আমাদের রাজশাহী ল্যাবরেটরি হাইস্কুলের কম্পাউন্ডটা ছিল বিশাল। কিং সাইজ একটা খেলার মাঠ, মাঝে সুরম্য তিনতলা এইচ প্যাটার্ন বিল্ডিংয়ের মধ্যে কেয়ারি করা গোলাপ আর ফুলের বাগান, জবার ঝাড়, স্যারদের কমনরুমের সামনে দোলনচাঁপা গাছের নরম সারি, রক্তকরবী আর শ্বেতকরবীর গাছ, যেটার ডাল আমাদের পেটানোর কাজে ব্যবহৃত হতো হামেশাই। পাঁচিলঘেরা কম্পাউন্ডের ভেতরেই বিল্ডিংয়ের পেছনে হোস্টেলের পাশে বিশাল আমবাগানঘেরা ছোট-বড় আরও পাঁচটা মাঠ, যেখানে টিফিনে, ক্লাস শুরুর আগে জমে যেত টিলো-এক্সপ্রেস আর বোম্ব বার্স্টিং খেলা।
এমন ছিল যে বড়রা যদি ফুটবল বা ক্রিকেটের জন্য বড় মাঠ বরাদ্দ নিত, তাহলেও আমাদের প্রতিটি ক্লাসের জন্য খেলার আলাদা আলাদা জায়গা বরাদ্দ পেতে অসুবিধা হতো না এতটুকুও। সত্যি বলতে কি, প্রায় তিন একর জায়গা নিয়ে এত বড় আর সুন্দর ক্যাম্পাসের স্কুল বাংলাদেশে আর একটিও নেই এটুকু বলতে আজ আর দ্বিধা নেই।
স্কুলের লাইব্রেরিটা ছিল দোতলায় অডিটরিয়ামের ঠিক ওপরে। দোতলায় কোনো ক্লাসরুম ছিল না। ছিল লাইব্রেরি, কমনরুম, ল্যাব, যেখানে একটা কঙ্কাল ঝোলানো ছিল, যেটা নাকি আত্মহত্যা করা এক নারীর, ছিল দুই হাজার বর্গফুটের একটা ঘেরা ছাদ, যেটায় শুধু আমাদের ক্লাসের ছেলেরা তাদের উদ্ভাবিত ফুটবলের স্টেডিয়াম বানিয়েছিল, যে ফুটবল খেলা হতো টেনিস বল, ডাবের মোচা, বাতাবি লেবু—এগুলো কিছু না পাওয়া গেলে ইটের বড় টুকরো, যেটা দিয়ে খেলতে গিয়ে নতুন বাটার কালো জুতার ডগার দফারফা হয়ে যেত কয়েক দিনেই। সপ্তাহে দুদিন লাইব্রেরি ক্লাস—সোম আর বুধবার। অধীর আগ্রহে আমরা অপেক্ষা করতাম সেই দিনগুলোর। ঘণ্টা পড়লে লাইন দিয়ে আমরা নেমে আসতাম দোতলায়। লাইব্রেরি রুমটা ছিল অদ্ভুত রকম ঠান্ডা। বইয়ের সোঁদা গন্ধে ভারি বাতাস রোমাঞ্চ জাগাত শরীরে। লাইব্রেরিয়ান স্যার ছিলেন সুদর্শন গোলগাল একজন মানুষ। আমরা সার দিয়ে বসতাম লাইব্রেরি রুমের স্যারের ডেস্কের বিপরীতে সাজানো চেয়ারে। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম কখন স্যার ক্যাপ্টেনকে বলবেন চাবি দিয়ে ৩ বা ৪ নম্বর আলমারি খুলতে। এই দুই আলমারিতে ছিল কিশোর উপযোগী অদ্ভুত সব বই। ৭০ আর ৮০-র দশকের ছাড়াও ছিল ইন্ডিয়ান দেব সাহিত্য কুটিরের গল্প সংকলন আর বাংলা একাডেমির ‘ধান শালিকের দেশে’ সংকলন। আমার আকর্ষণ ছিল ‘ধান শালিকের দেশে’র দিকে। আহা, কী সব চমৎকার সংকলন হতো তখন। উন্নতমানের আর্টপেপার পাতাগুলো বেশ মোটা আর মসৃণ। পাতায় পাতায় চোখ ধাঁধানো ছবি আর অলঙ্করণ। সেই সব বইতে অলংকরণ করতেন কাইয়ুম চৌধুরী, হাশেম খান, রফিকুন নবীর মতো প্রথিতযশা সব শিল্পী। লিখতেন শওকত ওসমান, শওকত আলী, শাহরিয়ার কবির, সৈয়দ শামসুল হক, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, বন্দে আলী মিয়া, আবুল খায়ের মুসলেহউদ্দিন, আলী ইমাম, হায়াৎ মামুদ, আরও অনেকে। মনোমুগ্ধকর সেসব গল্প উপন্যাস। একবার পড়লে সারা জীবন মনে ছাপ রেখে যাওয়ার মতো সব গল্প। মনে আছে শিশু একাডেমির আশির দশকের ‘শিশু পত্রিকা’র কথা। প্রতি সংখ্যার দাম ছিল দুটাকা করে, এ ছাড়া সেগুলোর ছিল ঈদসংখ্যা। দাম দশ টাকা মাত্র। তখন পকেটে টাকা থাকত না, জমানো টাকা নিয়ে দুপুরবেলা চলে যেতাম রাজশাহীর মনি বাজারে। জেলা পরিষদের নিচে পাবলিক লাইব্রেরির পাশে ছিল পুরোনো বইয়ের দোকানটা। একটা সংখ্যা কেনার পর তীব্র এক আনন্দ নিয়ে ফিরতাম বাড়িতে। পরে এসব বইয়ের অনেক খোঁজ করেছি। বগুড়ার উডবার্ন লাইব্রেরিতে গিয়ে জেনেছি এমন অনেক বই নষ্ট হয়ে যাওয়ায় গুদামে পাঠিয়ে দিয়েছে তারা।
ওপারের ইন্ডিয়ার পুরাতন সব ‘আনন্দমেলা’, ‘শুকতারা’, ‘সন্দেশ’সহ দেব সাহিত্য কুটিরের গল্প সংকলনগুলোকে ডিজিটালাইজ করে স্ক্যান করে সংরক্ষণ করেছে ধুলোখেলা নামের একটি অনলাইন গ্রুপ। হয়েছে ডিজিটাল আর্কাইভ, ন্যাশনাল ডিজিটাল আর্কাইভ। অথচ আমাদের এপারের অনেক রত্নভান্ডার ‘ধান শালিকের দেশ’সহ অন্যান্য শিশু-কিশোর পত্রিকা, বইগুলো ও রকম কোনো উদ্যোগের অভাবে হয়তো হারিয়ে যাবে চিরতরে। লেখা হয়তো পাওয়া যাবে অন্তরের। কিন্তু প্রখ্যাত আঁকিয়েদের ওইসব অনবদ্য আঁকা আর হয়তো কখনো দেখবে না বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা। আমাদের সময়ের গল্পের বই, রূপকথার বইগুলো ছিল দারুণ রকম আকর্ষণীয়, বেশির ভাগ নিউজপ্রিন্টে ছাপা। সেই বইগুলোর অদ্ভুত আকর্ষণের ধার হয়তো আজ বুঝবে না আনেকেই। ‘ঠাকুমার ঝুলি’ আর ‘ঠান দিদির থলে’ ছাড়াও ছিল
‘গল্পের মায়াপুরি’, ‘কাঞ্চনমালা’, ‘শঠে শঠাং’, ‘আজ বাকি কাল নগদ’ নামে বন্দে আলী মিয়াসহ আরও অনেক লেখকের গল্প সংকলন। ছিল রাহাত খানের ‘দিলুর গল্প’, মোহাম্মদ নাসির আলীর ‘লেবু মামার সপ্তকাণ্ড’, হাতেম তাই, সিন্দাবাদের গল্প। মনে আছে পঞ্চম শ্রেণির পরীক্ষার পর হাতে পেয়েছিলাম ‘আরব্য রজনী’। পদ্মার পাশেই ছিল আমাদের বাড়ি। গ্রীষ্মের এক সন্ধ্যা, বাইরে খোলা দরজা দিয়ে ভেসে আসা শীতল বাতাস ফ্যানের বাতাসের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার। ঘরের আলো নেভানো, সবাই কোথায় যেন গিয়েছিল সেদিন। নির্জন একা বাড়িতে বারান্দায় জ্বলা আলো এসে পড়েছিল বিছানার কিনারে, সেই আলোতে প্রথম পড়েছিলাম সে বই, আহা কী অনুভূতি, তা বলে বোঝানোর নয়।
মনে আছে রাশিয়ান বইগুলোর কথা। বইগুলোর গল্প আর অলংকরণের তুলনা হয় না। নামটা মনে নেই, একটা গল্প ছিল--একটা ছেলের ঘুম আসছে না, সে হাঁস-মুরগি, গরু-ভেড়া এদের বিছানা দেখে বেড়াচ্ছে। শেষ পর্যন্ত দেখা যায় তার বিছানাটাই সবচেয়ে আরামদায়ক। আরেকটা গল্প—একটা ছেলে ভেড়ার রাখাল, তার হাত ভেঙে যায়, আর একটা পিঁপড়ার বাড়ি বানানোর গল্প, সেই মাছ আর জেলের গল্প। মনে আছে ‘মালকাইটের ঝাঁপি’র কথা। এমন কোনো শিক্ষিত বাড়ি ছিল না, যেখানে এক কপি পাওয়া যেত না এই বই। ছিল সোভিয়েত পত্রিকা—একটার নাম ‘সোভিয়েত ইউনিয়ন’ আরেকটা ‘সোভিয়েত রাশিয়া’। বাংলায় প্রকাশিত সেই সব পত্রিকার কোনোটাতেই প্রথম পড়েছিলাম ‘কুড়ালের জাউ’ গল্পটা। পড়া হলে সেগুলো দিয়ে মলাট দিতাম বইয়ের। কী সব হাস্যোজ্জ্বল সুন্দর মানুষের ছবি। মেয়েগুলো কী মিষ্টি আর দারুণ সুন্দর! তখন মনে হতো আর কোথাও না হলেও সোভিয়েত দেশে একবার যাবই যাব।