আমাদের একজন বটবৃক্ষ ছিলেন। একজন দূরদর্শী বিচক্ষণ দৃঢ় সাহসী মুক্তচিন্তক উদার পথপ্রদর্শক ছিলেন! আমাদের একজন পরম পূজনীয় শিক্ষক ছিলেন! আমাদের একজন জাতীয় অধ্যাপক 'আনিসুজ্জামান স্যার' ছিলেন, যাঁর দ্বার সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল। তিনি চলে গেলেন। তবু তিনি আছেন। তিনি থাকবেন। সামান্য আমার অনেক স্মৃতি স্যারের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। কোনটা ছেড়ে কোনটা বলব। একটা সময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অঘোষিত নিয়ম ছিল, মাস্টার্সের মৌখিক পরীক্ষায় বহিঃশিক্ষক থাকতেন স্যার। আমরা যেন স্যারের আশীর্বাদ নিয়ে কর্মস্থলে প্রবেশ করি, হয়তো এমন একটা ভাবনা থেকেই আমাদের শিক্ষকগণ এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। খুব ভয়, কৌতূহল নিয়ে ভাইবা বোর্ডে প্রবেশ করি। সফেদ পাজামা-পাঞ্জাবিতে দীর্ঘদেহী সুপুরুষ মানুষটাকে দেখে শ্রদ্ধা-মুগ্ধতা যুগপৎ কাজ করছিল, সঙ্গে ভয়! কিন্ত স্যারের সহাস্য মুখাবয়ব, স্নেহশীল অভিব্যক্তি সব ভয় দূর করে দিল। ১৯৯৮ সালে এভাবেই আমার সৌভাগ্য হয়েছিল স্যারের কাছে ভাইবা দেওয়ার। অনেক কথার মাঝে তিনি আমাকে হেসে বলেছিলেন, 'তুমি চাঁদপুরের মেয়ে, কিন্তু তুমি কি জানো, তোমার উচ্চারণে সিলেটি প্রভাব আছে?' যখন এমফিল, পিএইচডি করছিলাম, তখনো স্যারের সঙ্গে দেখা হয়েছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালযের সঙ্গে তাঁর যেন এক প্রাণের যোগ, নাড়ির টান ছিল। যেন ঘরের ছেলে ঘরে ফিরতেন! তারপর ২০১৫ সালে 'বঙ্গবিদ্যা'র সম্মেলনে আরও অনেক বরেণ্য ব্যক্তির সঙ্গে স্যার জাপান যাত্রায় আমাদের সহযাত্রী ছিলেন।
যাত্রা থেকে শুরু করে ফিরে আসা পর্যন্ত অনেক স্মৃতিতে মিশে আছেন স্যার। তারপর ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে আমার মেয়ের বিয়েতে স্যারকে দাওয়াত দিতে চাইলে বললেন, 'বিভাগে কার্ড পাঠিয়ে দাও।' দুদিন পরে স্যারের ফোন এল, হাস্যকণ্ঠে বললেন, 'নিলুফা তোমার খামে কার্ড নেই।' আমার তখন লজ্জায় মাথা কাটা যাবার মত অবস্থা। বললেন, 'কোনো সমস্যা নেই। বাসার ঠিকানায় পাঠিয়ে দাও। শরীর ভালো থাকলে অবশ্যই আমি আসব।' স্যার কথা রেখেছিলেন। স্যার খুব সময় মেনে চলতেন। ঠিক সাড়ে সাতটায় এসেছিলেন, সাড়ে আটটা পর্যন্ত ছিলেন। সেদিন স্যারকে খুব প্রাণবন্ত দেখাচ্ছিল। তারপর স্যারের সঙ্গে ২০১৯ সালে দেখা। এর আগে ফোনে বলেছিলাম, স্যার আমি একটা উপন্যাস লিখছি। ওপাশ থেকে তাঁর কণ্ঠস্বরে বুঝলাম, খুব খুশি হয়েছেন। খানিকটা দুঃসাহস নিয়ে বলেই ফেললাম, আপনি যদি একটু আশীর্বাদ লিখে দিতেন স্যার! তিনি বললেন, 'পাণ্ডুলিপি দিয়ো, অবশ্যই আমি দেব।'
২০১৯-এর সেপ্টেম্বরে স্যারের বাসায় গেলাম। ১০ মিনিট দেরি হওয়াতে মৃদু ভর্ৎসনা করলেন। তিনি পাণ্ডুলিপি হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে বললেন, 'বেশ বড় উপন্যাস লিখেছ।' আমি বললাম, স্যার, মূল বিষয়টা কি সংক্ষেপে বলব? মৃদু হেসে বললেন, 'বলো।' স্যার মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। বললেন, 'নতুন কৌশল প্রয়োগ করেছে, চরিত্রের নাম রাখো নাই, পড়ার আগ্রহ হচ্ছে। ভালো হবে নিশ্চয়ই। আজকাল প্রায় অসুস্থ থাকি, ব্যাস্ততাও পিছু ছাড়ছে না।' তারপর বললেন, 'আমি পাণ্ডুলিপিটা পড়ে তোমাকে “মুখবন্ধ” দেব। সময় তো আছে।' আমি বললাম, জি স্যার। তারপর প্রায়ই স্যার ক্লিনিকে আর বাসায় আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকতেন। এই অসুস্থতার মধ্যেও স্যারকে কয়েকবার ফোন করে জ্বালিয়েছি, এ জন্য আমি আজ বারবার স্যারের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। স্যার আপনার এই নগণ্য ছাত্রীকে ক্ষমা করে দেবেন। অথচ স্যার একটিবারের জন্যও বিরক্ত হয়েছেন বলে মনে হয়নি। কখনো বলেছেন, 'আমি অসুস্থ', কখনো ব্যস্ত, কিন্তু দুঃখিত বলতে ভোলেননি এই বলে যে, 'তোমার লেখাটা দিতে পারছি না এখনো।' ফোন করে উল্টো আমি লজ্জা-অপরাধবোধে বিব্রত হয়ে গেছি বারবার। হ্যাঁ, সত্যিকারের মহৎ মানুষেরা এমনই হন! একদিন সকালে মেইল খুলে দেখি 'স্যারের আশীর্বাদ!' এবং বেশ বিস্তারিত। একজন নতুন লেখক তার প্রথম উপন্যাসে এত উদার আশীর্বাদপুষ্ঠ হবে, এ আমার কল্পনার অতীত ছিল! সম্ভবত আমার প্রথম উপন্যাস 'অতলান্ত খোঁজ' স্যারের শেষ আশীর্বাদের সাক্ষী হয়ে থাকল (ভুল হলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন, তথ্য থাকলে জানাবেন)। কিন্ত তিনি এত উদার, এত মহান ছিলেন যে এখন যখন ভাবছি, অপার বিস্ময়ে গভীর বেদনায় মূক হয়ে যাচ্ছি বারবার। তারপর স্যারের সঙ্গে শেষবার দেখা হলো ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২০-এ। 'অতলান্ত খোঁজ' হাতে নিয়ে খুব খুশি হলেন।
প্রত্যয় ইসলাম নাম দেখে হেসে বললেন, বিজুর ছেলে (শহীদুল ইসলাম বিজু) বাবার সঙ্গে ব্যবসায় ঢুকেছে, বেশ ভালো। 'পাঠক সমাবেশে'-এর কাজ খুব ভালো। প্রচ্ছদ দেখে বললেন, মনির ভাই কেমন আছেন? আমি বললাম, স্যার, তিনি আপনাকে সালাম জানিয়েছেন। বললেন, অনেক দিন দেখা হয় না! আমার উপন্যাসে কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপনস্বরূপ 'সৃষ্টির স্বপ্ন ও বেদনা' বলে একটা অংশ আছে। এই অংশটুকু বইয়ের শেষে যুক্ত দেখে বেশ বিরক্ত হলেন, বললেন, 'এটা শেষে দিয়েছ কেন?' আমি বিব্রত হয়ে বললাম, পাঠক সমাবেশের সঙ্গে কথা বলেই দিয়েছি, স্যার। তিনি বললেন, 'না, বিষয়টা আমার পছন্দ হলো না। দ্বিতীয় সংস্করণে বিজুকে বলবে, স্যার বলেছেন, এই অংশটা সামনে দিতে।' ওই দিন আমার বড় ছেলে সঙ্গে ছিল। স্যার অনেক কথা বললেন ওর সঙ্গে। মেয়ে কেমন আছে জানতে চাইলেন। আমার মেয়ের মামাশ্বশুর কমরেড মঞ্জুরুল আহসান খান স্যারের মেয়ের শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়। তাঁদের কথাও বললেন। বিদায় নিতে চাইলে বললেন, 'বসো, গল্প করো।' যখনি স্যারের সঙ্গে কথা হতো, দেখা হতো, তারেকের কথা জিজ্ঞেস করতে কখনোই ভুলতেন না। আসলেই, মহৎ মানুষেরা তো এমনই হন! এমনই হওয়া উচিত! একফাঁকে বললাম, স্যার, একটু ভিডিও করি? মৃদু হেসে বললেন, 'করো।' আমার ছেলে ভেঙে ভেঙে ভিডিও করছিল। আসলে ওর সংকোচ হচ্ছিল, আর আমি বারবার বলছিলাম, থেমে যাচ্ছ কেন? করছ না কেন, বাবা? তখন তিনি মৃদু হেসে বললেন, 'মা যখন চাইছেন, করো না!' বললেন, 'আজকাল শরীর ভালো যাচ্ছে না। শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেছে।' আমি বললাম, তারেককে ডাক্তার বলেছেন, হার্টে সিআরটিডি মেশিন লাগাতে। স্যার বললেন, 'আমাকেও বলেছেন, আমিও লাগাব ভাবছি।'
করোনার শুরুতে একদিন ফোন করেছিলাম, বললেন, শরীরটা ভালো যাচ্ছে না একদম। কাশছিলেন খুব। এ-ই স্যারের সঙ্গে আমার শেষ কথা! আর কখনো কথা হবে না! আর কখনো দেখা হবে না! আর কখনো আশীর্বাদ চাইতে পারব না! কিন্ত জানি, তিনি ওপর থেকে ঠিক আমাদের দেখছেন। আমাদের আশীর্বাদ করছেন। স্যার, ওপারে আপনি ভালো থাকুন। আপনার পরিবারকে যেন সৃষ্টিকর্তা এ শোক ধারণ করার শক্তি দেন। এই মুহূর্তে জানলাম, স্যারের করোনা পজিটিভ এসেছিল। পূর্বঘোষিত সব কর্মসূচি বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে। তাঁকে করোনার স্বাস্থ্যবিধি অনুসারে দাফন করা হবে। যে মহান মানুষটা জাতির সুখ-শোকের নিয়ত সহযাত্রী-সহমর্মী ছিলেন, আজ তাঁর মৃত্যুর সংযাত্রিকের সহযাত্রী বাঙালি জাতি হতে পারছে না! এই অসহনীয় বেদনার ভার কোথায় রাখি? এ দৃশ্যের যেন আর পুনরাবৃত্তি না হয়। হে সৃষ্টিকর্তা, হে প্রকৃতি, হে নিয়তি, হে শোষিত আত্মা, আমাদের ক্ষমা করুন।
বাঙালির বাতিঘর, বাঙালি সংস্কৃতির প্রাণ-পুরুষ, আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় ভালোবাসার মহান মানুষটাকে আর কখনো সচল দেখব না! যা দেখব, সব স্থিরচিত্র, সব স্মৃতিচারণ!
এই প্রগাঢ় বেদনা প্রকাশের ভাষা নেই! সহ্য করার ক্ষমতা নেই! আমাদের মহিরুহ আমাদের সবার পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষক আনিসুজ্জামান স্যারের প্রস্থান জাতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতি, যা কখনোই পূর্ণ হবার নয়। আমরা যেন তাঁর আদর্শ অনুসরণ করে জাতির প্রতি তাঁর ভালোবাসার সম্প্রদানকে পূর্ণতা দিতে পারি।
লেখক: শিক্ষক