কারও কাছে তিনি মোস্তফা চাচা, কারও কাছে মোস্তফা মামা। তবে তাঁর মূল নাম গোলাম মোস্তফা। সম্প্রতি নীলক্ষেতে পুরোনো বইয়ের দোকানটি বিক্রি করে দিয়েছেন তিনি, যা প্রবলভাবে আলোচিত হয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে পুরোনো বইপ্রেমীদের অতিপরিচিত মুখ গোলাম মোস্তফার জীবনসংগ্রামের কাহিনি এবং সামনের দিনগুলোতে কী করবেন তিনি, তা নিয়েই এই লেখা।
মহামারির ভয়াল থাবাটা সবার প্রথমে বইয়ের বাজারেই পড়েছে। নীলক্ষেতের পুরোনো বইয়ের দোকানি গোলাম মোস্তফা, সবার পছন্দের মোস্তফা চাচা তাঁর দোকান বিক্রি করে দিয়েছেন। তাঁর কাছ থেকে খবরটি যখন পেলাম, প্রথমে নির্বাক হয়ে গিয়েছিলাম। পরে ফেসবুকে সবার সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছিলাম দুঃখের সংবাদটি।
এই করোনাকালে অনেকবারই নীলক্ষেতে গিয়েছি। তখন দেখেছি ভালো নেই এখানকার পুরোনো বইয়ের দোকানিরা। ভালো থাকবেনই বা কীভাবে? অতিমারির দিনে বই তো কেউ কেনে না। ফলে বইপ্রিয় মানুষদের অতিপরিচিত মোস্তফা চাচা (অনেকের কাছে তিনি মোস্তফা ভাই বা মোস্তফা মামা। কিন্তু আমার কাছে মোস্তফা চাচা) কয়েক দিন আগে যখন আমাকে বললেন, দোকানটা বিক্রি করে দিয়েছেন। সে সময় মনের চোখে একে একে ভাসতে থাকল অজস্র স্মৃতি। আমার কাছে এই মানুষটা হলেন বইয়ের জাদুকর।
তাঁর সঙ্গে প্রথম দেখার কথা খুব স্পষ্ট মনে আছে আমার। ২০১২ সাল। ক্লাস শেষ করে টিফিনের জমানো একগাদা ভাঙতি টাকা দিয়ে পকেট ফুলিয়ে বেইলি রোড থেকে সোজা চলে গেলাম নীলক্ষেত। তখন ছিল বৃষ্টির দিন। তাই বৃষ্টিতে ভিজে একাকার হয়ে গেছি। এক বন্ধু বলেছিল, নীলক্ষেতে ২০০ টাকায় কমপক্ষে চারখানা বই তো পাওয়াই যায়। তো এ-গলি ও-গলি ঘুরতে ঘুরতে এলাম ১৩ নম্বর গলির সামনে। এ এক স্যাঁতসেঁতে ঘুপচি গলি। সেই গলিতে বইয়ের এক বিরাট পাহাড় দেখে থামতেই হলো আমাকে। নানা রকম কায়দা করে আঠা লাগানোতে ব্যস্ত একজন মানুষ। এর মধ্যে দেখলাম, বিমল মিত্রের ‘সাহেব বিবি গোলাম’ বইটার তৃতীয় মুদ্রণ তাঁর হাতে। তবে তাঁর এই বইপাহাড় দেখে ততক্ষণে আমি খানিকটা অবাক! আমার এই অবাক চোখ দেখে বইটা আমার হাতে দিয়ে তিনি বললেন,‘পড়ে দেখবেন?’
সেই প্রথম মোস্তফা চাচার কাছ থেকে কেনা হলো কিছু বই। আগেই বলেছি, সেদিন ছিল বৃষ্টিবাদলের দিন। তাই বইয়ের বিশাল থলে টানার সময় তিনি কঠিন মুখে একটা পলিথিনের টুপি বানিয়ে সেটি আমার মাথায় পরিয়ে দিলেন, যেন বৃষ্টির পানি মাথায় না লাগে। মনে আছে, তখন তিনি আমার বাড়িতে কে কে আছেন, কেমন আছেন সবাই—এসব খোঁজও নিয়েছিলেন। বলতে দ্বিধা নেই, তাঁর এমন কাণ্ডে অবাকই হয়েছিলাম। মনে হয়েছিল, এমন মানুষও আছেন এখনো!
সেই তো মোস্তফা চাচার সঙ্গে সখ্যের শুরু এবং নিয়মিত তাঁর দোকানে যাতায়াত। এরপর ঠিক কত দিন টিফিন না খেয়ে টাকা জমিয়ে কিনেছিলাম বই, মনে নেই। হাতে একসঙ্গে ৩০০ টাকা জমার জন্য অপেক্ষা করতাম, আর জমলেই নীলক্ষেতের দিকে দিতাম এক ছুট। কোনো মাসে এর ব্যতিক্রম ঘটলে মনটা যেন কেমন করে উঠত।
মোস্তফা চাচা এক কথার মানুষ। অনেকে এ জন্য তাঁকে কাঠখোট্টাও বলে। ১৫ টাকা থেকে শুরু করে ৩০০ টাকা—এই হলো তাঁর বইয়ের দাম। বইয়ের নাম বলতেই চট করে খুঁজে বের করতেন। মই বেয়ে তরতর করে ওপরে উঠে যেতেন বইয়ের খোঁজে—চোখ বন্ধ করলেই ভাসে এসব দৃশ্য। আমাকে নীহাররঞ্জন গুপ্ত, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, সুচিত্রা ভট্টাচার্য, ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়, চাণক্য সেন, সুবোধ ঘোষ, আশাপূর্ণা দেবী চেনানো মানুষটাকে আর ১৩ নম্বর গলিতে পাব না, এটা মেনে নেব কীভাবে!
একদিন তেজি গলায় বলেছিলেন, ‘ছফা (আহমদ ছফা) কখনো পুরান হয় না।’ আরেকবার মায়া নিয়ে বললেন, ‘শরৎচন্দ্র মানে তো আর্ট।’ নতুন-পুরোনো, দেশি-বিদেশি—কোন বই নেই তাঁর ভান্ডারে! কখনো নিজের দোকানে খুঁজে না পেলে প্রাপ্তিস্থান বলে দিতেন। তাঁর দোকানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বই দেখার সময় কত মানুষের সঙ্গে পরিচয় হলো! দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসা মানুষ এমনকি কলকাতা থেকেও আসতেন বইপ্রেমীরা।
পটুয়াখালীতে জন্ম মোস্তফা চাচার। ছোটবেলা থেকেই বই পড়ার নেশা তাঁর। স্কুলের পাঠাগার থেকে বই পড়তে পড়তে একসময় শেষ করে ফেললেন গোটা পাঠাগারের বই। তখন ভাড়ায় বই এনে পড়া শুরু করলেন। ১৯৭৬ সালে এইচএসসি পাস করে বরিশাল বিএম কলেজে ভর্তি হলেন ডিগ্রিতে। এখানে বছরখানেক পড়লেও পারিবারিক কারণে পরীক্ষা আর দিতে পারেননি।
এরপর কঠিন জীবনসংগ্রামে নেমে পড়া। ঢাকায় এসে ফুটপাতে প্রথমে শুরু করলেন বইয়ের ব্যবসা। তারপর তিলে তিলে গড়ে উঠল ‘মোস্তফা বইঘর’। তাঁর পরিষ্কার কথা, ‘নোট-গাইড বেচি না আমি।’
একটা বই পড়া শেষ হলে মোস্তফা চাচা আমাকে আরেকটা বই দিতেন। তাঁর কাছে পুরোনো বই বেচতেও গেলাম কতবার। গত দশ বছরে নীলক্ষেতের অনেক পরিবর্তন দেখেছি। কত বইয়ের দোকানে সাহিত্যের বই উঠে গিয়ে ভর্তি পরীক্ষা, বিসিএস যুদ্ধ, ব্যাংক পরীক্ষার বইয়ের পসরা দেখেছি। তবে মোস্তফা চাচা এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। সাহিত্যের বইপত্র নিয়েই ছিল তাঁর কায়কারবার।
কিন্তু করোনাকালে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেল তাঁরও। তাই তো পাঁচ গুদাম বইসহ নিজের সব সংগ্রহ বিক্রি করে দোকান ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেন তিনি। কেন এভাবে এত দিনের বইয়ের ব্যবসা গুটিয়ে নিলেন এই মানুষটি? কারণ একটাই। মহামারির ফলে বইয়ের ব্যবসা আগামী অন্তত দুই বছর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না বলেই সবার আশঙ্কা। মোস্তফা চাচা দোকান বিক্রি করার পর নীলক্ষেতের অন্যান্য বই ব্যবসায়ীদের মধ্যেও দেখলাম কষ্ট আর আতঙ্কের ছায়া।
আসলে নীলক্ষেত ঘুরতে ঘুরতে আমি ঢাকা চিনেছি, মানুষ চিনেছি। এখন সেখানে গেলে মাঝেমধ্যেই শুনতে পাই, ‘আরে ফেসবুকের বই আপা আসছে!’ তবে আজ দুপুরে যখন নীলক্ষেতে গেলাম, দেখলাম, যে কয়েকজন বই বিক্রেতা আছেন, সবার মুখই মলিন। কেউ আর বললেন না ‘ফেসবুকের বই আপা আসছে।’ আমারও তেমন কোনো কথা বের হলো না মুখ ফুটে। মোস্তফা চাচার সঙ্গে দেখা হলো। কথা হলো না। পরে বাসায় এসে ফোনে খানিকটা অভিমানভরা কণ্ঠে তাঁকে বললাম, ‘চাচা, আর ফিরবেন না ?’
তিনি বললেন বলেন, ‘৩০ বছরের নেশা আমার, একদিনের যায়? করোনা যাক! আসব আবার।’
মানে মোস্তফা চাচা কি সত্যি আবার ফিরবেন নীলক্ষেতে, তাঁর প্রিয় বইপাড়ায়, নাকি আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বললেন এমন করে? জানি না। তবে আমি চাই, বই অন্তঃপ্রাণ এই মানুষটি নীলক্ষেতের বইয়ের রাজ্যে আবার ফিরে আসুন। তবে সেটি কীভাবে সম্ভব হবে, তা তো জানি না। শুধু এটুকু বলতে চাই, নিয়তই আমরা জীবন থেকে কত কিছু হারাই। হারানোর এই তালিকায় মোস্তফা বইঘরকে দেখতে চাই না।
অন্য আলোতে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: info@onnoalo.com