ভারতীয় ছবির যখন নির্বাক যুগ চলছিল, তখন পৌরাণিক কাহিনি-নির্ভর ছবিতে ‘জীবনের চেয়ে বড়’ ক্যানভাসে চরিত্রদের আঁকা হতো। শব্দ যুক্ত হওয়ার পরও জীবনের চেয়ে বড় চরিত্ররা ছেড়ে যায়নি চলচ্চিত্রের পর্দাকে। তখন দৈব না হলেও পার্থিব ঘটনার ঘনঘটার ভেতর দিয়েই চরিত্ররা দেবতাদের কাছাকাছি হয়ে ওঠে, মানুষ তাদের দেবতা মানতে শুরু করে। এই রীতি এখনো অব্যাহত আছে। হলিউডের মতো বলিউডেও ‘সুপারহিরো’ নায়কদের জয়জয়কার। ভারতে মানুষ দেব-দেবীর ছবির পাশে নায়ক-নায়িকার ছবিও টাঙিয়ে রাখে দেয়ালে দেয়ালে। রাস্তায় শোভা পায় বড় বড় সিনেমার বিলবোর্ড। সেখানে বাস্তবের চেয়ে চার গুণ বড় হয়ে নায়কটি তাকিয়ে থাকে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া লোকদের দিকে।
চলচ্চিত্রমাধ্যমের এই গুণটি আছে। নন্দনতাত্ত্বিক প্রয়োগের মাধ্যমে সে মানুষের মনের ভেতরে ভক্তি ও শ্রদ্ধাকে জাগ্রত করতে পারে। এম কে রাঘবেন্দ্র ‘বলিউড’ বইয়ে যেমন বলছেন, অ্যারিস্টটলীয় মিমেসিস, যার মাধ্যমে বাস্তববাদ ও অভিব্যক্তিবাদ ফুটে ওঠে, সেটা বলিউডের জনপ্রিয় ধারার চলচ্চিত্রে পরিত্যাজ্য। এখানেই পৌরাণিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে জনপ্রিয় বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের মিল। ভারতীয় চলচ্চিত্রে এই জনপ্রিয় ও মজারু ধারার বাইরে বলতে গেলে সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, শ্যাম বেনেগাল, আদুর গোপালকৃষ্ণান, মনি কাউল, কুমার সাহানি প্রমুখ চলচ্চিত্রকারেরা এক অন্য রকম ঘরানার ছবি তৈরি করা শুরু করেন। তাঁদের ছবির চরিত্ররা পুরাণের চরিত্রের মতো অতিমানব নয়। তাদের ছবির চরিত্রগুলো মানবিক দোষ ও গুণ দিয়েই তৈরি। আর দশটা দর্শক যেমন, তাদের চরিত্রও পর্দার ওপর তেমনভাবেই অঙ্কিত। এই জায়গাতেই একটা মোটা দাগ টানা হয়ে যায় চলচ্চিত্রে—মানুষের মনোরঞ্জনের জন্য ছবি, না মানুষের চিন্তায় নাড়া দেওয়ার জন্য ছবি?
সদ্য প্রয়াত ইরফান খান কিন্তু মনে করতেন, ভারতীয় দর্শককে চিন্তার জন্য একলা ছেড়ে দিলে চলে না। তাঁদের যদি চিন্তার বীজ দিয়ে ছেড়ে দেন, তো তাঁদের সাথে ক্যাথারসিসও দিয়ে দিতে হয়। তবে চিন্তাশীল ছবির ব্যাপারে ইরফান মনে করতেন, এসব ছবির আলাদা কণ্ঠস্বর থাকে। দ্বিতীয় ধারার ভারতীয় ছবি, যেগুলো বাণিজ্যনির্ভর নয়, কারখানার সাপেক্ষে স্বাধীনভাবে নির্মিত, সেগুলোকে ইদানীং ‘হিন্ডি’ নামে ডাকা হয়। তো এসব হিন্ডি ছবিতেও যে ভারতীয় দর্শক ভাবাবেগ চায়, সেটা ভালো করে জানতেন ইরফান। বলেছেনও সাক্ষাৎকারে। ডার্ক ফিল্মের অতটা ভক্ত নন ভারতের দর্শকেরা। তাঁরা ট্র্যাজেডি পছন্দ করেন। তাঁরা কাঁদতে ভালোবাসেন। চিত্রনাট্যে এসব বৈশিষ্ট্য দেখেই নাকি ছবি করার সিদ্ধান্ত নিতেন ইরফান। অথচ আমরা জানি, তিনি ঠিক তথাকথিক বাণিজ্যিক ধারার ধুমধাড়াক্কা মার্কা ছবিতে অভিনয় করেননি। ভেতরে ভেতরে তিনি জানতেন কোন কাজ তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবে। তা ছাড়া দর্শকের রুচিও যে পরিবর্তিত হচ্ছিল, সেটাও তো তাঁর অজানা ছিল না। তাই নিজের অভিনয়প্রতিভা আর ছবি বাছাই, এই দুটো মিলিয়েই আসলে ইরফান খান হয়ে উঠেছেন তিনি। আর এতেই বলিউড কারখানার অন্য তিন খানের চেয়ে আলাদা হয়ে জ্বলজ্বল করছেন তিনি।
প্রশ্ন হলো, ইরফান খান কেন এত জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন? তিনি যখন বলিউডে যাত্রা শুরু করেন, তখন সুনীল শেঠি, অক্ষয় কুমাররা চুটিয়ে ছবি করছেন। কিছুদিনের ভেতর শাহরুখ খান, আমির খান, সালমান খানদের ছবি সুপারডুপার হিট হচ্ছে। আর ইরফান নাটকের জাতীয় প্রতিষ্ঠান থেকে অভিনয় শিখে জায়গা করে নেওয়ার সংগ্রাম করছেন। টিভির সাবান-ধারাবাহিক অথবা বিখ্যাত কোনো পরিচালকের ছবিতে নামমাত্র চরিত্রে; মিরা নায়ারের ‘সালাম বোম্বে’ (১৯৯৮) ছবিতে সেই চিঠি লেখকের যে ছোট্ট চরিত্রটি! কথায় বলে, বড় অভিনেতাকে ছোট চরিত্র দিলেও, তিনি ঠিকই নিজের জাত চিনিয়ে দেন। ইরফান খান নিজের ছোট ছোট সুযোগগুলোকে হাতছাড়া করেননি। এমনকি এফটিআইয়ের ডিপ্লোমা ফিল্মেও নয়। সন্দীপ চট্টোপাধ্যায়ের ‘রিকনেসঁস’ (১৯৯০) ছবিতে সেই পরিব্রাজক যুবকটির চরিত্রেও তিনি ছিলেন তাঁর মতোই।
প্রশ্নটিতে আবারও ফিরে আসা যাক, কেন বলিউডে এত বড় বড় তারকা-অভিনেতা থাকা সত্ত্বেও ইরফান খান, যাঁর নায়কোচিত চেহারা ও শরীর কাঠামো নেই, তিনি এত জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন? বা দর্শকের এত কাছের হয়ে উঠলেন? আমার কাছে মনে হয় তিনি উল্লম্ব নন, আনুভূমিক। অন্য তারকারা আকাশেই থাকেন, উল্লম্বরেখা বরাবর। ইরফান অবস্থান করতেন দর্শকের সমান্তরাল রেখায়। আর এটা তিনি করেছেন নিজের অভিনয়গুণ ও চরিত্র বাছাইয়ের মধ্য দিয়ে। বলিউডের জনপ্রিয় ধারার চরিত্ররা বড্ড সরল। তারা দর্শকের মনোরঞ্জন করে এবং হারিয়ে যায়। ছাপ রেখে যায় না। অপর দিকে, আপাতসরল মনে হলেও জটিল চরিত্রগুলো করে ইরফান মানুষের কাছাকাছি হয়েছেন। এর কারণ, মানুষ অতি জটিল প্রাণীই বটে। মানুষ কোনো রুপালি পর্দার মহানায়কের মতো এক বগ্গা নয়, যেন এক খলনায়ককে খতম করাই তার লক্ষ্য।
ইরফান নিজেই বলেছেন, পর্দায় তাঁকে দেখে দর্শক তাঁর চেহারা বা ঢংয়ের প্রেমে পড়ুক, তা তিনি চাননি। তিনি সব সময়ই চেয়েছেন দর্শকের মনে আলাদা জায়গা তৈরি করে নিতে। সেটা তিনি করেছেন। শেক্সপিয়ারের ‘ম্যাকবেথ’ ওরফে মকবুলের চরিত্র অভিনয় করেছেন (মকবুল, ২০০৩)। অত্যন্ত জটিল চরিত্র: আনুগত্য, প্রেম, বাসনা, পিতাহত্যার অপরাধ, ঈদিপাস কূট, হিস্টিরিয়া—সব মিলিয়ে তৈরি হয়েছে মকবুল চরিত্রটি। এই জটিল চরিত্রে অভিনয় করে তিনি শুধু দর্শককে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন, তা নয়, এই ছবির সহ-অভিনেতা, ভারতীয় চলচ্চিত্র ইতিহাসের কিংবদন্তি নাসিরউদ্দীন শাহকেও তিনি অভিভূত করেছেন। এক অনুষ্ঠানে নাসিরউদ্দীন নিজেই সে কথা বলেছেন ইরফানকে।
ইরফান তো নাসিরউদ্দীন শাহ, ওম পুরী—তাঁদেরই উত্তরসূরি। কিন্তু তাঁর কপালটা তাঁদের মতো ভালো ছিল না। বড় কোনো পরিচালকের বড় কোনো সুযোগ তিনি প্রথমেই পাননি। আশির দশকের শেষ দিকে বা নব্বইয়ের শুরুতে তিনি যখন চিত্রপাড়ায় ঘোরাঘুরি করছেন, যখন কারখানার রমরমা অবস্থা অন্যদের নিয়ে, অন্য কিছু নিয়ে। তখনকার ছবি মানেই নাচেগানে ভরপুর, মারামারিতে রক্তারক্তি, যৌনতায় টইটুম্বুর। হাল ছাড়েননি ইরফান। এক দশকের ওপরে অপেক্ষা করেছেন। নিজের উপর আস্থা হারাননি, কিন্তু বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন। এরই মধ্যে সুযোগ পান ব্রিটিশ ফিল্ম ‘দ্য ওয়ারিয়র’-এ (২০০১) অভিনয়ের। দুই বছরের মাথায় করেন ‘হাসিল’ (২০০৩), পরের বছরই মকবুলের মতো জটিল মনোস্তত্ত্বের চরিত্রে অভিনয় করেন।
‘দ্য নেইমসেক’ (২০০৬) ছবিতে প্রেমিক, স্বামী ও পিতার চরিত্র, ‘লাইফ ইন আ…মেট্রো’ (২০০৭) ছবিতে স্বামী ও পরকীয়া সম্পর্কে জড়িয়ে যাওয়া এক পুরুষের চরিত্র, ‘পান সিং তোমার’ (২০১১) ছবিতে বাস্তবের এক সৈনিক ও ক্রীড়াবিদের চরিত্রে অভিনয় করতে করতে এগিয়ে যাওয়া ইরফান যখন ‘লাঞ্চবক্স’ (২০১৩), ‘কারিব কারিব সিঙ্গেল’ (২০১৭), ‘পিকু’ (২০১৫), ‘তালভার’ (২০১৫), ‘ডুব’ (২০১৭), ‘হিন্দি মিডিয়াম’-এর (২০১৭) মতো ছবিতে অভিনয় করেন, তখন তিনি আরও বেশি দর্শকের মনে আলাদা জায়গা করে নেন।
অবশ্য এটা স্বীকার করতেই হয়, ইরফানের উত্থানকে অনেকখানি সাহায্য করেছেন বলিউড কারখানায় আসা উদীয়মান নির্মাতা ও প্রযোজকেরা। খেয়াল করলে দেখা যাবে, ইরফানের উত্থান মূলত এই একবিংশ শতকের গোড়ার দিকে, আর তখনই ভারতে বাণিজ্যিক ধারার বাইরে, আবার তথাকথিত আর্ট ফিল্মও নয়—এমন সব ছবি নির্মিত হতে থাকে। যেমন ‘ভারতীয় নোয়া’র যাত্রা শুরু হয় অনুরাগ কাশ্যপের হাত ধরে। রাজকুমার হিরানির মতো পরিচালকেরা বুঝতে পারলেন, বড় বড় তারকা, যাঁরা এত দিন মারপিট দিয়ে দর্শক মাতিয়েছেন, তাঁদের দিয়ে অন্য কিছু করতে হবে। তিনি করলেন ‘মুন্নাভাই এমবিবিএস’ (২০০৩), বা পরে ‘থ্রি ইডিয়টস’ (২০০৯)। এই শতকের মোড় বদলে দেওয়া ছবির কথা যদি নির্দিষ্ট করে বলতে হয়, তাহলে বোধ হয় ফারহান আখতারের ‘দিল চাহতা হ্যায়’-এর (২০০১) কথাই বলতে হয়। এ যেন সত্যজিৎ রায়ের ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র (১৯৭০) হিন্দি সংস্করণ।
হিন্দি ছবি যে মুহূর্তে বিশুদ্ধ বাণিজ্যিক ফর্মুলা থেকে সরে এসে বাণিজ্য ও শিল্পবোধকে মিলিয়ে কিছু একটি করার চেষ্টা করছে, তখন ইরফান খানই তো পরিচালক ও প্রযোজকদের প্রথম পছন্দ হবেন। আমরা কিন্তু দেখি শুধু ইরফান নন, এ সময় বাজপেয়ী, রগুভীর যাদব, পঙ্কজ ত্রিপাঠী, পরেশ রাওয়াল, নওয়াজউদ্দীন সিদ্দিকী প্রমুখ অভিনেতাকেও অন্য মাত্রায় দর্শকেরা পেতে থাকেন চলচ্চিত্রের পর্দায়। চাপে পড়ে অন্য তারকা অভিনেতারাও নিজেদের ভাবমূর্তি থেকে বেরিয়ে আসতে থাকেন।
তবে ইরফান খান কেন এত দর্শকপ্রিয় হলেন, সেই প্রশ্নে যদি ফিরে আসি, আর এককথায় জবাব দেওয়ার চেষ্টা করি, তো বলতে হয়, আমার-আপনার দেখা চারপাশের যে সরলে-গরলে মেলানো মেশানো চরিত্রগুলো, সেসব চরিত্রের ভেতরেই ঢুকে যেতেন ইরফান। খুনি থেকে সাধারণ কেরানি অথবা কাশ্মিরী কবি। ‘৭ খুন মাফে’র (২০১১) সেই মুসাফির কবি নাসরুল্লাহর চরিত্রটি, যাকে দেখলে আপনার মির্জা গালিবের কথা মনে পড়ে যাবে। ‘বিল্লু বারবার’ ছবিতে গ্রামের এক সাধারণ নাপিতের চরিত্রটিও কি ভোলা যায়? সেখানে তিনি স্ক্রিন ভাগাভাগি করেন বলিউড বাদশাহ শাহরুখ খানের সঙ্গে। শাহরুখ সেখানে বাস্তবের মতোই বড় চিত্রতারকা, আর ইরফান সেই তারকার ছোটবেলার বন্ধু, সামান্য নাপিত, যে সভয়ে লুকিয়ে রাখে ওই বন্ধুত্বের খবর। যাপন করে আর দশটা মানুষের জীবন। তো ইরফান তো সাধারণের কাছের মানুষই হবেন।
ভারতে মসলাদার ছবির মারকুটে সুপার হিরো তিনি হননি, কিন্তু হলিউডের সুপার হিরো ছবির খলনায়ক চরিত্র করে বাহবা পেয়েছেন: ‘দ্য অ্যামাজিং স্পাইডার ম্যান’ (২০১২)। এ ছাড়া হলিউডে ‘স্লামডগ মিলিয়নিয়ার’ (২০০৮), ‘লাইফ অব পাই’ (২০১২), ‘জুরাসিক ওয়ার্ল্ড’ (২০১৫), ইনফারনো (২০১৬) ইত্যাদি ছবিতেও কাজ করে প্রশংসিত হয়েছেন ইরফান।
তবে হলিউডের আদলে ভারতের ছবিকে ‘বলিউড’ বলতে নারাজ ছিলেন ইরফান। তিনি মনে করতেন, ভারতীয় ছবির আলাদা ধরন ও ইতিহাস রয়েছে। বলিউডকে তিনি তাই ‘বলিউড’ বলতে চাইতেন না। তিনি মনে করতেন, ভারতীয় সিনেমা জীবন উদ্যাপনেরই বর্ধিত রূপ। তবে সে শুধু ভারতীয় ছবি নয়, সব ছবির ক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য। মানুষ আনন্দকে যেমন উদ্যাপন করে, মৃত্যুকেও করে। যেমন আমরা তাঁর প্রস্থানকে উদ্যাপন করছি। ইরফানের চলে যাওয়ার পরের দিন ঋষি কাপুরের চলে যাওয়াকেও মানুষ উদ্যাপন করছে। সুখ আর দুঃখ উদ্যাপনের নামই জীবন। চলচ্চিত্র যতই স্থান, কাল ও যুক্তির সূত্রে নিজেকে বাঁধুক না কেন, জীবনকে এড়িয়ে কি চলচ্চিত্র হতে পারে?