ব্যস্ত নগর ঢাকা। এ শহরে প্রতিক্ষণেই ছুটছে মানুষ। এই ছোটাছুটির যেন শেষ নেই। কিন্তু ঢাকা শহরে মানুষ কি মানুষের জন্য অপেক্ষা করে?
আমি অনেক দিন অপেক্ষায় ছিলাম। অপেক্ষায় ছিলাম আমার এক বন্ধুর সঙ্গে দুর্দান্ত এক বিকেল কাটানোর। অপেক্ষায় ছিলাম খুব প্রিয় কোনো একটা জায়গায় বেড়াতে যাওয়ার। অপেক্ষায় ছিলাম বাড়ির সামনে জলাধারে চায়ের পেয়ালা আর ঝালমুড়ির বাটি হাতে মুষলধারায় বৃষ্টি দেখার। অপেক্ষায় ছিলাম আমার ভীষণ অভিমানের মুহূর্তে আমার কোনো এক বন্ধু মাথায় হাত বুলিয়ে দুদণ্ড পাশে বসে বলবে, ‘এত দিন কোথায় ছিলেন’?
মানুষের চোখ পাখির নিড়ের মতো নয়। মানুষ বনলতা সেনও হয়তো নয়। তবু মানুষই মানুষের জন্য অপেক্ষা করে। আর কবিরা সেই অপেক্ষাকে নানা উপমায় ভূষিত করে মহিমা দেন। ফলে আমরা অপেক্ষা করতে ভালোবাসি। যেমন আমিও অপেক্ষায় ছিলাম একদিন সব মেঘ সরে গিয়ে আলোঝলমলে এক সূর্য উঠবে। হ্যাঁ, সেই উজ্জ্বল মুহূর্তের প্রতীক্ষায় আমি ছিলাম।
কিন্তু যা কিছুর অপেক্ষায় আমার দিনযাপন, তার কিছুই আমি পাইনি। তার কিছুই আমার দুই হাতের মুঠোয় এসে ধরা দেয়নি। কিন্তু অপেক্ষার শেষও তো হয়নি।
আমরা এখন সবকিছু উদ্যাপন করতে চাই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমনির্ভর আমাদের নাগরিক জীবনে আমরা আসলেই সবকিছু উদ্যাপন করতে চাই। তবে সেটা নিজের জন্য না, বরং অন্যকে দেখানোর জন্য।
তোমরা যাকে অপেক্ষা বলো, আমি সেই সময়টাকে চিনি, জানি। এ সময়ের প্রতিটি পল, অনুপল, ক্ষণ আমার নিজেকে চিনতে শিখিয়েছে। নিজেকে জানতে আর বুঝতে দিয়েছে; এবং এই জানা, বোঝা বা চেনার ভেতর দিয়েই আমি পেয়েছি এই অনুভব: আমার জীবনে খুব বেশি তাড়না নেই, বাহুল্য নেই, এক দৌড়ে কোনো শিখরে পৌঁছে যাওয়ার ইচ্ছা নেই।
কিন্তু নিজেকে ভালোবেসে, ভালো রেখে না পাওয়া মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করে যাওয়ারও একটা অপরিসীম আকর্ষণ আছে। এই আলোঝলমলে শহরে প্রতিযোগিতায় নাম লেখানো প্রচণ্ড ব্যস্ত কোনো মানুষের যদি দুদণ্ড পাশে বসে থাকার প্রয়োজন হয়, আমি তার পাশে সহমর্মী হয়ে থাকার জন্য অপেক্ষায় আছি।
অপেক্ষায় থেকে থেকে নির্মল সময় উদ্যাপন আর উপভোগ করি আমি। মানুষের দুঃখ, কষ্ট, বেদনায় সহমর্মী হতে চাই। অজানা এক মরীচিকার খোঁজে ছুটতে ছুটতে কখনো এই শহর কিংবা দেশের সীমারেখা অতিক্রম করে পাড়ি দিতে চাই না বিদেশবিভুঁইয়ে। অপেক্ষায় থাকতে থাকতে আমাদের হাতে এসে সেই অধরা মরীচিকা যে ধরা দেয় না—এই ভীষণ সত্য, জেনে গেছি।
‘আমি অত তাড়াতাড়ি কোথাও যেতে চাই না,
আমার জীবন যা চায়,
সেখানে হেঁটে হেঁটে পৌঁছুবার সময় আছে।
পৌঁছে অনেকক্ষণ বসে অপেক্ষা করবার অবসর আছে।
আমি গভীরভাবে এক অচল মানুষ,
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে নক্ষত্রের নিচে।’
এই ব্যস্ত ঢাকা শহরে কেউ কারও জন্য কি অপেক্ষা করে? না, প্রেমের স্পর্শের অপেক্ষা নয়, বরং প্রেমের অপেক্ষার চেয়ে আরও যে প্রতীক্ষা কাঙ্ক্ষিত তা হলো, কেউ একজন সহমর্মী হয়ে পাশে থাকবে। গানের ভাষায় যাকে বলা যায়, ‘তুমি আমার পাশে বন্ধু হে একটু বসিয়া থাকো।’
এই বসে থাকার মতো একজন মানুষ কি আছে আমাদের? কেউ কি আপনার জন্য অপেক্ষা করে? আপনি কি কারও জন্য অপেক্ষা করেন, আকাশে মেঘ জমলে অথবা রোদ উঠে সূর্যটা ফিক করে হেসে উঠলে?
মনে কেবলই প্রশ্নের জন্ম হয়। জলের মতো ঘুরে ঘুরে একা কথা কয় মন। আর সে প্রশ্ন করে। শেষে আবার বাতলে দেয় উত্তরও। যেমন সব প্রশ্নের শেষে এই মন বলে, আমরা এখন সবকিছু উদ্যাপন করতে চাই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমনির্ভর আমাদের নাগরিক জীবনে আমরা আসলেই সবকিছু উদ্যাপন করতে চাই। তবে সেটা নিজের জন্য না, বরং অন্যকে দেখানোর জন্য।
এই প্রতিযোগিতায় অংশ না নিয়ে বরং পেছনে থেকে এক জায়গায় স্থির হয়ে থাকা, সাদামাটা একটা জীবন কাটানোই কি বেশি শান্তির? ঢাকা শহরে মানুষ কি মানুষের জন্য অপেক্ষা করে? আমিও তো অপেক্ষায় আছি বিকেল ডুবে গিয়ে, রাত ভোর করে সকালে সহমর্মিতার সূর্য উঠবে বলে!