এমন প্রাণবান মানুষ আর কোথায় পাব!

আসাদ চৌধুরী
 ছবি: প্রথম আলো
আজ ৫ অক্টোবর সকালে কানাডার অসোয়ায় মারা গেছেন ষাটের দশকের অন্যতম কবি আসাদ চৌধুরী। ৮৩ বছর বয়সী এই কবি দীর্ঘদিন বেসরকারি টেলিভিশন বাংলাভিশন–এ ‘রাত–বিরাতে’ নামের একটি অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতেন। তাঁর মৃত্যুর পর সেই অনুষ্ঠানের প্রযোজক কাওনাইন সৌরভ মেলে ধরেছেন উপস্থাপক আসাদ চৌধুরীকে নিয়ে তাঁর স্মৃতি।

: হ্যালো, সৌরভ ভাই,

: হ্যাঁ ভাই, বলো।

: খবরটা শুনছেন?

: কী খবর?

: আসাদ চৌধুরী আর নেই।

: কী বলছ? কখন?

: এই তো কিছুক্ষণ আগে।

আজ বৃহস্পতিবার বেলা ১টা ১৬ মিনিটে নির্লিপ্ত নয়নের (এখন আলতাফ শাহনেওয়াজ) ফোনটা আমাকে স্তব্ধ করে দেয়। বুকের ভেতর হু হু করে উঠছে।

কী যেন নেই, কী নেই!

আমাদের আসাদ ভাই, কবি আসাদ চৌধুরী মারা গেছেন।

অনেক দিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন। কিন্তু আমার মনে হতো, তিনি সুস্থ হয়ে ঠিকই ফিরে আসবেন। তা আর হলো না, আর ফোনে কথা হবে না তাঁর সঙ্গে। কী বলব, এই বেদনার কোনো ভাষা নেই। নিভৃতে রাখা একটা সম্পর্ক আমার ছিল আসাদ ভাইয়ের সঙ্গে। শুনেছি, রাত্রিযাপনে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক মজবুত হয়। আসাদ ভাইয়ের সঙ্গে তো আমার কয়েক বছর রাত জেগে কাটানোর অভিজ্ঞতা। একসঙ্গে ‘রাত–বিরাতে’ নামে একটি অনুষ্ঠান করেছি। আমি প্রযোজক আর তিনি উপস্থাপক। সেই সূত্রে তাঁকে নিয়ে আমার জমা আছে অনেক কথা, অনেক স্মৃতি।

আসাদ চৌধুরী

কোথা থেকে শুরু করব, ঠিক বুঝতে পারছি না। একসময় মজা করে অন্যকে হুঁশিয়ারি দিতাম, ‘নতুন পথ খোঁজ রে পাগলা! সামনে গর্ত পেছনে দেয়াল, খুব খেয়াল! খুব খেয়াল!’ কারণ, সময় তখন পক্ষে থাকে না। কে না জানে, সময় আর জীবন একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। জীবনের প্রতিটি ধাপে থাকে নানান বৈচিত্র্য, তার পুরোটা নিয়েই নির্দিষ্ট একটা দেয়াল তৈরি করে বা তৈরি করার দিকে এগিয়ে যায়। কিন্তু থেমে থাকে না। থামাতে পারে কেবল মৃত্যু। ওটা চিরন্তন সত্য। বরং বেঁচে আছি, জীবনের যে দেয়াল, সে দেয়ালের প্রতিটা ইট পরখ করছি, দুই ইটের মাঝখানে সিমেন্ট নামক জীবনীশক্তি ব্যয় করছি। নানান বৈচিত্র্যের মুখোমুখি হচ্ছি—এ সবই আমি সাধারণ ৮–১০ জন মানুষের মতো করে নীরবে উপভোগ করছি। আর রূপান্তরিত হচ্ছি একটা থেকে অন্যটায়। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। এই নিয়মের জীবনে প্রাপ্তিগুলো যত না সামনে এসে দাঁড়ায়, তার চেয়ে অনেক বেশি এসে দাঁড়ায় ক্ষুদ্রতা বা দৈন্যতাগুলো। আমার সবচেয়ে বড় দৈন্য—লিখতে না পারা। মাঝেমধ্যে ফুসফাস করে কিছু বিষবাষ্প বের হয়ে আসে, যা বাষ্পেই মিলিয়ে যায়। তারপরও সহজাতভাবে সম্পর্ক ও মূল্যায়নের ভিত্তিতে কিছু থেকে যায়। এই থেকে যাওয়া ভাবনাগুলো একটা একটা করে সংরক্ষণ করার অনুপ্রেরণা দিতেন, প্রতি সপ্তাহে তাগিদ দিতেন যে মানুষটি, সে আমার ‘অন্ধকারে আলো’র সঞ্চালক কবি আসাদ চৌধুরী। তাঁকে নিয়ে লেখার মতো যথেষ্ট শব্দভান্ডার আমার নেই বলেই আতঙ্ক অনুভব করছি। বলছি, সামনে গর্ত, পেছনে দেয়াল। তাই খুব খেয়াল করে সাধারণ মানের শব্দ ব্যবহার করে মূল পথের সঙ্গে একটা সরু পথ তৈরির চেষ্টা করছি—একজন প্রযোজকের চোখে সঞ্চালক আসাদ চৌধুরী—এ লেখায় হয়তো উঠে আসবে সে কথাই।

আসাদ চৌধুরী নিঃসন্দেহে আমার কাছে একজন আপাদমস্তক কবি। তাঁর উষ্কোখুষ্কো চুলের মধ্যে কবিতা। কাঁধে ঝোলানো ঝোলার মধ্যে কবিতা। সাদামাটা রঙিন পোশাক কিংবা পাঞ্জাবিতে কবিতা। সুগন্ধি পানের মধ্যে কবিতা। কোথায় নেই কবিতা! সাহিত্যিক, ছড়াকার, আবৃত্তিকার, রেডিও-টেলিভিশনের উপস্থাপক—এসবই তাঁর ‘কবি’ নামক দেয়ালের এক একটা ইটমাত্র। আমার ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে এই কবির সশরীর প্রবেশ ঘটে স্যাটেলাইট চ্যানেল বাংলাভিশনের একাধিক অনুষ্ঠানের সঞ্চালক হিসেবে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠান ‘রাত–বিরাতে’। রাত–বিরাতে মূলত অতিথির স্মৃতিবিজড়িত জায়গায় বা তাঁর পছন্দের জায়গায় গিয়ে কিছু সময় স্মৃতি হাতড়ানোর অনুষ্ঠান। একটা ক্যামেরা, দুটি সানগান, গাড়ির হেডলাইট এবং ড্রাইভারসহ পাঁচজন মানুষের মিলিত শ্রমের অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানের মূল শক্তি খোলা আকাশ, অন্ধকার এবং সংবেদনশীল সঞ্চালক। টেলিভিশন স্টুডিওতে হার্ডলাইট বা কড়া আলোকপ্রক্ষেপণের ফলে অতিথি যে সব কথা সচরাচর বলতে পারেন না, সেসব আটকে থাকা কথামালা খোলা আকাশের নিচে, অন্ধকারের মধ্যে আপনা থেকেই বের হয়ে আসত। করপোরেট কালচার ছুড়ে ফেলে, শরীরের খোলস ভেঙে প্রকৃতিতে বের হওয়া দুটি আত্মার কথোপকথন তুলে আনার অনুষ্ঠান ‘রাত–বিরাতে’। একটানা ১২ বছর চলার পর ৫০০তম পর্বে এসে অনুষ্ঠানটি শেষ হয় ২০১৮ সালে। এই অনুষ্ঠানে তার আগে আরও তিনজন উপস্থাপক ছিলেন, তবে আসাদ চৌধুরীর সময়কালে সুধী মহলে ব্যাপক আলোচিত অনুষ্ঠান ছিল ‘রাত–বিরাতে’। শুধু আসাদ চৌধুরীর সম্পৃক্ততার কারণে।

মোটাদাগে আমরা জ্ঞানী তাঁকেই বলি, যাঁর ভেতরে যথেষ্ট তথ্য আছে এবং যাঁর অভিজ্ঞতার পাল্লা সমৃদ্ধ। একটা ছাড়া অন্যটা অচল। এ জন্যই তিনি সব ধরনের অতিথির ভেতরে প্রবেশ করে আটকে থাকা অধ্যায়গুলো খুব সহজেই বের করে আনতে পারতেন। শিল্পী মমতাজের গানের অনুষ্ঠান হোক, লেখক-কবিদের আড্ডা হোক কিংবা অভিনেতা-অভিনেত্রী, নাচের শিল্পী, জাদুশিল্পী—সব শিল্পীর ভেতরের যাবতীয় তথ্য-উপাত্ত, অভিজ্ঞতা এবং আবেগপ্রবণ জায়গায় টোকা দিয়ে অজানা অনেক কিছু তুলে আনতে পারতেন। তাই নির্দ্বিধায় বলতে পারি, আসাদ চৌধুরী একজন সফল উপস্থাপক।
আসাদ চৌধুরী

প্রতি রাতেই ইট–কাঠ–পাথরের এই ঢাকা শহরের আচরণে থাকে ভিন্নতা, যা সাধারণের চোখের আড়ালে থাকে, কেবল সূক্ষ্মবোধের কাছেই সেই ভিন্নতা ধরা পড়ে। এমন হাজারো সাধারণ বিষয়কে তিনি অসাধারণ করে বিশ্লেষণ করতেন। বয়স নামক জীবনসংখ্যাকে উপেক্ষা করে তিনি কেবল নগরের রাতের সৌন্দর্য, অতিথির সঙ্গ এবং এই গলি, সেই গলির বাস্তবতাগুলো নিজের মতো করে উপভোগ করতেন। অতিথি হিসেবে যাঁরা আসতেন তাঁরাও স্বতঃস্ফূর্ত থাকতেন পুরো সময়, কারণ এই অনুষ্ঠানের উপস্থাপক আসাদ চৌধুরী। উপস্থাপক হিসেবে তাঁর সবচেয়ে বড় গুণ, সবকিছুতেই ইতিবাচক মানসিকতা।

টেলিভিশনে যেসব প্রযোজক অনুষ্ঠান নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত, তাঁরা প্রায়ই আটকে যান অতিথি নিশ্চিত করার জায়গায়। উপস্থাপকের শিডিউল, শুটিং শিডিউল, অতিথির শিডিউল মিললেই তবে একটা পর্ব সম্পন্ন সম্ভব। এটা একটা প্যারাযুক্ত কাজ। আর সবচেয়ে বড় প্যারা তৃতীয় পক্ষ হয়ে অতিথি এবং উপস্থাপকের কিছু কমন রসায়ন একত্র করে নির্দিষ্ট সময়ে তাঁদের মুখোমুখি করানো। কোনো রকম এক পর্ব শেষ তো আগামী পর্বের জন্য আবার অতিথি খোঁজা শুরু হয়। এটা প্রযোজকদের একটা কমন প্যারা। কথায় আছে, মন্দের পরে আসে ভালো, দুঃখের পরে সুখের আলো। আসলেই তাই, অন্তত আমার বেলায়। যেদিন থেকে উপস্থাপক হিসেবে আসাদ চৌধুরীকে পেয়েছি, সেদিন থেকেই অতিথির শিডিউল ম্যানেজ করা কেবল সময়ের ব্যাপার ছিল মাত্র। ব্যক্তিগত সমস্যা দূরে রেখে কাজের প্রতি নিষ্ঠা, আন্তরিকতা এবং কমিটমেন্ট ঠিক রাখা দুর্বল স্নায়ুর মানুষের পক্ষে সম্ভব হয় না; কিন্তু তিনি পারতেন, যা আমাকে ব্যক্তিগতভাবে নীরবে নাড়া দিত। উপস্থাপক হিসেবে তাঁর অসাধারণ যোগ্যতা হচ্ছে, স্বচ্ছ ব্যক্তি ইমেজ এবং পেশাদারি মনোভাব।

একজন উপস্থাপকের মোটাদাগে যেসব গুণ থাকা আবশ্যক, তা হলো পোশাকে ও আচরণে মার্জিত। সাবলীল ও শুদ্ধভাবে কথা বলার যোগ্যতা। সময়জ্ঞান থাকা। গল্প করার অভ্যাস। রসবোধ ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে সে গল্প/আড্ডাকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার দক্ষতা। অতিথির ব্যক্তি ইমেজ বুঝে প্রশ্ন করা। অতিথির কথার মধ্য থেকে কাঙ্ক্ষিত তথ্যগুলো তুলে আনা এবং অতিথির দর্শক কারা, সেই চিন্তা মাথায় রেখে নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট কথায় জোর দিয়ে একটা প্রাণবন্ত এবং গঠনমূলক অনুষ্ঠান শেষ করা। উপস্থাপনার এ যোগ্যতা কার নেই? সবার আছে। কিন্তু আমরা জানি, যোগ্য উপস্থাপকের কী পরিমাণ খরা। রেডিও শুধু কণ্ঠ দিয়ে চালিয়ে নেওয়া যায়; কিন্তু টেলিভিশনে লাগে পুরোটা। প্রায়ই এমন পাওয়া যায় যে গ্ল্যামার আছে, কিন্তু মগজ নেই। আবার মগজ আছে কিন্তু গ্লামার নেই। আর গ্ল্যামার না থাকলে বাণিজ্যিক টেলিভিশনের স্পনসর আসবে কোথা থেকে। সুতরাং এখানে ধারও লাগবে আবার ভারও থাকতে হবে। উপস্থাপক হিসেবে আসাদ চৌধুরী এসবের ঊর্ধ্বে। বরং তাঁকে বিশ্লেষণ করলে যাঁরা এ কাজের সঙ্গে যুক্ত, তাঁরা নিজেকে আরও শাণিত করতে পারবেন, এটা আমার বিশ্বাস।

সীমাবদ্ধতা মানুষের জীবনে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং নৈতিক সীমার মধ্যে কিছুকাল দাপাদাপি করে আমাদের জীবনাবসান হয়। এটা দোষের না। দোষের কেবল ভাবনার সীমাবদ্ধতা। ভয় ও সাহসের অভাবে আমাদের ভাবনার সীমাবদ্ধতা দিন দিন বাড়ছে, এটা আমাদের সমাজজীবনের জন্য ভয়াবহ। শিল্পের ক্ষেত্রে এ সীমাবদ্ধতা খাটে না; কিন্তু শিল্পীর ক্ষেত্রে খাটে বলেই আমরা বলে থাকি, অমুক ‘টাইপ’ অভিনেতা, তমুক ‘টাইপ’ উপস্থাপক। কিন্তু আসাদ চৌধুরীকে কোনো টাইপে ফেলা যায় না। এর মূল কারণ তিনি জ্ঞানী ব্যক্তি। জ্ঞান তাঁর সারা জীবনের সাধনা। মোটাদাগে আমরা জ্ঞানী তাঁকেই বলি, যাঁর ভেতরে যথেষ্ট তথ্য আছে এবং যাঁর অভিজ্ঞতার পাল্লা সমৃদ্ধ। একটা ছাড়া অন্যটা অচল। এ জন্যই তিনি সব ধরনের অতিথির ভেতরে প্রবেশ করে আটকে থাকা অধ্যায়গুলো খুব সহজেই বের করে আনতে পারতেন। শিল্পী মমতাজের গানের অনুষ্ঠান হোক, লেখক-কবিদের আড্ডা হোক কিংবা অভিনেতা-অভিনেত্রী, নাচের শিল্পী, জাদুশিল্পী—সব শিল্পীর ভেতরের যাবতীয় তথ্য-উপাত্ত, অভিজ্ঞতা এবং আবেগপ্রবণ জায়গায় টোকা দিয়ে অজানা অনেক কিছু তুলে আনতে পারতেন। তাই নির্দ্বিধায় বলতে পারি, আসাদ চৌধুরী একজন সফল উপস্থাপক।

উপস্থাপক হিসেবে তাঁর সবচেয়ে বড় যোগ্যতা, কাজের এবং বয়সের মানদণ্ড অনুযায়ী ছোট–বড়–মাঝারি—সব ধরনের অতিথিকে তিনি আগে থেকেই স্টাডি করে নিতেন। এ জন্য রেকর্ডিংয়ে  যাওয়ার আগে তাঁর হাতে অতিথির যাবতীয় তথ্য অন্তর্জাল থেকে কপি করে দুই পৃষ্ঠা, চার পৃষ্ঠা কিংবা দশ পৃষ্ঠার ‘নকল’ সাপ্লাই দিতে হতো। গাড়িতে বসেই তিনি পড়া শুরু করতেন, হোটেলে বসে রাতের খাবার শেষ করে পান চিবাতে চিবাতে পড়তেন। অর্থাৎ অতিথি না আসা পর্যন্ত তাঁর পড়াশোনা চলত। সত্যি বলছি মাইরি! এমন সিরিয়াস উপস্থাপক আমি আগে আর দেখিনি। নির্দিষ্ট লোকেশনে যাওয়া এবং ইউনিট প্রস্তুত করার সময়টুকু তিনি অতিথির সঙ্গে আড্ডা দিয়ে আরও কিছু তথ্য নিজের ঝুড়িতে জমা রাখতেন এবং ‘অ্যাকশন’ বলার পর উপস্থাপক হিসেবে অতিথিকে দর্শকের সামনে যেভাবে পরিচয় করাতেন, তা এককথায় অসাধারণ।

এরপর অতিথির কাজের বা ক্যারিয়ারের এমন সব তথ্য দিতেন যে অতিথি নিজেও বিস্মিত হতেন। প্রত্যেক অতিথিকেই আসাদ চৌধুরী একটা জীবন্ত বই/পুস্তক মনে করতেন এবং সেই বই থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো তুলে ধরতেন, যা একটা পর্বের জন্য যথেষ্ট। এমন পরিমিতিবোধের উপস্থাপক সব প্রযোজকের ভাগ্যে জোটে না।

আসাদ চৌধুরী

উদারতা, ক্ষুদ্রতা এবং সময় বণ্টন শব্দগুলোর সঙ্গে মানবজীবন সরাসরি জড়িত, যদিও এর ব্যবহার ব্যক্তিবিশেষের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু সময়ের চাহিদা বুঝে নিজেকে একটু ক্ষুদ্র করে অথবা অহংবোধ দূরে রেখে অন্যের সঠিক মূল্যায়নের জন্য যতটা উদার হতে হয়, তা সচরাচর আমাদের চর্চায় থাকে না। আমরা কেবল উদারতার পোশাক পরে ক্ষুদ্রতাকে ধারণ করে সময়ের সঙ্গে জীবনের তালগোল পাকিয়ে বিশ্ব রঙ্গমঞ্চে নিজের অভিনয় নিজেই শুটিং করি এবং দর্শক হিসেবে নিজেই দেখে থাকি। কিন্তু আসাদ চৌধুরীর মধ্যে এই উদারতার গুণটি ছিল। কাজের প্রতি তাঁর আন্তরিকতা, কমিটমেন্ট এবং পরিশ্রম সব সময় শুটিং ইউনিকে উজ্জীবিত রাখত। প্রতি মুহূর্তের উপলব্ধি শেয়ার করতেন তিনি, যা আমাদের বোধকে সমৃদ্ধ করত। নিজের বহন করা শরীরের ভালো–মন্দ, স্বার্থ কিংবা মানসিক সুবিধা বিসর্জন দিয়ে শীত, গ্রীষ্ম ও বর্ষা—সব সময় অনুষ্ঠানের মানের দিকে নজর রাখতেন। অনুষ্ঠান ধারণের শেষ প্রান্তে এসে তিনি অতিথির সঙ্গে যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন, সেই আলোচনার নির্যাস থেকে কোনো না কোনো মোটিভেশনাল মেসেজ বের করে আনতেন। একদিকে পারফেক্টশনিজ অন্যদিকে অহংকার এবং উচ্চতার ভার ভুলে যাওয়া একজন উপস্থাপক আসাদ চৌধুরী। বাইরের অন্ধকার দেখা যায় কিন্তু ভেতরের অন্ধকার দেখা যায় না। সেই অন্ধকারে বিনা বারুদে যিনি আলো জ্বালাতে পারেন, তিনিই অন্ধকারে আলোর সঞ্চালক। আমার কাছে আসাদ চৌধুরী ছিলেন এমনই এক অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব।

আজ তিনি নেই। কিন্তু তাঁকে কি আমি ভুলতে পারব? এটা সম্ভব? এমন সাদাসিধে মানুষ, এমন প্রাজ্ঞ কবি, এমন প্রাণবান মানুষ আর কোথায় পাব!