>‘মাসুদ রানা’ নিয়ে গোল বেঁধেছে কাজী আনোয়ার হোসেন ও শেষ আবদুল হাকিমের মধ্যে। এই সূত্রে আলোচনা-সমালোচনার তির যাচ্ছে দুজনের দিকেই। এই লেখায় তরুণ থ্রিলার লেখক নাবিল মুহতাসিম লিখেছেন ‘রানা’ পড়ার মধ্য দিয়ে তাঁরসহ আরও অনেকের লেখক হয়ে ওঠার কথা, ‘রানা’কে ঘিরে তাঁর আবেগ ও ভালোবাসার কথা।
বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের দুর্ধর্ষ, দুঃসাহসী গুপ্তচর মাসুদ রানা কম বিপদে পড়েনি। সত্যি বলতে কি, যেখানে বিপদ, সেখানেই ঝাঁপিয়ে পড়ে রানা বা বলতে গেলে, বিপদই খুঁজে নেয় রানাকে।
পুরোনো পাঠকদের নতুন করে বোঝাতে হবে না আমি কী বলতে চাইছি। গত শতকের ষাটের দশক থেকে দেশ-বিদেশে মিশন করে বেড়াচ্ছে রানা। সেই কবে কাপ্তাই বাঁধ হলো, সেই লেকের পানিতে ডুবে যাওয়ার যোগাড় হলো পাগল বিজ্ঞানী কবীর চৌধুরীর শয়তানি গবেষণাগার, তখন থেকে শুরু। পাকিস্তান আমলে ভারতের অসংখ্য কূট পরিকল্পনা নস্যাৎ করেছে রানা, উড়িয়ে দিয়েছে তাদের দুর্গম দুর্গ, ভারতের কবল থেকে উদ্ধার করেছে বন্দী গুরু মেজর জেনারেল (অব.) রাহাত খানকে, আবার মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধ করেছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে, মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে সেই রাহাত খানকেই আবার বাঁচিয়ে এনেছে পাকিস্তানের বন্দিশালা থেকে। আরও যে কত মহাশক্তিধর শত্রুর বিপক্ষে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে রানা! বার্মিজ ডন উ সেনের বিস্তৃত জাল ফুটো করেছে সে, মিলিয়নার বদমাশ সিডনি শেরিডানকে হারিয়েছে মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে উল্টো চাল চেলে, শয়তান উপাসক শিকদারের পৈচাশিকতার ইতি ঘটিয়েছে, ইসরায়েলের শ্রেষ্ঠ গুপ্তচর আলেক বোগানের সঙ্গে অবিশ্বাস্য বুদ্ধির লড়াই লড়েছে, স্নায়ুযুদ্ধের সময় সোভিয়েত রাশিয়া আর আমেরিকার ভেতরে নিশ্চিত পারমাণবিক যুদ্ধ ঠেকিয়েছে।
এ তো গেল বইয়ের পাতার বিপদ। বাস্তব জীবনেও অনেক ঝক্কি পোহাতে হয়েছে রানাকে। পাকিস্তান সরকার ‘স্বর্ণমৃগ’ বইটা নিষিদ্ধ করেছিল ‘অশ্লীলতা’র দায়ে (মনে রাখতে হবে মানদণ্ডটা ষাটের দশকের, আর মানদণ্ডের মালিকও পাকিস্তান রাষ্ট্র), লেখক কাজী আনোয়ার হোসেন এর প্রতিবাদ করলে গোটা সিরিজই বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। আবার ১৯৭১ সালের পরে অনেকে খেপে উঠল এই বলে যে ‘রানা’র বইগুলোতে ভারতবিরোধী কথাবার্তা আছে। কেউ কেউ ফোনে কাজীদাকে হুমকিও দেয় এ জন্য। আসলে তখন পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স বা পিসিআইয়ের এজেন্ট ছিল রানা, ভারতের বিরুদ্ধে মিশন তো করতেই হতো। এই ঝক্কি সামলাতে পরে অনেক বই সংশোধন করা হয়েছে, এমনকি দুটি বই নতুন করে লিখতেও হয়েছে পাকিস্তানকে শত্রু বানিয়ে। আবার একই সঙ্গে স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশের আর কোনো শত্রু দেশ রইল না, ভারত তো সদ্যোজাত বাংলাদেশের বন্ধু। রানা এসপিওনাজ মিশন চালাবে কার বিরুদ্ধে? যা হওয়ার তাই হলো, প্লটের সংকট। পরে অবশ্য রানা এ অবস্থা থেকে ভালোভাবেই উতরে যায় ‘রানা এজেন্সি’র বদৌলতে। গোয়েন্দা, অ্যাডভেঞ্চার, ট্রেজার হান্ট, এমনকি ওয়েস্টার্ন (‘কুউউ!’, ‘লাল পাহাড়’), হরর কাহিনিও (‘পিশাচ দ্বীপ’) ঢুকে পড়লো ‘রানা’র বইতে। আবার এত দিন সিরিজ চালাতে গিয়ে এক কাহিনি দুবার দুটি বই হিসেবে বের করার ভুলও আছে। ‘বন্দী গগল’-এর কাহিনিই পরে ‘ক্রিমিনাল’ নামে বেরিয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু এবারে এ কী সংকটে পড়ল রানা! আনকোরা নতুন এমন বিপদ ওর পঞ্চান্ন বছরের ক্যারিয়ারে কখনো আসেনি। এটাই কি ওর শেষ মোকাবিলা?
কিন্তু সেটা নিয়ে আলোচনা করার আগে পটভূমিটা জানা চাই। ‘মাসুদ রানা’ সিরিজ কীভাবে লেখা শুরু হয়, সেটা আগে অনেকবার অনেক জায়গায় বলেছেন এই চরিত্রের স্রষ্টা কাজী আনোয়ার হোসেন—বইয়ের পেছনের আলোচনা বিভাগে, ‘রহস্যপত্রিকা’র ‘চিঠিপত্র’তে, বিভিন্ন পত্রিকার সাক্ষাৎকারে। মূলত ছোটদের জন্য লেখা ‘কুয়াশা’ সিরিজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন তিনি। একদিন এই সিরিজের একটি বই পড়ে কাজীদার বন্ধু মাহবুব আমিন সমালোচনা করেন যে আধুনিক থ্রিলারের সঙ্গে তিনি বোধ হয় তাল মেলাতে পারছেন না। এরপর মাহবুব আমিন বন্ধুকে পড়তে দেন ইয়ান ফ্লেমিংয়ের ‘জেমস বন্ড’ সিরিজের ‘ডক্টর নো’ বইটা। একজন এসপিওনাজ এজেন্টকে নিয়ে লেখার আইডিয়াটা তখনই মাথায় আসে তাঁর। আবার সেই সময় কাজীদা মোটরবাইক নিয়ে সুদূর রাঙামাটিতে গিয়ে কাপ্তাই বাঁধ দেখে এসেছিলেন। ১৯৬৫ সালে তখন ওটা কেবল বানানো হয়েছে। কাপ্তাই লেক আর বাঁধ নিয়ে লেখা হলো মাসুদ রানার প্রথম বই ‘ধ্বংস-পাহাড়’। কাহিনি মৌলিক, লিখতে সময় লেগেছে নয় মাসের মতো। নায়কের নাম দেওয়া হলো কাজীদার কাছের বন্ধু গীতিকার মাসুদ করিম আর ছোটবেলার হিরো মেবারের রাজা রানা প্রতাপ সিংহের নাম মিলিয়ে।
পরের বই ‘ভারত নাট্যম’ও মৌলিক এবং দারুণ হিট। কিন্তু কাজীদা দেখলেন, এভাবে লম্বা সময় ধরে একটা বই লেখাটা অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক নয়। শুরু হলো অ্যাডাপ্টেশন। তৃতীয় বই ‘স্বর্ণমৃগ’ লেখা হলো ইয়ান ফ্লেমিংয়ের ‘বন্ড’ সিরিজের একাধিক বই মিলিয়ে। এরপর এভাবেই চলল বহু বছর, অ্যাডাপ্টেশনই হয়ে গেল ‘রানা’ সিরিজের ‘নিউ নর্মাল’। ফ্লেমিং ছাড়াও অ্যালিস্টার ম্যাকলিন, হেডলি চেজ, লুডলাম, ফরসাইথের মতো বিখ্যাত লেখকদের এক বা একাধিক বই থেকে কাহিনি বা অংশবিশেষ সংগ্রহ করে লেখা হতো ‘রানা’র একেকটা বই। প্রথম এগারোটা বইয়ের পরে কাজীদা ছাড়াও অন্য লেখকেরা লিখতে শুরু করলেন ‘রানা’র বই। কিন্তু লেখকের নামের জায়গায় ‘কাজী আনোয়ার হোসেন’ই লেখা থাকত।
সাহিত্যের জগতে এক লেখকের বই অন্য লেখকের নামে বের হওয়াটা অবশ্য নতুন নয়, একে বলে ‘গোস্ট রাইটিং’। যিনি লেখেন, তিনি ‘গোস্ট রাইটার’ বা ‘ভূত লেখক’।
বিভিন্ন গোস্ট রাইটার ‘রানা’র বই লিখেছেন। কিন্তু সবচেয়ে বেশি লিখেছেন শেখ আবদুল হাকিম। সেবা প্রকাশনীর আরেক জনপ্রিয় সাবেক লেখক। তাঁর ভাষ্যমতে ২৬০টি বই লিখেছেন তিনি, সঙ্গে পঞ্চাশটা ‘কুয়াশা’ সিরিজের বই। ইফতেখার আমিন নামে সেবার আরেক সাবেক লেখক এগিয়ে এসেছেন, যিনি দাবি করেছেন, তিনি ‘রানা’র চুয়ান্নটা বইয়ের গোস্ট রাইটার ছিলেন। তাঁরা লেখার বিনিময়ে পারিশ্রমিক পেতেন। তবে গ্রন্থস্বত্ব থাকত কাজী আনোয়ার হোসেনের নামে।
এ তো গেল পেছনের কথা। দুর্যোগের প্রথম আভাসটা সবার সামনে আসে সেবার সাবেক লেখক ইফতেখার আমিনের ফেসবুক পোস্ট থেকে। ১৩ আগস্ট ২০১৬-এর সেই পোস্টের নাম ‘কাজী আনোয়ার হোসেন, আমি এবং প্রথম ধাক্কা।’ বেশ লম্বা পোস্টের বিষয়বস্তু, তিনি কীভাবে সেবা প্রকাশনীর বইয়ের তথা ‘মাসুদ রানা’র ভক্ত হলেন, কীভাবে কাজী আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে পরিচিত হলেন এবং তাঁর ভাষায় ‘ধাক্কা’ খেলেন, সেই কাহিনি। নিয়মিত বিরতিতে তিন খণ্ডের এই পোস্টে আরও নানা রকম অভিযোগ এনেছেন, মূলত আর্থিক।
শেখ আবদুল হাকিমও গত বছর অর্থাৎ ২০১৯-এ সরব হয়ে ওঠেন ফেসবুকে। ‘সেবা প্রকাশনীর স্বরূপ’ নামের একটা পোস্টে তিনিও অনেক অভিযোগ করে বসেন এ প্রকাশনীর বিরুদ্ধে। তাঁর মূল বক্তব্য, ‘রানা’র বইগুলোর কপিরাইট তিনি লিখিতভাবে কাজীদাকে দেননি; তাই সেগুলোর মুদ্রণ ও পুনর্মুদ্রণের রয়্যালটি বাবদ বিপুল পরিমাণ অর্থ তাঁর পাওনা। তাঁর ভাষ্যমতে, এ ব্যাপারে তিনি মৌখিকভাবে অর্থ পাওয়ার আশ্বাস পেয়েছিলেন কাজীদার কাছ থেকে এবং কিছু সময় ত্রৈমাসিকভাবে টাকা পেয়েওছেন। পরে ‘বনিবনা না হওয়ায়’ সেবা ছেড়ে চলে এলে সেই ত্রৈমাসিক টাকা বন্ধ হয়ে যায়। আইনি লড়াইতে তিনি কীভাবে জড়ালেন, সেটাও এই পোস্ট থেকেই জানা যাচ্ছে। ২০১০ সালে তিনি ও ইফতেখার আমিন যে বইগুলোর গোস্ট রাইটিং করেছেন, সেগুলোর কপিরাইট দাবি করে বাংলাদেশ কপিরাইট অফিসে আবেদন করেন।
আইন-আদালতের নানা দীর্ঘসূত্রতা পেরিয়ে ১৪ জুন জানা যায় যে আদালত শেখ আবদুল হাকিমের পক্ষে রায় দিয়েছেন। সেই ২৬০টি মাসুদ রানার স্বত্ব এখন তিনি ভোগ করবেন। এ ঘটনা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সঙ্গে সঙ্গেই হুলুস্থুল পড়ে যায়।
বিষয়টি আদালতে গড়িয়েছে যখন, তখন আইনের মাধ্যমেই সমাধা হবে। আপিল, হাইকোর্ট—অনেক কিছুই বাকি আছে বোধ হয়, আমার স্বল্প জ্ঞান যা বলে।
অনেকেই পপকর্ন নিয়ে বসেছেন ফেসবুকের সামনে, শুনছেন এ-পক্ষ ও-পক্ষের কথা। কেউ কেউ হয়তো মজাও পাচ্ছেন। পান। কিন্তু পুরোনো রানাভক্ত হিসেবে আমি বিপর্যয় ছাড়া আর কিছু দেখছি না।
পড়তে শেখার পর থেকেই সেবা প্রকাশনীর প্রজাপতি-মার্কা বইগুলোর সঙ্গে পরিচয়। বাসার ‘রহস্যপত্রিকা’ থেকে শুরু। এরপর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময় ‘তিন গোয়েন্দা’র জগতে পা। ক্লাস সেভেন-এইটের মধ্যেই ‘রানা’র জগতে প্রবেশ এবং এখনো পর্যন্ত বেরোতে না পারা। রংপুরে আমার বাড়ি থেকে জিলা স্কুলে যাওয়ার পথে শহীদ জররেজ মার্কেট। প্রতিদিন—হ্যাঁ, প্রতিদিনই রিকশা থামিয়ে নামতাম সেখানে, পুরোনো বইয়ের স্তূপ ঘেঁটে বের করতাম কোন ‘রানা’টা পড়া হয়নি। পড়া শুরু হয়ে যেত রিকশাতেই, নিদেনপক্ষে বাড়ি ফিরে ভাতের প্লেট সামনে নিয়ে বসে। এক দিনেই পড়া শেষ—যদি–না শেষের দিকের পেজ ছেঁড়া থাকে। পরের দিনে আবার দোকানে হামলা। বিপদে পড়তাম যদি কাহিনির এক খণ্ড পড়ে পরের খণ্ড না পেতাম—কাহিনি কীভাবে শেষ হলো, খচখচ করত মনের ভেতর।
অজস্র রানা পড়েছি। কয়েকটি মহাকাব্যিক; যেমন ‘আই লাভ ইউ ম্যান’ বা ‘মুক্ত বিহঙ্গ’ বা ‘বিদায়, রানা’। কোনো বই পড়তে পড়তে আমি উত্তেজনায় সোজা হয়ে বসেছি, গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেছে। কখনো হা-হা করে হেসেছি, কখনো চোখের কোণ ভিজে উঠেছে। তীব্র আবেগের রোলার কোস্টার রাইড।
আমি কীভাবে রানা পড়েছি, সেটা অপ্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে, কিন্তু আসলে এটা আমার একার গল্প নয়। ষাটের দশক থেকেই এভাবে নানা প্রজন্মের অসংখ্য পাঠক রানা পড়েছেন। তাদের কেউ কেউ লিখতেও শিখেছেন সেবার বই পড়তে পড়তে। যেমন আমি। ২০০৭-এ ‘রহস্যপত্রিকা’য় গল্প ছাপিয়ে আমার লেখকজীবনের শুরু। এরপর যখন সিরিয়াসলি লিখতে শুরু করলাম, তখন আমার দ্বিতীয় উপন্যাসই যে একটা স্পাই থ্রিলার হলো (‘বাজিকর’ ট্রিলোজির প্রথম বই ‘বাজিকর’) এটা কি কাকতালীয়? মোটেই না। এ এক রানাভক্তের ট্রিবিউট ছাড়া আর কিছুই নয়।
সমালোচনার তির ছুটছে দিগ্বিদিক। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেবা বা ‘রানা’র বই না-পড়া, রিয়্যালিটি শো থেকে ‘মাসুদ রানা’র নাম প্রথম শোনা মবের ছোড়া সেই তিরে বিদ্ধ হচ্ছেন কাজী আনোয়ার হোসেনও, আবার শেখ আবদুল হাকিমও। জানি না, এই সমালোচনাগুলো কতটুকু যুক্তিযুক্ত। শুধু জানি, বাংলা থ্রিলারের জগতে কাজীদার ভূমিকা কতটুকু। বাংলায় থ্রিলার লেখার মতো ভাষা ছিল না, সে ভাষা আবিষ্কার করেছেন এই মানুষটি। মানুষকে বিদেশি থ্রিলারের সঙ্গে, বিদেশি ক্লাসিকের সঙ্গে পরিচয় করিয়েছেন এই মানুষটি। দাদা-বাবা-ছেলে—তিন পুরুষকে বই পড়ার অভ্যাস তৈরি করে দিয়েছেন এই মানুষটি। জন্ম দিয়েছেন ‘রহস্যপত্রিকা’র। আশি আর নব্বইয়ের দশকে ‘রহস্যপত্রিকা’র যে মান ছিল, তেমন মানের পত্রিকা বাংলাদেশে সম্ভবত খুব কমই বেরিয়েছে।
কাজী আনোয়ার হোসেনের বেশির ভাগ লেখা তো অ্যাডাপ্টেশেন—বলতে শুনেছি। ঠিকমতো করা অ্যাডাপ্টেশনও যে একটা আর্ট—জানেন তো? কাজীদার চারটি গল্প সংকলন আছে—‘ছায়া অরণ্য’, ‘ছয় রোমাঞ্চ’, ‘পঞ্চ রোমাঞ্চ’ আর ‘তিনটি উপন্যাসিকা’। বিদেশি লেখকদের গল্প ভেঙেচুরে নিজের মতো করে নিয়ে, দেশীয় পটভূমিতে বসিয়ে, অসাধারণ ‘কাজীদার ভাষা’য় সাজিয়ে এমন করে তুলেছেন যে গল্পের আবেদন বেড়ে গেছে অনেক গুণ। তা ছাড়া তিনি নিজে না বললে বোঝাই কঠিন হতো যে গল্পগুলো মৌলিক নয়।
শেখ আবদুল হাকিমের অবদান খাটো করার সুযোগ কোথায়? সেবার ট্রেডমার্ক ভাষাটা আরও উন্নত করতে, সবার চেনা করে তুলতে তাঁর অসাধারণ ভূমিকা আছে। দারুণ কিছু থ্রিলার অ্যাডাপ্ট করেছেন, আর অনেকেই তো জানেন, ‘অগ্নিপুরুষ’, ‘আই লাভ ইউ ম্যান’, ‘সেই উ সেন’, ‘সংকেত’-এর মতো সেরা লেখাগুলো তাঁরই লেখা। ‘রহস্যপত্রিকা’ যে অসাধারণ উৎকর্ষ লাভ করেছিল, তার সিংহভাগ অবদানই তখনকার সহসম্পাদক শেখ আবদুল হাকিমের। চিঠিপত্র বিভাগে সারা দেশের পাঠক যাঁকে পরম ভালোবাসায় ডাকতেন, শেআহা!
বিরোধের নিষ্পত্তি হোক সুষ্ঠুভাবে, আইনের মাধ্যমে। আমরা সবাই সেটা চাই। কিন্তু এই আলোচনা-সমালোচনা, ‘রানা’ আর তার স্রষ্টাকে ঘিরে এই নেতিবাচক আবহাওয়াটা যে আমাদের মতো পুরোনো রানাভক্তের দম আটকে দিচ্ছে। কাজীদাকে কেন অপমান করা হবে? আমরা সবাই জানি, কাজীদা কখনো তাঁর কাজের স্বীকৃতি পাননি। বাংলাদেশে যেখানে বই পড়া একটা বিলাসিতা, মূর্খতাই বড় গৌরব, সেখানে কাজীদা আমাদের বই পড়তে শিখিয়েছেন। রাষ্ট্রীয় পুরস্কার একটাও কি দেওয়া যায় না তাঁকে? আচ্ছা নাহয় না-ই দিলেন। প্রবীণ মানুষটাকে অপমান করাটা বন্ধ করুন অন্তত এখন, প্লিজ।
পঞ্চান্ন নটআউট ‘মাসুদ রানা’। কত ঝড়ঝাপটা সামলে এখনো বুকস্টলে আসে নতুন ‘রানা’র বই। আদালতের মামলা আদালতেই শেষ হোক, কিন্তু ‘রানা’র যেন কোনো ক্ষতি না হয়। আমার বাবা ‘রানা’ পড়েছেন, আমি দেখতে চাই আমার ছেলে নতুন ‘রানা’ পড়ছে।
‘রানা’ বিপদে পড়েছে। সম্ভবত ওর লম্বা ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় বিপদ। এ-ই কি ওর শেষ মোকাবিলা? ‘রানা’র পাঁড় ভক্তরা অবশ্য আশা হারাবেন না। শেরিডানকে শেষ করার পরে সেই অন্ধকার সাগরের তীরে হুমায়ূন দাদাকে কীভাবে হারিয়েছিল রানা? সব তাসই তো ওর বিরুদ্ধে ছিল। ‘অগ্নিপুরুষ’-এর শেষে আমরা তো মরতেই দেখি রানাকে। তবু তো ও ফিরেছিল ফিনিক্স পাখির মতো।
শেষ মোকাবিলা? কখনোই নয়। বিপজ্জনক হতে পারে, হৃৎকম্পন হতে পারে, কিন্তু শেষ হাসি রানাই হাসবে।
অন্য আলো অনলাইনে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: info@onnoalo.com