চৈত্রসংক্রান্তি কীভাবে এল

আজ ১৪২৯ বঙ্গাব্দের শেষ দিন—চৈত্রসংক্রান্তি। আগামীকাল সূর্যোদয়ের মধ্য দিয়ে শুরু হবে নতুন বাংলা বছর ১৪৩০। কিন্তু চৈত্র মাসের শেষ দিনে যে চৈত্রসংক্রান্তির উৎসব, বাংলার লোকাচারে তা কীভাবে এল?  

চৈত্রসংক্রান্তির দিনে গ্রামীণ জনপদে চলে নানা অনুষ্ঠান

মফস্বল শহরে বেড়ে ওঠা। প্রতিবছর একটা নির্দিষ্ট দিনে বাসায় এক ঠাকুরমার আগমন ঘটত। মাথা মুড়ানো, সাদা একথান কাপড়ে আপাদমস্তক ঢাকা সেই ঠাকুমার উপস্থিতি আমাদের জানিয়ে দিত—আজ বাংলা বর্ষের শেষ দিন। নাম তার চৈত্রসংক্রান্তি। তিনি তাঁর কাঁধে ঝোলানো এক মস্ত ঝোলা থেকে একে একে বের করতেন ১৪ পদের শাক। মায়ের কাছ থেকে শুনেছি, নাম অজানা সেই ঠাকুরমা জলাজঙ্গল, ঝোপঝাড় থেকে এই ১৪ প্রকার শাক তুলে আনতেন। চৈত্রসংক্রান্তির দিনে মাছ-মাংস খেতে নেই। খেতে হবে শুধু শাক-ভাত। তবে পাতে পড়া শাক আবাদি হলে চলবে না, হতে হবে অনাবাদি। শাক-ভাতের এই যুগলবন্দী আমাদের কাছে শাকান্ন নামে পরিচিত ছিল।

আদিকাল থেকেই বাংলার ঘরে ঘরে চৈত্রসংক্রান্তি উৎসবের প্রচলন ছিল। চৈত্র মাসে গ্রামীণ জীবনে আনন্দের ফল্গুধারা ছোটে। দেশের কিছু অঞ্চলে, বিশেষ করে মধ্যাঞ্চলে চৈত্রসংক্রান্তির দিন ছাতু উৎসবের প্রচলন আছে। বাড়ির প্রত্যেক সদস্যকে এদিন চাল কিংবা গমের ছাতু অবশ্যই খেতে হবে। চৈত্রসংক্রান্তির দিন বিকেলবেলায় নদীর ধারে দাঁড়িয়ে কুলোর বাতাসে ছাতু ওড়ান গ্রামের মা-বউ-ঝিরা। এ সময় গ্রামের কিশোর–কিশোরীরা সুর করে ছড়া কাটেন—‘শত্রুর মুখে দিয়া ছাই, ছাতু উড়াইয়া ঘরে যাই’।

বইপত্র ঘেঁটে যতটুকু জানা যায়, আদিকাল থেকেই বাংলার ঘরে ঘরে চৈত্রসংক্রান্তি উৎসবের প্রচলন ছিল। চৈত্র মাসে গ্রামীণ জীবনে আনন্দের ফল্গুধারা ছোটে। দেশের কিছু অঞ্চলে, বিশেষ করে মধ্যাঞ্চলে চৈত্রসংক্রান্তির দিন ছাতু উৎসবের প্রচলন আছে। বাড়ির প্রত্যেক সদস্যকে এদিন চাল কিংবা গমের ছাতু অবশ্যই খেতে হবে। চৈত্রসংক্রান্তির দিন বিকেলবেলায় নদীর ধারে দাঁড়িয়ে কুলোর বাতাসে ছাতু ওড়ান গ্রামের মা-বউ-ঝিরা। এ সময় গ্রামের কিশোর–কিশোরীরা সুর করে ছড়া কাটেন—‘শত্রুর মুখে দিয়া ছাই, ছাতু উড়াইয়া ঘরে যাই’। ছাতু ওড়ানোর পালা শেষ হতেই শুরু হয় নদীর পানিতে একে অপরকে ভিজিয়ে দেওয়ার খেলা। বছরের শেষ গোধূলিতে এই ভিজিয়ে দেওয়া পুণ্যস্নানের সূচনা বলে মনে করা হয়।

চৈত্রসংক্রান্তিতে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে বসে মেলা

চড়ক চৈত্রসংক্রান্তির অন্যতম প্রধান লোক উৎসব। মূলত চড়ক গাজন উৎসবের একটি প্রধান অঙ্গ। চৈত্র মাসের শেষ দিন অনুষ্ঠিত হয় চড়কপূজা। চৈত্র মাসে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা শিবের পূজা করে থাকেন। প্রচলিত মতে, পরম শিবভক্ত বাণরাজা যুদ্ধ করেছিলেন দ্বারকার অধিপতি তথা বিষ্ণুর অবতার কৃষ্ণের বিরুদ্ধে। যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত হওয়ার পর অমরত্ব পাওয়ার আশায় তিনি চৈত্র মাসের শেষ দিনে অনুচরদের নিয়ে নাচেগানে আত্মহারা হয়ে নিজের শরীরের রক্ত বের করেন শিবের উদ্দেশে। সেই ঘটনার স্মৃতিতেই প্রতিবছর চড়ক উৎসব পালন করা হয়। তবে এ নিয়ে ভিন্নমতও রয়েছে।

চড়ক উৎসব সম্পর্কে আর একটি প্রচলিত মত, উপমহাদেশজুড়ে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব হ্রাসের সময় কয়েকজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী আশ্রয় নিয়েছিলেন বাংলায়। পরে তাঁরা হিন্দুধর্ম গ্রহণ করেন। ফলে হিন্দুধর্মে মিশে যায় কিছু বৌদ্ধ তন্ত্রমন্ত্রের সাধনা। এই তান্ত্রিক ক্রিয়া থেকেই পরবর্তীকালে উদ্ভব চড়কপূজার। চড়কপূজায় যোগদানকারী সন্ন্যাসীরা তান্ত্রিক সাধনা অভ্যাসের ফলে নিজেদের শারীরিক কষ্টবোধের ঊর্ধ্বে চলে যান। ৩০–৪০ ফুট উঁচু চড়কগাছ থেকে পিঠে বড়শি গেঁথে শিবভক্তদের দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় চড়কপূজায়। জিবে বা শরীরের কোনো জায়গায় লোহার শিক গেঁথে দেওয়া, ভাঙা কাচের টুকরা কিংবা জ্বলন্ত কয়লার ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া ইত্যাদি দেখা যেত গাজন উৎসবে । তবে বর্তমানে নৃশংসতার অভিযোগে অনেক ক্ষেত্রেই লোকায়িত জীবনে গাজন উৎসবের প্রচলন নেই বললেই চলে।

সূর্য ডোবার মধ্য দিয়ে আজ শেষ হয়ে যাবে চৈত্রসংক্রান্তি

বাংলাজুড়ে যখন জমিদারি ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল, তখন ঘোড়ায় চড়ে চৈত্র মাসের শেষে জমিদারেরা প্রজাদের বাড়িতে যেতেন। জমিদারেরা প্রজাদের খোঁজখবর নিতেন। সেই ঐতিহ্যের সূত্র ধরে ঘোড়ায় চড়ে একজন কাল্পনিক জমিদার চৈত্র মাসের শেষ দিন সবার বাড়িতে ঘোড়ায় চড়ে উপস্থিত হতেন। অবিভক্ত বাংলার উত্তরাঞ্চলজুড়ে, বিশেষ করে রাজবংশী সমাজে ঘোড়া উৎসবের প্রচলন ছিল। তবে চৈত্রসংক্রান্তির ঘোড়া উৎসব আজ লুপ্ত হতে বসেছে।

একসময় লোকায়িত জীবনে শাকান্ন-চড়ক-গাজন কিংবা ঘোড়া উৎসবের ভিড় ঠেলে পয়লা বৈশাখ নতুন আশা নিয়ে উদিত হতো। কিন্তু লোকজ উৎসবের পরম্পরাটাই বর্তমানে বদলে গেছে। তবু প্রতিবছর চৈত্রসংক্রান্তি পেরিয়ে পয়লা বৈশাখ আসে। আমরা তাকে বরণ করি। জরাজীর্ণতা, মারি ভুলে আনন্দে মাতোয়ারা হই। কিন্তু চৈত্রের শেষ দিনের মোচড় সেই শাকান্ন আহার, সেই ঠাকুমাকে বড্ড মিস করি।