দ্য ইকোনমিস্ট গত জুলাই মাসে প্রকাশ করেছে সর্বকালের সেরা ৫০০ বইয়ের তালিকা।
দ্য ইকোনমিস্ট গত জুলাই মাসে প্রকাশ করেছে সর্বকালের সেরা ৫০০ বইয়ের তালিকা।

‘ললিতা’ বা ‘রেবেকা’র চেয়ে বেশি জনপ্রিয় ‘শত বছরের নিঃসঙ্গতা’

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম দ্য ইকোনমিস্ট গত জুলাই মাসে প্রকাশ করেছে সর্বকালের সেরা ৫০০ বইয়ের তালিকা। সেখানে প্রথম নামটি ‘ওয়ান হানড্রেড ইয়ারস অব সলিটিউড’।

‘বিছানায় লুটোপুটি করে ওরা জেগে ছিল সকাল হওয়া পর্যন্ত। আর তখন শোবার ঘরের ভেতর অন্যদিকে যে বাতাস বয়ে যাচ্ছিল, তা ছিল প্রুদেনসিও আগিলারের আত্মীয়দের কান্নায় ভারী।’

গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের লেখা ‘ওয়ান হানড্রেড ইয়ারস অব সলিটিউড’ বাংলায় ‘নিঃসঙ্গতার এক শ বছর’ বইয়ের সামান্য অংশ এটুকু। শুধু গত শতাব্দীর নয়, বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের এই সৃষ্টি এক হীরকখণ্ড। উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের সাহিত্যে আধুনিকতা এবং কিউবায় ভ্যানগার্ডিয়া শিল্প-আন্দোলনের অনুপ্রেরণা ছিল এই উপন্যাস। সে নামই উঠে এসেছে সর্বকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় বইয়ের তালিকার প্রথমে।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম দ্য ইকোনমিস্ট গত জুলাই মাসে প্রকাশ করেছে সর্বকালের সেরা ৫০০ বইয়ের তালিকা। সেখানে প্রথম নামটি ‘ওয়ান হানড্রেড ইয়ারস অব সলিটিউড’। এভাবে প্রথম ১০-এ স্থান পেয়েছে ধারাবাহিকভাবে ‘দ্য গ্রেট গ্যাটসবি’, ‘ইউলিসিস’, ‘দ্য ক্যাচার ইন দ্য রাই’, ‘নাইনটিন এইট্টি ফোর’, ‘ইন সার্চ অব লস্ট টাইম’, ‘ললিতা’, ‘টু কিল আ মকিং বার্ড’, ‘মবি ডিক’ এবং ১০ নম্বরে ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’।

দ্য ইকোনমিস্ট গত জুলাই মাসে প্রকাশ করেছে সর্বকালের সেরা ৫০০ বইয়ের তালিকা।

ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনটির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে গড় পাঠের সময় প্রকাশ। এই ৫০০ বইয়ের কোনটি পড়তে কতক্ষণ সময় প্রয়োজন হবে, তা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে করে পাঠক সহজেই বই নির্বাচনের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন যে তিনি কোন বইটি ঘরে নিয়ে পড়তে বসবেন। যেমন প্রথম ১০টি জনপ্রিয় বইয়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সময় লাগবে তালিকার ষষ্ঠ বই ‘ইন সার্চ অব লস্ট টাইম’ পড়তে। টানা পড়লেও তিন দিনের বেশি সময় লাগবে এটা শেষ করতে। কিন্তু এটা পাঠককে মানতেই হবে। এখানে সংক্ষিপ্ত কোনো রাস্তা নেই। যে উপন্যাস লিখতে লেখকের ১৩ বছর সময় লেগেছে, সে বই তো আর এক বসায় পড়ে হাত ধুয়ে উঠে যাওয়ার সুযোগ নেই। এর ওপর আবার আছে এর ভারিক্কি বিষয়ের ব্যাপার। বোঝাই যাচ্ছে যে ১৯১৩ সালে প্রকাশিত মার্শেল প্রুস্তের ‘ইন সার্চ অব লস্ট টাইম’ অথবা বাংলায় ‘হারিয়ে যাওয়া সময়ের সন্ধানে’র বইটি একেবারে পাঁড় পাঠকের জন্যই।

তালিকার প্রথম দশের মধ্যে সবচেয়ে কম সময় প্রয়োজন হবে দ্বিতীয় সেরা বই ‘দ্য গ্রেট গ্যাটসবি’ শেষ করতে। মার্কিন কথাসাহিত্যিক এফ স্কট ফিটজেরাল্ডের লেখা ১৯২৫ সালের এ লেখা শেষ করা যাবে মাত্র দুই ঘণ্টায়।

দ্য ইকোনমিস্ট এই ৫০০ বইয়ের তালিকা পাঠকের জন্য তুলে ধরেছে বিখ্যাত জার্মান দার্শনিক শোপেন হাওয়ারের একটি বক্তব্য দিয়ে। ১৯ শতকের এই দার্শনিক বলেছিলেন, ‘ভালো বই পড়ার পূর্বশর্ত হচ্ছে, খারাপ বই না পড়া। কারণ, জীবনের সময় আসলে সংক্ষিপ্ত।’ তবে উনিশ শতকের যে সময়কালে দাঁড়িয়ে শোপেনহাওয়ার এ বক্তব্য দিয়েছিলেন, তখনকার চেয়ে মানুষের গড় আয় কিছুটা বেড়েছে। কথা হচ্ছে, বইয়ের সংখ্যাও তো দিন দিন বাড়ছে। তাই শোপেনহাওয়ারের বই বেছে পড়ার উপদেশটি এখন আরও অনেক বেশি মূল্যবান হয়েছে। মানুষের হাতে আর এখন অঢেল সময় নেই এলিয়ে বই পড়ার। এর ওপর রয়েছে প্রযুক্তির আসক্তি। তাই বই পড়তে হবে বেছে, গুছিয়ে, নিজের প্রয়োজনের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে। আর এসব দিক বিবেচনা করেই ইকোনমিস্ট তৈরি করেছে এই গুরুত্বপূর্ণ তালিকা।

দ্য ইকোনমিস্ট গত জুলাই মাসে প্রকাশ করেছে সর্বকালের সেরা ৫০০ বইয়ের তালিকা।

এই প্রতিবেদনের আরেকটি জরুরি বিষয় হচ্ছে, পাঠের সময় সম্পর্কে পাঠককে একটি ধারণা দেওয়া। এই ৫০০ জনপ্রিয় বইয়ের ৬৮ শতাংশ বই হচ্ছে ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত, যার সংখ্যা ৩৪২। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বই ৮ শতাংশ ফরাসি, তৃতীয়তে আছে ৬ শতাংশ বই যা জার্মান ভাষায় লেখা আর চতুর্থতে আছে ৪ শতাংশ নিয়ে রুশ ভাষায় লেখা বই। এ তালিকার সবচেয়ে পুরোনো বইটির বয়স হাজার বছর।

৭৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে রচিত হোমারের ‘ইলিয়াড’ নামের সে মহাকাব্য পড়তে গড়ে সময় লাগবে ১০ ঘণ্টা ৪১ মিনিট। ‘ইলিয়াড’ কাব্যের পরবর্তী খণ্ড হিসেবে উল্লেখ করা হয় ওডিসির নাম। তবে ওডিসি তালিকার প্রথম দশে না থাকলেও এটিও হোমারের রচনা বলে মনে করেন বইবোদ্ধারা। আর এই দুটিকেই ধরা হয় পাশ্চাত্য সাহিত্যের সবচেয়ে পুরোনো সাহিত্যকর্ম হিসেবে। ফলে আগ্রহ না থাকলেও এত পুরোনো সাহিত্যকর্ম বিবেচনা করে পাঠক নিজের তালিকায় রাখবেন কি না, ভেবে দেখতে পারেন।

তালিকার ৩৭ নম্বরে থাকা এই গ্রিক মহাকাব্য নিয়ে যদি আপনার অনেক আগ্রহ না–ও থাকে; এর ঠিক পরের বইটির নাম কিন্তু পাঠককে টানবেই। কেননা এটি তুমুল জনপ্রিয় ও ব্যাপক আলোচিত-সমালোচিত লেখক সালমান রুশদির লেখা ‘মিডনাইট চিলড্রেন’। তালিকার ৩৮ নম্বরের এই বইয়ের লেখক যে সম্প্রতি ছুরিকাহত হয়ে গুরুতর আহত হয়েছিলেন, তা খোঁজখবর রাখা পাঠককুলের সবাই জানেন। লেখকের জীবনে হামলার ঘটনা এই প্রথম নয়। ‘স্যাটানিক ভার্সেস’–এর পর গোটা বিশ্বেই এ নিয়ে তোলপাড় হয়েছে। এখনো বিভিন্ন দেশে নিষিদ্ধ আছে সে বই। ‘মিডনাইট চিলড্রেন’ হচ্ছে ঔপনিবেশিক শাসন থেকে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার দিকে যাত্রাপথের সময়কালের এক উত্তরাধুনিক উপন্যাস। এ বই টানা পড়তে পাঠকের সময় লাগবে ১৩ ঘণ্টা ৩৪ মিনিট।

এসব ভারী বইই যে শুধু জনপ্রিয়, মোটেও তা না। আজীবনই মানুষের রহস্য, ভয়, গোয়েন্দাগল্প নিয়ে আগ্রহ অনেক বেশি। ব্রাম স্ট্রোকারের লেখা সেই বিখ্যাত ‘ড্রাকুলা’ তাই ঠিকই ঠাঁই করে নিয়েছে প্রথম ৫০টি বইয়ের মধ্যেই। ১৮৯৭ সালে প্রকাশিত এ বই পড়তে সময় প্রয়োজন হবে ৯ ঘণ্টার একটু বেশি। তবে ‘ড্রাকুলা’র মতো এই গথিক হরর নিয়ে মানুষের যেমন আগ্রহ রয়েছে, তেমনি আছে বাস্তবের ভয়ের গল্প নিয়ে। আর সেটা যদি হয় এক শিশুর জবানবন্দিতে, তাহলে এর প্রভাব সময়কালকে অতিক্রম করে যায়। তা–ই ঘটেছে ‘আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি’ নিয়েও।

ইতিহাসের এক নৃশংস ভয়াবহ সময়ের কথা সামান্য কয়েকটি পৃষ্ঠায় টুকে রেখেছিল ছোট্ট মেয়ে আনা। ১৯৪২ সালের ১২ জুন ১৩তম জন্মদিনে পাওয়া ডায়েরিটা তার নিজের কাছে ছিল দুবছরের বেশি সময়। গোপন ডেরায় পরিবারের সঙ্গে লুকিয়ে থাকার কালে নাৎসি বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার আগপর্যন্ত এ ডায়েরি ছিল ওর কাছে। সে ডায়েরি পরবর্তী সময়ে অনূদিত হয়েছে ৬০টির বেশি ভাষায়। শোনা যায়, এর বিক্রির সংখ্যা ৩০ মিলিয়ন কপির বেশি। এটা পৃথিবীর অন্যতম বিখ্যাত বইগুলোর মধ্যে একটা। আনার সেই ডায়েরি আছে তালিকার ৬০ নম্বরে। ১৯৪৭ সালে প্রকাশিত অল্প কয়েক পাতার মন খারাপ করা ডায়েরিটা পড়তে সময় লাগবে ঠিক সাড়ে তিন ঘণ্টা।

আর চূড়ান্ত ব্যঙ্গাত্মক রূপক উপন্যাস যেখানে শুয়োর, ঘোড়ার মতো প্রাণীদের রূপকভাবে বিভিন্ন রাজনৈতিক চরিত্র ভাবা হয়েছে, সেই ‘অ্যানিমেল ফার্ম’ আছে ৭৫ নম্বরে। জর্জ অরওয়েলের এই বই পড়তে গড়ে সময় লাগবে ১ ঘণ্টা ৪৬ মিনিট। তবে এর চেয়ে এগিয়ে আছে এক বিদেশির চোখে দেখা ভারতবর্ষের বর্ণনা নিয়ে লেখা ই এম ফস্টারের ‘আ প্যাসেজ টু ইন্ডিয়া’ বইটির জনপ্রিয়তা। সর্বকালের সেরা বইয়ের তালিকায় ৫৩ নম্বরের বইটি পড়তে সময় লাগবে ৫ ঘণ্টা ৪৯ মিনিট।

৫০০ বইয়ের তালিকার শততম বইটি এরিখ মারিয়া রেমার্কের সেই বিখ্যাত ‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’। প্রায় শত বছর ধরে তুমুল জনপ্রিয় থাকা এ বই পড়তে পাঠকের সময় লাগবে মাত্র সাড়ে চার ঘণ্টা।

এই ৫০০ বইয়ের তালিকার মধ্যে আছে ‘গালিভার ট্রাভেলস’, ‘ডেভিড কপারফিল্ড’, ‘লা মিজারেবল’, ‘থিংস ফল অ্যাপার্ট, ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’, ‘দ্য মাস্টার অ্যান্ড মার্গারিটা’, ‘দ্য স্কারলেট লেটার’, ‘দ্য লিটল প্রিন্স’, ‘আ ফেয়ারওয়েল টু আর্মস’–এর মতো এমন অসংখ্য জনপ্রিয় বই, যা অনূদিত হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায়। আর বাংলা অনুবাদেও পড়েছেন অনেক পাঠক।

৫৭ নম্বরের গথিক ফিকশন ‘রেবেকা’ পড়তে পাঠককে বইয়ের পাতায় চোখ রাখতে হবে আট ঘণ্টার মতো। আর তালিকার ৫ নম্বরের বই রুশ-মার্কিন লেখক ভ্লাদিমির নভোকভের লেখা আলোচিত-সমালোচিত ‘ললিতা’ পড়তে হবে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টায়।

দ্য ইকোনমিস্ট গত জুলাই মাসে প্রকাশ করেছে সর্বকালের সেরা ৫০০ বইয়ের তালিকা।

শেক্‌সপিয়ার, লিও তলস্তয়, ফিওদর দস্তয়েভস্কির মতো কালজয়ী লেখকদের অধিকাংশ উপন্যাসই স্থান পেয়েছে এ পছন্দের তালিকায়। আছে সাধারণ পাঠকের না জানা অনেক প্রখ্যাত লেখকের বইয়ের নাম। এই তালিকায় একটা মজার ব্যাপার আছে। এক নম্বরে থাকা ‘নিঃসঙ্গতার এক শ বছর’–এর লেখক জগদ্বিখ্যাত গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসেরই আরেকটি বিখ্যাত উপন্যাস ‘লাভ ইন দ্য টাইম অব কলেরা’র পাঠকপ্রিয়তা কিন্তু প্রথম ১০০–এর মধ্যে নেই। ওটা তালিকার ১১২ নম্বরে।

বিনোদন হিসেবে আপনি বইকে সঙ্গী করবেন কি না, সেটি পাঠকের রুচি। এ ক্ষেত্রে আমরা শুধু দ্য ইকোনমিস্ট-এর আরেক সাংবাদিকের লেখা একটি বক্তব্য আপনাদের জানাতে পারি। বই নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে ওই গণমাধ্যমের জ্যেষ্ঠ ডিজিটাল এডিটর ব্রুক আনগার মন্তব্য করেছেন, বই বিক্রেতারা বলেন যে বিনোদনের সবচেয়ে সস্তা উপকরণ হচ্ছে বই। একটা সিনেমা দেখার টিকিটের দাম দিয়ে একটা পেপারব্যাক বই কেনা যায়। ‘ডক্টর জিভাগো’ সিনেমাটি দেখতে সময় লাগবে ৩ ঘণ্টা, কিন্তু এই উপন্যাস গড়গতিতে পড়লে তা পাঠককে বিভোর করে রাখবে ১২ ঘণ্টার বেশি সময়।