আজ বাইশে শ্রাবণ। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুদিন। জীবনভর অজস্র স্বজনের মৃত্যু দেখেছেন তিনি। সে সময় কেমন ছিল তাঁর প্রতিক্রিয়া? কীভাবে শেষ হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের বংশধারা?
‘আমার ঘরেতে আর নাই সে যে নাই—
যাই আর ফিরে আসি, খুঁজিয়া না পাই।
আমার ঘরেতে নাথ, এইটুকু স্থান—
সেথা হতে যা হারায়, মেলে না সন্ধান’
স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতন ফিরে গেলেন। তখন তিনি নতুন প্রতিষ্ঠিত ওই বিদ্যায়তনের শিক্ষাদানপদ্ধতি নিয়ে বিশেষভাবে কাজ করছিলেন। পরীক্ষা–নিরীক্ষা করছিলেন বারবার। সেখানকার কাজে এতটাই মগ্ন হয়ে গেলেন, যেন কোনো কিছুই তাঁর মনঃসংযোগে বিঘ্ন ঘটাতে পারবে না। বাইরে থেকে তাঁকে বেশ শক্ত দেখাত। কিন্তু ভেতরে ভেতরে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ। বিচ্ছেদ ও একাকিত্বের গভীর বেদনার ছাপ কবি প্রকাশ করতেন তাঁর কবিতায়, লেখায়। উপরোক্ত কবিতাটি তখনই লেখা, যা প্রকাশিত হয়েছিল স্মরণ কাব্যগ্রন্থে।
তিন কন্যা ও দুই পুত্রসন্তানের পিতা ছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৯৪১ সালে কবির মৃত্যুর পর আর মাত্র ২৮ বছর কবির ঔরসজাত বংশধরেরা বেঁচে ছিলেন। এই প্রবন্ধে মৃত্যুর দূত কীভাবে রবি ঠাকুরের পরিবারে হানা দিয়েছিল, পাঠককে তা জানাব।
কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির ‘জমিদারপুত্র’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ২২ বছর বয়সে বিয়ে করেছিলেন খুলনার দক্ষিণ ডিহির মেয়ে ৯ বছরের ভবতারিণীকে, পরে রবি ঠাকুরই যাঁর নাম দেন মৃণালিনী দেবী। একেবারেই আড়ম্বরহীন জীবনযাপন করতেন এই মৃণালিনী। দিনের বড় একটা সময় তাঁর হেঁশেলেই কাটত। ভোজনরসিক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আর মৃণালিনীকে নতুন নতুন পদ রান্না করতে হতো। কবির বন্ধুবান্ধব যাঁরা আসতেন, সবাই ‘বৌঠানের’ রান্নার ভক্ত ছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ-মৃণালিনীর দাম্পত্যজীবন ছিল মাত্র ১৯ বছরের। মৃত্যুর সময় মৃণালিনীর বয়স ছিল মাত্র ২৯ বছর। ১৮৭৩ সালে তাঁর জন্ম, আর মৃত্যু ১৯০২ সালে।
মৃণালিনী অসুখে পড়লে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে কলকাতায় নিয়ে গেলেন। চিকিৎসকেরা আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বর্ণনায়, ‘শেষবার আমি যখন তাঁর শয্যাপাশে গেলাম, তখন তিনি কথাও বলতে পারেন না। আমাকে দেখে তাঁর গাল বেয়ে নীরব অশ্রুধারা বইতে লাগল।’
রথীন্দ্রনাথ ও তাঁর ছোট ভাই শমীন্দ্রনাথ তখন খুব ছোট। ওই রাতে তাঁদের তিন বোন বেলা, রানী ও মীরা বাড়িতে উপস্থিত ছিলেন। রাতে কেউ ঘুমাতে পারেননি। রথীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘একটা প্রচ্ছন্ন ভয় আমাদের জাগিয়ে রেখেছিল।’ তিনি লিখেছেন, ‘চিলেকোঠা থেকে মায়ের ঘরটা দেখা যেত। খুব সকালে আমরা সেখানে গেলাম ও ভয়ে ভয়ে উঁকি দিলাম। সারা ঘরে একটা অলক্ষুনে নীরবতা। যেন মৃত্যুর ছায়া সে রাতে গোপনে বাড়ির চারিধার মাড়িয়ে গেছে। কেউ বলে না দিলেও আমরা বুঝতে পারছিলাম যে মা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।’
স্ত্রীর মৃত্যু ছিল রবীন্দ্রনাথের পরিবারে দুঃখের মিছিলের শুরু। শান্তিনিকেতনে ফিরে গিয়ে স্কুলের কাজে যেই মনোনিবেশ করেছেন, অমনি মেজ কন্যা রানীর (রেনুকা দেবী) যক্ষ্মা। তখন এ রোগের কোনো চিকিৎসা ছিল না। কবিগুরু মেয়েকে নিয়ে গেলেন প্রথমে হাজারিবাগ (ঝাড়খন্ড), পরে আলমোড়ার পাহাড়ে (উত্তরাখন্ড)। সেখানে রানীর স্বাস্থের কিছুটা উন্নতি হলো। তা দেখে রানীকে কলকাতায় নিয়ে এলেন কবি; কিন্তু কিছুদিন না যেতেই আবার ফিরে এল যক্ষ্মা। এবার আরও শক্তিশালী রূপে। রানীকে বাঁচানো গেল না। স্ত্রীর মৃত্যুর ৯ মাসের মাথায় মেয়ে রানীকে হারালেন রবীন্দ্রনাথ। কবি এই মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন মাত্র ১০ বছর ৬ মাস বয়সে। রেনুকা বেঁচে ছিল মাত্র ১২ বছর সাত মাস। মাঝের সময়টুকু ছিল তাঁর দাম্পত্যজীবন।
রেনুকার মৃত্যুর পর আবার শান্তিনিকেতনে ফিরে স্কুলের কাজে আত্মনিয়োগ করলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তখনকার দিনে শিক্ষক খুঁজে পাওয়া ছিল বিরাট কঠিন কাজ। রথীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘প্রায়শ শিক্ষক বদলাতে হতো। নতুন শিক্ষক নিয়োগ করা হলে বাবা নিজেই তাঁর প্রশিক্ষণের ভার নিতেন। তাঁকে শিখিয়ে-পড়িয়ে শান্তিনিকেতনের আদর্শের উপযুক্ত করে তুলতেন। তাঁর পরিচালনায় স্কুলের উন্নতি হতে লাগল। মাত্র পাঁচজন ছাত্র নিয়ে এর যাত্রা শুরু হয়েছিল। এ সংখ্যা পঞ্চাশ ছাড়িয়ে গেল।’ প্রসঙ্গত, রথীন্দ্রনাথ ছিলেন প্রথম পাঁচ ছাত্রের একজন।
রথীন্দ্রনাথ ও তাঁর ছোট ভাই শমীন্দ্রনাথ তখন খুব ছোট। ওই রাতে তাঁদের তিন বোন বেলা, রানী ও মীরা বাড়িতে উপস্থিত ছিলেন। রাতে কেউ ঘুমাতে পারেননি। রথীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘একটা প্রচ্ছন্ন ভয় আমাদের জাগিয়ে রেখেছিল।’
স্কুলের যখন এমন উন্নতি, তখনই রবীন্দ্রনাথের কাছে খবর এল পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর অসুস্থ। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের তখন বিশাল ব্যক্তিত্ব, বিরাট প্রভাব। রবীন্দ্রনাথ পড়িমড়ি করে কলকাতায় ফিরে গেলেন। পিতাকে বাঁচানো গেল না। তবু রবীন্দ্রনাথ কলকাতা ছাড়তে পারলেন না। কারণ ঠাকুর পরিবারের কর্তার মৃত্যু হয়েছে। বিষয়সম্পত্তির বিলিবণ্টনসহ নানা কিছু সামনে এল। মহর্ষির মৃত্যুর পর অপ্রত্যাশিতভাবে যৌথ পরিবারটি ভেঙে গেল। কারণ ঠাকুর পরিবারের কেউ আর একসঙ্গে থাকতে চাইলেন না।
ততদিনে রথীন্দ্রনাথ যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে গেছেন। কৃষিবিজ্ঞান নিয়ে পড়ছেন। ছোট ছেলে শমীন্দ্রনাথ ও ছোট কন্যা মীরা দেবীকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ এ সময় শান্তিনিকেতনে থাকতেন। শমীন্দ্র ছিল কল্পনাপ্রবণ। পরিবারের সবার আশা ছিল, শমীন্দ্র একদিন পিতার মতোই বড় কবি হবে; কিন্তু মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক। ছুটি কাটাতে বন্ধুদের সঙ্গে মুঙ্গের (বিহার) গিয়েছিল শমীন্দ্র। সেখানে গিয়ে আক্রান্ত হলো কলেরায়। তখনকার দিনে কলেরা ও যক্ষ্মার মতো রোগের চিকিৎসা ছিল না বললেই চলে। রবীন্দ্রনাথ মুঙ্গের পৌঁছানোর কিছুক্ষণ পর শমীন্দ্রর মৃত্যু হলো। তখন তাঁর বয়স ১১ বছর। পাঁচ বছর আগে মা যেদিন মারা গিয়েছিলেন, সেই একই দিনে মারা গেল শমীন্দ্র (২৩ নভেম্বর, ১৯০৭)।
স্বামীর সঙ্গে কলকাতায় বাস করতেন রবীন্দ্রনাথের বড় কন্যা বেলা (মাধুরীলতা)। রানীর মতো এই বেলারও যক্ষ্মা ধরা পড়ল। বেলাকে রবীন্দ্রনাথ বোধ হয় একটু বেশি ভালোবাসতেন। রথীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘অসুখ ধরা পড়া থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সর্বক্ষণ বাবা তাঁর বিছানার পাশে থাকতেন। বাবা যে যত্ন করতেন আর যেভাবে তাঁকে আনন্দিত রাখতে রাখতে চেষ্টা করতেন, সম্ভবত কোনো নার্সই তা পারত না। বেলার লেখার হাত ভালো ছিল। বাবা কাহিনীর মসলা যোগান দিতেন আর তাঁকে দিয়ে গল্প লেখাতেন।’ বেলার মৃত্যু রবীন্দ্রনাথকে বড় আঘাত দিয়েছিল। মৃত্যুর সময় বেলার বয়স হয়েছিল ৩১ বছর ৬ মাস।
তবে ছেলেমেয়েদের অসুস্থতা, একের পর এক মৃত্যু হলেও রবীন্দ্রনাথের কলম থেমে থাকেনি। মেজ কন্যা রানীকে যখন আরোগ্য লাভের আশায় এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যাচ্ছেন, সে সময়টায় তিনি লেখেন চোখের বালি ও ‘নৌকাডুবি’র মতো উপন্যাস। একটি অধ্যায় লেখা হলেই তিনি পত্রিকায় পাঠিয়ে দিতেন। নিজে যত দুঃখ–কষ্টের মধ্যে থাকুন না কেন, পত্রিকার সম্পাদকদের অপেক্ষায় রাখতেন না। রথীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘চারপাশের পরিবেশগত বা মানসিক এত ঝড়-ঝঞ্ঝার মধ্যেও যে গল্প, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ আর অন্যান্য লেখার স্রোত বয়ে গেছে, আবেগ নিয়ন্ত্রণের পূর্ণ ক্ষমতা আর সৃষ্টির অদম্য তাড়না না থাকলে তা সম্ভব হতো না।’
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, কবির পাঁচ পুত্র-কন্যার মধ্যে তিনজন—বেলা, রানী ও শমীন্দ্র কবির জীবদ্দশাতেই মারা যান। রইলেন কেবল পুত্র রথীন্দ্রনাথ ও কন্যা মীরা দেবী।
কবির বয়স তখন ৭১ বছর। এ সময় সব পরীক্ষা–নিরীক্ষায় নিশ্চিত হলো পুত্র রথীন্দ্রনাথের ঔরসে সন্তান হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। রথীন্দ্রনাথের স্ত্রী প্রতিমা দেবী সারা জীবন ‘বাবা–মশায়ের’ সেবাযত্ন করেই কাটিয়েছেন। রথীন্দ্রনাথ নন্দিনী (পুপে) নামের একটি মেয়েকে দত্তক নিলেন। এই নন্দিনীও নিঃসন্তান ছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের মেয়ে মীরা আর জামাতা নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের পুত্র নীতিন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় এবং তাঁর বোন নন্দিতা গঙ্গোপাধ্যায় (বুড়ি) তখন রবীন্দ্রনাথের একমাত্র জীবিত বংশধর। জার্মানিতে পড়াশোনার সময় নীতিন্দ্রনাথ মারা যান ১৯৩২ সালের ৭ আগস্ট। আর নন্দিতাও নিঃসন্তান ছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রয়াত হন ১৯৪১ সালে। এর কুড়ি বছর পর ১৯৬১ সালে মারা যান পুত্র রথীন্দ্রনাথ। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন তিনি। এরপর ১৯৬৭ সালে মৃত্যু হয় নাতনি নন্দিতার। তখন কবির ঔরসজাত বংশধর ছিলেন কেবল কন্যা মীরা দেবী। এই মীরাও শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন মেয়ের (নন্দিতা) মৃত্যুর দুই বছর পর, ১৯৬৯ সালে। তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে শেষ হয়ে গেল কবির বংশধর।
সূত্র: ‘আমার বাবা রবীন্দ্রনাথ’, রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অনুবাদ: কবির চান্দ। রথীন্দ্রনাথের ‘অন দ্য এজেস অব টাইম’ বইটির প্রথম অনুবাদ করেন ক্ষিতীশচন্দ্র রায়। তিনি নামকরণ করেছিলেন ‘পিতৃস্মৃতি’। কবির চান্দর অনুবাদে নাম হয় ‘আমার বাবা রবীন্দ্রনাথ’। প্রকাশক অ্যাডর্ন পাবলিকেশন।