উত্তরার গ্যালারি কায়ায় চলছে কথাশিল্পী আনিসুল হকের চিত্রপ্রদর্শনী। আনিসুল হকের ছবির স্বকীয়তা আদতে কোথায়?
২০১৬ বা ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের আগমুহূর্ত। কথাশিল্পী আনিসুল হককে যেন ভূতে পেল। বইমেলা সমাগত। কিন্তু মেলা উপলক্ষে সেবার তিনি কোনো বই লিখছেন না, কেবলই রং-তুলি দিয়ে ছবি আঁকছেন। সে সময় ছবি আঁকায় আনিস ভাই এমন মত্ত হলেন যে দিনদুনিয়া প্রায় ভুলেই গেলেন। প্রথম আলো অফিসে আমাদের যে কাউকে দেখলেই বলতেন, ‘বসো।’
তারপর এধার-ওধার টানটোন। এর কিছুক্ষণ পর ওই ব্যক্তির ছবি এঁকে দিয়ে উদাস ভঙ্গিতে উঠে পড়তেন।
এ সময় একদিন তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আনিস ভাই, বইমেলা আসছে। আপনি কিছু লিখবেন না এবার?’
তিনি বললেন, ‘আমাকে ছবির ঘোরে পেয়েছে।’
আনিসুল হকের সেই ঘোরগ্রস্ত সময়ে আঁকা ছবিগুলো নিয়ে উত্তরার গ্যালারি কায়ায় গতকাল ২৬ জানুয়ারি শুরু হয়েছে প্রদর্শনী। চলবে ৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।
গতকাল বিকেল পাঁচটায় প্রদর্শনীটির উদ্বোধন করেছেন কবি নির্মলেন্দু গুণ ও চিত্রশিল্পী হাশেম খান।
আনিসুল হক লেখার জগতের মানুষ। তাই তাঁর ছবির মধ্যে আঁকার পাশাপাশি লেখাও আছে। কথাটি একটু ঘোরালো লাগল, তাই না? তাহলে একটু খোলাসা করে বলি। ক্যানভাসে তিনি এঁকেছেন রবীন্দ্রনাথের প্রতিকৃতি। তবে এই প্রতিকৃতি কেবল ‘প্রতিকৃতি’তেই সীমাবদ্ধ হয়ে থাকেনি, এর সঙ্গে তিনি যখন রবিঠাকুরের দু-এক চরণ জুড়ে দিয়েছেন, তখন তা ছবি (পড়ুন: প্রতিকৃতি) ও লেখা মিলিয়ে হয়ে উঠেছে যেন ‘ছবিলেখা’।
চিত্রকর অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘ওবিন ঠাকুর (অবন ঠাকুর) ছবি লেখে।’ কথাটি পূর্ববঙ্গে জন্ম নেওয়া শিল্পী পরিতোষ সেনের ‘জিন্দাবাহার’ বইয়ের ভূমিকায় তাঁর সম্পর্কেও বলেছেন অমলেন্দু বসু। তিনি লিখেছেন এভাবে যে ‘ছবি লিখেছেন পরিতোষ সেনও’।
তাঁদের লেখা থেকে ধার করে একইভাবে আমরা বলতে পারি, আনিসুল হক ছবি আঁকেননি, প্রথাগতভাবে ছবি আঁকেননি তিনি, তিনি ছবি লিখেছেন।
আমাদের সংস্কৃতি অঙ্গনের অনেককেই নিজের ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। তাঁর ক্যানভাসে ফুটে উঠেছেন কালজয়ী রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দসহ বিভিন্ন সাহিত্যিকেরাও। তা এই কাজটি তো তাঁর আগে অনেকেই করেছেন, কিন্তু তাঁর ক্ষেত্রে কথাটি একটু বিশেষভাবে বলতে চাইছি কেন?
বলছি এ কারণে যে আনিসুল হক যাঁদের ছবি (পড়ুন: প্রতিকৃতি) এঁকেছেন, আঁকার সময় তিনি তাঁদের চেহারা ও গড়ন হুবহু নকল করেননি, শিল্পী হিসেবে তাঁর মনের ভেতরে বা কল্পনায় ওই ব্যক্তিদের যে গড়ন স্থিত আছে, তাই তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন নিজের চিত্রপটে। এ ক্ষেত্রে আমাদের মনে পড়তে পারে কিংবদন্তি চিত্রকর এস এম সুলতানের ছবির কৃষকদের কথাও। সাধারণত বাংলাদেশের কৃষিজীবী মানুষদের আমরা ক্ষীয়মাণ বা রুগ্ণ হিসেবেই দেখতে পাই। তবে সুলতানের কৃষিজীবী মানুষেরা আকৃতির দিক দিয়ে শক্তিমান। কৃষককে কখনো রুগ্ণ করে আঁকেননি সুলতান। তাঁর কল্পনায়, তাঁর আকাঙ্ক্ষায় বাংলার কৃষকেরা ছিলেন বিশালাকার, ‘স্বপ্নের সমান বড়’। একইভাবে আনিসুল হক যখন কাউকে নিজের চিত্রপটে ধারণ করেছেন—সে রবীন্দ্রনাথ কি শামসুর রাহমান বা সৈয়দ শামসুল হক অথবা হালের মোস্তফা সরয়ার ফারুকী—তাঁদের তিনি এঁকেছেন নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে, অর্থাৎ যেভাবে তিনি তাঁদের কল্পনা করেন, অনেকটা সেভাবেই।
এসব ব্যক্তিবর্গের বাইরেও অনেক ছবিই তিনি এঁকেছেন। সেসব ছবিতে নদী আছে, নৌকা আছে, গ্রাম আছে, পূর্ণিমার ঝলসানো চাঁদ আছে, গ্রাম আছে, দুরন্ত কিশোর আছে। সর্বোপরি যা আছে তা হলো বাংলাদেশ। তবে এই ছবিগুলোর অধিকাংশতেও তিনি ছবির সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন লেখা। এই লেখাকে অনেক সময় ক্যানভাসের অলংকার হিসেবেও তিনি ব্যবহার করেছেন। কখনোবা লেখাগুলো হয়ে উঠেছে ক্যানভাসের টেক্সচারও। আর এভাবেই ছবি আর লেখা মিলেমিশে গড়ে উঠেছে শিল্পী আনিসুল হকের ছবির ক্যানভাস বা ক্যানভাসের ব্যক্তিত্ব।
হ্যাঁ, ‘ব্যক্তিত্ব’ বিশেষণটি যথেষ্ট ভেবেচিন্তেই প্রযুক্ত হয়েছে এখানে। কারণ, অনিসুল হকের ছবির (পড়ুন: ছবিলেখার মধ্যে) এই ‘ব্যক্তিত্ব’ বিষয়টি বড়ভাবে নজর কাড়ে; এবং তা প্রতিটি ছবির অঙ্কনরীতি থেকে শুরু করে রং নির্বাচন ও রং বিন্যাস—সব ক্ষেত্রেই।
বোধ করি এই বৈশিষ্ট্যই আনিসুল হকের ছবিকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করেছে।
আনিসুল হকের এই ‘ছবিলেখা’ দেখতে আজ, কাল, পরশু, তরশু—৪ ফেব্রুয়ারি অব্দি যেকোনো দিন আপনি যেতে পারেন উত্তরার গ্যালারি কায়ায় (ব্লক: ৪, সড়ক: ১৬, বাড়ি ২০)। আশা করি এই প্রদর্শনীতে নতুন এক ভুবনের সন্ধান আপনি পেলেও পেতে পারেন।