ঢাকার ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনে ছিল একটি বইয়ের দোকান। আর এই দোকানের সূত্রে সামনে এল অনালোচিত এক অধ্যায়
১৮৭৭ সালের এক সকাল। বইয়ে ঠাসা আলমারিটা নিয়ে এমিল মোরো যখন এলাহাবাদ স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়ালেন, তখন ঘড়িতে সকাল ৯টা। জব্বলপুর থেকে ট্রেন এসে পৌঁছাতে কম করে হলেও দুই ঘণ্টা সময় বাকি। এলাহাবাদ স্টেশনটা জমকালো। জংশন হওয়ার কারণে উত্তর ভারতের আর সব রেলস্টেশনের চেয়ে এর পরিসর বড়। ট্রেন আসুক বা না আসুক, ব্যস্ততা যেন এ স্টেশনের পিছু ছাড়ে না। রেলের এই ব্যস্ততা মোরোর বেশ লাগে।
তবে তখনো তিনি জানেন না যে এই ভালো লাগা তাঁকে বদলে দেবে অভিনব এক উদ্যোক্তায়, নিয়ে যাবে বহুদূর, যেখানে ভারতীয় রেলের সঙ্গে তাঁর নামটি চিরকালের জন্য জড়িয়ে যাবে। মোরোর উদ্যোগে সে বছরই রেলওয়ের প্ল্যাটফর্মে গড়ে ওঠে এ এইচ হুইলার অ্যান্ড কোম্পানি নামের বইয়ের দোকান। বইয়ের এই ব্যবসা এলাহাবাদে শুরু হয়ে ছড়িয়ে পড়ে গোটা ভারতবর্ষে। ঢাকার ফুলবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশনের নাতিদীর্ঘ প্ল্যাটফর্মেও একসময় চালু হয় হুইলারের এই বইয়ের দোকান।
গোটা ভারতের রেলওয়ে নেটওয়ার্কজুড়ে হুইলারের দোকান আজও টিকে আছে। ঢাকার হুইলারের পাট চুকে গেলেও তাঁকে ঘিরে রয়েছে নানা স্মৃতি আর গল্প।
ফরাসি দেশের এমিল মোরো ১৮৭৩ সালে যখন ভারতে পা রাখেন, সে সময় তাঁর বয়স মাত্র ১৭ বছর। এসেই যোগ দেন মামা স্যাম বার্ড ও পল বার্ডের ম্যানেজিং এজেন্সি বার্ড অ্যান্ড কোম্পানিতে। ভারতবর্ষজুড়ে তখন চলছে রেলওয়ের সম্প্রসারণের কাজ। এ কাজের জন্য দরকার প্রচুর নির্মাণশ্রমিক। পাশাপাশি ট্রেনে চেপে দেশের নানা প্রান্তে পণ্য পৌঁছানো, সেসব পণ্যের খালাসের জন্যও প্রয়োজন অনেক শ্রমিক ও কুলি।
নির্মাণকাজ তদারকি আর শ্রমিক সরবরাহের জন্য তাই গোটা ভারতে তখন কাজ করছে কার, ট্যাগোর অ্যান্ড কোম্পানি, ম্যাকিনন ম্যাকেঞ্জি অ্যান্ড কোম্পানি, বার্ন অ্যান্ড কোম্পানি, বার্ড অ্যান্ড কোম্পানি—এমন ৬০টির বেশি ম্যানেজিং এজেন্সি। কলকাতায় বার্মা (বর্তমানে মিয়ানমার) থেকে জাহাজে চেপে আসা চাল নামানোর তদারকি দিয়ে মোরো শুরু করেন তাঁর কর্মজীবন।
ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়েতে প্রয়োজনীয় শ্রমিক সরবরাহের দায়িত্বে ছিল বার্ড অ্যান্ড কোম্পানি। পরের দুই বছর মোরোকে এদিকটা দেখাশোনা করতে হয়। ১৮৭৫ সালে কাজটি হাতছাড়া হলে হোঁচট খায় বার্ড অ্যান্ড কোম্পানির রমরমা ব্যবসা। এ নিয়ে পল বার্ডের সঙ্গে মনোমালিন্য হয় মোরোর। ঝামেলা এড়াতে কলকাতা ছেড়ে এলাহাবাদ চলে আসেন তিনি।
এলাহাবাদে ইউরোপীয়দের সমাগম কলকাতার মতো নয়। বেশির ভাগ সময় তারা আসা-যাওয়ার ওপরেই থাকে। ছোট্ট এ শহরে কয়েকজন সমমনা বন্ধু পেলেন মোরো। তাঁদের একজন আর্থার হেনরি হুইলার। হুইলারের সঙ্গে মোরোর পরিচয় হয়েছিল বিলেতে থাকতে। বই–অন্তঃপ্রাণ এক মানুষ। তাঁর বইয়ের সংগ্রহ ঈর্ষণীয়। কিন্তু এলাহাবাদে হুইলারের অবস্থান দীর্ঘস্থায়ী হলো না, হঠাৎই বিলেতে ফিরে গেলেন। যাওয়ার সময় তাঁর বিশাল বইয়ের সংগ্রহ দিয়ে গেলেন বন্ধু মোরোকে। এদিকে মোরোর ঘরেও এত বইয়ের সংকুলান হয় না। অগত্যা হুইলারের বইয়ের সংগ্রহ বিক্রির সুযোগ খুঁজতে লাগলেন মোরো।
ভারতে অভিনব হলেও ১৮৫০ সালের পর থেকে ইউরোপের রেলস্টেশনে বই–পুস্তকের দোকান ছিল একটি স্বাভাবিক অনুষঙ্গ। ভারতের নতুন গড়ে ওঠা রেলওয়ে–ব্যবস্থায় স্টেশনগুলোতে সে রকম কোনো দোকান ছিল না। বিষয়টি নিয়ে স্টেশনমাস্টারের কাছে হতাশ ইউরোপীয় যাত্রীদের অনুযোগ ছিল নিত্যঘটনা। হুইলারের বইগুলোর সদ্গতির জন্য মোরো তাই স্টেশনের প্ল্যাটফর্মকে বেছে নিলেন। দুজন কুলিকে সঙ্গে নিয়ে বইয়ের আলমারিটা বসালেন প্রথম শ্রেণির বিশ্রামাগারের সামনে।
তাঁর অনুমানই সত্যি হলো, মাত্র তিন দিনে হুইলারের সংগৃহীত বইয়ের সব কপি বিক্রি হয়ে গেল। ট্রেনযাত্রীদের মধ্যে বইয়ের এমন চাহিদা নতুন করে ভাবতে শেখাল মোরোকে। পরে হুইলারের সঙ্গে পরামর্শ করে ১৮৭৭ সালে তিনি চালু করলেন বইয়ের ব্যবসা, বন্ধুর সম্মানে যার নাম হলো এ এইচ হুইলার অ্যান্ড কোম্পানি। রেলওয়ের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী, ভারতবর্ষের প্রধান সব স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ছড়িয়ে পড়ল এর দোকান। পুরোনো ইংরেজি হরফে লেখা নামফলকসমেত দোকানগুলোর গঠন প্রায় একই রকম—সব কটিই কাঠের তৈরি।
নতুন এ ব্যবসায় অংশীদার হিসেবে বন্ধু হুইলারের পাশাপাশি মোরো পেলেন এ এল হুইলার, ডব্লিউ এম রজ ও আর্মেনীয় ব্যবসায়ী টি আর ডেভিডকে। আর উনিশ শতকের শেষে এই ব্যবসায় যুক্ত হলেন মোরোর বাঙালি বন্ধু তিনকড়ি কুমার ব্যানার্জি। অবশ্য লন্ডন গ্যাজেট–এ প্রকাশিত তথ্যমতে, ১৯১৬ সালের শেষ নাগাদ ভারতের হুইলার কোম্পানির সঙ্গে লন্ডনের টেম্পল অ্যাভিনিউয়ে অবস্থিত একই নামের অন্য কোম্পানির সব ব্যবসায়িক সম্পর্কের সমাপ্তি ঘটে।
ভারতবর্ষের সুবিস্তৃত রেলওয়ে নেটওয়ার্কের কল্যাণে হুইলার অ্যান্ড কোম্পানির ব্যবসার প্রসার থেমে থাকেনি। ১৯৩৭ সালে মোরোর মৃত্যুর পর ব্যবসার হাল ধরেন তিনকড়ি কুমার ব্যানার্জি। বিশ শতকের শেষভাগে পুরো ভারতে হুইলারের স্টলের সংখ্যা তিন শর কাছাকাছি পৌঁছে যায়।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে হুইলার অ্যান্ড কোম্পানিতে কেবল ইংরেজি ভাষার বইপত্র বিক্রির চল ছিল। এই বইয়ের সিংহভাগই আসত বিলেত থেকে। এক হিসাবে দেখা গেছে, ১৮৯৪-৯৫ সালে আমদানি করা বই–পুস্তক আর পত্রিকার সংখ্যা ৫ মিলিয়ন ছাড়িয়ে যায়। ইংরেজি বইয়ের ব্যাপক চাহিদা মাথায় রেখে পাঠকপ্রিয় লেখকদের বই ছাপানোর উদ্যোগ নিলেন মোরো।
চালু করলেন সুলভ মূল্যের ‘ইন্ডিয়ান রেলওয়ে লাইব্রেরি সিরিজ’। সে সময়ের জনপ্রিয় তরুণ লেখক রুডইয়ার্ড কিপলিংকে তিনি এই সিরিজের আওতায় বই প্রকাশের আমন্ত্রণ জানালেন। আর দুই শ পাউন্ড অগ্রিম নিয়ে কিপলিং লিখে চললেন একের পর এক বই। মাত্র ১ রুপি দামের ধূসর প্রচ্ছদের পেপারব্যাক বইগুলো বিক্রিও হলো দেদার, পাঠকপ্রিয়তার তুঙ্গে পৌঁছালেন কিপলিং।
ট্রেনযাত্রীদের ভ্রমণের অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে উঠল সেসব বই। কিপলিংয়ের কলমে ইউরোপীয়রা ভারতবর্ষকে চিনল নতুনভাবে। উনিশ শতকের শেষ দশকে তিনকড়ি কুমার ব্যানার্জি এখানে যোগ দেওয়ার পর বিক্রির তালিকায় যুক্ত হলো আঞ্চলিক ভাষার বইপত্র। ফলে দেশি পাঠকদের কাছেও জনপ্রিয় হয়ে উঠল হুইলারের দোকান। শুধু বইয়ের ব্যবসা নয়, রেলস্টেশনে যেকোনো বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্যও হুইলার কোম্পানি ছিল সরকারের অধিভুক্ত একমাত্র এজেন্ট।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ইংরেজদের যুদ্ধের নানা খবরসহ যুদ্ধের প্রোপাগান্ডা প্রচারের জন্য হুইলারের খ্যাতি আর বিপণনব্যবস্থাকে কাজে লাগাল ইংরেজ সরকার। সরকারের এ প্রোপাগান্ডায় অংশ নিলেন রুডইয়ার্ড কিপলিং থেকে শুরু করে আর্থার কোনান ডয়েল, জি কে চেস্টারটনের মতো নামকরা লেখকেরা। এ সময় সরকারি প্রচারপত্র স্থানীয় ভাষায় অনুবাদ করে ভারতবাসীর মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হলো। দক্ষিণ ভারত বাদে গোটা ভারতবর্ষের প্রত্যন্ত প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ল হুইলারের দোকান। বঙ্গভঙ্গ রদে অবহেলিত এই জনপদের প্রধান রেলস্টেশন তখন ঢাকার ফুলবাড়িয়া। সেই স্টেশনেও একসময় বসল হুইলারের বইয়ের ছোট্ট দোকান।
১৮৮৫ সালে ঢাকা-ময়মনসিংহ স্টেট রেললাইনের অংশ হিসেবে ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত সোয়া ১০ মাইল লাইনে প্রথম ট্রেন চলা শুরু হয়। এ সময় ফুলবাড়িয়া এলাকায় প্রায় ৫০ একর জমি অধিগ্রহণ করে তৈরি করা হয় স্টেশন, ওয়ার্কশপ, রেলওয়ে কর্মীদের আবাসন, হাসপাতালসহ নানা স্থাপনা।
পুরান ঢাকার শেষ সীমানায় স্থাপিত এই স্টেশনকে ঘিরে কর্মচঞ্চল হয়ে ওঠে ফুলবাড়িয়া এলাকা। ছোট্ট এই স্টেশন ছিল নিরাভরণ, জৌলুশহীন। লোকে একে ফুলবাড়িয়া নামে চিনলেও কাগজপত্রে নাম ছিল ঢাকা স্টেশন। পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত প্ল্যাটফর্মের দুই প্রান্তে বসানো নামফলকেও খোদাই ছিল ‘ঢাকা’ নামটি। ছাউনিবিহীন প্ল্যাটফর্মটি খুব দীর্ঘ ছিল না, বড়জোর চার শ ফুট।
ট্রেন এসে দাঁড়ালে বেশ কটি কামরা প্ল্যাটফর্মের বাইরে থাকত। স্টেশনের মূল ভবন ঘিরে ছিল কয়েকটি টিনশেড ভবন। লাল ইটের মূল ভবনে ছিল স্টেশনমাস্টারের কক্ষ, বিশ্রামাগার আর ঠিক মাঝখানটায় টিকিট কাউন্টার। স্টেশনের বাইরে পশ্চিম দিকে বাঁশপট্টি, সেখানে বাঁশবেতের আসবাবের অনেকগুলো দোকান। পূর্ব দিকের এলাকার নাম বটতলা, সেখানে রাস্তাজুড়ে কোচোয়ানরা দাঁড়িয়ে থাকত টমটম নিয়ে। এ এলাকায় গড়ে উঠেছিল বেশ কিছু খাবারের দোকান ও হোটেল। স্টেশন রোডের দুই ধারে ছিল সাইকেলের যন্ত্রাংশ আর ঘোড়ার গাড়ি সারাইয়ের দোকান।
হুইলারের দোকানটি বসানো হয়েছিল স্টেশনে প্রবেশের মুখে, প্ল্যাটফর্মের পূর্ব পাশে। ভারতবর্ষের অন্যান্য হুইলারের মতো এখানেও ছিল বিলেতি সাময়িকী আর বইপত্রের সমারোহ। লন্ডন ইলাস্ট্রেটেড, পাঞ্চ, লন্ডন ওপিনিওন, হেলথ অ্যান্ড এফিহেয়েন্সি—এমন সব বিখ্যাত সাময়িকীর সঙ্গে সেখানে শোভা পেত কিপলিং ও ডয়েলের পেপারব্যাক বইগুলো।
হুইলারের নিজস্ব ছাপাখানায় ছাপানো হতো কিছু জনপ্রিয় বিলেতি বইয়ের সুলভ সংস্করণ। একটি বইয়ের নাম উল্লেখ করা জরুরি, দ্য রোমান্স অব এন ইস্টার্ন ক্যাপিটাল। ইংরেজ সিভিলিয়ান এফ বি ব্রাডলি-বার্টের লেখা এই বই ঢাকার ইতিহাসচর্চার এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯০৬ সালে, লন্ডনের স্মিথ, এল্ডার অ্যান্ড কোম্পানি থেকে। প্রথম প্রকাশের আট বছর পর হুইলারের উদ্যোগে ছাপানো হয় এর সুলভ সংস্করণ। বাঙালি পাঠকের জন্য হুইলারের সংগ্রহে ছিল সচিত্র ভারত, বসুমতী, প্রবাসী, ভারতবর্ষ, শিশুসাথী, শুকতারা, দেশ ইত্যাদি সাময়িকী।
এ ছাড়া ছিল চলচ্চিত্রবিষয়ক ম্যাগাজিনের এক সমৃদ্ধ সংগ্রহ—আর্ট পেপারে ছাপানো ফিল্ম ইন্ডিয়া, মাদ্রাজ থেকে প্রকাশিত দ্য সাউন্ড, কলকাতা থেকে বেরোনো রূপমঞ্চ, রূপাঞ্জলি, চিত্রালী—এমন আরও অনেক নাম। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শ্রীকান্ত ও শশধর দত্তের দস্যু মোহন সিরিজের বইগুলো ছিল সংখ্যার বিচারে বিক্রীত বইয়ের তালিকার শীর্ষে।
বিক্রীত কপিগুলো বহন করত হুইলারের ডিম্বাকৃতি সিলমোহর। এসব বই–পুস্তক কিংবা সাময়িকীর ক্রেতা যে শুধু ট্রেনযাত্রীরা ছিলেন, তা নয়, ঢাকার অনেক উৎসাহী পাঠক তাদের পছন্দের বই সংগ্রহের জন্যও ঢুঁ মারতেন হুইলারে। কয়লার ধোঁয়া আর গন্ধের মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্টলে দাঁড়িয়ে পাতা ওলটানোর কিংবা পুরো বই পড়ে নেওয়ার লোকের অভাব ছিল না। আদতে বইপ্রেমী পাঠকদের জন্য বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগের এক জানালা হয়ে উঠেছিল হুইলার।
ঢাকাপ্রেমীদের জন্য প্রথিতযশা সাংবাদিক ও সম্পাদক মীজানুর রহমানের অনন্য উপহার ঢাকা পুরাণ। এ শহরে যাপিত তারুণ্যের দিনগুলোর অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছেন হুইলারের কথা। হুইলারে মোহাবিষ্ট লেখক স্মৃতিচারণা করেছেন, ‘আমার কাছে ফুলবাড়িয়ার প্রধান আকর্ষণ ওর মায়াবী লোহার টুনানুং টুনানুং শব্দ নয়, কিংবা শিটির অলৌকিক আহ্বানও নয়, নতুন আনকোরা কালি ও বাঁধাইয়ের গন্ধমাখা বই আর পত্রপত্রিকার আড়ং ওই যে হুইলার বুকস্টল, ওইটে।’ মীজানুর রহমানের দেওয়া তথ্যমতে, ঢাকার বাইরে রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও আখাউড়া রেলজংশনে হুইলারের বইয়ের ব্যবসা চালু ছিল।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পরও বেশ কয়েক বছর ফুলবাড়িয়ায় টিকে ছিল হুইলারের ব্যবসা। শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী তখন সদ্য প্রতিষ্ঠিত আর্ট ইনস্টিটিউটের ছাত্র। ছবি আঁকার প্রয়োজনে সহপাঠীদের নিয়ে প্রায়ই ছুটে যেতেন ফুলবাড়িয়ায়। তারুণ্যের সেই দিনগুলোর কথা স্মরণ করে পরিণত বয়সে নস্টালজিক হয়েছেন তিনি, সেখানে এসেছে হুইলার প্রসঙ্গ।
১৯৭৮ সালে প্রকাশিত সচিত্র সন্ধানীর এক সংখ্যায় তাঁর স্মৃতিচারণা, ‘কোনো দিন ছুটির পরে ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনে বসে বসে দূরযাত্রীদের অপেক্ষমাণ উত্তেজনার ছবি এঁকেছি একের পর এক। খাতা ভরে তুলেছি চলমান জীবন নিয়ে। হুইলারের স্টলে বোম্বে, কলকাতা থেকে আসা ম্যাগাজিনগুলো আমাকে ভীষণভাবে টানত।’
দেশভাগের পর ভারত থেকে আসা পত্রিকার সরবরাহ অনিয়মিত হয়ে পড়ে। এ সময় স্থানীয় বেশ কিছু পত্রিকা যুক্ত হয় হুইলারের বিক্রির তালিকায়। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য এক পত্রিকা ছিল সিরাজুর রহমানের সম্পাদিত প্রকাশিত মাসিক সংকেত। শামসুর রাহমান ও হাসান হাফিজুর রহমানের কবিতা আর আলাউদ্দিন আল আজাদের ছোটগল্পসমৃদ্ধ সংকেত–এর প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৯৪৮ সালের আগস্টে।
সিরাজুর রহমানের স্মৃতিকথা প্রীতি নিন সকলে শিরোনামের বই থেকে জানা যায়, ‘হুইলার কোম্পানিকে যে সংখ্যক কপি দেওয়া হয়েছিল, তার কোনোটাই তারা অবিক্রীত দেখাননি। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সামনে বুকস্টল করেছিলেন কলেজেরই ছাত্র মিজানুর রহমান। তার কপিগুলো এক সপ্তাহের মধ্যেই বিক্রি হয়ে গিয়েছিল।’ ১৯৪৭ সালে হলো দেশভাগ। এর ফলে মূল হুইলারের সঙ্গে ফুলবাড়িয়ায় অবস্থিত হুইলারের সম্পর্ক ধীরে ধীরে শিথিল হয়ে আসছিল।
তবে হুইলার নামটির ব্যবহার তখনো অব্যাহত ছিল। সর্বশেষ ১৯৬৮ সালে কমলাপুরে স্টেশন চালুর পর বিলুপ্তি ঘটে হুইলারের ঢাকা অধ্যায়ের। নতুন তৈরি স্টেশনে ফিরে আসে ফুলবাড়িয়ার কুলির চিরচেনা ছোটাছুটি, গানের বই, টুথপাউডার, কিংবা ‘সর্বরোগের ঔষধ’ বিক্রেতার হাঁকডাকসহ ভিক্ষুকের কাতরকণ্ঠে গান। কেবল ফেরেনি হুইলারের রোমাঞ্চভরা সেই দিনগুলো। ভারতবর্ষের অন্যান্য জনপদে এই কোম্পানির ব্যবসা টিকে থাকলেও ঢাকাবাসীর হৃদয়ে হুইলারের নাম রয়ে যায় শুধু এক মধুর নস্টালজিয়া হয়ে।
দেশভাগের পর ভারত থেকে আসা পত্রিকার সরবরাহ অনিয়মিত হয়ে পড়ে। এ সময় স্থানীয় বেশ কিছু পত্রিকা যুক্ত হয় হুইলারের বিক্রির তালিকায়। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য এক পত্রিকা ছিল সিরাজুর রহমানের সম্পাদিত প্রকাশিত মাসিক সংকেত। শামসুর রাহমান ও হাসান হাফিজুর রহমানের কবিতা আর আলাউদ্দিন আল আজাদের ছোটগল্পসমৃদ্ধ সংকেত–এর প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৯৪৮ সালের আগস্টে।
সিরাজুর রহমানের স্মৃতিকথা প্রীতি নিন সকলে শিরোনামের বই থেকে জানা যায়, ‘হুইলার কোম্পানিকে যে সংখ্যক কপি দেওয়া হয়েছিল, তার কোনোটাই তারা অবিক্রীত দেখাননি। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সামনে বুকস্টল করেছিলেন কলেজেরই ছাত্র মিজানুর রহমান। তার কপিগুলো এক সপ্তাহের মধ্যেই বিক্রি হয়ে গিয়েছিল।’ ১৯৪৭ সালে হলো দেশভাগ। এর ফলে মূল হুইলারের সঙ্গে ফুলবাড়িয়ায় অবস্থিত হুইলারের সম্পর্ক ধীরে ধীরে শিথিল হয়ে আসছিল। তবে হুইলার নামটির ব্যবহার তখনো অব্যাহত ছিল।
সর্বশেষ ১৯৬৮ সালে কমলাপুরে স্টেশন চালুর পর বিলুপ্তি ঘটে হুইলারের ঢাকা অধ্যায়ের। নতুন তৈরি স্টেশনে ফিরে আসে ফুলবাড়িয়ার কুলির চিরচেনা ছোটাছুটি, গানের বই, টুথপাউডার, কিংবা ‘সর্বরোগের ঔষধ’ বিক্রেতার হাঁকডাকসহ ভিক্ষুকের কাতরকণ্ঠে গান। কেবল ফেরেনি হুইলারের রোমাঞ্চভরা সেই দিনগুলো। ভারতবর্ষের অন্যান্য জনপদে এই কোম্পানির ব্যবসা টিকে থাকলেও ঢাকাবাসীর হৃদয়ে হুইলারের নাম রয়ে যায় শুধু এক মধুর নস্টালজিয়া হয়ে।