আজ নন্দিত লেখক হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুদিন। তাঁর জন্ম ও মৃত্যুদিনে এখনো আমরা এই লেখকের ‘দুই বিয়ে বা শওন অথবা হিমু, বাকের ভাই, জ্যোৎস্না, চিরকুট, বৃষ্টি’—এই টেমপ্লেটের বাইরে সেভাবে কিছু বলি না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লোকজন যা পছন্দ করে, তা–ই বলবে, সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু বেশির ভাগ সাহিত্য পত্রিকাগুলোও সেই একই টেমপ্লেট মেনে চলে। সেখানে হুমায়ূন আহমেদের ‘সাহিত্য’ আলোচনার নামে আলোচিত হয় লেখকসংক্রান্ত নস্টালজিক আলাপ। একই চর্বিতচর্বণ। সেই একই রকম তকমার ফুলঝুরি—কালজয়ী নক্ষত্র আর শব্দের জাদুকর।
কে যে আমাকে কবে অ্যান টেইলরের বই হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল, সেটা কিছুতেই মনে করতে পারি না। কিন্তু একদিন ভোরবেলায় যখন প্রথমবার টেইলর পড়তে বসলাম, আমি চমকে উঠলাম। গল্প বলার এ ছক আমার চেনা।
অ্যান টেইলর বলছেন ঘরের গল্প, বাড়ির গল্প। সেখানে মফস্সলীয় মধ্যবিত্ত পরিবার আছে। পরম মমতায় গড়া ‘মিসফিট’ চরিত্র আছে। আপাতদৃষ্টে স্বাভাবিক মনে হওয়া লোকেদের আচানক ‘অ্যাবসার্ড’ আচরণ আছে। আর এই সবকিছুর মাঝে ছড়িয়ে আছে মৃত্যু, প্রেম, শোক ও সুখের নিত্য আসা-যাওয়া।
আমি কেন, বঙ্গমুলুকের পাঠকমাত্রই গল্পের এই ছক চেনেন। ঘরের গল্প, বাড়ির গল্প, মধ্যবিত্ত পরিবারের সুখ-দুঃখ-সন্তাপের গল্প দিয়ে হুমায়ূন আহমেদ আমাদের মুগ্ধ করে রেখেছেন অন্তত গত চার যুগ। মাজেদা খালা আমাদের চির ‘অ্যাবসার্ড’, আর আতাহার বা বাদল আমাদের চিরচেনা ‘মিসফিট’। হিমুকে ঠিক ‘মিসফিট’ বলা যায় কি না, তা অবশ্য এখন আর আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি না। অন্য কেউ হয়তো বলবে। মিসফিটের প্রতি পক্ষপাতিত্ব? সে তো আমরা দীর্ঘকাল ‘ক্ল্যাসিক হুমায়ূন আহমেদ’ বলেই জেনেছি।
অ্যান টেইলর পড়তে শুরু করেছিলাম ‘দ্য টিন ক্যান’ নামের এক উপন্যাস দিয়ে। ছয় বছর বয়সী বালিকার মৃত্যুতে এক বাড়ির সদস্যদের নানা কাণ্ডকারখানা, অনুভূতি আর আবেগ (বা নিরাবেগ) নিয়ে উপন্যাস। কাহিনি-সংক্ষেপ শুনে বোঝা কঠিন যে কেন ‘দ্য টিন ক্যান’ পড়ে ‘মন্দ্রসপ্তক’ মনে পড়ে অথবা খানিকক্ষণের জন্য সুপ্রভাকে রোজ পাইক মনে হয়। কিন্তু আপনি যদি হুমায়ূন আহমেদ পড়ে অ্যান টেইলর পড়তে বসেন, এই ‘মনে পড়া’ বা ‘মনে হওয়া’ থেকে আপনার রক্ষা নেই।
অ্যান টেইলর আর হুমায়ূন আহমেদের লেখাসংক্রান্ত মিলের কথা যে বন্ধুকে প্রথম বলেছিলাম, সে অবাক না হয়ে আঁতকে উঠেছিল। স্বভাবতই প্রশ্ন এসেছিল, নকল নাকি? বেচারার দোষ নেই। সে তখনো মাতিল্ডা–সংক্রান্ত শোক কাটায়ে উঠতে পারেনি। তাকে যুক্তি-তর্ক-উদাহরণ দিয়ে বোঝানো হলো হুমায়ূন আহমেদ আর টেইলরের গল্পে যে সূক্ষ্ম থিমেটিক মিল, তা নকল করে সৃষ্টি করা যায় না। নকল আরও স্থূল বিষয়, তার ছায়া ঢাকা কঠিন। এদের লেখায় যে মিল, তাকে ঠিক ‘মিল’ বলাও বোধ হয় উচিত হবে না, বড়জোর একধরনের আত্মীয়তা আছে বলা যায়। তবে ইদানীং জানতে ইচ্ছা করে, হুমায়ূন আহমেদ কি টেইলর পড়তেন? টেইলর থেকে কি তিনি অনুপ্রাণিত? সুপ্রভা বা রাবেয়ার কোথাও কি ছিটেফোঁটা রোজ পাইকও ছিল? হতে পারে, না–ও হতে পারে। তবে এই লেখায়-লেখায় ‘আত্মীয়তা’ ধরতে পারার এক পরম আনন্দ আছে। পাঠকসুলভ নির্দোষ আনন্দ। তাতে যা কিছু ভালোবেসে পড়ি ও পড়তে চাই, তার আরেকটু কাছাকাছি যাওয়া যায়।
কিন্তু বেছে বেছে হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুদিবসে কেন অ্যান টেইলর প্রসঙ্গ বলতে বসলাম? একটাই কারণ। হুমায়ূনীয় দুই দিবসে আমরা এখনো এই লেখকের ‘দুই বিয়ে বা শাওন অথবা হিমু, বাকের ভাই, জ্যোৎস্না, চিরকুট, বৃষ্টি’—এই টেমপ্লেটের বাইরে কিছু বলি না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লোকজন যা পছন্দ করে, তা–ই বলবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বেশির ভাগ সাহিত্য পত্রিকাও সেই একই টেমপ্লেট মেনে চলে। সেখানে হুমায়ূন আহমেদের ‘সাহিত্য’ আলোচনার নামে আলোচিত হয় লেখকসংক্রান্ত নস্টালজিক আলাপ। একই চর্বিতচর্বণ। সেই একই রকম তকমার ফুলঝুরি—কালজয়ী নক্ষত্র আর শব্দের জাদুকর।
অথচ অ্যান টেইলর না হোক, অন্তত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাসের সঙ্গে হুমায়ূন সাহিত্যের ‘যোগাযোগ’ নিয়ে কথা হতে পারত। যোগাযোগ প্রসঙ্গে হয়তো তাঁদের কোনো একজনের সীমাবদ্ধতা উঠে আসত, কারও শক্তির দিক। কোথাও অনুপ্রেরণার ছায়া পাওয়া যেত, কোথাও হয়তো সরাসরি প্রভাব। কিন্তু সেই সব আলোচনা কোথাও নেই। কেন নেই? আমার নিতান্তই ব্যক্তিগত ধারণা হলো, হুমায়ূন আহমেদকে আমাদের সাহিত্যবিশ্লেষকেরা যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে দেখেননি। অন্তত এখনো পর্যন্ত নয়। আমি আশা করি ও বিশ্বাস করি, আমাদের সাহিত্যবিশ্লেষকদের ব্যাপক পড়াশোনা আছে। একটু চোখ মেলে দেখতে গেলেই তাঁরা মাইক্রো সেকেন্ডের মধ্যে খেয়াল করতেন, জেন স্মাইলি, মেরিলিন রবিনসন, সুবোধ ঘোষের সঙ্গে হুমায়ূন–সাহিত্যের গাঢ় সখ্য। সেই সখ্যের পরতে পরতে গল্পের তবক।
তবে সেসব আর হচ্ছে কই? চারদিকে কেবল মাতমের মতো উচ্চারিত হচ্ছে—‘আহারে তিনি আমাদের জ্যোৎস্না ও বৃষ্টি দেখতে শেখালেন’।