একটি কবিতা ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল শাসকের। একটি কবিতার মধ্য দিয়েই আপামর মানুষের অন্তরে পৌঁছে গিয়েছিলেন একজন কবি—মোহাম্মদ রফিক। ‘সব শালা কবি হবে, পিঁপড়ে গোঁ ধরেছে উড়বেই,/ দাঁতাল শুয়োর এসে রাজাসনে বসবেই।’—এই দুই পঙ্ক্তি যেন বিদ্যুতের মতো ছড়িয়ে পড়ল সারা দেশে। যে কবিতার দুটি পঙ্ক্তি নিয়ে তোলপাড় হয়েছিল তখন এবং যে কবিতার পঙ্ক্তিগুলো স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে জুগিয়েছিল নতুন রসদ, তার নাম ‘খোলা কবিতা’। কবিতাটি মোহম্মদ রফিক লিখেছিলেন আশির দশকে, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে। পরে এই কবিতা লেখার জন্য সেই সময় তাঁকে দুর্ভোগও কম পোহাতে হয়নি। সেনানিবাসে ডেকে নেওয়া হয়েছিল তাঁকে। মামলা মাথায় নিয়ে যেতে হয়েছিল আত্মগোপনে। এই বিষয়গুলো এখন ইতিহাস। তবে গতকাল ৬ আগস্ট মোহাম্মদ রফিকের মৃত্যুর পর থেকে তাঁর সঙ্গে সঙ্গে ‘খোলা কবিতা’ এবং সেই ইতিহাসই আবার আলোচনায় এসেছে নতুন করে।
কীভাবে লেখা হয়েছিল ‘খোলা কবিতা’? সেদিনের মোহাম্মদ রফিক, যিনি তখন ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক, তিনি কার উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘সব শালা কবি হবে’?
প্রশ্নগুলোর উত্তর জানার আগে ষাটের দশকের অন্যতম এই কবির বেড়ে ওঠা সম্পর্কে জানা দরকার। ১৯৪৩ সালের ২৩ অক্টোবর বাগেরহাটের বৈটপুর গ্রামে তাঁর জন্ম। কৈশোরে কৃষ্ণা নামের এক মেয়ের প্রেমে পড়েছিলেন। সেই প্রেমের আবেগে অষ্টম শ্রেণিতে থাকাকালে প্রথমবার কবিতা লিখেছিলেন। তবে প্রথম যৌবনে কবিতার চেয়ে রাজনীতিই তাঁকে বেশি পেয়ে বসে, বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লেষ ঘটে। ষাটের দশকে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে সোচ্চার ছিলেন। এ সময় কারাগারেও যেতে হয় তাঁকে। কারাগার থেকে বের হয়ে রাজনৈতিক স্লোগান অপেক্ষা কবিতার পঙ্ক্তির মাধ্যমেই বলতে চেয়েছেন মানুষের মুক্তির কথা। তত দিনে ‘সমকাল’সহ সেই সময়কার বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হতে শুরু করেছে তাঁর কবিতা। ১৯৭১ সালে মোহাম্মদ রফিক যোগ দিলেন মুক্তিযুদ্ধে।
দেশমাতৃকার মুক্তি এবং দেশের সব প্রগতিশীল আন্দোলনে এই কবি ছিলেন সক্রিয়। ‘খোলা কবিতা’ তাঁর রাজনৈতিক সক্রিয়তার শিল্পিত নিদর্শন।
পুরো কবিতাটি ছিল অনেক বড়—প্রায় ১৬ পৃষ্ঠা। তো, কবিতা লেখার পর দেখা দিল মধুর এক সমস্যা। সামরিক শাসকের বিরুদ্ধে লেখা এই কবিতা প্রকাশ করবে কে? কার আছে এত বড় বুকের পাটা?
আশির দশকে প্রথম ভাগ। দেশে তখন চলছে সামরিক শাসন। পালাবদল হয়ে হুসাইন মুহম্মদ এরশাদ বসেছেন ক্ষমতায়। মাঝেমধ্যই তাঁর বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠছে ছাত্রজনতা। ওদিকে ক্ষমতার মসনদে বসার পর কবি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন এরশাদ। তখনকার বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের প্রথম পাতায় ‘বিশেষ মর্যাদা’য় প্রকাশিত হতে শুরু করেছে তাঁর কবিতা। সে সময় কানাঘুষা এমন ছিল যে এরশাদের নামে পত্রিকার পাতায় যেসব কবিতা ছাপা হয়, তার রচিয়তা তিনি নন, অন্য কেউ। বিষয়টি নিয়ে আড়ালে–আবডালে অনেকেই কথা বলেন, তবে প্রকাশ্যে থাকেন মুখে কুলুপ এঁটে। এই বাস্তবতায় প্রথম মুখ খুললেন মোহাম্মদ রফিক। সরাসরি এরশাদকে উদ্দেশ করেই লিখলেন ‘খোলা কবিতা’ নামের সেই বিখ্যাত কাব্য—‘সব শালা কবি হবে, পিঁপড়ে গোঁ ধরেছে উড়বেই।’
১৯৮৩ সালে সামরিক শাসক এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন যখন ধীরে ধীরে দানা বাঁধছে, তখনই কবিতাটি লিখলেন কবি। তাঁর সঙ্গে সে সময় কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ফরহাদের অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। কমিউনিস্ট পার্টি তথা কমরেড ফরহাদের অনুপ্রেরণায় ১৯৮০–এর দশকে মোহাম্মদ রফিক গঠন করেছিলেন ‘সাংস্কৃতিক মঞ্চ’ নামে একটি সংগঠন। এ সংগঠনের উদ্দেশ্য ছিল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনকে বেগবান করা। সাংস্কৃতিক মঞ্চের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন দিলওয়ার হোসেন। ‘খোলা কবিতা’ রচনার স্মৃতিচারণা করেন তিনি, ‘আমি, কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়, তানভীর মোকাম্মেল, শফি আহমেদ, সুবীর দত্ত—সবাই মিলে আমরা তখন ধানমন্ডির ১ নম্বর রোডের তের নম্বর বাড়িতে থাকি। জাহাঙ্গীরনগর থেকে এখানে প্রায়ই আসতেন রফিক ভাই। কখনো কখনো রাতেও থাকতেন। “খোলা কবিতা”র একটি অংশ তিনি এখানে বসেই লিখেছিলেন।’
আগেই বলা হয়েছে, মোহাম্মদ রফিক তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক। শিক্ষকতার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক সংগ্রামেও দারুণভাবে সক্রিয়। ফলে কবি হিসেবে এরশাদের এই হঠাৎ উত্থান এবং পত্রিকার প্রথম পাতায় সেগুলো বিশেষভাবে ছাপা হওয়া তাঁকে পীড়িত ও ক্ষুব্ধ করেছিল। বিষয়টি ২০১৯ সালে বিবিসির এক সাক্ষাৎকারে মোহাম্মদ রফিক স্বীকারও করেছেন, ‘কবিতাটি আমি লিখেছিলাম ১৯৮৩ সালের জুন মাসের এক রাতে, এক বসাতেই। আমার মনে একটা প্রচণ্ড ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল, মনে হচ্ছিল একজন ভুঁইফোড় জেনারেল এসে আমাদের কবিতার অপমান করছেন।’
এরশাদের মার্শাল ল জারি আমার কাছে একটা ঘটনা। একজন লোক, যে কোনো দিন লেখালেখির মধ্যে ছিল না—ভুঁইফোড়—সে আজ সামরিক শাসন জারির বদৌলতে কবিখ্যাতি অর্জন করবে, এটা মানতে পারছিলাম না।’—মোহাম্মদ রফিক
পুরো কবিতাটি ছিল অনেক বড়—প্রায় ১৬ পৃষ্ঠা। তো, কবিতা লেখার পর দেখা দিল মধুর এক সমস্যা। সামরিক শাসকের বিরুদ্ধে লেখা এই কবিতা প্রকাশ করবে কে? কার আছে এত বড় বুকের পাটা? স্বভাবতই কবিতাটি প্রকাশ করতে সাহস করছিল না কেউ। তখন কবির কিছু ছাত্র আর সুহৃদের উদ্যোগে এটি ছাপানোর বন্দোবস্ত হয়। গোপনে ছাপানো হয় ছাপাখানায়। পরে নিউজপ্রিন্টে এক ফর্মায় ছাপানো সেই কবিতা গোপনে বিলি করেন মোহাম্মদ রফিকের ছাত্রছাত্রীরা। হাতে হাতে নিষিদ্ধ ইশতেহারের মতো কবিতাটি ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে।
‘খোলা কবিতা’ মূলত এরশাদকে উদ্দেশ করে রচিত হলেও পরে মোহাম্মদ রফিক বলেন, ‘এটা শুধু এরশাদকে নিয়ে লেখা কবিতা নয়। এরশাদের মার্শাল ল জারি আমার কাছে একটা ঘটনা। একজন লোক, যে কোনো দিন লেখালেখির মধ্যে ছিল না—ভুঁইফোড়—সে আজ সামরিক শাসন জারির বদৌলতে কবিখ্যাতি অর্জন করবে, এটা মানতে পারছিলাম না।’
কবির কথা থেকে এটা স্পষ্ট, এক এরশাদ ও তাঁর সামরিক শাসন—দুটি বিষয় ‘খোলা কবিতা’র জন্মের ভরকেন্দ্র।
কবিতাটি যখন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে, তখন নড়েচড়ে বসেন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন। এর মধ্যে একদিন মোহাম্মদ রফিকের ডাক পড়ে সাভারে সেনাবাহিনীর নবম পদাতিক ডিভিশনের দপ্তরে। এর আগে মামলা মাথায় নিয়ে তিন দিন হাজারীবাগে আত্মগোপন করে ছিলেন তিনি।
মোহাম্মদ রফিককে যখন সেনাবাহিনীর দপ্তরে ডেকে নেওয়া হয়েছিল, কী ঘটেছিল সেখানে?
কবির জবানে শোনা যাক সেই কাহিনি, ‘সেখানে তিনজন সেনা কর্মকর্তার মুখোমুখি আমি। তাঁদের প্রথম প্রশ্ন, “এটা কি আপনার লেখা?” আমি বললাম হ্যাঁ, আমার লেখা। আমি তাঁদের বললাম, আমি আপনাদের সব প্রশ্নের উত্তর দেব, কিন্তু একটা প্রশ্নের উত্তর দেব না। সেটা হচ্ছে, এটা কে ছেপে দিয়েছে। কারণ, আমি তাঁকে বিপদে ফেলতে চাই না।’
নির্ভীক কবি সেদিন এ কথাগুলো যখন বলেছিলেন, তার আগে যা হওয়ার তা হয়ে গেছে—একটি কবিতা, সামান্য কয়েকটি শব্দরাজি কাঁপিয়ে দিয়েছে সামরিক শাসকের তকত।
পরে অনেক ঝড়ঝঞ্ঝা শেষে ১৯৮৪ সালে বইমেলায় ‘খোলা কবিতা’ বই আকারে বের হয়। প্রথমে এক ফর্মা থাকলেও বই করার সময় কবি মোহাম্মদ রফিক কবিতাটি বড় করেন। তখন বইয়ের আয়তন দাঁড়ায় ৪ ফর্মা। এ কবিতা লেখার সঙ্গে যেমন, তেমনি বইয়ের সঙ্গেও ঘনিষ্টভাবে যুক্ত ছিলেন দিলওয়ার হোসেন। একদা সাংস্কৃতিক মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত এই মানুষটি বর্তমানে প্রকাশনা ব্যাবসায় যুক্ত। বই প্রসঙ্গে তাঁর কাছে জানতে চাইলে আবারও তিনি খুলে দিলেন স্মৃতির অর্গল, ‘মনে আছে, ১৯৮৪ সালের ১৯ ও ২০ ফেব্রুয়ারি গোপীবাগের সুবর্ণ প্রিন্টার্সে রাত জেগে আমরা বইটি কম্পোজ করেছিলাম। সুবর্ণ প্রিন্টার্সের মালিক মজিবর রহমান ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত। এমন একটা বইয়ের সঙ্গে থাকতে পারছি, তা নিয়ে আমাদের তখন সে কী উত্তেজনা! অবশেষে ২১ ফেব্রুয়ারি “খোলা কবিতা” আমরা মেলায় আনতে পেরেছিলাম। বই নিয়ে আমি আর রফিক ভাই গিয়েছিলাম মেলায়।’
বই হিসেবেও ‘খোলা কবিতা’ পাঠকেরা গ্রহণ করেছিল। এরপর দিনে দিনে এটি স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে অনেকটা শ্লোগানের মতোই হয়ে ওঠে। মূলত ‘খোলা কবিতা’র জন্যই ‘সব শালা’ কবি হতে পারেনি।