছু ঘটায় না। কিন্তু মনের মধ্যে ঝড় উঠলে তার যে মাতঙ্গী রূপ, তা কি আর দেখা যায়? যায় না।
ফলে ঝড়ের রাতেই আকুলি–বিকুলি করে বাঙালির বেয়াড়া মন। আমরা হয়তো বসে থাকি কোনো এক পরানসখার অপেক্ষায়।