১৯ জুলাই নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুদিন। ২০১২ সালের বর্ষায় সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেছেন তিনি। তাঁর প্রয়াণবার্ষিকীতে এ সংখ্যায় থাকল হুমায়ূনের অনালোচিত দুই
চিত্রশিল্পী মাসুক হেলাল ছিলেন কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদের উত্থানপর্বের ঘনিষ্ঠ প্রত্যক্ষদর্শী। নন্দিত এই ঔপন্যাসিকের সঙ্গে তাঁর রয়েছে এন্তার স্মৃতি। এবার সেই স্মৃতির ঝাঁপি খুলেছেন তিনি।
সময়টা তখনো এখনকার মতো ‘ডিজিটাল’ হয়নি—সবই ছিল ‘অ্যানালগ’। তো সেই সময়ে বাংলাবাজারের প্রকাশকেরা অনেকেই নীহাররঞ্জন, নিমাই ভট্টাচার্য আর ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের বই ছাপাতে ব্যস্ত। আমেরিকা থেকে ফিরে হুমায়ূন আহমেদ আবার লিখতে শুরু করেছেন। এরও সাত-আট বছর আগে তাঁর নন্দিত নরকে খান ব্রাদার্স থেকে বের হয়েছিল। দেশে ফেরার পর তখন সাপ্তাহিক রোববার-এ সৌরভ নামে একটা উপন্যাস বেরিয়েছে তাঁর। হাতেও রয়েছে বেশ কয়েকটি পাণ্ডুলিপি। অথচ কোনো প্রকাশকই হুমায়ূন আহমেদের বই বের করতে রাজি হচ্ছেন না। চা খাওয়ান, নানা কথা বলেন। কিন্তু কেউ বই ছাপাতে আগ্রহ দেখান না। এ সময়ই হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হয়। ঘনিষ্ঠতার সূত্রেই একদিন নসাসের (নওরোজ সাহিত্য সংসদ) ইফতেখার রসূল জর্জের দোকানে হুমায়ূন ভাইকে নিয়ে গিয়েছিলাম আমি। সে সময় আমি আর হুমায়ূন ভাই মাঝেমধ্যেই বাংলাবাজারে যেতাম। এভাবেই যাওয়া জর্জদার কাছে, তিনি কথা দিলেও হুমায়ূন ভাইয়ের বই ছাপছেন না, সে সময় তিনি সত্যজিৎ রায়ের বই ছাপা নিয়ে ব্যস্ত।
তখন মাঝেমধ্যে ইমদাদুল হক মিলনের সঙ্গেও দেখা হয়। মিলন ভাইও লড়াই করেছেন। একদিন মিলন ভাই জর্জদাকে বললেন, ‘জর্জদা, দেইখেন, আমি আর হুমায়ূন ভাই এ বাংলাবাজারে থাইক্যা দাদাগো খেদামু। তখন আমরাই রাজত্ব করুম।’ জর্জদা এক-দেড় বছর পর হুমায়ূন ভাইয়ের বই ছাপলেন। বইয়ের নাম অরণ্য। প্রচ্ছদটা আমার আঁকা ছিল।
যে সময়ের গল্প বলছি, তখন আমি রাতে সদরঘাট ও কমলাপুর রেলস্টেশনে ছবি আঁকতে যেতাম। কয়েকবার আমার সঙ্গে ছিলেন হুমায়ূন ভাই। আমি ছবি আঁকি। হুমায়ূন ভাই ঘুরে ঘুরে ঘুমন্ত মানুষ দেখেন। ভোররাতের দিকে দুজনে হলে ফিরি। একবার রাতে হাইকোর্টের সামনে একদল মাতাল হাইজ্যাকার আমাদের ছুরি দেখিয়ে ঈদগাহের ভেতর আটকে রাখল। সেই ছেলেগুলো কথা বলছিল উল্টো করে। সেটা নিয়ে হুমায়ূন ভাই উপন্যাস লিখলেন চাঁদের আলোয় কয়েকজন যুবক।
১৯৮৫ বা ’৮৬ সাল। ধানমন্ডি ১৯ নম্বরে হুমায়ুন ফরীদির বাসায় থাকি আমি। হুমায়ূন আহমেদ বিটিভির জন্য একটি নাটক লিখলেন অযাত্রা নামে। একজন পেনশনপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক পেনশনের টাকা পাচ্ছে না। এর জন্য সে ঢাকায় আসে। ওঠে এক দূরসম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়িতে। পেনশনের টাকার জন্য সরকারি অফিসের টেবিলে ঘোরে লোকটি। এই বৃদ্ধের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন হুমায়ুন ফরীদি। এটি ছিল সাপ্তাহিক নাটক। প্রযোজনা করেছিলেন নওয়াজীশ আলী খান। নাটকের রেকর্ডিং শেষ হয়েছিল বিটিভির স্টুডিওতে। দুই দিন পর আউটডোরে এক দিনের শুটিং হবে।
ফরীদি ভাইয়ের মা-বাবা থাকতেন ফতুল্লায়। ছোট বোনের শ্বশুরবাড়িও কাছেই ছিল। তাঁর স্বামীর সঙ্গে বনিবনা ছিল না। রাগের মাথায় কীটনাশক খেয়ে নারায়ণগঞ্জ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। খবর পেয়ে ফরীদি ভাইসহ নারায়ণগঞ্জ হাসপাতালে গেলাম আমি। অযাত্রা নাটকের আউটডোর শুটিং যেদিন হবে, তার আগের রাতে বোনটি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে দাফন করা হয় ফতুল্লাতেই।
এর মধ্যে খবর পেলাম, ফরীদি ভাইকে খুঁজছেন হুমায়ূন আহমেদ। ফোন করে তাঁকে ফরীদি ভাইয়ের বোনের মৃত্যুর খবর জানালাম আমি। কথাটা তিনি যেন কাউকে না বলেন, তা-ও বললাম তাঁকে। তাঁকে আরও বললাম, ফরীদি ভাইকে নিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি বিটিভিতে চলে আসব।
এদিকে ফরীদি ভাইয়ের মা-বাবার অবস্থা খুব খারাপ।
রাতে ফরীদি ভাই বোনের হাত ধরে হাসপাতালে বসে ছিলেন। তাঁর সামনেই মারা গেছেন ছোট বোনটি। তাঁর মৃতদেহের পোস্টমর্টেমের সময়ও সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন ফরীদি ভাই। বোনটিকে মাটি দিয়েছেন। এরপর ফরীদি ভাই ও আমি বেবি ট্যাক্সি করে ফতুল্লা থেকে রামপুরা টিভি ভবনে আসি। দেখি, গেটে দাঁড়িয়ে আছেন হুমায়ূন আহমেদ, হুমায়ূন ভাই। ফরীদি ভাই হাত বাড়িয়ে দিলেন হুমায়ূন ভাইয়ের দিকে। ফরীদি ভাইয়ের হাত ধরে আছেন হুমায়ূন ভাই। কেউ কোনো কথা বলছেন না। ফরীদি ভাই এসে মেকআপ নিতে বসে গেলেন। হুমায়ূন ভাই বসে রইলেন চুপচাপ। মেকআপ শেষ হলে ফরীদি ভাই হুমায়ূন ভাইকে বললেন, মিতা আসেন। হেঁটে গিয়ে টিভির শুটিং ভ্যানে পাশাপাশি বসলেন তাঁরা। ক্যামেরাম্যান আনোয়ার হোসেন বুলু গাড়িতে উঠেই বললেন, ‘ফরীদি কই, আসে নাই?’ ফরীদি ভাই বৃদ্ধের মেকআপ নেওয়াতে আনোয়ার হোসেন বুলু তাঁকে চিনতেই পারেননি।
শুটিং হয়েছিল বেইলি রোডের আশপাশে। বৃদ্ধ স্কুল মাস্টার একটা ফাইল নিয়ে ঘুরছে। এ অফিস থেকে অন্য অফিসে। সন্ধ্যা পর্যন্ত শুটিং হলো। শুটিং শেষে গাড়িতে করে টিভি ভবনে আসি আমরা। ফরীদি ভাইয়ের মেকআপ দাড়ি তোলা হলো। হুমায়ূন ভাই, আমি ও ফরীদি ভাই বেবি ট্যাক্সিতে করে ধানমন্ডির বাসায় এলাম। রাত ১০টা পর্যন্ত হুমায়ূন ভাই বসে রইলেন ফরীদি ভাইয়ের পাশে। একসময় ফরীদি ভাই বললেন, ‘মিতা, এবার আপনি বাসায় যান। আমি ঠিক আছি। আমি ফতুল্লায় যাব এখন। আপনি অনেক কষ্ট করেছেন।’ হুমায়ূন ভাই হাত ধরে বললেন, ‘মিতা, আপনি গ্রেট অভিনেতা। ভালো থাকবেন।’
হুমায়ূন ভাই এর মধ্যে টিভিতে কিছু সফল নাটক লিখে ফেলেছেন। দেশজুড়ে বিখ্যাত হয়ে গেছেন। তখন আমি সাপ্তাহিক বিচিত্রায় চিত্রশিল্পী হিসেবে কাজ করি। হুমায়ূন ভাই হঠাৎ হঠাৎ বিচিত্রায় আসেন, সেখান থেকে তাঁর সঙ্গে যাই বিটিভিতে। বিচিত্রার ঈদসংখ্যায় তখন নিয়মিত উপন্যাস লিখছেন হুমায়ূন ভাই। অফিস থেকে আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হতো হুমায়ূন ভাইয়ের কাছ থেকে উপন্যাস আদায় করার। বিচিত্রার সহযোগী পত্রিকা আনন্দ বিচিত্রায় একবার হুমায়ূন ভাইয়ের ওপর কী যেন একটা খবর ছাপা হলো। এতে খেপে গেলেন হুমায়ূন ভাই। ঠিক করলেন, বিচিত্রায় আর উপন্যাস লিখবেন না। তখন বিচিত্রার নির্বাহী সম্পাদক শাহরিয়ার কবির আমাকে দায়িত্ব দিলেন, যে করে হোক হুমায়ূন আহমেদের কাছ থেকে উপন্যাস আদায় করতে হবে।
গেলাম হুমায়ূন ভাইয়ের বাসা শহীদুল্লাহ হলের বাসায়। আমাকে দেখেই খেপে গেলেন তিনি। বললেন, ‘তোমাদের বিচিত্রায় আমি লিখব না।’ আমি বসে রইলাম চুপচাপ। একপর্যায় তাঁর রাগ কমল। নিজেই বললেন, ‘বিচিত্রা ঈদসংখ্যা বেরোবে, আর আমার লেখা থাকবে না, তা হয় না।’
হাঁটু মুড়ে চেয়ারের ওপর কাগজ–কলম নিয়ে লিখতে শুরু করলেন তিনি। সারা রাত লিখলেন। একটা একটা করে পাতা তিনি লিখছেন আর আমি পড়ছি। সেটাই মিসির আলির প্রথম গল্প। বিচিত্রায় আমিই উপন্যাসটির অলংকরণ করেছিলাম।
হুমায়ূন আহমেদ সে সময় মাটিতে বসে টি-টেবিলের ওপর কাগজ রেখে লিখতে বসতেন, মাটিতে প্লেটে কিছু ভাত থাকত। সঙ্গে একটা কাঁচি। লেখা ভুল হলে সে অংশ কেটে তার ওপর ভাতের আঠা দিয়ে সাদা কাগজ সেঁটে দিতেন। তাঁর ওপর আবার লিখতেন। আমি একবার তাঁর এ অবস্থা দেখে একটা পেলি গাম কিনে দিয়ে এলাম। এর কয়েক দিন পর সেই গাম নিয়ে বিচিত্রা অফিসে এলেন হুমায়ূন ভাই। আমাকে বললেন, ‘নাও মিয়া তোমার গাম। এইটা দিয়ে আমার কাম হয় না। আমার ভাতই ভালো।’
হুমায়ূন ভাই লিখতে বসলে একটা ঘোরের মধ্যে থাকতেন। চায়ের কাপে ঘন ঘন চুমুক দিতেন। লিখে চলতেন ছোট ছোট অক্ষরে। বিড়বিড় করে কথা বলতেন। হঠাৎই আবার লেখা ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেন। লুঙ্গিটা কোমরের কাছে বা হাত দিয়ে ধরে রেখে ঘরময় হাঁটতেন। তখনো যেন ঘোরের মধ্যেই রয়েছেন। কেউ এ সময় কথা বললে তিনি একটু তোতলা হয়ে যেতেন। কথা বলতেন দ্রুতলয়ে।
দরজার ওপাশে উপন্যাসের জন্য হুমায়ূন ভাইয়ের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন আইনজীবী। বিচার বিভাগের কিছু লোকের প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে হুমায়ূনের এই উপন্যাসের একটি চরিত্র বলে, তারা ‘কাতলা মাছের মতো গবগব করে ঘুষ খায়।’ তাতেই খেপে গেলেন ওই আইনজীবী, কোর্টে মামলা ঠুকে দিলেন তিনি।
হুমায়ূন ভাইয়ের মামলা লড়ার জন্য একজন আইনজীবী ঠিক করে দিয়েছিলেন জাহানারা ইমাম। হুমায়ূন ভাই আমাকে একদিন ফোন করে বললেন, ‘মাসুক, তুমি আমার বাসায় চলে আসতে পারবে সন্ধ্যা ছয়টার মধ্যে, তোমাকে নিয়ে মিসেস ইমামের বাসায় যাব।’ আমি তখন বিচিত্রা অফিসে কাজ করছিলাম।
সন্ধ্যায় হুমায়ূন ভাইয়ের এলিফ্যান্ট রোডের বাসায় গেলাম। তিনি তখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির মধ্যে আমরা হেঁটে রওনা দিলাম জাহানারা ইমামের বাসার দিকে।
আমার পিছু পিছু হাঁটছেন হুমায়ূন ভাই। হঠাৎ থেমে বললেন, ‘মাসুক দোখো।’ দেখি, হুমায়ূন ভাইয়ের হাতে একটা ৫০০ টাকার নোট, কুড়িয়ে পেয়েছেন। হুমায়ূন ভাই হাঁটার সময় মাটির দিকে চেয়ে হাঁটতেন। মাঝেমধ্যে চোখ তুলে সামনের দিকে তাকাতেন।
আমি বললাম, ‘আপনার কপাল! আমি আপনার আগে হাঁটছি আর আপনি পেছনে। টাকাটা পেলেন আপনি।’
‘দাঁড়াও টাকা দিয়ে একটা কাজ করব।’
আমরা ততক্ষণে জাহানারা ইমামের বাসায় পৌঁছে গেছি। জাহানারা ইমাম ব্যারিস্টার ইশতিয়াকের সঙ্গে ফোনে কথা বললেন। হুমায়ূন ভাই মামলার বিষয়ে পরামর্শ করলেন জাহানারা ইমামের সঙ্গে। রাত ১০টার দিকে জাহানারা ইমামের বাসা ‘কণিকা’ থেকে বের হলাম আমরা। হাঁটতে হাঁটতে হুমায়ূন ভাই বললেন, ‘৫০০ টাকাটা কোনো টোকাইকে দেব, দেখি ও কী করে।’
‘মল্লিকা’ সিনেমা হলের সামনে দিয়ে গাউছিয়া মার্কেটের পাশের ওভারব্রিজে উঠলাম আমরা। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে পুরোনো ব্যানার পেঁচিয়ে শুয়ে আছে এক টোকাই। হুমায়ূন ভাই তাকে ডেকে তুললেন। তার হাতে ৫০০ টাকা দিতেই হুমায়ূন ভাইয়ের দিকে ফিরে তাকিয়ে সে দিল ভোঁ–দৌড়। আর তাঁকে দেখে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলেন হুমায়ূন ভাই।
১৯৯৪ সালের কথা। আগুনের পরশমণি সিনেমার শুটিং–পূর্ব প্রস্তুতিযজ্ঞ চলছে। অভিনেতা মোজাম্মেল ভাই তাঁর শ্যামলীর বাসার দোতলায় হুমায়ূন আহমেদের জন্য একটি সুন্দর ঘর করেছিলেন। সেখানে বসে হুমায়ূন ভাই লেখালেখির কাজ করতেন। আমরা যাঁরা আগুনের পরশমণি চলচ্চিত্রে কাজ করছি, সন্ধ্যার পর আমরা সেখানে যেতাম। অভিনেতা-অভিনেত্রীরাও আসতেন। চরিত্র নির্বাচন তখন শেষ পর্যায়ে। মোজাম্মেল ভাই এ সিনেমার প্রযোজনা-সংক্রান্ত কাজগুলো দেখছেন। রাত–দিন দৌড়াদৌড়ি করছেন। আগুনের পরশমণির আখড়ায় প্রতিদিনের মতো সবশেষে আসত বন্ধু তুহিন (আজ রবিবার নাটকে হিমু চরিত্র করেছিল।) হুমায়ূন ভাই তাকে বলতেন, ‘তুহিন শুরু করো।’ তুহিন গাইত শাহ আবদুল করিমের গান, সেলিম চৌধুরী গাইতেন হাসন রাজার গান—এসব স্মৃতি আসলে ভোলার নয়।
এ চলচ্চিত্রের অভিনেতা-অভিনেত্রীর তালিকাটা মোটামুটি এ রকম: নায়িকা রাত্রি চরিত্রটি করছেন বিপাশা হায়াত। নায়ক বদি—আসাদুজ্জামান নূর। মা চরিত্রে ডলি জহুর। বাবা—আবুল হায়াত। কাজের মেয়ে—পুতুল। মামা—হুমায়ুন ফরীদি প্রমুখ। শুটিং শুরু হয়েছে এফডিসিতে। হঠাৎ একদিন খেয়াল করলাম, মোজাম্মেল ভাই শুটিংয়ে আসছেন না। হুমায়ূন ভাই আমাকে বললেন, ‘যাও তো মাসুক, মোজাম্মেল সাহেবকে ধরে নিয়ে আসো।’
মোজাম্মেল ভাই তখন ধানমন্ডির ১০ নম্বরে, যেখানে হুমায়ূন ভাইয়ের বাড়ি তৈরি হচ্ছে, সেখানে দেখাশোনা করছেন। আমি গিয়ে বললাম, হুমায়ূন ভাই আপনাকে যেতে বলেছেন। মোজাম্মেল ভাই কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
‘না, আমি যাব না’ বলে মোজাম্মেল ভাই চোখ মুছতে থাকেন, ‘মামা চরিত্রটা আমারে না দিয়ে ফরীদিরে দিয়ে দিয়েছে। আমি গিয়ে কী করব। আপনি যান।’
আমি তাঁকে ধরে নিয়ে এলাম এফডিসিতে। হুমায়ূন ভাই চুপচাপ বসে আছেন। মোজাম্মেল ভাই দাঁড়িয়ে। কারও মুখে কোনো কথা নেই। শেষ পর্যন্ত মামা চরিত্রে অবশ্য মোজাম্মেল ভাই-ই অভিনয় করেছিলেন।
এ ঘটনায় অবশ্য খুবই কষ্ট পেয়েছিলেন হুমায়ূন আহমেদের মিতা হুমায়ুন ফরীদি। এফডিসিতে আমরা যে ফ্লোরে শুটিং করছিলাম, তার পাশের ফ্লোরেই মনোয়ার খোকনের একটি সিনেমার শুটিং করছিলেন হুমায়ুন ফরীদি। হঠাৎ দেখলাম, ফরীদি ভাইয়ের গাড়িচালক আমাদের ফ্লোরে এসে হাজির। আমাকে বলল, ‘স্যার আপনাকে যেতে বলেছে, চলেন।’ গিয়ে দেখি, গাড়িতে ফরীদি ভাই এসি চালিয়ে বসে আছেন। আমাকে বললেন, ‘চলো, আমার সাথে হোটেল পূর্বাণীতে।’ তাঁর তখন হাঁপানির টান উঠেছে। সন্ধ্যা সাতটার মতো বাজে। পূর্বাণী হোটেলের কর্মকর্তা ছিলেন অভিনেতা মজিবুর রহমান দিলু। সেখানে একটি রুম ফরীদি ভাইয়ের জন্য ভাড়া নেওয়া হলো। বারবার কাশি আসছিল তাঁর। শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল খুব। ফরীদি ভাই ওই শ্বাসকষ্টের মধ্যেই কয়েকবার বললেন, ‘হুমায়ূন কাজটা ঠিক করল না! অন্যায় করল।’
এফডিসির পর আগুনের পরশমণিরশুটিং হবে চাঁদপুরে। ছবি নেওয়া হবে ‘অঙ্গীকার’ ভাস্কর্যের।এটি হবে ছবির টাইটেল শট। একটি দোতলা লঞ্চ ভাড়া করা হলো। ইউনিটের সঙ্গে রয়েছে একদল গানবাজনার লোক। চাঁদনি রাতজুড়ে লঞ্চের ছাদে গানবাজনা ও খাওয়াদাওয়া হলো। হুমায়ূন ভাই চাঁদ দেখার জন্য শুয়ে আছেন আকাশের দিকে তাকিয়ে। চোখ বুজলে এই দৃশ্যগুলো এখনো দেখতে পাই! হুমায়ূন ভাইকে মনে পড়ে। আমি ছিলাম তাঁর উত্থানপর্বের একজন প্রত্যক্ষদর্শী। কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে আমার স্মৃতিগুলো আমার জীবনে যেন সোনারুপা হয়ে আছে।