আনিসুল হকের ধারাবাহিকের এই লেখায় উন্মোচিত হয়েছে বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের মুখ
ছোটবেলা থেকেই সেলিনা হোসেনের লেখা পড়ে আসছি। রংপুরে বসে আমরা অপেক্ষা করতাম ঈদসংখ্যাগুলোর জন্য। ‘বিচিত্রা’, ‘সন্ধানী’, ‘রোববার’। সেলিনা হোসেনের উপন্যাস থাকত। ‘চাঁদবেনে’ নামে খুব সুন্দর একটা উপন্যাস পড়লাম। চাঁদ সওদাগরের গল্পটা আধুনিক পটভূমিতে বলেছেন। অনেক পরে ‘মগ্ন চৈতন্যে শিস’ও পড়েছিলাম কোনো এক ঈদসংখ্যায়। ‘নীল ময়ূরের যৌবন’ পড়ে অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম। চর্যাপদের চরিত্রগুলোকে ধরে কল্পনার জাল বিস্তৃত করছেন। কতখানি কল্পনাশক্তি ও সৃজনশক্তি থাকলে এমন একটা প্লট নিয়ে এই রকম একটা উপন্যাস লেখা যায়!
ঢাকায় এলাম ১৯৮৪ সালে। সেলিনা আপার সঙ্গে কবে প্রথম পরিচয় হলো, তা মনে নেই। তবে তাঁকে মনে হয় আমার বড় বোন। চিরদিনই তিনি আমার আপা ছিলেন, আছেনও। সেলিনা আপা একনিষ্ঠ লেখক। সিরিয়াস। বাংলাদেশ, ভারত, সার্কে যত ধরনের সাহিত্য পুরস্কার আছে, তার সবই তিনি পেয়েছেন। ফিলিপস পুরস্কার, সার্ক পুরস্কার, একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কার—তাঁর অর্জিত পুরস্কারের তালিকা করতে গেলে এই লেখার পরিসরে আঁটবে না। কলকাতা থেকে পেয়েছিলেন একটা বিশেষ পুরস্কার, যার অর্থমূল্য ছিল ১৫ বা ২০ লাখ টাকা। এই টাকা তিনি মানুষের কল্যাণে দান করেছেন, তাঁর অকালপ্রয়াত মেয়ে ফারিয়া লারার নামে ফাউন্ডেশন করে গ্রামের মেয়েদের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মেয়েদের হোস্টেল, এ-জাতীয় কর্মসূচির জন্য। এ সম্পর্কে প্রথম আলোয় প্রকাশিত রাশেদা আখতার খানমের একটা লেখা থেকে উদ্ধৃতি দিই:
‘বরগুনার একটি প্রত্যন্ত অঞ্চল বামনার ডৌয়াতলা গ্রামে ফারিয়া লারা ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেছেন। মেয়ের স্মৃতি ধরে রেখেছেন। সেলিনা হোসেনের স্বামী আনোয়ার হোসেন খানের পৈতৃক জমিতে স্থাপিত হয়েছে এই প্রতিষ্ঠান। “দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে বঞ্চনা ও অবহেলার শিকার প্রান্তিক নারী-মেয়ে-শিশু ও সাধারণ মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন এবং বেকার সমস্যা নিরসনে সর্বাত্মক সহায়তা দান”—এই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি।
‘দুস্থ ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার জন্য স্কুল আর কলেজ করেছেন, মেয়েদের থাকার জন্য একটা হোস্টেলও আছে। খেলার মাঠ আছে।’
সেলিনা আপা এখন বাংলা একাডেমির সভাপতি, আগে তিনি শিশু একাডেমির সভাপতি ছিলেন। ইউনেসকোতে বাংলাদেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। ফোর্ড ফাউন্ডেশনের ফেলোশিপ পেয়েছিলেন ‘গায়ত্রীসন্ধ্যা’ উপন্যাসত্রয়ী লেখার জন্য। দেশে-বিদেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর উপন্যাস পাঠ্য, তিনি রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিলিট পেয়েছেন। কত ভাষায় যে তাঁর লেখা অনূদিত হয়েছে, কত দেশ থেকে তাঁর রচনা প্রকাশিত হয়েছে। শ্রেষ্ঠ কাহিনিকার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন দুবার।
আমি সাপ্তাহিক ‘খবরের কাগজ’-এ কাজ করতাম ১৯৯০ দশকের শুরুতে। ওই সময় একই প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন ফারিয়া লারা। খুবই হাসিখুশি প্রাণবন্ত মেয়ে ছিলেন লারা। লারার বোন লাজিনা মুনার সঙ্গেও দেখা হতো সাধারণত বিতর্কের অনুষ্ঠানে। আমি ‘ভোরের কাগজ’-এ অনেক দিন ‘বইমেলা প্রতিদিন’ ধরনের লেখা লিখেছি। তখন বাংলা একাডেমির পরিচালক সেলিনা হোসেনের সঙ্গে প্রায়ই দেখা হতো। তাঁর সাক্ষাৎকার নিতাম।
তাঁর বাড়িতে তিনি আমাদের নেমন্তন্ন করেছেন। ওডিশার লেখক সরোজিনী সাহু কিংবা আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক লেখক কর্মসূচির পরিচালক ক্রিস্টোফার মেরিল ঢাকা এলে আমিও তাঁদের বাড়িতে ডেকেছি, অবশ্যই সে আয়োজনে উপস্থিত হয়েছেন সেলিনা হোসেন। সেলিনা আপার সঙ্গে আমেরিকায় নিউইয়র্কে বা ওয়াশিংটন ডিসিতে বইমেলায় অংশ নিয়েছি, ঢাকার বাইরে শামসুজ্জামান খানের স্কুলে কিংবা হবিগঞ্জের লাইব্রেরিতে গেছি একই গাড়িতে। কলকাতায় গেছি টাইমস অব ইন্ডিয়ার বইমেলায়। টেলিভিশনে বহু টক শোতে একসঙ্গে অংশ নিয়েছি। বহু সাহিত্য অনুষ্ঠানে তাঁরই সঙ্গে অংশ নেওয়ার সুযোগ আমার হয়েছে।
সেলিনা হোসেন মানুষ হিসেবে স্নিগ্ধ ও দ্যুতিময়। সাহিত্যই তাঁর জীবন। আর তাঁর লেখালেখির পেছনে আছে দেশ, সমাজ ও মানুষের জন্য অঙ্গীকার।
সাহিত্যের জন্য যে ক্ষুধা দরকার হয়, এটা সেলিনা হোসেনের মধ্যে আছে। আমি একবার আমার একটা কলামের শিরোনাম দিয়েছিলাম ‘পোকামাকড়ের ঘরবসতি’। এটা সেলিনা হোসেনের একটা উপন্যাসের নাম। কিন্তু কলামে কোথাও তা উল্লেখ করিনি। সেলিনা আপা ফোন করলেন, আনিস, আপনি তো লিখলেন না যে এটা আমার বইয়ের নাম।
আমি বললাম, আপা, ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি’ বা ‘আবার আসিব ফিরে’ লেখার সময় কি বলে দিতে হয় এগুলো জীবনানন্দ দাশের লাইন। এগুলো আমাদের বাগধারার অংশ। সবাই জানে এর স্রষ্টা জীবনানন্দ দাশ। তেমনি আপনার ‘পোকামাকড়ের ঘরবসতি’ আপনার লেখা—এটা সবাই জানে, আবার এটা আমাদের বাগধারার অংশও হয়ে গেছে। সেলিনা আপা আমার কথায় তুষ্ট হয়েছিলেন কি না জানি না।
আমাকে তিনি কত ভালোবাসেন, একটা উদাহরণ দিই। বাংলা একাডেমি পুরস্কার ঘোষিত হয়েছে। আমি পাইনি। সকালবেলা সেলিনা হোসেন ফোন করলেন, ‘আনিস, পুরস্কার ঘোষিত হচ্ছে, আপনি পাননি।’ বলে তিনি কাঁদতে লাগলেন। আমি বলি, আপা, তাতে কী হয়েছে, পাইনি, পাব। আর আপনি আমার জন্য ভাবছেন—এটাই আমার জন্য বড় পুরস্কার। আমার আর পুরস্কার লাগবে না।
শিল্প-সাহিত্যে একটা কথা প্রচলিত আছে, ভালো লেখা জনপ্রিয় হয় না, জনপ্রিয় লেখা উৎকৃষ্ট হয় না। সেলিনা হোসেন সেই বিরল সৌভাগ্যবান লেখকদের একজন, যাঁর লেখা একই সঙ্গে উৎকৃষ্ট ও জনপ্রিয়।
সেলিনা আপার সামনে আপনি বলে দেখুন, অমুক লেখিকার লেখা ভালো বা অমুক লেখিকার এই লেখাটা কি পড়েছেন? অমনি তিনি প্রতিবাদ করে উঠবেন, লেখিকা না, বলুন লেখক। লেখক ও লেখিকা আলাদা করবেন না।
সেলিনা হোসেনের ছোট মেয়ে ফারিয়া লারা ছিলেন শিক্ষানবিশ পাইলট। প্রশিক্ষণ বিমান নিয়ে উড়তে গিয়ে ১৯৯৮ সালে মাত্র ২৮ বছর বয়সে মায়ের বুক খালি করে চলে যান ফারিয়া লারা। তখন বুকে পাথর বেঁধে সেলিনা হোসেন লেখেন ‘লারা’।
সেলিনা আপার বই খুবই বিক্রি হয়। আমি বইমেলায় দেখেছি, পাঠকেরা, তরুণ-তরুণীরা, বইমেলায় সেলিনা আপার পা ছুঁয়ে সালাম করছেন, বলছেন, তাঁর লেখা তাঁরা কত পছন্দ করেন!
সেলিনা আপার ডায়াবেটিস। ব্যাগে তিনি চকলেট রাখেন। মাঝেমধ্যে হাইপো হয়ে যায়। তখন তিনি চকলেট ব্যাগ থেকে বের করে মুখে দেন। বেশ কয়বার তাঁকে আমি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এ রকম কাতর হয়ে পড়তে দেখেছি।
কিন্তু তিনি অদম্য, অপ্রতিরোধ্য। লিখছেন, মানুষের সেবা করছেন, অনুষ্ঠানে হাজির হচ্ছেন, বক্তৃতা দিচ্ছেন। মোটেও ভেঙে পড়েননি, বরং আমাদের জন্য এক আদর্শ উদাহরণ হিসেবে সামনে আছেন, দেখিয়ে যাচ্ছেন, কীভাবে লেখালেখি নিয়ে লেগে থাকতে হয়, কীভাবে দেশ-সমাজ-মানুষের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ থাকতে হয়, কীভাবে আলো ছড়াতে হয়! মুক্তিযুদ্ধ, অসাম্প্রদায়িকতা, বঙ্গবন্ধু—বাংলাদেশের মৌলিক আদর্শগুলো তিনি হৃদয়ে-মননে, কর্মে-চিন্তায় ধারণ করেন।
সেলিনা আপার সামনে আপনি বলে দেখুন, অমুক লেখিকার লেখা ভালো বা অমুক লেখিকার এই লেখাটা কি পড়েছেন? অমনি তিনি প্রতিবাদ করে উঠবেন, লেখিকা না, বলুন লেখক। লেখক ও লেখিকা আলাদা করবেন না।
এই একটা ব্যাপার থেকেই বোঝা যায়, সেলিনা হোসেন কী এবং কেন।
সেলিনা আপা যখন বক্তৃতা করেন, আপনি শ্রোতা হিসেবে হিপনোটাইজড হয়ে থাকবেন। এত মিষ্টি, এত সুরেলা, এত ‘মিউজিক্যাল’ এবং এত চিন্তাঋদ্ধ বক্তৃতা খুব কমই শোনা যায়।
সেলিনা আপা, আপনি সুস্থ থাকুন, দীর্ঘজীবী হোন, লিখে যান, বলে যান, কাজ করে যান আর আমাদের পথ দেখিয়ে যান।