রবীন্দ্রনাথের যে বৈশাখ বেদনাময়

বৈশাখেই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আবির্ভাব, ২৫ বৈশাখ তাঁর জন্মদিন। কিন্তু এই বৈশাখ কবির কাছে বেদনাময়ও ছিল। কিন্তু কেন?

কাদম্বরী দেবী ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবি অবলম্বনে
কাদম্বরী দেবী ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবি অবলম্বনে

মধ্য বৈশাখ পেরোলেই প্রতিবছর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে নতুন করে কিছু আলাপ-আলোচনা হয়। নানান অনুষ্ঠান হয় ২৫ বৈশাখ স্মরণে। আজও সেটা হবে। এসবই স্বাভাবিক। রবীন্দ্রভক্তদের কাছে বৈশাখ আনন্দের ক্ষণ। তবে রবির জীবনে বৈশাখ অনন্ত বিষাদের মাসও বটে। ওভাবে আমরা হয়তো কমই দেখি বৈশাখকে।

রবীন্দ্রজীবনকে গভীরভাবে পাঠ করলে, বিশেষ করে তাঁর মানসলোকে বৈশাখ ভীষণ ব্যথা ভরা এক সময় হিসেবেও চিহ্নিত হয়। এর কারণ হয়তো সবারই জানা, কাদম্বরী দেবীর মৃত্যু। এই ‘বৌঠান’ ও তাঁর আত্মহত্যা রবিকে জীবনভর বিষণ্নতায় ভুগিয়েছে। অনেক সময়ই তাঁর জন্মদিনের আনন্দ ছাপিয়ে গেছে ১২৯১ বঙ্গাব্দের ৮ বৈশাখের শোক-স্মৃতি। জানি না রবীন্দ্রভক্তরা বৈশাখের এ রকম চিত্রায়ণ মানতে চাইবেন কি না।

রবীন্দ্রজীবনকে গভীরভাবে পাঠ করলে, বিশেষ করে তাঁর মানসলোকে বৈশাখ ভীষণ ব্যথা ভরা এক সময় হিসেবেও চিহ্নিত হয়। এর কারণ হয়তো সবারই জানা, কাদম্বরী দেবীর মৃত্যু। এই ‘বৌঠান’ ও তাঁর আত্মহত্যা রবিকে জীবনভর বিষণ্নতায় ভুগিয়েছে।

কাদম্বরী সাধারণ কোনো বৌঠান হলে এবং তাঁর স্বাভাবিক মৃত্যু হলে হয়তো রবি এতটা আলোড়িত হতেন না। হয়তো শোক সামলে ওঠার প্রস্তুতি থাকত তখন ঠাকুরপোর। কিন্তু এই বৌঠান ছিলেন বিশেষ একজন, ১৭ বছর ধরে যিনি ‘বিশেষ একজন’ হয়ে উঠে রবির ‘চিত্তের উদ্বোধন ঘটিয়েছিলেন বিশ্ব প্রকৃতির মাঝে’।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে কাদম্বরী দেবীর বিয়ে হয় ৯ বছর বয়সে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বয়স তখন ১৯, আর রবির ৭। সেই রবি নিজে বিয়ে করলেন ২৩ বছর বয়সে। তার চার মাস পরই কাদম্বরী দেবীর স্বেচ্ছামৃত্যু। হারিয়ে গেলেন রবির ‘হৃদয়ের রানি’।

কেন যে এমন হলো, সেই রহস্য রবীন্দ্র-গবেষকেরা খুব একটা খুঁজে পেয়েছেন বলা যায় না। কিন্তু ১৩৯ বছর পরও সেই খোঁজ থামানোর উপায় নেই। কারণ রবীন্দ্র-সাহিত্যের অনেকখানি জুড়ে অদৃশ্যভাবে হলেও আছেন এই নারী। ১৭ বছরের এক মানসসঙ্গী।

রবীন্দ্রনাথ যে বড় কবি, সেটা হয়তো কাদম্বরীর মৃত্যুর পাহাড়সম শোককে সাহিত্যসঙ্গী করতে পারার কারণেও। অমিয় চক্রবর্তীকে কবি লিখেছিলেন, ‘কাদম্বরীর চলে যাওয়া ছিল চিরস্থায়ী এক শূন্যতার কুহক।…আমি বুঝতে পারলুম জীবনকে মৃত্যুর জানালা দিয়ে দেখেই তার সত্যরূপ জানতে হবে। মৃত্যুর আকাশেই জীবনের মুক্তরূপ প্রকাশ পায়।’ যদিও তা বড় দুঃসহ। এই দুঃসহ অনুভব রবিকে কাঁদিয়েছে যতটা, মগ্ন করেছে তার চেয়ে অনেক বেশি।

একে গতানুগতিক প্রেম বললে হয়তো ভুলই বলা হবে। নিশ্চিতভাবেই সেটা তার চেয়েও বেশি, কোনো হিম হওয়া অনুভব ও বন্ধুত্ব। রবি ঠাকুর লিখেছেন, ‘যে গেছে সে সমস্ত জগৎ হইতে লাবণ্যচ্ছায়া তুলিয়া লইয়া গেছে।’ এ বাক্যে যে মহাকাব্য ঘনীভূত হয়ে আছে, তার মর্ম উদ্ধার সহজ নয়। তবে এসব পড়তে গিয়ে ভাবতে বসলে ৮ বৈশাখ গভীর ছায়া বিস্তার করে ২৫ বৈশাখের পাঠকের ওপর।