১৯৩২ সালে অস্ট্রেলিয়ায় ইমু পাখির সঙ্গে সে দেশের সেনাবাহিনীর শুরু হলো অসম এক যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে মানুষের বিরুদ্ধে জিতে গিয়েছিল পাখিরাই।
শিকারির এক গুলির শব্দেই গাছের মগডালে বসে থাকা সব পাখি উড়ে যায় ডানা ঝাপটে। এ দৃশ্যের সঙ্গেই পরিচিত আমাদের চোখ। তবে প্রয়োজনে যে সেই পাখিই কত ভয়াবহ হতে পারে, তা একবার দেখিয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার ইমু বাহিনী। প্রায় শত বছর আগে মানুষের বন্দুকের গুলির সামনে দাঁড়িয়েও জিতে গিয়েছিল সামান্য প্রাণিকুল। ওরা ভয় পায়নি; বরং সংঘবদ্ধ হয়েছে, প্রাণ দিয়েছে, পিছু হটেনি। উড়তে না জানা, কথা বলতে না পারা এই প্রাণিকুল নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছিল প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীকেও।
তাই সেই অসম যুদ্ধে এই পাখিদের বিরুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া মেজর ইমুদের বুলেটের ক্ষত সহ্য করার ক্ষমতায় মুগ্ধ হয়ে বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, এরা (ইমু) মেশিনগান থেকে শুরু করে ট্যাঙ্কের সামনেও অভেদ্য।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসির ওয়াইল্ড লাইফ বিভাগে এ বছরের ৯ জানুয়ারি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে পাওয়া যাবে মেজরের সে মন্তব্য। তবে মানুষ আর পাখির এই অসম যুদ্ধের ফলাফলের গল্প শোনার আগে জানতে হবে, বিরোধটা কেমন করে ঘনিয়ে উঠেছিল। বিশ্ব অর্থনীতির মতো গুরুতর জটিল বিষয়ের সঙ্গে কীভাবে সম্পর্ক থাকে একটি প্রজাতির পাখিদেরও। এই যুদ্ধ ইতিহাসে ‘ইমু যুদ্ধ’ হিসেবে নথিবদ্ধ হয়েছে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর হাজার হাজার যুদ্ধফেরত সৈনিককে কীভাবে কাজে লাগানো যায়, তা নিয়ে ভাবনায় পড়েছিল অস্ট্রেলিয়ার সরকার। দুশ্চিন্তার আরেক কারণ, এই সৈনিকেরা যুদ্ধ করা ছাড়া আর কিছু জানে না। তখন পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ায় সরকার ‘সৈনিক পুনর্বাসন প্রকল্প’ নামে এক প্রকল্প শুরু করে। এই প্রকল্পের আওতায় সেনারা শুরু করেছিল কৃষিকাজ করা। তবে জমির বণ্টন অসম হওয়ার অভিযোগ ছিল। বিকল্প হিসেবে কেউ কেউ শুরু করে অন্য কাজ। সব মিলিয়ে ওই মন্দার সময় কিছু চাষি লাভবান হলেও অধিকাংশই ছিল চরম দুর্বিপাকে। এর মধ্যে ‘গ্রেট ডিপ্রেশন’ শুরু হয়ে গেছে বিশ্বজুড়ে। তখন ১৯৩২ সালের অক্টোবরে পশ্চিম অষ্ট্রেলিয়ায় শুরু হলো এক উটকো ঝামেলা। এই ঝামেলার গল্পে প্রবেশের আগে বোঝা দরকার এসব জটিল বৈশ্বিক পরিস্থিতির সঙ্গে ইমু পাখিদের সম্পর্ক কোথায়।
সেনারা দেখল, ইমুরা বন্দুকের রেঞ্জ থেকে অনেক দূরে থাকে এবং ছড়িয়ে–ছিটিয়ে অবস্থান নেয়। এভাবে প্রথম ধাপে ব্যর্থ হয়ে তাঁরা পাখির বিরুদ্ধে গোপন হামলার পরিকল্পনা করেছিল। তাতেও বিশেষ লাভ হলো না, একদিকে ইমুদের ক্ষিপ্র গতি, অন্যদিকে সেনাদের বন্দুক গেল মাঝপথে জ্যাম হয়ে। পরের কয়েক দিনও এভাবেই যায়। মেজর জি পি ডব্লিউ মেরেডিথ তখন খেয়াল করতে শুরু করেন, ইমুদের মধ্যেও রয়েছে আশ্চর্য শৃঙ্খলা ও প্রকৃতি প্রদত্ত সামরিক প্রবৃত্তি।
ইমু পাখিরা একসময় রক্ষিত প্রাণী ছিল। অস্ট্রেলিয়ার ১৮৭৪ সালের ‘শিকার আইন’ অনুযায়ী ঊনবিংশ শতকের শেষ পর্যন্ত রক্ষিত প্রাণী হিসেবেই গণ্য করা হতো ইমুদের; কিন্তু একসময় তারা শস্য ক্ষতিকারক প্রাণী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গেল। কারণ খাদ্যাভাবে তখন ওরা ফসলের খেতে তাণ্ডব শুরু করেছে। এই সময় শস্য রক্ষায় ইমুদের শিকার করা যাবে, এমন আইন হলো। বলে রাখা দরকার, এই আইন হয়েছিল পুনর্বাসিত সৈনিকদের অনুরোধেই। তাঁরা বলছিল, তাদের শস্য ইমুদের তাণ্ডবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। গত শতকের প্রথম দিকে মারাও হয়েছিল অনেক ইমু। ১৯২৮ সালে পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার জেরাল্ডটনের উত্তরেই প্রায় তিন থেকে চার হাজার ইমু হত্যা করা হয়; কিন্তু ওই যে সংখ্যায় বেশি থাকলে যা হয়, এত হত্যার পরেও ইমু পাখিদের টিকিটিও নাড়াতে পারেনি বিশ্বযুদ্ধফেরত প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী।
সাধারণত বাঁশ ও তারকাঁটার বেড়া দিয়ে আটকে রাখা হতো এই ইমুদের। ত্রিশের দশকের শুরুতে তখন অর্থাভাবে চাষিরা ফসলের খেতে বেড়া দিতে পারছে না। এই সুযোগে ইমুরা শুরু করল স্বাধীনভাবে বিচরণ। দেশটির পশ্চিমের প্রান্তিক এলাকাগুলো তখন হয়ে উঠল হাজার হাজার ইমুর বিশাল বাহিনীর চারণভূমি। ফলে ইমু আর সেনা থেকে কৃষক হওয়া মানুষেরা তখন চলে এল মুখোমুখি অবস্থানে। তাঁরা বুঝল, নিজেদের সাধারণ বন্দুক দিয়ে এই পাখিদের কিছুই করা যাবে না; বরং এরা আরও নির্মম হয়ে তাণ্ডব বাড়িয়ে দিতে পারে। ব্যাপারও আসলে তা–ই ঘটেছিল। শুরু হয়েছিল মানুষ আর পাখির মধ্যে যুদ্ধ। শেষ পর্যন্ত জিতেছিল পাখিরাই।
যুদ্ধের দুই পক্ষের মধ্যে এক দলের ছিল আগ্নেয়াস্ত্র আর অন্য দলের ছিল ক্ষিপ্রতা। তবে এই আগ্নেয়াস্ত্র সেনা সদস্যদের যে নিজেদের কাছেই ছিল তা নয়। কারণ তত দিনে প্রথম বিশ্বযুদ্ধফেরত সেনারা কৃষক হয়ে গেছে। তাঁরা পার্থ শহরে দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জর্জ পিয়ার্সের কাছে নতুন প্রযুক্তির স্বয়ংক্রিয় বন্দুক চায়।
পিয়ার্স কেন্দ্রীয় সরকারকে না জানিয়ে বন্দুক দিলেন সৈন্যদের। একই সঙ্গে সেখানকার পুলিশ ও অন্যান্য প্রতিরক্ষা বাহিনীর সাহায্যের আবেদনও মেনে নিলেন। এই যুদ্ধে পাখিদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া দলে নেতৃত্ব দিলেন মেজর জি পি ডব্লিউ মেরেডিথ, সার্জেন্ট ম্যাকমারেসহ কয়েকজন। তাঁরা পাখির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে নামালেন দুটি ‘লুইস মেশিনগান’ ও ১০ হাজার বুলেট। আসলে পার্থের পঞ্চম সেনা কমান্ড্যান্ট ব্রিগেডিয়ার মার্টিন ভেবেছিলেন, পাখি মারতে মেশিনগান দিলে, মশা মারতে কামান দাগানোর মতো হবে। তাই মাত্র দুটি মেশিনগানই নিয়েছিলেন। এই লুইস বন্দুকগুলো দিয়ে প্রতি মিনিটে কয়েক শ গুলি করা যেত। তবুও ভাবুন, পাখির বিরুদ্ধে চলছে মেশিনগান!
কিন্তু সেনারা দেখল, ইমুরা বন্দুকের রেঞ্জ থেকে অনেক দূরে থাকে এবং ছড়িয়ে–ছিটিয়ে অবস্থান নেয়। এভাবে প্রথম ধাপে ব্যর্থ হয়ে তারা পাখির বিরুদ্ধে গোপন হামলার পরিকল্পনা করেছিল। তাতেও বিশেষ লাভ হলো না, একদিকে ইমুদের ক্ষিপ্র গতি, অন্যদিকে সেনাদের বন্দুক গেল মাঝপথে জ্যাম হয়ে। পরের কয়েক দিনও এভাবেই যায়। মেজর জি পি ডব্লিউ মেরেডিথ তখন খেয়াল করতে শুরু করেন, ইমুদের মধ্যেও রয়েছে আশ্চর্য শৃঙ্খলা ও প্রকৃতি প্রদত্ত সামরিক প্রবৃত্তি। তারা পায়ের আওয়াজ পেলেই ছোট দলে ভাগ হয়ে যায়। প্রতিটি দলে একটি করে নেতা থাকে, যারা লক্ষ্য রাখে শত্রু আসার পথে। আর ততক্ষণে ইমুরা তাদের ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে থাকে ফসলের মাঠে।
১৯৩২ সালের নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে শুরু হওয়া যুদ্ধের জন্য ১২ নভেম্বর সরকারের প্রতিরক্ষা বিভাগ আবারও মঞ্জুর করল ওই অঞ্চলে সেনা ও অস্ত্র সাহায্য। ১৩ নভেম্বর থেকে প্রথম দুদিনের অভিযান এবার বেশ ভালোই হলো, প্রায় ৪০টির মতো ইমু হত্যা করা হলো। এর পরে ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতি সপ্তাহে প্রায় ১০০ টি করে ইমু মারা হচ্ছিল। ১৯৩২ সালের ১০ ডিসেম্বর মেজর জি পি ডব্লিউ মেরেডিথ নিজের দেওয়া প্রতিবেদনে লিখলেন, ‘৯ হাজার ৮৬০ রাউন্ডে ৯৮৬টি ইমুর মৃত্যু হয়েছে।’ অর্থাৎ প্রতিটি ইমুর জন্য গড়ে ১০টি করে বুলেট খরচ করতে হয়েছিল সেনাবাহিনীকে।
কিন্তু এত করেও থামানো গেল না ইমুদের। সেনাবাহিনী দিয়েও প্রায় ১০ বছর পর্যন্ত তাদের আটকে রাখা যায়নি। এরপরে ইমুদের জন্য বিশেষভাবে তৈরি বেড়ার ব্যবহার চাষিদের আসন্ন ভরাডুবি থেকে বাঁচিয়েছিল বটে; কিন্তু এই যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত জিতে গিয়েছিল ইমুরাই।
কয়েক বছর ধরে চলা সে যুদ্ধের পর ইমু পাখিদের নিয়ে মেরেডিথ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘এই ইমু বাহিনীকে বন্দুক দিয়ে প্রশিক্ষিত করতে পারলে আমরা পৃথিবীর যেকোনো বাহিনীর সামনে দাগাতে পারতাম। মেশিনগানের বিপরীতে এই ইমু বাহিনী হতো ট্যাঙ্কের মতো।’ কানাডার মন্ট্রিয়ল থেকে প্রকাশিত ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি বিষয়ক ওয়েবসাইট ‘দ্য কালেক্টর’ ২০২৩ সালের ১৫ সেপ্টেম্বরের ‘দ্য গ্রেট ইমু ওয়ার: হোয়েন অস্ট্রেলিয়ানস লস্ট টু ফ্লাইটলেস বার্ড’ নামের প্রবন্ধে পাওয়া যাবে মানুষ আর পাখির সে যুদ্ধের ইতিহাস।
‘ইমু যুদ্ধ ১৯৩২: অষ্ট্রেলিয়ার সেনাবাহিনীকে কীভাবে পরাজিত করল উড়তে না জানা ইমুরা’ শিরোনামের ওই প্রতিবেদনের শুরুটাই মানুষের বিপরীতেও পাখি পর্যন্ত জিতে যেতে পারে স্তুতি দিয়ে। লেখা হয়েছে, ‘বিশ্বের অন্যতম বড় পাখি ইমুর সঙ্গে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত ছিল হয় ভীষণ সাহসের, না হয় একেবারে বোকামির চূড়ান্ত।’
এ বিষয়ে ‘ইমু ওয়ার’ নামে একটি চলচ্চিত্রও হয়েছে। সে চলচ্চিত্র মূল্যায়ন করে ‘দ্য গার্ডিয়ান’ এ বছরের জুনে একটি প্রতিবেদনও প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়েছে, রুপালি পর্দায় পাখি আর মানুষের মধ্যে যুদ্ধের দৃশ্য দেখে কোন কোন জায়গায় দর্শকের হাসিও পেয়েছে। শত বছর পর মানুষ–পাখির যুদ্ধ পৌরাণিক গল্পের মতো শোনালেও এ কথা সত্যি যে সেদিন মেজরের বন্দুকের গুলি পরাজিত করতে পারেনি সামান্য পাখিদেরও।