বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক ঘটনা মূর্ত হয়েছে শামসুর রাহমানের কবিতায়। এর বাইরেও তাঁর কবিতা হেঁটেছে বিচিত্র পথে। বাংলা কবিতার ভাষায় ঢাকার মালিকানাস্বত্বের প্রতিষ্ঠাও কি এই কবির হাতে ঘটেনি? কবির জন্মদিন মনে রেখে এসব প্রশ্নের তত্ত্বতালাশ
বাংলাদেশের কবিতাবিষয়ক আলাপ-আলোচনায় শামসুর রাহমানকে ‘জাতীয়তাবাদী কবি’ হিসেবেই প্রধানত বিবেচনা করা হয়ে থাকে। এ জন্য তিনি যথেষ্ট নন্দিত ও নিন্দিত হয়ে থাকেন। নিন্দুকেরা বলেন, তিনি ‘আইটেম কবি’। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ সব ঘটনায় তিনি কবিতা লিখেছেন। ফলে কবিতা নয়, কবিতায় ধারণ করা ঘটনাই রাহমানকে বাঁচিয়ে রেখেছে। নতুবা এত দিনে রাহমান মরে ভূত হয়ে যেতেন। অনেকে তো এ–ও বলেন যে রাহমান বাংলাদেশের কবিতার ‘গন কেস’।
শামসুর রাহমান বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার সবচেয়ে নিকটজন কবিদের একজন। কথাটা অমূলক নয়। তাঁর চিন্তাধারা ওই চেতনার সঙ্গেই সবচেয়ে বেশি মিলমিশ খায়। তিনি বরাবর ওই চেতনার সঙ্গে মিলেমিশেও চলেছেন। আবার ১৯৫২ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত সব গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনার জুতসই কবিতাটির রচয়িতাও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তিনিই—এ কথাও সত্যি। কিন্তু শামসুর রাহমান এতেই ফুরিয়ে যান না। তাঁর অন্যতর গুরুত্ব আছে বলে মনে করি। গুরুত্বটা প্রধানত বাংলা কবিতার ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত। বিস্তারে যাওয়া যাক।
২.
শামসুর রাহমান পঞ্চাশের দশকের কবি। তাঁর আগের প্রজন্ম; অর্থাৎ চল্লিশের দশকের কবিদের অধিকাংশই কবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন মূলত কলকাতায়। তাঁদের যে কারও কবিতা ছাপা হওয়ার ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, অধিকাংশ কবিতাই ছাপা হয়েছে মুসলমান সম্পাদিত পত্র–পত্রিকায়। তখন ‘কবিতার মান’, বিষয়-আশয় এবং আরও নানা কারণে দু–একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিজেদের কবিতা নিজেদের পত্রিকায় ছাপা হতো। যে কারণে বিশেষ সম্প্রদায়ের ‘কোটারি-কবি’ পরিচয়েই তাঁদের বেড়ে উঠতে হয়েছে। ‘কলকাতার মূলধারার বড় বড় কবি’ মাঝেমধ্যে এঁদের কারও কারও পিঠ চাপড়ে দিয়েছেন। তাতেই এঁরা খুশিতে আটখানা হয়ে উঠতেন। কিন্তু ভেতরে–ভেতরে নগর কলকাতার সাহিত্যিক পরিমণ্ডলে একটা অপরতারবোধ যে তাঁদের তাড়িত করত, একটা চাপা অসন্তুষ্টির তলে যে তাঁরা কবিজীবন যাপন করতেন, এটা বোঝা কোনো জটিল বিষয় নয়। এ কারণে চল্লিশের দশকে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ব্যতিক্রম বাদে তাঁরা প্রায় সবাই শামিল হয়েছেন। যাঁর যতটুকু সামর্থ্য ছিল, তা–ই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন পাকিস্তান হাসিলের লড়াই-সংগ্রামে। রচনা করেছেন পাকিস্তানবাদী চেতনাসমৃদ্ধ কবিতার পর কবিতা। কারণ, তাঁরা সবাই সাংস্কৃতিক স্বায়ত্তশাসন চাইতেন; চাইতেন আত্মমর্যাদা।
কিন্তু শামসুর রাহমানের এসব সংকট ছিল না। তাঁর জন্ম, বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা, কবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ—সবই বর্তমান বাংলাদেশের ভূগোলে ঘটেছে। আরও সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, ঢাকায় ঘটেছে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলন নয়; বরং পাকিস্তানবিরোধী নানা আন্দোলনের ভেতর দিয়ে তিনি বেড়ে উঠেছেন। ফলে তিনি ও তাঁর প্রজন্মের কবিরা পূর্বজদের পাকিস্তানবাদী ও সাম্প্রদায়িক পরিচয়-চিহ্নিত কবিতার কাছে হাত পেতে নেওয়ার মতো তেমন কিছু দেখলেন না। তাঁরা বরং কলকাতার ত্রিশের দশকের কবিদের আধুনিকতাবাদী কবিতার সঙ্গে নিজেদের গভীরভাবে যুক্ত করলেন। প্রেরণা ও নন্দনরুচি—সবই নিলেন সেখান থেকেই। এ কারণে দেখি, শামসুর রাহমানের প্রথম কবিতা ‘রূপালী স্নান’কে অনেকে জীবনানন্দ দাশের কবিতা বলে মনে করেছিলেন। প্রথম দিকের এক স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে আত্মজীবনী কালের ধুলোয় লেখায় শামসুর রাহমান বলেছেন, রেডিওতে ‘আমন্ত্রিত হয়ে আবুল হোসেনের কাছে একটি মুদ্রিত কবিতা জমা দিই। তিনি আমাকে অন্য একটি কবিতা আনতে বললেন, সম্ভবত জীবনানন্দগন্ধী কবিতাটি তাঁর ভালো লাগেনি।’
কিন্তু খুব দ্রুতই রাহমান নিজের কবিতায় নোঙর করতে পারলেন। আবদুল মান্নান সৈয়দের মতে, দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ রৌদ্র করোটিতে (১৯৬৩) থেকেই রাহমান ওই প্রভাব কাটিয়ে ওঠেন। কিন্তু নিবিড় পাঠ দিলে বোঝা যায়, আসলে প্রথম কাব্যগ্রন্থেই অনেক কবিতা পাওয়া যাবে, যেখানে তিনি নিজের কবিতাটি নিজের মতো করে লিখে উঠছেন। এরপর তিনি এমন সব কবিতা লিখে উঠতে লাগলেন, যেসব কবিতা ভাবে, ভাষায়, বিন্যাসে, উচ্চারণে কিছুতেই আর জীবনানন্দের নয়; কলকাতার নয়।
৩.
ত্রিশের দশকের কবিরা চেয়েছিলেন কবিতার ভাষাকে গদ্যের কাছাকাছি আনতে। এই কাজে তাঁরা কিছুটা সফল হলেও চলিত গদ্যের চলনভঙ্গির মধ্যে কবিতার ভাষাকে পুরোপুরি তাঁরা আঁটিয়ে উঠতে পারেননি। সেই কাজ সম্ভব করলেন ঢাকার কবি শামসুর রাহমান। বাংলা কবিতার ভাষাকে তিনি ড্রয়িংরুম থেকে জনসমুদ্র হয়ে অলিগলির মধ্যে, নিত্যকার কলকোলাহলের মধ্যে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন। কবিতার ভাষার গা থেকে আরোপিত কাব্যিকতাকে অনেকটাই ঝেড়ে ফেলেছিলেন। উদাহরণের জন্য শামসুর রাহমানের যেকোনো কবিতাকেই নেওয়া যাবে। যেমন লক্ষ করা যাক, রৌদ্র করোটিতে কাব্যের ‘দুঃখ’ কবিতাটির একটি অংশ, ‘আমাদের একরত্তি উঠোনের কোণে উড়ে আসে চৈত্রের পাতায়/ পাণ্ডুলিপি বই ছেঁড়া মলিন খাতায়/ গ্রীষ্মের দুপুরে ঢক্ঢক্/ জল-খাওয়া কুঁজোয় গেলাশে, শীত-ঠক্ঠক্/ রাত্রির নরম লেপে দুঃখ তার বোনে/ নাম/ অবিরাম’। অথবা প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগের ‘তিন শো টাকার আমি’ কবিতার একটি অংশও লক্ষ করা যায়, ‘আখেরে হলাম এই? আর দশজনের মতন/ দৈনিক আপিশ করা, ইস্ত্রি করা কামিজের তলে/ তিন শো টাকার এই পোষমানা আমিকে কৌশলে/ বারো মাস ঝড়ে জলে বয়ে চলা যখন তখন?’ দেখা যাচ্ছে, কবিতাকে তিনি যত দূর সম্ভব জনপাঠ্যের কাছাকাছি আনতে পেরেছিলেন। বর্ণনাত্মক রীতির সঙ্গে উপমা-চিত্রকল্পের ব্যাপকভিত্তিক তালিকাপাত এবং এরই মধ্যে সহজিয়া টুংটাং ধ্বনিব্যঞ্জনার মধ্যস্থতায় রাহমান এমন এক কাব্যভাষার জন্ম দিলেন, যা তাঁকে ঈর্ষণীয়ভাবে পাঠকপ্রিয় করে তুলল। তাঁর নতুন আধুনিক কবিতার বার্তা দ্রুতই পৌঁছে গেল বাংলা কবিতার দীর্ঘ দেড় শ বছরের রাজধানী কলকাতায়। সেখানকার বাঘা বাঘা কবি স্বীকার করে নিলেন তাঁকে। প্রায় প্রত্যেকেই স্বীকার করলেন, বাংলা কবিতার নতুন রাজধানীর নতুন যুবরাজ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন একজন—শামসুর রাহমান।
ঢাকার মতো একটা অনগ্রসর শহরে বসে শামসুর রাহমান সমগ্র বাংলা কবিতার মধ্যে এই যে একটা বিশেষত্ব নিয়ে এলেন, তা কিন্তু তিনি আনলেন নিজের দেশকালের পক্ষে থেকেই। রবীন্দ্রোত্তর যুগের আধুনিক কবিদের; বিশেষত ত্রিশের দশকের অধিকাংশ কবির কবিতা আস্বাদনের জন্য নির্দিষ্ট দেশকাল বা ভূগোল জরুরি ছিল না। কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মের কবি হিসেবে রাহমানের একটা বড় বিশেষত্ব এই যে কবিতাকে তিনি নির্দিষ্ট দেশকালের মধ্যে নামিয়ে আনলেন।
শামসুর রাহমান বাংলাদেশের কবিতার পঞ্চাশের দশকের সেই কবি, যাঁর কবিতার মধ্যে একটা ‘লোকাল ফ্লেবার’ আছে। সেটা ঢাকাই ফ্লেবার। তাঁর কবিতায় মূলত ঢাকা শহরের পার্ক থেকে ফুটপাত হয়ে ড্রয়িংরুম পর্যন্ত সবই প্রায় বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে। পুরান ঢাকার অলিগলি আর জীবনের কথা না–হয় বাদই দিলাম। যদিও অনির্দিষ্ট ভূগোলের কবিতাও রাহমানের কম নয়, তবু ঢাকার নাগরিক জীবনের খুঁটিনাটির উপস্থাপনে রাহমানের জুড়ি বোধ করি তিনি নিজেই। ঢাকাই জীবনের কবিতার জন্য কলকাতাই সমীহ প্রথম বোধ করি আদায় করতে পেরেছিলেন শামসুর রাহমান।
শুধু কি ঢাকার জীবন! না, শুধু জীবন নয়; জবানও। রাহমানের কবিতায় যেহেতু ঢাকাকে বোঝা যায়, সেহেতু ঢাকার জবানও নানাভাবে তাঁর কবিতায় মূর্ত হয়েছে। এই মূর্তি যে খুব বেশি প্রত্যক্ষ, তা নয়। জসীমউদ্দীন, আল মাহমুদ বা আসাদ চৌধুরীর ভাষার সঙ্গে ঢাকার, তথা পূর্ব বাংলার, তথা বাংলাদেশের ভাষার যে ধরনের সম্পর্ক, রাহমানের কবিতার ভাষার সঙ্গে ঠিক সেই ধরনের সম্পর্ক নয়। কিন্তু রাহমানের কবিতার ভাষার মধ্যকার আটপৌরে চলনস্বভাব আর প্রচুর আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার তাঁর ভাষাকে অন্তত ঢাকার শিক্ষিত মধ্যবিত্তের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত করে দিয়েছে। উপনিবেশায়নের কালে বাংলা ভাষা যে সংস্কৃতায়নের শিকার হয়েছিল এবং মুসলিম জবানের অপরায়ণের ভেতর দিয়ে গিয়েছিল, রাহমানের কবিভাষা ওই অপরায়ণের ঐতিহাসিক পরম্পরাকে যথেষ্ট পাশ কাটাতে পেরেছে।
এদিক থেকে বলা যায়, বাংলা কবিতার ভাষায় এই প্রথম ঢাকার মালিকানাস্বত্বের প্রতিষ্ঠায়ন ঘটল। এর আগে চল্লিশের দশকে ঢাকার কবিতার ভাষায় স্বাতন্ত্র্য আরোপের যে চেষ্টা চলেছিল, তা বাংলাদেশের কবিতায় এবং বাংলা কবিতার ‘মূলধারায়’ খুব বেশি সমীহ আদায় করতে পারেনি। কিন্তু রাহমান ঢাকার কথ্য বাংলার স্বভাব, শিক্ষিত বাঙালি মুসলমানের মুখ থেকে নেওয়া উল্লেখযোগ্য আরবি-ফারসি শব্দের প্রযোজনায় সেই সমীহ আদায় করতে পেরেছিলেন। যদিও হুমায়ুন আজাদ তাঁর শামসুর রাহমান: নিঃসঙ্গ শেরপা গ্রন্থে রাহমানের কবিতায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহারকে ‘অধিকতর ক্ষতি’র কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু আজাদের কাছে যা ‘ক্ষতি’, তা–ই আসলে রাহমানের ‘সম্পদ’ বলে অনেকে মনে করেন।
ফলে শামসুর রাহমান কেবল জাতীয়তাবাদী চেতনার কবি নন, নন শুধু ‘রাজনৈতিক আইটেমসর্বস্ব’ কবি। বাংলাদেশের কবিতায় শুধু নন, সমগ্র বাংলা কবিতার ভূগোলে রাহমান বেঁচে থাকবেন ওপরে আলোচিত তাঁর নিজস্ব নানা মৌলিক অবদানের জন্য; বাংলাদেশের ভাষা আর ভূগোলের অনুকূলে থেকেও ঢাকাকে বাংলা কবিতার নতুন রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠার কৃতিত্বের জন্য। এ কারণেই বোধ করি শামসুর রাহমান পঞ্চাশ-ষাট—এমনকি সত্তরের দশকেও ‘পূর্ব বাংলায় সাধারণের কাছে এবং কবি প্রার্থীদের কাছেও’ হয়ে উঠেছিলেন ‘কবি ও কবিতা হয়ে ওঠা–না ওঠার গজকাঠি’। এই ঐতিহাসিক বাস্তবতার মধ্যেই শামসুর রাহমান বেঁচে থাকবেন বলে মনে করি।