অনেকের কাছে তিনি গুরু, অনেকে তাঁকে বলেন বাংলাদেশের শীর্ষ রকস্টার। তিনি ফারুক মাহফুজ আনাম জেমস। আজ ২ অক্টোবর তাঁর জন্মদিন। এদিনে চলুন জানা যাক কেন তিনি জেমস, কেন তিনি অন্যদের চেয়ে আলাদা।
টেলিভিশনের পর্দায় চলছে সরাসরি গানের অনুষ্ঠান। মধ্যরাত। গাইছেন বরেণ্য এক সংগীতশিল্পী। একটি গান পরিবেশনার পর স্বাভাবিকভাবেই সঞ্চালক বেশ প্রশংসা করলেন। শিল্পীর সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। তিনি চুল বা গিটারের ফিতা ঠিক করছেন। সঞ্চালক বিনয়ের সঙ্গে জানতে চাইলেন, ‘এবার আমরা কোন গানটি শুনব?’ এ অবস্থায় যেকোনো শিল্পীই গানের শিরোনাম বলবেন, গীতিকার-সুরকারের তথ্য দেবেন, হয়তো ছোট্ট করে গানটি তৈরির গল্পও জুড়বেন। কিন্তু না। এই শিল্পী তা করলেন না। তিনি মঞ্চ ছেড়ে দলবল নিয়ে হাঁটা শুরু করলেন ব্যাকস্টেজের দিকে। যাওয়ার আগে গুরুগম্ভীর কণ্ঠে মাইক্রোফোনে শুধু বললেন, ‘আমরা এখন ব্রেকে যাব।’ উপস্থাপক কিছুটা অপ্রস্তুত! কিছুটা হতবাক টিভি সেটের সামনে থাকা আমার মতো অনুরক্ত দর্শকসমাজ।
কয়েক মিনিটের বিরতির পর সেই শিল্পী ফিরেছিলেন যথারীতি, নিয়ম মেনে, শুনিয়েছিলেন শ্রোতৃপ্রিয় সব গান। কিন্তু বিরতিটা তিনি নিয়েছিলেন নিজের রীতি বা ইচ্ছায়, অনুষ্ঠান কর্তৃপক্ষের প্রোগ্রাম ফ্লো বা স্লট মেনে নয়। তিনিই জেমস। একটু আলাদা। আপাতদৃষ্টে রুক্ষ, গম্ভীর, বেমানান, বেখেয়ালি।
সিনায় সিনায় লাগে টান...
জেমস কি সত্যিই বেখেয়ালি? বেদরদি? তাঁর গানে এত দরদ, এত মায়া, এত হাহাকার কোত্থেকে আসে! তাঁর গানের কবিতা তাহলে এত সমৃদ্ধ হয় কী করে? সচেতনভাবে গানের কথা নির্বাচন না করলে শুরু থেকেই তিনি এমন ভিন্নপন্থী হলেন কীভাবে! যেসব কথার গান গেয়ে জেমস নিজের পরিচিতি, ভিত ও জগৎ তৈরি করেছেন, এর পেছনে লুকিয়ে আছে বিরাট এক যুদ্ধ, যা এখনো চলমান। আর এই যুদ্ধটা গানে ভিন্ন স্বাদ গ্রহণে উদ্বু্দ্ধ করার, আধুনিক ধারার রোমান্টিক কথা-সুর-নাচে মোহাবিষ্ট শ্রোতৃশ্রেণিকে নতুন কিছু শোনানোর।
তবে এমন একটা অন্য ধরনের জগৎ আপনাআপনি গড়ে ওঠেনি। ‘ব্যান্ডের গান’ যখন প্রায় চিল্লাচিল্লির নামান্তর, তিনি সে সময় গ্রামবাংলার নির্যাস তুলে এনেছেন গানের কথায়। মাটির সুরের সঙ্গে মিশিয়েছেন পশ্চিমের ধুন, বাজনাবাদ্য। অপ্রচলিত, অব্যবহৃত, লোকায়ত কিংবা উচ্চমার্গীয় অথচ গভীরার্থ বহন করে এমন শব্দের অভিধান হাজির করেছেন একেকটি গানে। নগরবাউল হয়ে সেসব গান পরিবেশন করেছেন মাঠে-ময়দানে, ওপেন এয়ার কনসার্টে। যুগের পর যুগ। জেমসের গান এভাবেই ধীরে ধীরে আমাদের প্রাণের সম্পদ হয়ে উঠেছে। ভক্তমাত্রই তাঁর লিরিক মনে করতে খুব জোর খাটাতে হয় না। কারণ, তাঁর লিরিক মানেই আমাদের চেনাজানা শব্দের মিছিল। গানের ভিন্নতার খোঁজে কখনো তিনি কড়া নেড়েছেন কবির দরজায়, এভাবেই তারায় তারায় রটিয়ে দিয়েছেন ভালোবাসা ও বিশ্বাসের বার্তা...
তবে বন্ধু নৌকা ভেড়াও
‘বাংলা রক গানের ইতিহাস’ নামের একটি বই লেখা হলে ওই বইটিতে ‘দ্য জেমস চ্যাপ্টার’-এ কী থাকবে? লম্বা চুলের গোমড়োমুখো ক্ষীণকায় এক সাদামাটা লোক, যাঁর কণ্ঠ শুনলে মনে হয়, ভরা নদীর কলতান? মনে হয় সর্বহারা এক মাঝির আর্তনাদ! নাকি মিছিলে স্লোগান দেওয়া তাগড়া যুবক? সঙ্গীহীন খ্যাপাটে প্রেমিক? মা-হারা, বাবা-হারা ক্লান্ত সন্তান! আর কিছু শব্দ, শব্দের নতুন ব্যঞ্জনা? আর কিছু সুর; চেনা-অচেনায় মিলেমিশে একটা ঘোর, আবহ! মনে হয় তিনি এমন এক জাদুকর—ফুঁ দিলেই সেরে ওঠে আমাদের যার যার ক্ষত, পুষিয়ে যায় ক্ষতি আর অপ্রাপ্তিও লাগে সুন্দর। লোকটার কী দুঃসাহস, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে ভাব জমিয়ে তিনিও বলেন, ‘আমি তোমাদেরই লোক’! বলা নেই কওয়া নেই, নাক গলান এই বলে, ‘ঠিক আছে বন্ধু’। আহা, আমাদের বেদনারা গলে গলে যায়। সত্যি, এ তো আমাদেরই লোক, আমাদের ভাই, বন্ধু, স্বজন, প্রিয়ভাজন...
বাংলার অন্য রূপ...
শিক্ষক, কৃষক, ফেরিওয়ালা, মলম বিক্রেতা, চোর, গার্মেন্টস–কন্যা, নববধূ, ছেলেপুলে, ধর্ষিতা, বাইজি, খুনি, লাঠিয়াল, যৌনকর্মী, জুয়াড়ি, নেশাগ্রস্ত, রাজনৈতিক নেতা, টোকাই থেকে শুরু করে মা-বাবাসহ বিচিত্র শ্রেণি-পেশার মানুষ হয়ে উঠেছে তাঁর গানের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেবল প্রেম-বিরহের অতিচর্চিত গানের দুনিয়ায় আটকে থাকেননি জেমস। গানে-সুরে আমাদের গল্প তাঁর মতো করে বিস্তৃত পরিসরে কম জনই তুলে ধরেছেন। যাত্রাপালা, বায়োস্কোপ, পুঁথি, গাথা, খেলাধুলা, গীত, মুক্তিযুদ্ধ, রূপকথা, দেহতত্ত্ব, মেলা, বাউল ভাবধারা, লোকগানের বিচিত্র অনুষঙ্গ জেমসের গানের দুনিয়াকে করেছে বিচিত্র। এ কারণেই বলা যায়, দেশীয় সংস্কৃতির বড় ধারক, বাহক, প্রচারক ও পরিবেশক এই একরোখা মানুষটি। অন্যদিকে প্রেম-বিরহের গানেও ভিন্নমাত্রা সংযোগ স্থাপনে—এ ধারার গানকে তারুণ্যদীপ্ত করে তোলার ক্ষেত্রে অনন্য ভূমিকা রয়েছে তাঁর। ফলে এই রকস্টারকে নিয়ে আমাদের আলাদাভাবেই ভাবতে হয়।
‘বাংলা রক গানের ইতিহাস’ নামে একটি বই লেখা হলে ওই বইটিতে ‘দ্য জেমস চ্যাপ্টার’-এ কী থাকবে? লম্বা চুলের গোমড়ামুখো ক্ষীণকায় এক সাদামাটা লোক, যাঁর কণ্ঠ শুনলে মনে হয়, ভরা নদীর কলতান? মনে হয় সর্বহারা এক মাঝির আর্তনাদ! নাকি মিছিলে স্লোগান দেওয়া তাগড়া যুবক? সঙ্গীহীন খ্যাপাটে প্রেমিক? মা-হারা, বাবা-হারা ক্লান্ত সন্তান!
চাল চালে...
ঘর পালিয়ে চট্টগ্রামের আজিজ বোর্ডিং। কী এক অজানা ‘ফিলিংস’-এ সেখান থেকে ঢাকা মহানগর হয়ে বলিউড। সাদা পাঞ্জাবি, ব্লু জিনস, ভ্রু পিয়ার্সিং, নব্বইয়ের সাইকেডেলিক রকস্টার, আজকের আধপাকা দাড়ির কিংবদন্তি তথা ফারুক মাহফুজ আনাম জেমস। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সোনার বাংলা বা জীবনানন্দ দাশের রূপসী বাংলা ছেড়ে জেমস কোথাও যাননি, যেতে চাননি। ঘুরেফিরে এই বাংলাকেই তুলে ধরেছেন গানে। বিদেশের মঞ্চে দাঁড়ালেও দর্শকসারি হয়ে ওঠে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া। কনসার্ট ছাড়া জনসংযোগ নেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁর সক্রিয়তা নেই সেভাবে। জেমস তবু জননন্দিত আপন মহিমায়। এ এক বিস্ময়। এমন নজির খুব কম দেখা যায়। এমন বোহেমিয়ানকেই আমরা গ্রহণ করেছি সাদরে, যার একেকটি সুরেলা হুংকার গভীরভাবে আক্রান্ত করে, ভাবিয়ে তোলে। প্রশান্তিময় অবগাহনের আরেক নাম—জেমসের গান। বাংলা গানে তুমুল প্রভাব বিস্তারকারীর শীর্ষে থাকা মানুষটি অগণিত তরুণকে স্বপ্ন দেখাচ্ছেন।
হৃদয়ের একলা প্রান্তরে
গানের পাশাপাশি জেমসের ব্যক্তিত্ব তাঁকে অনন্য করে তুলেছে। দিনের পর দিন তিনি লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকছেন। পারছেন। সামাজিকতা খুব একটা রক্ষা করা লাগে না, এমন শিল্পীজীবন বেছে নিয়েছেন, যে জীবন কখনো কখনো নিঃসঙ্গও মনে হতে পারে! কে জানে? এটাও এক ত্যাগের ব্যাপার। কজন পারে! সামাজিকতা, অনুষ্ঠানাদি, বিশেষ চেয়ার, পুরস্কার, স্বীকৃতির হাতছানিকে তিনি অবলীলায় দূরে ঠেলেছেন সেই কবে! একের পর এক জনপ্রিয় গান করে, আরও আরও প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে বলিউডকেও বলে দিয়েছেন, ‘আলবিদা’। কে পারে!
এবং কিছুটা ওপর থেকে...
গান যাঁর প্রধান ভাষ্য, তিনি সাধারণ মানুষের ভাষায় কেন কথা বলবেন! গিটার যাঁর অস্ত্র, তিনি কেন টক শো বা সেমিনারে জড়াবেন বাক্যযুদ্ধে! গণমানুষের ভালোবাসা ও মায়ার অদৃশ্য উত্তরীয় যিনি গলায় পরেছেন, তিনি কেন গ্রহণ করবেন সামান্য স্বর্ণখচিত ক্রেস্ট! মহাকাল জয়ের নেশায় বুঁদ কেউ শোনে কি সমকালের লাভ-ক্ষতির বয়ান!
মহামান্য জেমস এসবই দেখেন কিছুটা ওপর থেকে...।