আম্মা
বহুদূর হতে ভেসে আসে অগ্রহায়ণের হাওয়া—
হাওয়ার গন্ধে লেগে থাকে হেঁসেলের সৌরভ,
নিঝুম নবগ্রামের বুড়ো তেঁতুলগাছের নিচে
রক্তজবার লাল শরীর ঘন কালো হওয়া দেখতে দেখতে
রান্নাঘরের বেড়ার ফাঁকে ফাঁকে শিশির জমে যায়,
আর আমার আম্মা বসে বসে রেঁধে ফেলেন
নতুন আলু পেঁয়াজ মেশানো ছোট মাছের চচ্চড়ি,
সেই ঝাঁজালো রান্নার স্বাদ পুড়ে যেতে থাকে
আমার বাড়ি না ফেরার আক্ষেপে,
ততক্ষণে বেলা পড়ে গেছে—
আম্মার গোসলের সময় চলে গেছে বিকেলের দেশে,
কোমর ছড়ানো দীর্ঘ চুলেরা জলজ ব্যাধিতে
আম্মার কপাল ছুঁয়ে ছুঁয়ে চিনিয়ে দেয়
তেড়ে আসা জ্বরের ভুলভাল নামতা ও ব্যাকরণ,
রাত পালানোর আগে আম্মা উঠে বসেন ফের—
টিনের মধ্যবয়সী পুরোনো ড্রাম খুলে
আম্মা বের করে আনেন ধান বিক্রির টাকায় কেনা
খেজুরের গুড় আর ঘ্রাণ ছড়ানো চিকন চাল,
ইংরেজ আমলের খয়েরি খাটের তলা থেকে
বের করে আনেন মাটির হাঁড়ি
ঢাকনা খুলে দুধ নেন প্রিয় গাভিনের,
এলাচ দারুচিনি তেজপাতার সৌরভে
ম-ম করে ক্ষীরের সুবাস,
ততক্ষণে রাত পৌঁছে যায় আম্মার বয়সে
আম্মার চোখে এতক্ষণে আসে জল
বিড়বিড় করে অভিমানের স্বরে
কথা কয়ে ওঠেন আম্মা আমার—
তুই আর কবে বাড়ি আসবি বাবা?
ছুটি পেলে আমাদের দেখতে যাব
তোমার আর কবে ছুটি হবে
প্রতিদিন দেখছি নতুন ব্যস্ততা
ক্রমাগত আটকে যাচ্ছ নতুন অঞ্চলে
কবে হবে ছুটি আমরা পাহাড়ে যাব
বহুবার সমুদ্র দেখেছি দুজন
ঢেউয়ের সীমা অতিক্রম করে
আমরা পৌঁছে গেছি বাতাসের কাছে
সেই বাতাস আমাদের তুলে নিয়েছে উঁচুতে
সেদিকে আকাশ, গভীর আকাশ
ঘন নীল আকাশ এবং
কিছুটা সবুজ জল যেদিকে
সেদিকেও কেমন রঙিন আকাশ,
কবে হবে ছুটি তোমার
আমরা এবার পাহাড়ে যাব,
তোমাকে দেব রডোডেনড্রন
বিষাদ ভ্রমণ শেষে।
তোমার আর কবে ছুটি হবে
কবে আমরা পা হতে খুলে ফেলব শিকল
এবার আমরা সমুদ্র ভুলে পাহাড়ে যাব
ঝাউগাছের ছায়ায় ঢাকা পৃথিবীর পুরনো পথে
হাঁটতে হাঁটতে শুষে নেব ছাতিমের অমৃত ঘ্রাণ
বারবেরির ঝোপ থেকে উড়ে আসবে প্রজাপতি
তোমার অল্পস্বল্প চুলে খুঁজে নেবে ঠিকানা তার
আর আমরা ততক্ষণে পৌঁছে যাব প্রিমরোজের কাছে
তুমি-আমি সেই রঙিন পৃথিবীর খোঁজে
আর একবার ছুটি নিই চলো।
তোমার ছুটি হলে আমরা এবার
পাহাড়ের দিকে যাব
যাব সেই টলটলে পারো নদী
তার আয়না ভাঙা গুঁড়ো গুঁড়ো করা
স্রোতের শরীর ছেনে জল নেবে আঁজলায়,
দেব তোমার গালভর্তি উদার স্পর্শ
তুমি কেঁপে উঠবে লজ্জায়
ওদিকের ঘরবাড়ি মন্দির সব এক রং জেনেও
তাকাবে দূরের কোনো সোনালি মিনারের দিকে
আর আমাদের মনে হবে এই সব দিন
আমাদের খুব প্রয়োজন জেনেছি
বিগত সমুদ্র জীবনে।
তোমার আর কবে ছুটি হবে
ভাবতে ভাবতে দুজনেই ক্যামন
খটখটে পাহাড় হয়ে যাচ্ছি
আমরা ছুটি পাচ্ছি না।
নাড়ি অথবা নারী
কেমন আছে নবগ্রাম?
কাটল কেমন গত বিশটা বছর?
কেমন আছে লিপি হ্যাপি ঝর্না কুসুম?
এখনো কি ইসমাত আরা হাতে তার পপি গাইড,
পড়া বুঝে নেবে এই ছলে লজিং মাস্টারের দরজায় খিল।
কবে যেন শুধাল এক ব্যাপারীর বেটি—
একটা কবিতা লেইখা দেন,
কলেজে স্বরচিত কবিতার খেলা, জমা দেব কাল।
কাল? কালক্ষেপণ করার আর সুযোগ থাকে নাকি?
কাল সেই ঝালে ঝালে ফার্স্ট হয় মেয়ে,
আমারে বাঁশবন হাতছানি দেয়—
পিতলের মেডেল পরাব তোমায়,
আসবার কালে শুধু শিস দিয়ো কবি।
সেই শিস বিষ হয়ে নালিশে সালিস...
নিমেষেই উধাও হায় সহস্র দিন,
ঋণে ঋণে বেড়ে ওঠে বিশটা বছর।
তারও আগে দিদির ছেলেটা কোলে অর্চনা সেই—
তোমার গানে খুব মায়া আছে গো,
আমারে নিয়া বাইন্ধো একখানা গান,
দোহাই তোমার।
তারপর আসে সে শূন্য কোলে,
দিদির ছেলের স্থানে আমারে রাখে,
বদলায় শুধু তার চুমুর ধরন।
ডুবে যাই, ভেসে যাই, উড়ে যাই, পুড়ে যাই,
বাঁধিতে থাকি গান আর গান।
কোলের খবর নিতে তাহারে দেখি—
সিঁথিতে লম্বা করে সিঁদুরের দাগ।
সেই থেকে ভাগাভাগি বিরহ আমার,
কারে দেব কতখানি বিশটা বছর?
কেমন আছে নবগ্রাম?
কাটল কেমন গত বিশটা বছর?